এক উপদেষ্টার সিদ্ধান্তে নিরসন হতে পারে পদ্মা সেতু সঙ্কট- কূটনৈতিক সাপোর্ট আমরা পেয়েছি, সেতু হবেই ॥ গওহর রিজভী by হামিদ-উজ-জামান মামুন
পদ্মা সেতু সঙ্কট সমাধানে এক উপদেষ্টার দিকে তাকিয়ে আছে গোটা জাতি। তিনি হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা এবং এ সেতুর ইন্টেগ্রিটি এ্যাডভাইজর হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ড. মসিউর রহমান। তাঁর ছুটিতে যাওয়া কিংবা পদত্যাগের ওপরই নির্ভর করছে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের সমঝোতা। কিন্তু তিনিই বসে রয়েছেন গোঁ ধরে।
তাঁর সাফ কথাÑ দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারলে পদত্যাগ করবেন না। সরকারের নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছেন সবাই। যেন রেফারি বাঁশিতে ফুঁ দিলেই আবার নড়েচড়ে উঠবে সবকিছু।
অন্যদিকে এখন এ সেতুতে দাতাদের অর্থায়নে আশাবাদী সরকার। এমনই বক্তব্য দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর অপর উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী। পররাষ্ট্র বিষয়ক এ উপদেষ্টা মঙ্গলবার এক টেলিভিশন সাক্ষাতকারে বলেছেন, পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংককে ফিরিয়ে আনতে সর্বোচ্চ কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চলছে। শীঘ্রই সমঝোতা হবে। তাছাড়া ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, চীন আমাদের পক্ষে চাপ দিচ্ছে। পাকিস্তানও আমাদের পক্ষে। কূটনৈতিক বিরাট সাপোর্ট আমরা যোগাড় করেছি। আমাদের সেতু হবেই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, সরকার থেকে নির্দেশ দেয়া হলেই আমি ওয়াশিংটনে যেতে প্রস্তুত রয়েছি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বর্তমানে চীন সফরে রয়েছেন। সেখান থেকে তিনি মঙ্গলবার পদ্মা সেতুর বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছেন। তাছাড়া পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীর সঙ্গেও টেলিফোনে যোগাযোগ হয়েছে তাঁর। তবে কি কথা হয়েছে সে বিষয়ে কিছু জানা যায়নি।
অর্থ মন্ত্রণালয় বিশ্বব্যাংকের ঋণ চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য অনুরোধপত্র পাঠাতে প্রস্তুত হয়ে আছে। অপেক্ষা শুধু সরকারের নির্দেশনার। বিশ্বব্যাংকের শর্ত অনুযায়ী ড. মসিউর রহমানের ছুটিতে যাওয়ার পরই এ চিঠি পাঠানো হবে।
পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের বিষয়ে শুরু থেকেই বিশ্বব্যাংক তার অবস্থানে অনড় রয়েছে। এর আগে চুক্তি বাতিলের কারণ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংক দীর্ঘ ব্যাখা প্রদান করেছিল। সংস্থাটি বলেছিল পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের ব্যাপারে বাংলাদেশের সরকারী কর্মকর্তা, এসএনসি নাভালিনের কর্মকর্তা এবং বেসরকারী পর্যায়ে ব্যক্তিবর্গের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতিমূলক ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-প্রমাণ বিশ্বব্যাংকের কাছে রয়েছে। বিশ্বব্যাংক ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এবং ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে দুটি তদন্তের তথ্য-প্রমাণ প্রদান করেছে। আমরা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি পূর্ণ তদন্ত করতে এবং যথাযথ বিবেচিত হলে দুর্নীতির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলাম। আমরা এ পদক্ষেপ নিয়েছিলাম, কারণ আমরা আশা করেছিলাম যে সরকার বিষয়টিতে যথাযথ গুরুত্বারোপ করবে।
কানাডায় যেখানে এসএনসি-নাভালিনের সদর দফতর অবস্থিত সেখানে বিশ্বব্যাংকের রেফারেন্সের ভিত্তিতে ক্রাউন এসিকিউশন সার্ভিসেস কয়েকটি সার্চ ওয়ারেন্ট তামিল করে এবং এক বছরব্যাপী তদন্ত চালিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত সংশ্লিষ্ট দু’জন সাবেক এসএনসি নাভালিনের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ দাখিল করেছে। তদন্ত ও বিচার কাজ অব্যাহত রয়েছে। আদালতে পেশকৃত তথ্য এই ঘটনার গুরুত্ব তুলে ধরছে। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ তথা এ অঞ্চলের উন্নয়নের ক্ষেত্রে পদ্মা সেতুর ভূমিকা বিবেচনায় আমরা প্রকল্পের বাস্তবায়নের জন্য বিকল্প উপায় তথা টার্নকি পন্থায় প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তাব দিয়েছিলাম এই বিবেচনায় যে সরকার আমাদের দ্বারা উন্মোচিত উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবে। সুশাসন এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে এসব হুমকির ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণে জোর না দেয়া বিশ্বব্যাংকের জন্য দায়িত্বহীনতার পরিচয় হবে।
সংস্থাটি বলেছে, টার্নকি পন্থায় অগ্রসর হওয়ার জন্য আমরা নিন্মেক্ত পদক্ষেপসমূহ প্রস্তাব করেছিলাম। প্রথমত, যেসব সরকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের অব্যাহতি প্রদান করা। দ্বিতীয়ত, এই অভিযোগ তদন্তের জন্য দুদকের অধীনে একটি বিশেষ তদন্ত দল নিয়োগ করা এবং তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত বিশ্বব্যাংকের নিয়োগকৃত একটি প্যানেলের কাছে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সকল তথ্যের পূর্ণ ও পর্যাপ্ত প্রবেশাধিকারে সরকারের সম্মতি প্রদান যাতে এই প্যানেল তদন্তের অগ্রগতি, ব্যাপকতা ও সুষ্ঠুতার ব্যাপারে উন্নয়ন সহযোগীদের নির্দেশনা দিতে পারে। আমরা সরকার ও দুদকের সঙ্গে ব্যাপক ও গভীরভাবে কাজ করেছি এটি নিশ্চিত করতে যে অনুরোধকৃত সকল পদক্ষেপ সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশ নিজস্ব আইন ও বিধি-বিধানের আওতায় থাকে।
আমরা প্রস্তাব দিয়েছিলাম, প্রথমবার দরপত্র আহ্বান করা হলে বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী প্যানেলে মূল্যায়নের ভিত্তিতে প্রকল্পে অর্থায়নের ব্যাপারে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নেবে, যদি পূর্ণ ও সুষ্ঠু তদন্ত চলছে এবং যথাযথ অগ্রগতি হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়।
বাড়তি প্রয়াস হিসেবে আমরা বিশ্বব্যাংকের অবস্থান ব্যাখা করে সরকারের জবাব জানার জন্য ঢাকায় একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু সরকারের প্রতিক্রিয়া বা জবাব সন্তোষজনক ছিল না। তাই বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির ঘটনায় চোখ বুজে থাকতে পারে না, তা উচিত নয় এবং থাকবেও না। আমাদের শেয়ারহোল্ডার ও আইডিএ দাতা দেশগুলোর প্রতি আমাদের নৈতিক দায়বদ্ধতা এবং সুষ্ঠু আর্থিক ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত দায়িত্ব রয়েছে। এটি নিশ্চিত করা আমাদেরই দায়িত্ব যে আইডিএ সম্পদ কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং কেবল তখনই একটি প্রকল্পে আমরা অর্থায়ন করব, যখন যথেষ্ট নিশ্চয়তা পাব যে প্রকল্পটি পরিষ্কার ও স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন হবে। বাংলাদেশ সরকার থেকে পর্যাপ্ত বা ইতিবাচক সাড়া না মেলায় বিশ্বব্যাংক পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের সহায়তার ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার ঋণ বাতিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
No comments