স্মরণ- তিনি ভাবতেন সমাজ পরিবর্তনের কথা by দিল মনোয়ারা

দিন-তারিখ ঠিক মনে নেই। সালটা ১৯৭৮। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তাসের দেশ নাটকের রিহার্সেল হচ্ছিল প্রয়াত ড. নাজমা জেসমিন চৌধুরীর বাসায়। আপা তখন লিটল থিয়েটার গ্রুপের দায়িত্বে থেকে নির্দেশক হিসেবে এই নাটকের রিহার্সেল করাচ্ছিলেন।


নাজমা আপাকে ঘিরেই এ সংগঠনের জন্ম এবং তাসের দেশ নাটকটি তিনিই ছোটদের উপযোগী করে তৈরি করেছিলেন। ড্রয়িংরুম, বারান্দা অভিভাবক ও ছোট ছেলেমেয়েদের ভিড়ে জমজমাট। নাটক মঞ্চায়িত হওয়ার সাত-আট দিন আগে থেকেই সেই ব্যস্ততা আরও বেড়ে যেত। বুদ্ধিদীপ্ত, আন্তরিক, সদা হাস্যময়, টিপটপ, চঞ্চল হরিণীর মতো নাজমা আপাকে তখন থেকেই আমার ভালো লাগতে শুরু করে। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন আমার এবং আমার মতো আরও অনেকের অকৃত্রিম শুভাকাঙ্ক্ষী। ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ উঠলেই তিনি সবাইকে সাহস এবং সৎ, শুভ পরামর্শ দিতেন। শিশুদের মাঝে তিনি একেবারেই শিশু হয়ে যেতেন। শিশুদের প্রতি তাঁর অপরিসীম ভালোবাসা একান্তই তাঁর স্বভাবের অন্তর্গত। তাঁর নিজের লেখা একটি বই উৎসর্গ করেছিলেন কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলা এবং লিটল থিয়েটারের ভাইবোনদের। তিনি কচি-কাঁচার মেলার উপদেষ্টা ছিলেন। শহীদুল্লা কায়সারের কালজয়ী উপন্যাস সংশপ্তক-এর কিশোর সংস্করণ তিনি দক্ষ হাতে তৈরি করেছিলেন। শিশুদের জন্য লেখা বিভিন্ন নাটকে তিনি সমাজ বদলের কথা বলেছেন। ১৯৮৯-এ লেখা ওরা ছিল বাগানে নাটকে তিনি দেখিয়েছেন দৈত্যরা বারবার সমাজে ফিরে আসে। শিশুরা বাগান থেকে ওদের তাড়িয়ে দেয়, ভবিষ্যতেও তাড়াবে; কেননা, এসব দুরন্ত শিশুই আমাদের ভবিষ্যৎ। বড়দের নাট্য গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠিত না হলেও নাজমা আপাই প্রথম শিশুতোষ নাট্যচর্চার ধারা এ দেশে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।
এ ক্ষেত্রের পথিকৃৎ এই মানুষটি শিশুদের নাটক নিয়ে চিন্তা, নিরীক্ষা, গবেষণা ও মঞ্চাভিনয়ের ব্যবস্থা আন্তরিকতার সঙ্গে করে শুধু নন্দিতই হননি, সে সময়ে এটিকে একটি আন্দোলনেও রূপ দিয়েছিলেন।
সমাজ পরিবর্তনে বিশ্বাস করতেন তিনি। স্বীয় গণ্ডির ভেতরে অবস্থান করেও তিনি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাঁর কর্মকাণ্ডকে প্রসারিত করেছিলেন। নিরলস সাহিত্যচর্চার মধ্য দিয়েই তিনি সমাজ পরিবর্তনের মূলধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে চেয়েছেন। তাঁর নাতিদীর্ঘ জীবনেও তিনি সাহিত্যিক, গবেষক, সমালোচক, কথাশিল্পী, নাট্যকার হিসেবে উল্লেখযোগ্য ও ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছিলেন। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই, যেখানে তাঁর পদচারণ ছিল না। প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, শিশুসাহিত্য, নাটক—সর্বত্র। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ তাঁর ড. আহমদ শরীফের তত্ত্বাবধানে করা পিএইচডি থিসিস, যা বাংলা উপন্যাস ও রাজনীতি নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিষয়ের অভিনবত্ব ও রচনার মুনশিয়ানার জন্য এটি একটি উল্লেখযোগ্য গবেষণাকর্ম হিসেবে পশ্চিমবঙ্গেও সমাদৃত হয়েছে। সৃজনশীলতার মধ্য দিয়ে তিনি ছুঁতে চেয়েছিলেন জীবনকে, জীবনের নানা অনুষঙ্গকে। তাই উঠে এসেছে সেখানে দেশ-কাল, সমাজ-পটভূমি, মানুষ ও তার জীবনসংগ্রাম। তাঁর সাহিত্যকর্মের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক গবেষণা ও মননশীল রচনা। তিনিই প্রথম রাজনীতির আলোকে ও সমাজ দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে উপন্যাসের মূল্যায়ন করেছেন।
ড. নাজমার লেখা নাটক একসময় টিভি দর্শকদের মুগ্ধ করেছিল। তাঁর লেখা ছাড়পত্র নাটকটি পুরস্কারে ভূষিত হয়। খেলা, পালাবদলের পালা, প্রথম অঙ্গীকার, প্রতিদ্বন্দ্বী নাটক লিখেও তিনি প্রশংসিত হন। তিনি বিভূতিভূষণ, আবদুল ওদুদ, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ, গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ লিখে বিদগ্ধ পাঠকদের প্রশংসা পেয়েছিলেন।
নাজমা জেসমিন চৌধুরী বেশি উপন্যাস লেখেননি, তবে আমি বিশ্বাস করি তিনি বেঁচে থাকলে উপন্যাস তাঁর সৃষ্টিকর্মের প্রধান মাধ্যম হতে পারত। তাঁর সামনে সময়, ঘরের ছায়া, মেঘ কেটে গেলো বক্তব্যপ্রধান উপন্যাস। এখানে সমাজ বদলের প্রক্রিয়ায় মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত, সচেতন নারীর অংশগ্রহণের কথা বলা হয়েছে। সমাজ প্রগতির লক্ষ্যে এর প্রয়োজন অত্যন্ত বেশি, কারণ তিনি তাঁদের নিয়ে লিখতেন যাঁরা লেখাপড়া শিখছেন ঠিকই, কিন্তু চেতনার স্তর বেশি দূর বিস্তৃত হয়নি। নাজমা জেসমিন সমাজের সমস্যাকে অনুভব করেছেন শুধু হূদয় দিয়ে নয়, বুদ্ধি দিয়েও। এখানেই তাঁর স্বাতন্ত্র্য ও অভিনবত্ব। উপন্যাসের মধ্যে তাঁর সমাজের প্রতি অঙ্গীকার সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর সমানাধিকারের যে প্রশ্ন এবং সে প্রশ্নে নারীর যে শৃঙ্খল, পুরুষশাসিত সমাজে তার মুক্তির তাগিদ, তার যথাযথ চিত্রায়ণ ঘটেছে তাঁর উপন্যাসে।
মাত্র ৪৯ বছর বয়সে ১৯৮৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর বিশাল ভালোবাসার পরিমণ্ডল ছেড়ে তাঁকে চলে যেতে হয়েছিল। অসংখ্য বন্ধু-বান্ধব, সুহূদ, সহকর্মী, ছাত্রছাত্রীর শোকার্ত মিছিল দেখেই সেদিন অনুমান করা গিয়েছিল তাঁর ভালোবাসার ক্ষেত্র কত প্রসারিত, কত গভীরে তা প্রোথিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের সেদিনের বুকভাঙা কান্নার মধ্যে নাজমা আপার সুধা-স্নিগ্ধ হূদয়খানির বিশাল ব্যাপকতার ছায়াই উদ্ভাসিত হয়েছিল। তিনি নিজের মতাদর্শের সঙ্গে, নীতি ও আজন্ম লালিত বিশ্বাসের সঙ্গে কখনো আপস করেননি। তাঁর অবিচলিত আদর্শনিষ্ঠা এবং যে কর্মস্পৃহা, তার ব্যাপক প্রসার ঘটুক, আজকের দিনে আমাদের সেটাই চাওয়া। এ ধরনের অনন্যসাধারণ বিরল ব্যক্তিত্বের মানুষের সংখ্যা সমাজে যতই বাড়বে, ততই অবক্ষয়ের অন্ধকার থেকে সমাজ মুক্তি পাবে, আলোকিত হবে।
দিল মনোয়ারা

No comments

Powered by Blogger.