‘নির্ঘুম স্বপ্নের দেশে’ মিনার মাহমুদ by সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল

কাছের বন্ধুরা একে একে অনেক দূরে চলে যাচ্ছেন। তাঁদের সাথে এ জীবনে আর কোনোদিন দেখা হবে না! দেখা হবে না- রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, নাসিমা সুলতানা, আবিদ আজাদ, ত্রিদিব দস্তিদার, সৈয়দ হায়দার, মিশুক মুনীর, তারেক মাসুদ, হুমায়ুন ফরিদীদের সাথে। দেখা হবে না, কথা হবে না- মিনার মাহমুদের সাথে।

স্বাধীনতা উত্তর উত্তাল সময়ে, আশি দশকের শুরুতে আমরা এক ঝাঁক তরুণ ঢাকার বাইরে বিভিন্ন মফস্বল শহর থেকে এসে তারুণ্যে রাজধানী মাতিয়ে তুলেছিলাম- কেউ লেখালেখিতে, কেউবা সাংবাদিকতায়, কেউ-কেউ রাজনীতিতে, আবার কেউ গানে-নাটকে-সংস্কৃতি চর্চায়। লেখালেখির ক্ষেত্রে আমাদের প্রশ্রয়-আশ্রয়-পৃষ্ঠপোষতায় ছিলেন দৈনিক বাংলার সাহিত্য সম্পাদক কবি আহসান হাবীব। মিনার লেখালেখি শুরু করেন সেখান থেকেই। তবে প্রথমে সরাসরি লেখালেখি নয়; আলোকচিত্রী হিসেবে। দৈনিক বাংলায় কবিতার পাশাপাশি স্থান পায় মিনারের ক্যামারার তোলা নান্দনিক শাদাকালোর খেলা। আর তখনই হাবীব ভাই পাল্টে দেন তার নাম। তারপর থেকেই ফরিদপুরের আলীপুরে মোঃ আলী খান মিনার হয়ে উঠলেন মিনার মাহমুদ। এবং শুরু করলেন গল্প লেখা। তার গল্পগুলো একেবারে শাদামাটাও নয়, আবার খুব যে বিশ্লেষণধর্মী তাও না। প্রথম বই ‘মনে পড়ে রুবি রায়’ হাতে দিয়ে বলেছিলেন, কোথাও লিখবেন। আমি ছোট্ট একটা রিভিউ লিখেছিলাম সাপ্তাহিক বিচিত্রায়। আর সেই বিচিত্রায় তিনি শুরু করেন সাংবাদিকতা। ‘মনে পড়ে রুবি রায়’-এর পর বের হয় মিনারের আরেকটি গল্পের বই- ‘নির্ঘুম স্বপ্নের দেশে’। আজ তিনি অভিমানে জন্মমাসেই মৃত্যুর গান গেয়ে চলে গেলেন সেই নির্ঘুম স্বপ্নের দেশে!

কবি আহসান হাবীবের কক্ষেই তার সাথে পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব। মিনার গল্প লেখা ছেড়ে দিয়ে সাংবাদিকতায় মনোনিবেশ করেন। বিচিত্রা ছেড়ে দিয়ে ’৮৭ সালের ১০ জুন বের করেন সাপ্তাহিক বিচিন্তা। বিচিন্তার মাধ্যমে সাংবাদিকতায় নতুন মাত্রায় হইচই ফেলে দেন, চমকে দেন স্বৈরচারবিরোধী আন্দোলনে সাহসী বিরল ভূমিকায় ‘গণভ্যুত্থান দিবসে গণহত্যা এং নিরুর বাঁশি’ শীর্ষক প্রচ্ছদ প্রতিবেদন আমাদের ইতিহাস হয়ে আছে। সেজন্যই মিনারে বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হয়। কৌশলে বন্ধ করে দেয়া হয় বিচিন্তা। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লেখালেখির জন্য ’৮৮ সালে এরশাদ তাকে জেলে পাঠান। জেল খাটেন ৮/৯ মাস। এরশাদের পতনের পর নানান কারণে দেশান্তরী হয়ে পাড়ি দেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে কাটান জ়ীবনের এক তৃ্তীয়াংশ সময়। ১৮/১৯ বছর পর ২০০৯-এ স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলেন অনেক রঙিন স্বপ্ন নিয়ে। আবার বিয়ে করলেন। নতুন করে সংসার পাতলেন। নতুন আশার স্বপ্ন দেখলেন--বিচিন্তার। ভেবে ছিলেন আবারো জেগে উঠে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবেন সাংবাদিকতায়। কিন্তু এরই মধ্যে বুড়িগঙ্গার জল গড়িয়ে গেছে বহুদূর, গণ মাধ্যমের চিত্র-চেহারা বদলে গেছে অনেক। তাই ভেতরে ভেতরে বেদনায় ভেঙ্গে পড়লেন। হেরে গেলেন নিজের কাছে। স্বপ্ন নিয়ে চলে গেলেন- নির্ঘুম স্বপ্নের দেশেই!

রেখে গেলেন অনেক স্মৃতি। ব্যক্তিগত স্মৃতিগুলো আজ মনে করিয়ে দিচ্ছে মিনারের নানান ঘটনা। টগবগে, স্মার্ট, মেধাবী, আড্ডাবাজ, স্বপ্নবাজ, রাগী, দ্রোহী, অস্থির, উড়নচণ্ডী, উচ্ছল আর অভিমানী, বিষন্ন, নিঃসঙ্গ, আনন্দ-বেদনায় দ্রবীভূত হয়ে মিনার নিজেকে নাটকের চরিত্রের মতো তৈরি করেছিলেন এক অদ্ভূত ব্যতিক্রমধর্মী মানুষ হিসেবে। যা আমাদের আর কোনো বন্ধুর সাথে মেলে না।

মিনার আমেরিকায় যান ১৯৯১-এ আর আমি কানাডায় আসি ২০০৫ সালে। হয়তো হঠাৎ নেশার ঘোরে ফোন করে আড্ডা দিতেন। বলতেন ঢাকায় ফেলে আসা দিনগুলির কথা। একবার আমাকে ডাকলেন। নিয়ে যেতে বললেন- নাসিমা আর আমার যৌথ কাব্যগ্রন্থ ‘তবু কেউ কারো নই’। গেলাম তার অফিস-কাম-বাসা ৪১/২ দিলু রোডে। বললেন- ‘আগামী সংখ্যায় এটির রিভিউ যাবে। আর একটা কাজ করতে হবে। আপনাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আমার মামলার ফাইল আছে। এ বিষয়ে আপনার সহযোগিতা দরকার!’ অবশ্য পরে আর যোগাযোগ করেন  নি। কারণ, এরই মধ্যে তাকে গ্রেফতার করা হয়। নিষিদ্ধ করা হয় বিচিন্তা।

‘তসলিমা নাসরিনের মিথ্যাচার’ শীর্ষক একটি লেখায় লিখেছিলাম- ‘তসলিমা নাসরিন আমার তিন বন্ধুকে বিয়েকরেছিলেন----এরা যথাক্রমে কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সাংবাদিক নাঈমুল ইসলাম খান এবং গল্পকার মিনার মাহমুদ’। (সাপ্তাহিক বেঙ্গলি টাইমস, জানুয়ারি ০৭, ২০১০, কানাডা।) তা নিয়ে নানান বিতর্ক হয়। ততদিনে প্রবাসজীবনের পাঠ চুকিয়ে মিনার ফিরে গেছেন ঢাকায়।

২৬ মার্চ ২০১০-এ স্বাধীনতাদিবসে ‘আমাদের সময়ে’ প্রতারিত হয়ে কানাডায় এক ‘ভুয়া বীরপ্রতীক সেতার বেগম’ নিয়ে একটি লেখা লিখি। তা দেখে প্রকৃত বীরপ্রতীক সেতার বেগম প্রতিবাদ করেন। তা নিয়ে আলোচনা হলে আমাদের সময় ক’দিন পর আমার লেখাটি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়। তখন মিনার তার বক্তব্য তুলে ধরে প্রতিবাদ করেন---প্রকাশিত লেখা প্রত্যাহারের কী আছে?

‘তসলিমা নাসরিনের মিথ্যাচার’ এবং ‘ভুয়া বীরপ্রতীক সেতার বেগম’ এই লেখা দু’টি নিয়ে তার সাথে আমার সর্বশেষ দীর্ঘক্ষণ কথা হয়। তিনি বলেন- ‘তসলিমা একজন মিডিয়ার প্র...। সে মেরেও জিততে চায়, কেঁদেও জিততে চায়। একজনকে এক জায়গায় জিততে হবে, কিন্তু সে দু’জায়গায় জিততে চায়।...’

জানতে চাইলাম- ‘আপনি নাকি নিউ ইর্য়কে ট্যাক্সি চালানোর সময় এক ভিনদেশি যাত্রী আপনার দেশ বাংলাদেশ শুনে নাকি জানতে চেয়েছিলেন আপনি তাসলিমা নাসরিনকে চেনেন কিনা? আপনি তার প্রাক্তন স্বামী শুনে সেই যাত্রী আপনাকে মাতাল বলে পুলিশের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন?’ আমার কথার জবাব না দিয়ে মিনার হাসলেন। আমি সেদিন মিনারকে আরো বলেছিলাম- `এ সব লিখুন। অনেকেই তো আপনাকে ভুল বোঝে। গল্প লেখাটাও ছেড়ে দিলেন! মনে পড়ে রুবি রায়ের বদলে বলতে চাই- মনে পড়ে মিনার মাহমুদ, আপনি এক সময় গল্প লিখতেন?`

মিনার বলেছিলেন- `লিখবো। সময় আসুক। কিন্তু সেই সময় তিনি আর পেলেন না। তার আগেই তাকে চলে যেতে হলো- ``নির্ঘুম স্বপ্নের দেশে``ই!

তিনি আরো জানালেন, মানবজমিনের ‘জনতার চোখ’ গত বছর (মে ২১, ২০০৯) আমার উপর একটা লেখা লিখেছে কাজল ঘোষ। লিঙ্কটা পাঠাবো। পরদিন ই-মেইলে তার লিঙ্ক পেলাম। পড়লামঃ “তসলিমা ছিল আমার ভুল সময়ের ভুল মানুষ। ...তসলিমা আমার কাছে এক্স, ওয়াই, জেড, আকুলি, বিকুলিদের মতই একজন সাধারণ মানুষ”।

তসলিমার সাথে তার বিরোধ বা দূরত্ব যাই বলি না কেন, সুকুমারী রায়ের লেখা হুবহু মেরে দিয়ে বিচিন্তায় ছাপানো এবং প্রতিবাদ করার পরও সেই লেখা ‘নির্বাচিত কলাম’-এ অন্তর্ভুক্ত করা। এসব আদর্শগত কারণেই তাদের সাংসারিক দ্বন্দ্বের সূচনা হয়। এরকম অনেক অজানা-অপ্রকাশিত বিচিত্র জীবন ফেলে চলে গেলেন মিনার মাহমুদ।

প্রিয় মিনার, গেছেন যখন যান। রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, নাসিমা সুলতানা, আবিদ আজাদ, ত্রিদিব দস্তিদার, সৈয়দ হায়দার, মিশুক মুনীর, তারেক মাসুদ, হুমায়ুন ফরিদীদের পদ ও পথ অনুসরণ করুন; যান। ক’দিন পর আমারও আসছি...।

saifullahdulal@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.