আন্তর্জাতিক-লিবিয়ার নতুন চ্যালেঞ্জ by হাসান শাহরিয়ার

উত্তর আফ্রিকার তেল ও খনিজসমৃদ্ধ দেশ লিবিয়ায় ছয় মাসের গৃহযুদ্ধের পর একনায়ক কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফির দীর্ঘ ৪২ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। গাদ্দাফির কোনো হদিস নেই। অনুমান করা হচ্ছে, তিনি সুড়ঙ্গপথ দিয়ে পালিয়ে গেছেন। সমগ্র লিবিয়া এখন বিদ্রোহীদের সংগঠন ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিলের (এনটিসি) করায়ত্তে।


এরপরও গাদ্দাফির অনুগত বাহিনী বিচ্ছিন্নভাবে লড়ছে। তবে সব বিদ্রোহের শেষ পর্যায়ে যা হয়, লিবিয়ায়ও তা-ই হয়েছে। সর্বত্র বিরাজ করছে এক অরাজকতা। এই মুহূর্তে এনটিসির প্রধান কাজ হলো আইন-শৃঙ্খলা নিশ্চিতকরণ, জনগণের আস্থা অর্জন, স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা এবং সব ধরনের কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়া। এ কাজটি হয়তো এনটিসির জন্য কঠিন হবে না। তবে আফগানিস্তান ও ইরাকের যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বিশ্ব যা বুঝতে পেরেছে তা হলো : একটি সরকারের পতন বা স্বৈরশাসকের উৎখাত যতটা কঠিন, তার চেয়ে কঠিন কাজ হলো সেই রাষ্ট্র শাসন করা। বিশেষ করে দীর্ঘ একনায়কত্বের অবসানের পর একটি শক্তিশালী সরকার কায়েম খু্ব সহজ কাজ নয়। আর সরকার যদি দৃঢ় না হয় তাহলেই নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভব হবে।
সাধারণত দেখা যায়, গৃহযুদ্ধ বা জনরোষে কোনো স্বৈরশাসকের উৎখাতের পর রাষ্ট্র পরিচালনায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংস্থা বা গোষ্ঠী এবং সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে বিভেদ দেখা দেয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নতুন গৃহযুদ্ধের সূচনা করে এবং তা হয় স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের চেয়ে অধিকতর ভয়ঙ্কর। যদি গৃহযুদ্ধ না হয়, তবে এই বিভেদ বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
এনটিসি যে দেশের শাসনভার গ্রহণ করবে_ এ প্রশ্নে বোধ করি কোনো বিরোধ নেই। আর এ মুহূর্তে এনটিসি ছাড়া কোনো বিকল্পও সম্ভবত নেই। তবে এনটিসি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করলে কী ঘটতে পারে তা বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। লিবিয়ার প্রধান সমস্যা হলো নৃতাত্তি্বক গোষ্ঠী, উপজাতি ও আঞ্চলিকতার বিভেদ। লিবিয়ার জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই মুসলমান এবং আরব বংশোদ্ভূত। তবে তাদের মধ্যে ইতিহাস ও ঐতিহ্যগত বিরোধ রয়েছে। যেমন_ নাফুসা পর্বতের বর্বর, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় মরু অঞ্চল ফেজ্জুনের তুয়ারেগ এবং সাহারা মরুভূমির সাইরেনেইকান অংশের তুবো। কোনো ইস্যুতেই তাদের মধ্যে সমঝোতা হয় না। এ ছাড়া রয়েছে কয়েকশ' উপজাতি। লিবিয়ার মূল ভাষা আরবি হলেও উপভাষা বা ডায়লেক্ট রয়েছে অনেক। ত্রিপোলিতানিয়া ও সাইরেনাশিয়া অঞ্চল প্রাচীন। তাদের বিভেদ দীর্ঘদিনের। সাইরেনাশিয়া অঞ্চলের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অত্যন্ত প্রাচীন ও সমৃদ্ধ; খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকের। গ্রিক, রোমান, আরব, অটোমান, ইতালি ও ব্রিটিশ এই অঞ্চল শাসন করেছে। রাজা ইদ্রিসের নেতৃত্বে লিবিয়া ১৯৫১ সালে স্বাধীনতা লাভ করার পর বাহ্যত দেশের দুটি রাজধানী ছিল। সরকারিভাবে পশ্চিমের ত্রিপোলি রাজধানী থাকলেও রাজার ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু পূর্বাঞ্চলীয় বেনগাজি ছিল প্রকৃত রাজধানী। কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফি ২৭ বছর বয়সে রাজা ইদ্রিসকে হটিয়ে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন ১৯৬৯ সালে। তিনি ত্রিপোলিকে করেন রাষ্ট্রের একমাত্র রাজধানী। তার শাসনামলে অলিখিত রাজধানী বেনগাজির গুরুত্ব হ্রাস পায়। অর্থনৈতিক সমস্যা দেখা দেয়, বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, গাদ্দাফির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূত্রপাত হয় সাইরেনাশিয়া অঞ্চল থেকে। এই অঞ্চলের দুটি প্রধান শহর হলো বেনগাজি ও দাবনা। জিহাদি লিবিয়ান ইসলামিক ফাইটিং গ্রুপের (এলআইএফজি) অবস্থানও এই দুই শহরেই। তবে বিদ্রোহীরা সাইরেনাশিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। তারা সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি তারা নাফুসা পর্বতের জনগণেরও সমর্থন আদায় করে। এসব ঘটে গেছে ন্যাটোর সামরিক অভিযানের আগেই।
এনটিসির শীর্ষ নেতাদের বেশিরভাগই সাইরেনাশিয়ার। সব গ্রুপের দাবি মেটাতে এনটিসি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। তারা যদি সব গ্রুপের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় না রাখে তাহলে লিবিয়ার গগনে যে অশনিসংকেত দেখা দেবে, তা ত্রিপোলির জন্য নতুন সমস্যার সৃষ্টি করবে। তবে প্রত্যেক গ্রুপের দাবি মেটানোও চাট্টিখানি কথা নয়। তাদের সবারই রয়েছে ভিন্ন স্বার্থ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। এনটিসি নেতারা যদি গোড়াতেই অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এ সমস্যার মোকাবেলা না করেন, তাহলে আফগানিস্তানের মতো ঘটনা ঘটতে পারে। আফগানিস্তানে নাজিবুল্লাহ সরকারের পতন ঘটে ১৯৯২ সালে। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে কোয়ালিশনের মধ্যে বিরোধ বাধে। প্রধানত তালেবানদের নেতৃত্বেই যুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু দেশ শাসন করতে গিয়ে সহযোগী নর্দার্ন অ্যালায়েন্সের সঙ্গে লড়তে হয়েছে পুরো সময়টাই। অর্থাৎ ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দখল করার পূর্ব পর্যন্ত। সোমালিয়ার একনায়ক মুহম্মদ সাঈদ বারে উৎখাত হন ১৯৯১ সালে। অভ্যন্তরীণ কোলাহল এখনও চলছে। এমনকি জিহাদি গ্রুপ আল-সাবাসহ কোনো গ্রুপই ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে পারছে না। শুধু যে উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায়ই এ ঘটনা ঘটে, তা নয়। নিকারাগুয়ায় সফল বিপ্লব হয় ১৯৭৯ সালে। কিন্তু সেনডিনিস্ট ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট বিপ্লবের সহযোদ্ধাদের বাদ দিয়ে নিজেরাই ক্ষমতা দখল করে। ফলে যা হওয়ার তাই হলো। বিপ্লবী নেতা এডেন পাস্টার নেতৃত্বে শুরু হলো গৃহযুদ্ধ। অবশেষে ১৯৮৮ সালে যুদ্ধবিরতি হয়।
যে কোনো দেশে সফল বিপ্লব বা যুদ্ধের পর বৈদেশিক শক্তির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। আফগানিস্তানে তালেবান বিপ্লবের পর নতুন সরকারের ওপর প্রভাব সৃষ্টির চেষ্টা করে পাকিস্তান, ইরান, রাশিয়া ও ভারত। নিকারাগুয়ায় তৎপর ছিল যুক্তরাষ্ট্র, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কিউবা। কিউবা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মদদপুষ্ট ছিল সেনডিনিস্টরা। অতএব যুক্তরাষ্ট্র এদের বিরোধিতা করেছে। বৈদেশিক শক্তিগুলো লিবিয়ায় প্রভাব খাটাবে না_ এমন কথা কেউ বলতে পারে না। বরং তেল ও খনিজসমৃদ্ধ এ দেশটির দিকে সবারই দৃষ্টি রয়েছে। তারা লিবিয়ার উপজাতি ও আঞ্চলিক সমস্যাগুলো কাজে লাগাবে। একের বিরুদ্ধে অন্যকে দাঁড় করাতে এটি একটি মোক্ষম হাতিয়ার। এই হাতিয়ার কাজে লাগাতে পারলেই যথেষ্ট। গাদ্দাফির বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধে সরাসরি জড়িত ছিল ইতালি, ফ্রান্স ও ব্রিটেন। লিবিয়ার প্রদেশগুলো ১৯১১ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত ইতালির কলোনি ছিল। পরে মিত্রবাহিনীর অধীনে চলে গেলে ১৯৫১ সালে স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত ব্রিটেন নিয়ন্ত্রণ করে ত্রিপোলিতানিয়া ও সাইরেনাশিয়া এবং ফ্রান্স ফেজ্জান প্রদেশ। কাজেই ন্যাটোর সামরিক অভিযানে ফ্রান্স ও ব্রিটেনের উৎসাহ ছিল সবচেয়ে বেশি। ইতালি, ফ্রান্স, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার তেল কোম্পানিগুলোর দৃষ্টি লিবিয়ার বিশাল তেলক্ষেত্রে। অপরদিকে কাতার, তুরস্ক ও সংযুক্ত আরব আমিরাত বিদ্রোহীদের সমর্থন দান করায় লিবিয়ার নতুন নেতৃত্বের ওপর প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করবে। মিসর লিবিয়ার একটি শক্তিশালী প্রতিবেশী। কায়রো বরাবরই ত্রিপোলির অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলাতে চেয়েছে। এর ফলে গাদ্দাফির সঙ্গে হোসনি মোবারকের সুসম্পর্ক ছিল না। এখন মিসর নিজেই বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন। ইসরায়েল ও প্যালেস্টাইন ছাড়াও রয়েছে অভ্যন্তরীণ সমস্যা। হয়তো ভবিষ্যতে লিবিয়ার দিকে নজর দেবে।
লিবিয়া তেলের সন্ধান পায় ১৯৫৯ সালে। তখন থেকেই ব্রিটিশ, আমেরিকান ও ইতালীয় কোম্পানিগুলো তেল উদ্ধারের কাজে নিয়োজিত। এর ফলে পশ্চিমাদের সঙ্গে গাদ্দাফির বিরোধ বাধে। মুসলিম উগ্রবাদী এই নেতা কখনও পশ্চিমাদের সহ্য করতে পারতেন না। পশ্চিমারাও তাকে উৎখাত করার চেষ্টা অব্যাহত রাখে। অবশেষে বিদ্রোহ দেখা দিলে তাদের মনস্কামনা পূর্ণ হয়। গাদ্দাফি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা বর্তমান রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। রাশিয়া তাকে অস্ত্র সরবরাহ করে এবং বিদ্রোহীদের সমর্থন দেয়নি। শেষ পর্যন্ত গাদ্দাফিকে তারা সহায়তা দিয়েছে। বিদ্রোহীরা জিতে যাওয়ায় আপাতত রাশিয়ার ক্ষতি হলো বলে অনুমান করা যায়। তবে গাদ্দাফি সরকারের যেসব সিনিয়র কর্মকর্তা বিদ্রোহীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন তাদের অনেকেই রাশিয়ার প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন। প্রয়োজনে মস্কো এদের ব্যবহার করে লিবিয়ার নতুন নেতৃত্বের নৈকট্যে আসার চেষ্টা করবে। দীর্ঘদিন ধরেই চীনের নজর আফ্রিকা ও উত্তর আফ্রিকার দিকে। বেইজিং প্রচুর টাকা ঢালছে আফ্রিকায়। গাদ্দাফি চীনের এই ঔপনিবেশিকতার বিরোধী ছিলেন। সবসময় এসব প্রতিহত করার চেষ্টা করেছেন। অবশ্য লিবিয়ার এনার্জি খাতে চীন ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে এবং বেনগাজির উন্নয়নে অর্থনৈতিক সহযোগিতা করেছে। চীন মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা চায়। কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন, বিদ্রোহীরা দেশ গড়তে চীনের কাছ থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা নিতে পারে। এ ছাড়া রয়েছে লিবিয়ার চিরশত্রু ইসরায়েল। তারা পদে পদে বাধার সৃষ্টি করবে। এসব মাথায় রেখেই নতুন সরকারকে এগিয়ে যেতে হবে।
লিবিয়ার পরিস্থিতি এখনও ঘোলাটে। তবে সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে, গাদ্দাফির বিদায়ের পর লিবিয়ার পরবর্তী সরকার হবে দুর্বল। এখন দেখতে হবে তালেবান, জিহাদি ও কট্টর ইসলামপন্থিদের প্রশ্নে নতুন সরকার কী ভূমিকা নেয়। আরব বিশ্ব ও পশ্চিমা শক্তিগুলোর সঙ্গে কী ধরনের সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তাও লক্ষ্য করার মতো। এ ছাড়া রয়েছে নতুন গৃহযুদ্ধের ভয়। ফলে লিবিয়ার নতুন নেতৃত্বকে গাদ্দাফির উগ্র নীতি পরিহার করে 'জনকল্যাণ এবং বৈরিতা নয়, বন্ধুত্ব'_ এই নীতি অনুসরণ করে অত্যন্ত কৌশলের সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে।

হাসান শাহরিয়ার : ইন্টারন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট, কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন (সিজেএ)
 

No comments

Powered by Blogger.