সমাজ-স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে দিন by শম্পা ইফতেখার
'বুকটা খাঁখাঁ করে'_ মুঠোফোনের বিজ্ঞাপনের এই গানের কলির নেপথ্যে রয়েছে জীবনসংগ্রাম_ প্রিয়জনের সঙ্গে বিচ্ছেদ বেদনা। তবে সেই কাহিনী আজ নয়। আজ মানবিক বোধসম্পন্ন প্রতিটি মানুষের বুক চিরে যে হাহাকার_ তা মানবতার চরম লাঞ্ছনা দেখে। কোথায় আছি আমরা, কোথায় আমাদের মনুষ্যত্বের বোধ;
কীভাবেই আমরা সৃষ্টির সেরা জীব? সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একের পর এক সামাজিক ও মানবিক অবক্ষয়ের কাহিনী নিঃস্ব করে দেয় আমাদের_ আমরা কি আজও মানুষ পর্যায়ে আছি?
পুলিশ বাহিনীর হাতে যে অসীম ক্ষমতা তা বুঝতে দ্বিধা হয় না আমাদের। আর এই ক্ষমতার অপব্যবহার এতই বেশি যে আঁতকে না উঠে উপায় থাকে না। চাইলে তারা কোনো নিরীহ বিশ্ববিদ্যালয়পড়ূয়া ছাত্রকে ডাকাত আখ্যা দিয়ে চাপাতি দিয়ে কোপাতে পারে_ চাইলেই তিন-চারটা মিথ্যা মামলা রুজু করে নিরপরাধীকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারে_ আবার তারাই মিথ্যা তদন্ত রিপোর্ট দিয়ে নিজেদের বাঁচাতে তৎপর। বিপন্ন এই বাহিনী তার মনুষ্যত্ব বিবর্জিত কার্যকলাপ দ্বারা আজ বিতর্কিত। মানব অবয়বের খোলসে এই দানব সমাজযন্ত্রে বিষফোঁড় হয়ে পড়েছে_ হয়তো গুটিকয়েক দুর্নীতিবাজ, অসৎ ও অমানুষের জন্য। বড়দেশী গ্রামে ডাকাত সন্দেহে ছয় ছাত্র হত্যা, আবদুল কাদিরের ওপর নির্যাতন ও মিথ্যা মামলা, নোয়াখালীর মিলন হত্যা_ প্রতিটি ঘটনার নেপথ্যনায়ক পুলিশ ও তার দায়িত্বহীন আচরণ। সামগ্রিক চিত্র কতটা ভয়াবহ তা বহুল প্রচারিত এই ঘটনাগুলো বিচার করলেই বোঝা যায়। নিরাপত্তা বাহিনী বিপন্ন করছে আমাদের জীবন; ঘরে-বাইরে কোথাও আজ স্বস্তি নেই। দায়ভার তো পুলিশ বাহিনী এড়াতে পারে না। অথচ তাদের মাসিক বেতন-ভাতা সবই দেওয়া হয় সরকারি কোষাগার থেকে, যেখানে জমা হয় আমাদের কষ্টার্জিত করের টাকা। আমাদের অর্থে দানব পোষার কোনো অর্থ নেই।
এবার চোখ ফিরাই আমজনতার ওপর। তারাই দেশের বৃহত্তর অংশ_ নীরব কিন্তু পরাক্রমশালী। অন্তত পাঁচ বছর পরপর তাদের কাছে ধরনা দেন মন্ত্রী, বিরোধী পদধারী ক্ষমতাবান লোকগুলো। সাধারণভাবে এই জনতার ক্ষমতা খুবই সীমিত, তা দেখানোর উপায়ও নেই। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে গণপিটুনি দেওয়ার যে সামর্থ্য তারা দেখাচ্ছে তা এতটাই ভীতিকর যে সামাজিক নিরাপত্তাবোধ শূন্যের কোঠায় চলে আসে। কেন মিলন পুকুরপাড়ে নিশ্চিত মনে বসে থাকতে পারবে না? বাংলাদেশে কি আমাদের স্বাধীনভাবে চলাচলের অধিকার নেই? অপরিচিত মনে হলেই সে ডাকাত? আর ডাকাত সন্দেহে মেরে ফেলার এই অধিকার কি আইনসম্মত? অন্যায়_ বড়ই অন্যায়। কী অমানবিক পন্থায় এই জনতা নিরীহ জনকে পৃথিবীছাড়া করছে_ তা ভাবতে শিউরে উঠি। কেন এত অবিশ্বাস, এত সন্দেহ? শিক্ষাহীন পশু আমরা। জুলিয়াস সিজার নাটকে যে জনতা ন্যায়বিচার সাব্যস্ত করেছিল_ সেই জনতা আজ আর নেই। পাসের সার্টিফিকেট হয়তো আছে, কিন্তু শিক্ষার যে মূলনীতি_ মানবিক বোধ, সুপ্ত বৃত্তির পরিপূর্ণ বিকাশ তা অধরাই রয়ে গেছে। তাই সুবেশী যুবকের ইটের আঘাতে প্রাণ দিতে হয় মিলনকে; সাক্ষী থাকে চারপাশে ঘিরে থাকা নির্বোধ জনতা আর পুলিশ পোশাকধারী দানবরা। অবলীলায় মায়ের বুক খালি করে দিই পবিত্র শবেবরাতের রাতে_ কিংবা রৌদ্রোজ্জ্বল দিবালোকে।
সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে টালমাটাল করে দিচ্ছে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। রোজায় আমাদের অবধারিত নিয়তি হলো বর্ধিত মূল্যে তেল, পেঁয়াজ, মরিচসহ সবকিছু ক্রয় করা। এ সুযোগ সন্ধানীদের তালিকায় ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বাড়িওয়ালা, রিকশাওয়ালা পর্যন্ত আছেন। যে সংযম শিক্ষার কথা রোজায় বলা হয়েছে তা যেন প্রহসনে পরিণত হয়েছে। মন্ত্রী পদধারী ক্ষমতাশালীরা বাকসংযমী না হয়ে আমাদের আহার সংযমী হওয়ার বিশাল বাণী দেন। প্রান্তিক শ্রেণীর আমরা আরও ঋজু হয়ে পড়ি। সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা আমাদের আর থাকে না। শেয়ারবাজারে ক্রমাগত পতন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগে অনাস্থা, সহিংসতা, রাজনৈতিক অবিশ্বাস_ সব মিলিয়ে অস্থির এক অবস্থা। শুধু যদি শেয়ারবাজার নিয়ে বলা হয় তবে উত্থান-পতন স্বাভাবিকভাবেই ধরা হয়। কিন্তু এই যে উত্থান-পতন তা কি স্বাভাবিক? স্বাভাবিক বৃষ্টিধারা প্রত্যাশিত ফলনের আশ্বাস; কিন্তু অতিবৃষ্টি বন্যার কারণ। শেয়ারবাজারের পতনের এই অতিমাত্রা ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগকৃত অর্থ_ অর্থের সঙ্গে জড়িত স্বপ্ন-আশা। দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে কয়েক হাজার কোটি টাকা।
বাঁচতে দিন আমাদের। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মরার আশ্বাস দিন। মানবতার শিক্ষা নিশ্চিত করুন_ বিপন্ন মানবতা নয়তো একদিন ধ্বংস করে দেবে পুরো জাতিসত্তাকে।
শম্পা ইফতেখার : শিক্ষক, স্টাম্পফোর্ড ইউনিভার্সিটি
পুলিশ বাহিনীর হাতে যে অসীম ক্ষমতা তা বুঝতে দ্বিধা হয় না আমাদের। আর এই ক্ষমতার অপব্যবহার এতই বেশি যে আঁতকে না উঠে উপায় থাকে না। চাইলে তারা কোনো নিরীহ বিশ্ববিদ্যালয়পড়ূয়া ছাত্রকে ডাকাত আখ্যা দিয়ে চাপাতি দিয়ে কোপাতে পারে_ চাইলেই তিন-চারটা মিথ্যা মামলা রুজু করে নিরপরাধীকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারে_ আবার তারাই মিথ্যা তদন্ত রিপোর্ট দিয়ে নিজেদের বাঁচাতে তৎপর। বিপন্ন এই বাহিনী তার মনুষ্যত্ব বিবর্জিত কার্যকলাপ দ্বারা আজ বিতর্কিত। মানব অবয়বের খোলসে এই দানব সমাজযন্ত্রে বিষফোঁড় হয়ে পড়েছে_ হয়তো গুটিকয়েক দুর্নীতিবাজ, অসৎ ও অমানুষের জন্য। বড়দেশী গ্রামে ডাকাত সন্দেহে ছয় ছাত্র হত্যা, আবদুল কাদিরের ওপর নির্যাতন ও মিথ্যা মামলা, নোয়াখালীর মিলন হত্যা_ প্রতিটি ঘটনার নেপথ্যনায়ক পুলিশ ও তার দায়িত্বহীন আচরণ। সামগ্রিক চিত্র কতটা ভয়াবহ তা বহুল প্রচারিত এই ঘটনাগুলো বিচার করলেই বোঝা যায়। নিরাপত্তা বাহিনী বিপন্ন করছে আমাদের জীবন; ঘরে-বাইরে কোথাও আজ স্বস্তি নেই। দায়ভার তো পুলিশ বাহিনী এড়াতে পারে না। অথচ তাদের মাসিক বেতন-ভাতা সবই দেওয়া হয় সরকারি কোষাগার থেকে, যেখানে জমা হয় আমাদের কষ্টার্জিত করের টাকা। আমাদের অর্থে দানব পোষার কোনো অর্থ নেই।
এবার চোখ ফিরাই আমজনতার ওপর। তারাই দেশের বৃহত্তর অংশ_ নীরব কিন্তু পরাক্রমশালী। অন্তত পাঁচ বছর পরপর তাদের কাছে ধরনা দেন মন্ত্রী, বিরোধী পদধারী ক্ষমতাবান লোকগুলো। সাধারণভাবে এই জনতার ক্ষমতা খুবই সীমিত, তা দেখানোর উপায়ও নেই। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে গণপিটুনি দেওয়ার যে সামর্থ্য তারা দেখাচ্ছে তা এতটাই ভীতিকর যে সামাজিক নিরাপত্তাবোধ শূন্যের কোঠায় চলে আসে। কেন মিলন পুকুরপাড়ে নিশ্চিত মনে বসে থাকতে পারবে না? বাংলাদেশে কি আমাদের স্বাধীনভাবে চলাচলের অধিকার নেই? অপরিচিত মনে হলেই সে ডাকাত? আর ডাকাত সন্দেহে মেরে ফেলার এই অধিকার কি আইনসম্মত? অন্যায়_ বড়ই অন্যায়। কী অমানবিক পন্থায় এই জনতা নিরীহ জনকে পৃথিবীছাড়া করছে_ তা ভাবতে শিউরে উঠি। কেন এত অবিশ্বাস, এত সন্দেহ? শিক্ষাহীন পশু আমরা। জুলিয়াস সিজার নাটকে যে জনতা ন্যায়বিচার সাব্যস্ত করেছিল_ সেই জনতা আজ আর নেই। পাসের সার্টিফিকেট হয়তো আছে, কিন্তু শিক্ষার যে মূলনীতি_ মানবিক বোধ, সুপ্ত বৃত্তির পরিপূর্ণ বিকাশ তা অধরাই রয়ে গেছে। তাই সুবেশী যুবকের ইটের আঘাতে প্রাণ দিতে হয় মিলনকে; সাক্ষী থাকে চারপাশে ঘিরে থাকা নির্বোধ জনতা আর পুলিশ পোশাকধারী দানবরা। অবলীলায় মায়ের বুক খালি করে দিই পবিত্র শবেবরাতের রাতে_ কিংবা রৌদ্রোজ্জ্বল দিবালোকে।
সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে টালমাটাল করে দিচ্ছে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। রোজায় আমাদের অবধারিত নিয়তি হলো বর্ধিত মূল্যে তেল, পেঁয়াজ, মরিচসহ সবকিছু ক্রয় করা। এ সুযোগ সন্ধানীদের তালিকায় ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বাড়িওয়ালা, রিকশাওয়ালা পর্যন্ত আছেন। যে সংযম শিক্ষার কথা রোজায় বলা হয়েছে তা যেন প্রহসনে পরিণত হয়েছে। মন্ত্রী পদধারী ক্ষমতাশালীরা বাকসংযমী না হয়ে আমাদের আহার সংযমী হওয়ার বিশাল বাণী দেন। প্রান্তিক শ্রেণীর আমরা আরও ঋজু হয়ে পড়ি। সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা আমাদের আর থাকে না। শেয়ারবাজারে ক্রমাগত পতন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগে অনাস্থা, সহিংসতা, রাজনৈতিক অবিশ্বাস_ সব মিলিয়ে অস্থির এক অবস্থা। শুধু যদি শেয়ারবাজার নিয়ে বলা হয় তবে উত্থান-পতন স্বাভাবিকভাবেই ধরা হয়। কিন্তু এই যে উত্থান-পতন তা কি স্বাভাবিক? স্বাভাবিক বৃষ্টিধারা প্রত্যাশিত ফলনের আশ্বাস; কিন্তু অতিবৃষ্টি বন্যার কারণ। শেয়ারবাজারের পতনের এই অতিমাত্রা ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগকৃত অর্থ_ অর্থের সঙ্গে জড়িত স্বপ্ন-আশা। দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে কয়েক হাজার কোটি টাকা।
বাঁচতে দিন আমাদের। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মরার আশ্বাস দিন। মানবতার শিক্ষা নিশ্চিত করুন_ বিপন্ন মানবতা নয়তো একদিন ধ্বংস করে দেবে পুরো জাতিসত্তাকে।
শম্পা ইফতেখার : শিক্ষক, স্টাম্পফোর্ড ইউনিভার্সিটি
No comments