ঢাকা লিটল থিয়েটার ও নাজমা আপা by নাসির উদ্দীন ইউসুফ

ছোটদের জন্য নাটক রচনা কঠিন কাজ। কিন্তু ছোটদের নিয়ে নাটক করা আমার মতে সহজ। কেননা ছোটদের মন ও মগজ রেখাহীন সরল স্লেট। অনেক কঠিন বিষয় সহজেই ওরা বুঝতে পারে। কোনো বিষয়কেই জটিল করে তোলে না। হয়তো বড়দের মতো একটি নাটকীয় মুহূর্ত ও অবস্থানকে বিশ্লেষণ করতে পারে না; কিন্তু পরিচালক যদি সঠিকভাবে


বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দিতে পারেন, তবে যেকোনো খুদে অভিনেতা অবিশ্বাস্যভাবে শিল্পোত্তীর্ণ করতে পারে সেই মুহূর্তগুলোকে। একজন খুদে অভিনেতা বা অভিনেত্রীর মধ্যে যে অপার সম্ভাবনা রয়েছে, তা আবিষ্কারের তেমন উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি কখনোই।
একমাত্র ঢাকা লিটল থিয়েটারের নাম উল্লেখ করা যায় এ প্রসঙ্গে। যে দলটি দীর্ঘদিন নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে ছিল। ভাবতে অবাক লাগে, এ দলটি হারিয়ে গেল সবার অলক্ষে। ভাবতে গিয়ে ভালো লাগে আমি এ দলটির প্রতিষ্ঠালগ্নে নিজেকে জড়িত করেছিলাম। ভাবতে ভালো লাগে সে সময় অর্থাৎ ১৯৭৫ সালে ঢাকা শিশু নাট্যমের মধ্য দিয়ে যে শিশুদের সঙ্গে প্রথম কাজ শুরু করেছিলাম তারা আজ একেকজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ।
ভালো লাগার ভেতর দুঃখও আছে। কষ্টও আছে। কষ্ট এ জন্য যে যাকে ঘিরে ঢাকা লিটল থিয়েটারের জন্ম ও বেড়ে ওঠা, সেই মানুষটি আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। তিনি নাজমা জেসমিন চৌধুরী। ২৩ বছর আগে আজকের এই দিনে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁকে ঘিরে তাঁর ঘরেই এই লিটল থিয়েটারের জন্ম ও পথচলা।
নাজমা আপার বড় ধরনের বসার ঘর, বারান্দা, এমনকি শোবার ঘর, বাড়িজুড়েই চলত লিটল থিয়েটারের কাজ। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে প্রায় জনাচল্লিশ তাদের হৈচৈ কিচিরমিচির ছোটাছুটি কোনো কিছুতেই বিরক্ত হতেন না তিনি। হাসিমুখে সবার দিকে খেয়াল রেখেছেন। কার কী প্রয়োজন। লিটল থিয়েটারের প্রথম নাটক কী হতে পারে এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলেছিল। আমরা সবাই তাঁকেই বললাম নাটক রচনা করতে। তিনি স্বভাবসিদ্ধ বিনয়ের সঙ্গে বললেন, 'আমি পারব কি?' সবাই চেপে ধরলে তিনি রাজি হলেন।
রবিঠাকুরের 'তাসের দেশ' ছোটদের উপযোগী করে লেখার কাজে হাত দিলেন। নাটকটি রচনার সময় প্রায়ই আলাপ হয়েছে- মঞ্চে নাটকের প্রয়োগ সম্পর্কে, উপস্থাপনা সম্পর্কে। কখনো মতে মিলেছে, কখনো মিলেনি। কিন্তু সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। সারা দিন রচনার কাজ, সন্ধ্যায় নাটকের মহড়া। সব একাই সামাল দিতেন। এভাবে গড়ে মঞ্চে উঠল 'তাসের দেশ' নাটক। শিশুদের মাঝে শিশু হয়ে যেতেন তিনি।
একটি নাটক প্রযোজনার মধ্য দিয়েই একটি নাট্যদলের জন্ম হয়। ঢাকা লিটল থিয়েটারের বেলায়ও তা-ই হয়েছিল। মঞ্চায়ন সময়েও তিনিই মূল কাণ্ডারি। মঞ্চের পেছনে থেকে সব কিছু নীরবে সামলেছেন। তাই কোনো দিনই নিজের নাটক পুরো দেখতেও পারেননি।
আমি নিজে ঢাকা থিয়েটার ও অন্যান্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ কমে আসে। মাঝেমধ্যে দেখা হলে তিনি বলতেন, 'বাচ্চু, তুমি যত বড় নির্দেশক হও না কেন, তুমি কিন্তু আমার কাছে একজন মুক্তিযোদ্ধা। তোমার এই পরিচয়টি আমার কাছে যেমন বড় তেমনি অধিক মর্যাদাপূর্ণ। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমার অসীম শ্রদ্ধা।'
আমি চমকে যেতাম- দেশকে, স্বাধীনতাকে, মুক্তিযুদ্ধকে কতটুকু ভালোবাসলে এমন কথা বলা যায়। মুক্তিযোদ্ধা তাঁর কাছে সব সময়ই অসীম শ্রদ্ধার মানুষ। তিনি মাঝেমধ্যে বলতেন, আমি একটু স্থির হয়ে নিই, তারপর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখব। বড় আকারে লিখব। তিনি প্রচুর লিখেছেন; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যেমন বড় করে ভাবতেন তেমন লিখে যেতে পারলেন না। মৃত্যু এসে বড় অসময়ে তাঁকে নিয়ে চলে গেল।
লিটল থিয়েটার নিয়ে ভাবতে গেলে অনিবার্যরূপে নাজমা আপার কথাই প্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। কারণ নাজমা আপাকে ঘিরে এই সংগঠনটির জন্ম; আর তাঁর স্নেহ-মমতায় বেড়ে উঠেছিল এই সংগঠন।
নাজমা আপা নেই। তবে তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্যেই তিনি বেঁচে আছেন এবং থাকবেন অনন্তকাল। তাঁর ২৩তম মৃত্যুবার্ষিকীর এই দিনে নাজমা আপার প্রতি আমার পরম শ্রদ্ধা। একজন কথাশিল্পী-নাট্যকার আমরা অকালে এই দিনে হারিয়েছিলাম। যিনি অঙ্গীকারে ছিলেন সমাজ বদলের এক অনন্য সাহসী যোদ্ধা।
লেখক : চলচ্চিত্র নির্মাতা

No comments

Powered by Blogger.