বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৩৫৬ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। শহীদ আলী আকবর
বীর প্রতীক সহযোদ্ধাদের বাঁচাতে জীবন দেন তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রায় ১০ বছর আগে বিয়ে করেছিলেন আলী আকবর। কৃষিকাজ করে সংসার চলছিল।


মুজাহিদ বাহিনীর অনিয়মিত সদস্য হিসেবে প্রশিক্ষণও নেওয়া ছিল তাঁর (১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর পাকিস্তান সরকার এই বাহিনী গঠন করে)।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আলী আকবর নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলেন না। স্ত্রী ও এক ছেলে, দুই মেয়েকে রেখে ২৬ মার্চেই ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে তিনি যখন ভারতে যাচ্ছিলেন, তখন তাঁর স্ত্রী ও স্বজনেরা যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে বারণ করেছিলেন না যেতে। তিনি তাঁদের বলেছিলেন, ‘বিপদের সময় কাপুরুষেরাই ঘরে বসে থাকে। বাড়িতে থাকলেও মরতে হবে। তার চেয়ে মা-বোনের ইজ্জত এবং দেশকে রক্ষা করতে যুদ্ধ করে মরাও ভালো।’ এ কথা জানালেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আলী আকবরের স্ত্রী।
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম এলাকায় অনেকের মুজাহিদ বাহিনীর প্রশিক্ষণ নেওয়া ছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই প্রায় ৩০ জন মুজাহিদ স্থানীয় আবদুল কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে সংগঠিত হন। আলী আকবরও ছিলেন এ দলে। ২৫ মার্চের পর তাঁরা চৌদ্দগ্রাম বাজার, বাতিসা, ফালগুনকরাসহ একাধিক স্থানে বড় বড় গাছ কেটে রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করেন। পরে তাঁরা স্থানীয় থানা থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। থানা থেকে অস্ত্র সংগ্রহে আলী আকবর সাহসী ভূমিকা পালন করেন।
মে মাসের মাঝামাঝি তাঁরা চৌদ্দগ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সম্মুখযুদ্ধ করেন। এরপর আরও কয়েক দফা সেখানে যুদ্ধ হয়। বেশির ভাগ যুদ্ধই ছিল রক্তক্ষয়ী। কয়েক দিনের যুদ্ধে তাঁদের হাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩০-৩৫ জন নিহত ও অনেকে আহত হয়। মুক্তিবাহিনীর সাত-আটজন শহীদ হন। ৩০ মের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিপুল শক্তি নিয়ে তাঁদের ওপর আক্রমণ শুরু করলে তাঁরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতে বাধ্য হন। তাঁদের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। এরপর আলী আকবর ভারতে গিয়ে পুনঃসংগঠিত হন। পরে ২ নম্বর সেক্টরের অধীন রাজনগর সাবসেক্টরে যুদ্ধ করেন। বেশ কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নেন। এর মধ্যে লাকসামের বাগমারা রেলসেতু ধ্বংসের অপারেশন অন্যতম। এই অপারেশনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে আলী আকবরের বেশ কয়েকজন সহযোদ্ধা শহীদ ও আহত হন। তিনি অল্পের জন্য বেঁচে যান।
অক্টোবর মাসের শেষে অথবা নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে কুমিল্লার মিয়াবাজার এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়াবহ এক যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে অংশ নেন আলী আকবর। তুমুল যুদ্ধে দুই পক্ষেই বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তীব্র আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এ সময় বাধ্য হয়ে তাঁরা পিছু হটেন। পিছু হটে ভারতে যাওয়ার সময় তাঁরা নোয়াবাজারে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অ্যামবুশে পড়েন। তখন তাঁদের কাছে তেমন গুলি-গোলা ছিল না। এই অবস্থায় তিনি ও আরেকজন সহযোদ্ধাদের বলেন নিরাপদ স্থানে চলে যেতে। তাঁরা দুজন পাকিস্তানি আক্রমণ মোকাবিলা করতে থাকেন। একপর্যায়ে তাঁদের গুলি শেষ হয়ে যায়। তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুলিতে তাঁরা শহীদ হন। পরে সহযোদ্ধারা তাঁর মরদেহ উদ্ধার করে গ্রামের বাড়িতে পাঠান।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য শহীদ আলী আকবরকে মরণোত্তর বীর প্রতীক খেতাব দেওয়া হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী, তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৬৫।
শহীদ আলী আকবরের পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার ফালগুনকরা গ্রামে। তাঁর বাবার নাম সৈয়দ আলী। মা আমেনা বেগম। স্ত্রী রোকেয়া বেগম। আলী আকবরের ছবি পাওয়া যায়নি।
সূত্র: প্রথম আলোর চৌদ্দগ্রাম (কুমিল্লা) প্রতিনিধি এম এ কুদ্দুস।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.