কণ্ঠস্বর-পদ্মা সেতু ও আগামী নির্বাচন by রাহাত খান
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন কেন নিরপেক্ষ, অবাধ, স্বচ্ছ হবে না এ বিষয়ে খানিকটা আলোচনা করা যাক। বলা বাহুল্য, এই দাবি বিএনপি-জামায়াত জোটের। এই ইস্যুতে পক্ষ-প্রতিপক্ষের আলোচনায় বসা উচিত ছিল আগেই।
আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকার নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে বিরোধী দলকে বহুবার জাতীয় সংসদে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছে। এমন কথাও মহাজোট সরকার বলেছে, সংসদে বিএনপি-জামায়াত আসতে না চাইলে সংসদের বাইরেও বিষয়টি নিয়ে দু'পক্ষের আলোচনা হতে পারে। বর্তমান সরকার বলেছে, বিকল্প প্রস্তাব নিয়েও বিরোধী দলের সঙ্গে তাদের আলোচনা হতে পারে
বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে মনে হয় শেষ কথা বলে দিয়েছেন বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ম্যানেজার মিস গোল্ডস্টেইন। তিনি গিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে নিজের দেশে। হয়তো ছুটি কাটাতে। হয়তো অফিসের কাজে। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশে ফিরেছেন তিনি। ফিরে এসে সাংবাদিকদের মোকাবেলায় বিশ্বব্যাংকের সম্ভাব্য অর্থায়ন নিয়ে দ্ব্যর্থহীনভাবে যে মন্তব্যটি তিনি করেছেন, তা আমার বিবেচনায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মনে হয় পদ্মা সেতুর সম্ভাব্য অর্থায়ন নিয়ে শেষ কথাটা তিনি বলে দিয়েছেন।
গোল্ডস্টেইন কোনো রকম কূটনৈতিক কৌশল বা ভাষার আশ্রয় না নিয়ে সোজা-সাফটা বলে দিয়েছেন, বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পদ্মা সেতুর স্থগিত করা অর্থায়ন নির্ভর করছে বাংলাদেশের ওপর। এই মন্তব্যটির অবধারিত অর্থ হচ্ছে, বিশ্বব্যাংক কর্তৃক আরোপিত সব ক'টি শর্ত মানা হলে তবেই পদ্মা সেতুর অর্থায়নের বিষয়টি বিশ্বব্যাংক বিবেচনা করে দেখবে।
পদ্মা সেতুর অর্থায়নের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ সরকারকে চারটি শর্ত দিয়েছিল। একটু গড়িমসি করে হলেও বাংলাদেশ সরকার তিনটি শর্ত ইতিমধ্যে মেনে নিয়েছে। বাকি আছে একজন উপদেষ্টার পদত্যাগ কিংবা ছুটিতে যাওয়া। আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশ সরকার চাইছে অর্থায়নে বিশ্বব্যাংকের একটা গ্রিন সিগন্যাল। সেই সিগন্যাল পেলে উপদেষ্টার পদত্যাগ বা পদচ্যুতি কোনো ব্যাপারই নয়। বাংলাদেশ সরকার সেই শর্ত (উপদেষ্টার পদত্যাগ) মেনে নেবেই।
মুশকিল হচ্ছে, বিশ্বব্যাংক তার বর্তমান অবস্থানে অবিচল। এদিকে সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। যা করার অতি দ্রুত করতে হবে। অনেকের মতো আমিও ভেবেছিলাম, পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন যখন জরুরি, বিশ্বব্যাংক এই ব্যাপারে রাজি না হলে এডিবি এবং জাইকাও যখন প্রতিশ্রুত অর্থায়ন করা থেকে নিজেদের হাত গুটিয়ে নেবে, তখন দ্বিমাসিক ইংরেজি পত্রিকা ইকোনমিস্টের ভাষায়, 'পানি ঘোলা না করে' চতুর্থ শর্তটি মেনে নিলেও তো হয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের হয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে দূতিয়ালির কাজ করছে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং ভারত। চতুর্থ শর্তটি পরিপূরণ হলে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু অর্থায়নে গড়িমসি করবে কিংবা বর্তমান অবস্থানে অটল থাকবে_ এমন ভাবার কোনো হেতু দেখি না।
চতুর্থ শর্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অর্থ বিষয়ক মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা অতি সম্প্রতি কিছুটা যেন অনমনীয় ভাষায় বলেছেন, তার দুর্নীতি আগে প্রমাণ করুক বিশ্বব্যাংক, তার আগে তিনি উপদেষ্টার পদ থেকে সরে যাবেন না। কথাটা তিনি কিসের ভরসায় বলেছেন আমার জানা নেই। তবে শুধু তার পদত্যাগে গোঁয়ার্তুমির কারণে এবং সরকারের তার প্রতি দুর্বলতার কারণে সেতুর অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংক যদি সরে দাঁড়ায়, সেই সঙ্গে এডিবি এবং জাইকা_ তাহলে তিনি জাতীয় ভিলেনে পরিণত হবেন। এ ছাড়া পদ্মা সেতু নির্মিত না হলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এবং উত্তরাঞ্চলের ভোটাররা যদি আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকারের প্রতি বিমুখ হন অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
পদ্মা সেতু শুধু যে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এবং উত্তরাঞ্চলের মানুষ ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত সহায়ক তা-ই নয়; এই সেতু বাস্তবায়িত হলে চীন, ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে সরাসরি মেলবন্ধনে বিশাল ভূমিকা রাখবে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং হিংসাপরায়ণ দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে যে কোনো রাষ্ট্রের জন্য মহাক্ষতিকারক। ক্ষমতার দুই মেয়াদেই বিএনপি-জামায়াত যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই আত্মহত্যামূলক নীতি অনুসরণে অটল ছিল। পাছে ভারত সুবিধা পেয়ে যায়, এ জন্য তারা এশিয়ান হাইওয়েতে যোগ দেয়নি। মিয়ানমার-বাংলাদেশ-ভারত গ্যাস-তেল পাইপলাইনে সম্মত হয়নি, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের জন্য যা ছিল উপযোগী ও লাভজনক, সেই ট্রানজিটের সুবিধা দিতে নারাজি ছিল।
মহাজোট সরকার দেশের জন্য সুইসাইডাল নীতি পরিহার করে চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সব দেশের সমর্থন ও সাধুবাদ পেয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মাণে তাই সরকারের একজন উপদেষ্টার জেদ বা গোঁয়ার্তুমির অবস্থান সরকারের জন্য কোনো জটিল বিষয় হয়ে দাঁড়ানোর অবকাশ নেই। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও সরকারে তার সঙ্গী দলগুলোর দ্বিতীয় মেয়াদ পাওয়ার ক্ষেত্রে পদ্মা সেতুসহ আরও কয়েকটি ইস্যু, বিশেষ করে তিস্তা চুক্তি ইত্যাদি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেবে। কথাটি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বও নিশ্চয় জানে। তাহলে খামাখা সময় নষ্ট করে লাভ কী।
এই প্রসঙ্গের এখানেই ইতি। বরং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন কেন নিরপেক্ষ, অবাধ, স্বচ্ছ হবে না এ বিষয়ে খানিকটা আলোচনা করা যাক। বলা বাহুল্য, এই দাবি বিএনপি-জামায়াত জোটের। এই ইস্যুতে পক্ষ-প্রতিপক্ষের আলোচনায় বসা উচিত ছিল আগেই। আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকার নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে বিরোধী দলকে বহুবার জাতীয় সংসদে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছে। এমন কথাও মহাজোট সরকার বলেছে, সংসদে বিএনপি-জামায়াত আসতে না চাইলে সংসদের বাইরেও বিষয়টি নিয়ে দু'পক্ষের আলোচনা হতে পারে। বর্তমান সরকার বলেছে, বিকল্প প্রস্তাব নিয়েও বিরোধী দলের সঙ্গে তাদের আলোচনা হতে পারে। কিন্তু আলোচ্য ইস্যুতে বিরোধী দল প্রত্যেকটা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। ভদ্রলোকের এক কথার মতো নির্বাচন হতে হবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই। এই দাবির প্রতি কিছুসংখ্যক জ্ঞানপাপীও সমর্থন জানিয়েছেন, এখনও জানাচ্ছেন।
জ্ঞানপাপী কেন বলছি? বলছি কারণ একটি নির্বাচিত সর্বদলীয় সরকার, একটি প্রয়োজনীয় ক্ষমতা ও সহযোগিতা দেওয়া শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন অবশ্যই দেশে একটি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারে। পক্ষ-প্রতিপক্ষের মধ্যে দর কষাকষি হতে পারে নির্বাচিত সংসদ ভেঙে দেওয়া এবং সর্বদলীয় তিন মাসকালীন সরকারের প্রধান কে থাকবেন এসব নিয়ে। তবে এর জন্যও তো পক্ষ-প্রতিপক্ষের মধ্যে আলোচনা হওয়া জরুরি। যাদের আমি জ্ঞানপাপী বলছি_ একেকজন তারা বিশাল মাপের লোক, সন্দেহ নেই। তারা কেন 'বিচারপতি' এবং 'নির্দলীয়' শব্দ দুটির ওপর অন্ধের মতো এমন সমর্থন জোগান? জোগাচ্ছেন?
বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় বিচারপতিদের যোগ্যতা নিয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে (সম্মানিত ব্যতিক্রম সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান শেলী) কেউ-ই তো বাঞ্ছিত পক্ষপাতহীন ব্যক্তিত্ব ও কর্তৃত্বের পরিচয় দিতে পারেননি। বিচারপতিদের নাম ও অপকীর্তির বিষয়ে কিছু বলতে চাই না। তবে নির্বাচনকালীন তিন মাসমেয়াদি সর্বদলীয় নির্বাচিত সাংসদদের দ্বারা গঠিত একটি সরকার অবশ্যই চিন্তা ও বিবেচনার অপেক্ষা রাখে। এই চিন্তাটা তথাকথিত জ্ঞানী ব্যক্তিরা কেন যে করেন না, কেন যে নির্বাচনের সময়কালীন বিএনপি-জামায়াতের 'নির্দলীয়', 'আমার সোনার হরিণ চাই' জাতীয় ধারণাকে হাওয়া দিচ্ছেন, এই প্রশ্ন অনেকের মতো আমারও ছিল, এখনও আছে।
সত্য বটে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণার বাহক ছিল আওয়ামী লীগ। তবে তখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ছিল সম্পূর্ণই ভিন্ন। মাগুরা উপনির্বাচন এবং নির্বাচন কমিশনে বিচারপতি আবদুর রউফ এবং পরে বিচারপতি আবদুল আজিজ বিএনপির খাস লোক ছিলেন। আর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে সাবেক প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ ও সাবেক প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান সম্পর্কে যত কম বলা যায় ততই শ্রেয়। আর ফখরুদ্দীন আহমদের সেনা সমর্থিত সরকার দেশি-বিদেশি চাপের মুখে একটা স্বচ্ছ, অবাধ ও নিরপেক্ষা নির্বাচন দেওয়া ছাড়া আর যা কিছু করেছিল, সংবিধান লঙ্ঘন করে তিন মাসের জায়গায় দু'বছর ক্ষমতায় বহাল থাকা, অপরিমেয় দুর্নীতি, রাজনীতি ধ্বংস করার অপপ্রয়াস ইত্যাদি তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতিবাচক ভাবমূর্তিই শুধু প্রতিষ্ঠা করেছে। এরপরও 'নির্দলীয়' অনির্বাচিত লোকদের নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি?
আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি মানতে মহাজোট সরকারকে বাধ্য করার ক্ষমতা বিএনপি-জামায়াতের নেই। সেই ক্ষেত্রে বিএনপি-জামায়াত যা করতে পারে, তা হলো জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের দিয়ে বোমাবাজি, গ্রেনেডবাজি, হত্যা ইত্যাকার পন্থার আশ্রয় নিয়ে দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে একটা নৈরাজ্য এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি। তবে সেই পন্থার আশ্রয় নিলে বিএনপি বিদেশি মিত্র ও দাতাগোষ্ঠীর সমর্থন হারাবে। সমর্থন হারাবে দেশের জনগণের। বাংলাদেশের মানুষ তো বিএনপি-জামায়াতের ২০০১-০৬ সালের শাসন পর্বের কথা ভুলে যায়নি। আবার সে রকম একটা বিএনপি-জামায়াত জোটকে ভোট দিয়ে জনগণ ক্ষমতায় আনবে_ এটা দুরাশারও বেশি।
বিএনপি ও আওয়ামী লীগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে, উভয় দলকে ছাড় দিতে হবে। সে জন্য পক্ষ-প্রতিপক্ষ দলের জন্য আলোচনার টেবিলে ফিরে যাওয়া জরুরি। কাজটা বিএনপি ও আওয়ামী লীগ যত তাড়াতাড়ি শুরু করে ততই মঙ্গল; দল দুটির জন্য তো বটেই, দেশের জন্যও। আমরা সেই বহু কাঙ্ক্ষিত শুভক্ষণটির জন্য অপেক্ষা করছি। রাজনীতিতে জেদ ও সন্ত্রাসের কোনো স্থান নেই।
রাহাত খান : কথাসাহিত্যিক
ও কলাম লেখক
বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে মনে হয় শেষ কথা বলে দিয়েছেন বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ম্যানেজার মিস গোল্ডস্টেইন। তিনি গিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে নিজের দেশে। হয়তো ছুটি কাটাতে। হয়তো অফিসের কাজে। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশে ফিরেছেন তিনি। ফিরে এসে সাংবাদিকদের মোকাবেলায় বিশ্বব্যাংকের সম্ভাব্য অর্থায়ন নিয়ে দ্ব্যর্থহীনভাবে যে মন্তব্যটি তিনি করেছেন, তা আমার বিবেচনায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মনে হয় পদ্মা সেতুর সম্ভাব্য অর্থায়ন নিয়ে শেষ কথাটা তিনি বলে দিয়েছেন।
গোল্ডস্টেইন কোনো রকম কূটনৈতিক কৌশল বা ভাষার আশ্রয় না নিয়ে সোজা-সাফটা বলে দিয়েছেন, বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পদ্মা সেতুর স্থগিত করা অর্থায়ন নির্ভর করছে বাংলাদেশের ওপর। এই মন্তব্যটির অবধারিত অর্থ হচ্ছে, বিশ্বব্যাংক কর্তৃক আরোপিত সব ক'টি শর্ত মানা হলে তবেই পদ্মা সেতুর অর্থায়নের বিষয়টি বিশ্বব্যাংক বিবেচনা করে দেখবে।
পদ্মা সেতুর অর্থায়নের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ সরকারকে চারটি শর্ত দিয়েছিল। একটু গড়িমসি করে হলেও বাংলাদেশ সরকার তিনটি শর্ত ইতিমধ্যে মেনে নিয়েছে। বাকি আছে একজন উপদেষ্টার পদত্যাগ কিংবা ছুটিতে যাওয়া। আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশ সরকার চাইছে অর্থায়নে বিশ্বব্যাংকের একটা গ্রিন সিগন্যাল। সেই সিগন্যাল পেলে উপদেষ্টার পদত্যাগ বা পদচ্যুতি কোনো ব্যাপারই নয়। বাংলাদেশ সরকার সেই শর্ত (উপদেষ্টার পদত্যাগ) মেনে নেবেই।
মুশকিল হচ্ছে, বিশ্বব্যাংক তার বর্তমান অবস্থানে অবিচল। এদিকে সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। যা করার অতি দ্রুত করতে হবে। অনেকের মতো আমিও ভেবেছিলাম, পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন যখন জরুরি, বিশ্বব্যাংক এই ব্যাপারে রাজি না হলে এডিবি এবং জাইকাও যখন প্রতিশ্রুত অর্থায়ন করা থেকে নিজেদের হাত গুটিয়ে নেবে, তখন দ্বিমাসিক ইংরেজি পত্রিকা ইকোনমিস্টের ভাষায়, 'পানি ঘোলা না করে' চতুর্থ শর্তটি মেনে নিলেও তো হয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের হয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে দূতিয়ালির কাজ করছে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং ভারত। চতুর্থ শর্তটি পরিপূরণ হলে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু অর্থায়নে গড়িমসি করবে কিংবা বর্তমান অবস্থানে অটল থাকবে_ এমন ভাবার কোনো হেতু দেখি না।
চতুর্থ শর্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অর্থ বিষয়ক মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা অতি সম্প্রতি কিছুটা যেন অনমনীয় ভাষায় বলেছেন, তার দুর্নীতি আগে প্রমাণ করুক বিশ্বব্যাংক, তার আগে তিনি উপদেষ্টার পদ থেকে সরে যাবেন না। কথাটা তিনি কিসের ভরসায় বলেছেন আমার জানা নেই। তবে শুধু তার পদত্যাগে গোঁয়ার্তুমির কারণে এবং সরকারের তার প্রতি দুর্বলতার কারণে সেতুর অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংক যদি সরে দাঁড়ায়, সেই সঙ্গে এডিবি এবং জাইকা_ তাহলে তিনি জাতীয় ভিলেনে পরিণত হবেন। এ ছাড়া পদ্মা সেতু নির্মিত না হলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এবং উত্তরাঞ্চলের ভোটাররা যদি আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকারের প্রতি বিমুখ হন অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
পদ্মা সেতু শুধু যে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এবং উত্তরাঞ্চলের মানুষ ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত সহায়ক তা-ই নয়; এই সেতু বাস্তবায়িত হলে চীন, ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে সরাসরি মেলবন্ধনে বিশাল ভূমিকা রাখবে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং হিংসাপরায়ণ দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে যে কোনো রাষ্ট্রের জন্য মহাক্ষতিকারক। ক্ষমতার দুই মেয়াদেই বিএনপি-জামায়াত যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই আত্মহত্যামূলক নীতি অনুসরণে অটল ছিল। পাছে ভারত সুবিধা পেয়ে যায়, এ জন্য তারা এশিয়ান হাইওয়েতে যোগ দেয়নি। মিয়ানমার-বাংলাদেশ-ভারত গ্যাস-তেল পাইপলাইনে সম্মত হয়নি, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের জন্য যা ছিল উপযোগী ও লাভজনক, সেই ট্রানজিটের সুবিধা দিতে নারাজি ছিল।
মহাজোট সরকার দেশের জন্য সুইসাইডাল নীতি পরিহার করে চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সব দেশের সমর্থন ও সাধুবাদ পেয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মাণে তাই সরকারের একজন উপদেষ্টার জেদ বা গোঁয়ার্তুমির অবস্থান সরকারের জন্য কোনো জটিল বিষয় হয়ে দাঁড়ানোর অবকাশ নেই। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও সরকারে তার সঙ্গী দলগুলোর দ্বিতীয় মেয়াদ পাওয়ার ক্ষেত্রে পদ্মা সেতুসহ আরও কয়েকটি ইস্যু, বিশেষ করে তিস্তা চুক্তি ইত্যাদি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেবে। কথাটি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বও নিশ্চয় জানে। তাহলে খামাখা সময় নষ্ট করে লাভ কী।
এই প্রসঙ্গের এখানেই ইতি। বরং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন কেন নিরপেক্ষ, অবাধ, স্বচ্ছ হবে না এ বিষয়ে খানিকটা আলোচনা করা যাক। বলা বাহুল্য, এই দাবি বিএনপি-জামায়াত জোটের। এই ইস্যুতে পক্ষ-প্রতিপক্ষের আলোচনায় বসা উচিত ছিল আগেই। আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকার নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে বিরোধী দলকে বহুবার জাতীয় সংসদে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছে। এমন কথাও মহাজোট সরকার বলেছে, সংসদে বিএনপি-জামায়াত আসতে না চাইলে সংসদের বাইরেও বিষয়টি নিয়ে দু'পক্ষের আলোচনা হতে পারে। বর্তমান সরকার বলেছে, বিকল্প প্রস্তাব নিয়েও বিরোধী দলের সঙ্গে তাদের আলোচনা হতে পারে। কিন্তু আলোচ্য ইস্যুতে বিরোধী দল প্রত্যেকটা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। ভদ্রলোকের এক কথার মতো নির্বাচন হতে হবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই। এই দাবির প্রতি কিছুসংখ্যক জ্ঞানপাপীও সমর্থন জানিয়েছেন, এখনও জানাচ্ছেন।
জ্ঞানপাপী কেন বলছি? বলছি কারণ একটি নির্বাচিত সর্বদলীয় সরকার, একটি প্রয়োজনীয় ক্ষমতা ও সহযোগিতা দেওয়া শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন অবশ্যই দেশে একটি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারে। পক্ষ-প্রতিপক্ষের মধ্যে দর কষাকষি হতে পারে নির্বাচিত সংসদ ভেঙে দেওয়া এবং সর্বদলীয় তিন মাসকালীন সরকারের প্রধান কে থাকবেন এসব নিয়ে। তবে এর জন্যও তো পক্ষ-প্রতিপক্ষের মধ্যে আলোচনা হওয়া জরুরি। যাদের আমি জ্ঞানপাপী বলছি_ একেকজন তারা বিশাল মাপের লোক, সন্দেহ নেই। তারা কেন 'বিচারপতি' এবং 'নির্দলীয়' শব্দ দুটির ওপর অন্ধের মতো এমন সমর্থন জোগান? জোগাচ্ছেন?
বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় বিচারপতিদের যোগ্যতা নিয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে (সম্মানিত ব্যতিক্রম সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান শেলী) কেউ-ই তো বাঞ্ছিত পক্ষপাতহীন ব্যক্তিত্ব ও কর্তৃত্বের পরিচয় দিতে পারেননি। বিচারপতিদের নাম ও অপকীর্তির বিষয়ে কিছু বলতে চাই না। তবে নির্বাচনকালীন তিন মাসমেয়াদি সর্বদলীয় নির্বাচিত সাংসদদের দ্বারা গঠিত একটি সরকার অবশ্যই চিন্তা ও বিবেচনার অপেক্ষা রাখে। এই চিন্তাটা তথাকথিত জ্ঞানী ব্যক্তিরা কেন যে করেন না, কেন যে নির্বাচনের সময়কালীন বিএনপি-জামায়াতের 'নির্দলীয়', 'আমার সোনার হরিণ চাই' জাতীয় ধারণাকে হাওয়া দিচ্ছেন, এই প্রশ্ন অনেকের মতো আমারও ছিল, এখনও আছে।
সত্য বটে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণার বাহক ছিল আওয়ামী লীগ। তবে তখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ছিল সম্পূর্ণই ভিন্ন। মাগুরা উপনির্বাচন এবং নির্বাচন কমিশনে বিচারপতি আবদুর রউফ এবং পরে বিচারপতি আবদুল আজিজ বিএনপির খাস লোক ছিলেন। আর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে সাবেক প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ ও সাবেক প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান সম্পর্কে যত কম বলা যায় ততই শ্রেয়। আর ফখরুদ্দীন আহমদের সেনা সমর্থিত সরকার দেশি-বিদেশি চাপের মুখে একটা স্বচ্ছ, অবাধ ও নিরপেক্ষা নির্বাচন দেওয়া ছাড়া আর যা কিছু করেছিল, সংবিধান লঙ্ঘন করে তিন মাসের জায়গায় দু'বছর ক্ষমতায় বহাল থাকা, অপরিমেয় দুর্নীতি, রাজনীতি ধ্বংস করার অপপ্রয়াস ইত্যাদি তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতিবাচক ভাবমূর্তিই শুধু প্রতিষ্ঠা করেছে। এরপরও 'নির্দলীয়' অনির্বাচিত লোকদের নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি?
আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি মানতে মহাজোট সরকারকে বাধ্য করার ক্ষমতা বিএনপি-জামায়াতের নেই। সেই ক্ষেত্রে বিএনপি-জামায়াত যা করতে পারে, তা হলো জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের দিয়ে বোমাবাজি, গ্রেনেডবাজি, হত্যা ইত্যাকার পন্থার আশ্রয় নিয়ে দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে একটা নৈরাজ্য এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি। তবে সেই পন্থার আশ্রয় নিলে বিএনপি বিদেশি মিত্র ও দাতাগোষ্ঠীর সমর্থন হারাবে। সমর্থন হারাবে দেশের জনগণের। বাংলাদেশের মানুষ তো বিএনপি-জামায়াতের ২০০১-০৬ সালের শাসন পর্বের কথা ভুলে যায়নি। আবার সে রকম একটা বিএনপি-জামায়াত জোটকে ভোট দিয়ে জনগণ ক্ষমতায় আনবে_ এটা দুরাশারও বেশি।
বিএনপি ও আওয়ামী লীগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে, উভয় দলকে ছাড় দিতে হবে। সে জন্য পক্ষ-প্রতিপক্ষ দলের জন্য আলোচনার টেবিলে ফিরে যাওয়া জরুরি। কাজটা বিএনপি ও আওয়ামী লীগ যত তাড়াতাড়ি শুরু করে ততই মঙ্গল; দল দুটির জন্য তো বটেই, দেশের জন্যও। আমরা সেই বহু কাঙ্ক্ষিত শুভক্ষণটির জন্য অপেক্ষা করছি। রাজনীতিতে জেদ ও সন্ত্রাসের কোনো স্থান নেই।
রাহাত খান : কথাসাহিত্যিক
ও কলাম লেখক
No comments