কাজে আসছে না টাইফয়েডের ওষুধ, উদ্বিগ্ন চিকিৎসকরা by তৌফিক মারুফ
দেশে হঠাৎ করেই টাইফয়েডের প্রকোপ বেড়ে গেছে। এবার টাইফয়েড পরিস্থিতি নিয়ে চিকিৎসকরা আগের চেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে টাইফয়েডের জীবাণু প্রতিরোধে ওই সব ওষুধের কার্যকারিতা কমে যাওয়ায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) জ্যেষ্ঠ চিকিৎসা ও ভ্যাকসিন বিজ্ঞানী ড. ফিরদৌসী কাদরী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা এবার অন্যবারের তুলনায় বেশি মাত্রায় টাইফয়েড দেখছি। এ ছাড়া আগে যেমন টাইফয়েড বেশি দেখা যেত বড়দের মধ্যে, এখন তা ছোট-বড় নির্বিশেষে সবার মধ্যেই সমানভাবে দেখা দিচ্ছে।'
ওই বিজ্ঞানী বলেন, 'টাইফয়েড নিয়ে আমরা অনেক কাজ করছি। ভ্যাকসিন তৈরির কাজ চলছে। এসব কাজ পূর্ণতা পাওয়ার আগে পরিস্থিতি কিভাবে সামাল দেওয়া যায় তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। কারণ আগে টাইফয়েড চিকিৎসায় যেসব অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করত, তার বেশির ভাগই এখন অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এখন যেটা ব্যবহার করা হয় তা খুবই কঠিন এবং অত্যন্ত শক্তিশালী। এর কার্যকারিতাও যদি নষ্ট হয়, তবে কী হবে!'
ড. ফেরদৌসী কাদরী জানান, টাইফয়েড জীবাণু ক্রমেই ওষুধপ্রতিরোধী হয়ে ওঠায় এর চিকিৎসা জটিল হচ্ছে। আর অবাধে ও যথেচ্ছভাবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের কুফল থেকেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'টাইফয়েড রোগী প্রতিদিনই কম-বেশি পাচ্ছি। দূষিত পানি, খোলা জায়গার খাবার ও খাবারের পরিচ্ছন্নতা বজায় না থাকার ফলে এ রোগ দেখা যায়। এটা দ্রুত শনাক্ত করা না গেলে বা সময়মতো এর সঠিক চিকিৎসা না করানো গেলে রোগীর অবস্থা খারাপ হয়।'
ড. ফিরদৌসী কাদরী বলেন, 'টাইফয়েড শনাক্ত করা খুব একটা সহজ নয়। ছয়-সাত দিনের আগে এটা ধরা মুশকিল হয়ে পড়ে। শনাক্তকরণেই অনেক সময় চলে যায়। তবে আমরা আইসিডিডিআরবিতে এখন একটি পরীক্ষা করছি, যেটা দিয়ে জ্বরের তিন-চার দিনের মধ্যেই টাইফয়েড শনাক্ত করা সম্ভব হবে।'
এবার টাইফয়েডের প্রকোপ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সোহেলা আখতার বলেন, 'আমাদের এখানে জ্বর নিয়ে প্রতিদিন যে শিশুরা চিকিৎসা নেয়, তাদের মধ্যে ২৫-৩০ শতাংশই থাকে টাইফয়েডে আক্রান্ত। টাইফয়েডের এমন প্রকোপকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত।'
ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মঞ্জুর হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, আগের তুলনায় টাইফয়েডের সংক্রমণ বেশি দেখা যাচ্ছে। বর্ষা ও গরমের সময় এর প্রকোপ বেশি থাকে বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশ শিশু চিকিৎসক সমিতির সাবেক মহাসচিব ডা. মেসবাহউদ্দিন আহম্মেদ বলেন, বর্তমানে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে টাইফয়েড জ্বরের ওষুধগুলো কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলছে। সামান্য কারণে অধিক পাওয়ারের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার বন্ধ করতে না পারলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ রূপ নেবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. বেনজির আহম্মেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, টাইফয়েড তো আছেই। তবে এটা সব এলাকায় সমানভাবে নেই। যে এলাকার পানি বা খাদ্যে বেশি দূষণ থাকে, সেসব এলাকায় এর প্রকোপ থাকাটাই স্বাভাবিক। ঢাকায় এখনো নিরাপদ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার নিশ্চিত হচ্ছে না। পানিবাহিত জীবাণু থেকে উৎপত্তি হওয়া রোগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এটাই এখন বড় রকম সমস্যা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বে প্রতিবছর ২০ লাখ মানুষ টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়। তাদের মধ্যে মারা যায় দুই লাখ। তবে বাংলাদেশে মৃত্যুর হার নিয়ে এখনো সঠিক কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে না। আইসিডিডিআরবির গবেষণায় দেখা গেছে, মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টাইফয়েডে আক্রান্ত রোগীদের মৃত্যুহার বেড়ে ৪ দশমিক ২ শতাংশ হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সময়মতো টাইফয়েড ধরা না পড়লে এবং চিকিৎসায় অবহেলা হলে এ রোগে শরীরের কোনো একটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ স্থায়ীভাবে অকার্যকরও হয়ে যেতে পারে। এমনকি পেটের ভেতর রক্তক্ষরণ ও ছিদ্র হয়ে যেতে পারে। তবে টাইফয়েড যাতে না হয়, সেজন্য দেশেই এখন টিকা পাওয়া যায়, যা তিন বছরের জন্য টাইফয়েড প্রতিরোধ করে। ফলে এটি তিন বছর অন্তর নিতে হয়। দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য টিকা এখনো পাওয়া যায় না। আবার ১৯ বছর বয়সের পর আর টিকার প্রয়োজন নেই। এ ছাড়া এখন মুখে খাওয়ার টিকাও এসেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে- স্বাস্থ্য সচেতনতা, দূষিত পানি ও খাবার পরিহার করা, পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেটের ব্যবহার ইত্যাদি।
No comments