অপরাধের ধরন পাল্টে গেছে, দমনে নেই মেধা ও প্রযুক্তির সমন্বয়- ০ ব্রিটিশ আমলের আইন দিয়ে চলছে একবিংশ শতাব্দীর পুলিশ- ০ এক অপরাধ থেকে নানা অপরাধের বিস্তার- ০ অত্যাধুনিক অপরাধ মোকাবেলায় মান্ধাতার আমলের দৃষ্টিভঙ্গি by সমুদ্র হক
অপরাধের ধরন দিনে দিনে যেভাবে আধুনিকায়ন হয়ে পাল্টে যাচ্ছে তা দমনে ও প্রতিরোধে সেইভাবে তৈরি হচ্ছে না আইন প্রয়োগকারী সংস্থা পুলিশ বাহিনী। সে-ই ১৮৬১ সালে ব্রিটিশদের তৈরি কলোনিয়াল এ্যাক্ট দিয়ে একবিংশ শতকেও পরিচালিত হচ্ছে পুলিশ। এদিকে একটা সময় ক্রিমিনালের ঘরেই তৈরি হতো অপরাধী (কিছু ব্যত্যয় ছাড়া)।
বর্তমানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সামাজিক অবক্ষয়ের ধারা এবং সামাজিক অস্থিরতার পটভূমিই অপরাধের উৎপত্তিস্থল। একটি অপরাধ থেকে একাধিক অপরাধের পকেট সৃষ্টি হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে শহর ও গ্রামে। বর্তমানে অপরাধে ব্যবহার হচ্ছে প্রযুক্তি। অপরাধের শাখা প্রশাখার বিস্তারে যোগ হচ্ছে চাঁদাবাজি, ভূমি দখল, টেন্ডারবাজি, জালিয়াতি ও চাকরি বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য ইত্যাদি। এর মধ্যেই বড় একটি জায়গা দখল করে নিয়েছে দুর্নীতি। যা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবাহিত।
সামাজিক অবক্ষয়ের পালায় অপরাধীর বড় একটি অংশ তরুণ শ্রেণী। এদের শুদ্ধ হওয়ার পথে না এনে চতুরতা এবং কৌশলে ব্যবহার করছে প্রভার প্রতিপত্তির বলয়ে থাকা ‘গডফাদার’ চক্র। যাদের মধ্যে ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা আছেন। আবার প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর ব্যক্তির অনেক পরিবারের সদস্যরাও নানাভাবে জড়িয়ে পড়ছে অপরাধে। প্রযুক্তি, আধুনিক যানবাহন, অস্ত্রÑ সবই এখন অপরাধের ‘প্যাকেজে’ পরিণত। এখন চেহারায় অপরাধীর ছাপ খুঁজে পাওয়া যায় না। তারা এখন ‘কুল এ্যান্ড কাম।’
পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ এক কর্মকর্তা বললেন, ষাটের দশকে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা অপরাধের মাত্রা নির্ণয় করতেন দারিদ্র্যের কারণে গরু চুরির তথ্য বিশ্লেষণে। চৌকিদার দফাদারের (বর্তমান গ্রাম পুলিশ) কাছে খোঁজখবর নিতেন ক্রিমিনালদের বাড়িঘর কোথায় তাদের কে কি করে। সেদিনের চৌকিদার দফাদার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বড় ভূমিকা রাখত। ওই সময়ে থানার পরিধিও ছিল বড়। পুলিশের সংখ্যা ছিল কম। সিনিয়র সাব-ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার একজন অফিসার ইন চার্জ (ওসি) ও একজন এ্যাসিসটেন্ট সাব-ইন্সপেক্টর (এএসআই) ও ৮ জন কনস্টেবল ৮টি থ্রি-নট থ্রি (বিলুপ্ত) রাইফেল দিয়ে পরিচালিত হতো একটি থানা। ওসিকে বলা হতো বড় বাবু ও এএসআইয়ের পরিচিতি ছিল জমাদার। থানার কেরানির পরিচয় মুনশী। বাইসাইকেলই ছিল তাঁদের যানবাহন। কোন থানায় ক্রাইম বেড়ে গেলে অভিজ্ঞ ওসি সেখানে পোস্টিং পেতেন। মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহারেই ক্রাইম কন্ট্রোল হতো। বর্তমানে এর কয়েক শ’ গুণ বেশি স্ট্রেন্থের সঙ্গে মোটরযান আধুনিক, অস্ত্র দিয়েও অপরাধ দমন কঠিন হয়ে পড়েছে। বর্তমানে সামাজিক অবক্ষয় এবং প্রযুক্তির ‘এ্যাবিউজ’ থেকে বেশিরভাগ অপরাধ সংঘটিত। প্রযুক্তি আপডেট আপগ্রেড হচ্ছে। বাড়ছে এ্যাবিউজ। বিদেশে প্রযুক্তিকে গ্রহণ করা হয় এ্যাবিউজকে বাদ দিয়ে এবং কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। দেশে এ্যাবিউজ নিয়ন্ত্রণের কোন বালাই নেই। আইনও তৈরি হয় নি। অনেক পুলিশ কর্মকর্তা এখনও জানেন না সাইবার ক্রাইমসহ সোশ্যাল ক্রাইম কিভাবে হ্যান্ডেল ও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এ নিয়েও তেমন আইন নেই। অপরাধের কয়েকটি চিত্র বিশ্লেষণ করলেই অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। যেমন ইভটিজিংÑ সামাজিক এই ব্যাধি বর্তমানে অনেকটা নিয়ন্ত্রিত। পথে প্রান্তরে ইভটিজারদের চিহ্নিত করা যায়। এই ইভটিজিং যখন মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ও মনিটরে চলে আসে তখন অপরাধের আরেকটি পকেটও তৈরি হয়। একটি পকেট থেকে একাধিক পকেটে একাধিক অপরাধ তৈরি হতে থাকে। কৌতূহলী তরুণরা ভাল ছবি থেকে অশ্লীল ছবি তুলে ব্ল্যাক মেইলিং শুরু করে। আবার তরুণদেরই একটা অংশ ড্রাগ এ্যাডিকটেড হয়ে বিপথে যায়। ড্রাগের পেছনে অর্থের জোগান পেতে জড়িয়ে পরে অপরাধে। ছিনতাই, হাইজ্যাক থেকে শুরু করে কখনও হত্যাকা- ঘটায় তারা। ওইসব তরুণ-তরুণীকে নিয়ে পরিবারে নেমে আসে অশান্তি ও দুশ্চিন্তা। এমনিতেই বর্তমানে মধ্যবিত্ত পরিবারে সংসার চালাতে নুন আনতে পান্তা ফুরোবার মতো অবস্থা। তার ওপর বাড়তি কঠিন অশান্তি থেকে পরিবারের সদস্যদের বেদনাদায়ক ঘটনাও ঘটছে। সামাজিক এই অবক্ষয়ের সমান্তরালে মধ্যবয়সীদেরও (নারী-পুরুষ) একটি অংশ ‘এক্সট্রা মেরিটাল রিলেশন্সে’র অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। যা পরোক্ষভাবে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে থাবা ফেলছে এক পরিবার থেকে একাধিক পরিবারের সদস্যদের ওপর। এই অপরাধ থেকেও নুইসেন্স পকেট ক্রাইম, অতি উচ্চাভিলাসী ভাবনায় দুর্নীতিসহ বড় ধরনের বহু অপরাধের পকেট তৈরি হচ্ছে। এই অপরাধগুলোও শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত।
হালে একটি বিষয় লক্ষ্য করা যায়, শহরে ও গ্রামে আত্মহননের প্রবণতা ও হত্যা অতি মাত্রায় বেড়ে গেছে। আশির দশকে কোন এলাকায় আত্মহত্যার ঘটনা বেড়ে গেলে মিডিয়া ধাক্কা দিত। নড়ে উঠত প্রশাসন। বর্তমানে সারা দেশে এ ধরনের ঘটনা এত ঘটছে যে এ নিয়ে কারও ভাবনা নেই। মানবাধিকার সংস্থাগুলো নীরব। কোন বিশ্লেষণও নেই। হত্যার অনেক ঘটনা আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। যা পুলিশের খাতায় ‘আনন্যাচারাল ডেথ’ হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকে। এ নিয়ে গভীরে তদন্ত হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্থানীয় প্রভাবশালীরা (অনেক সময় ক্ষমতাধর) হত্যার ঘটনা মিটমাট করে ফেলেন। কি ভাবে হয় তাও এখন ওপেন সিক্রেট। এদিকে প্রযুক্তির অগ্রসরতার পরও অনেক ক্ষেত্রে অপরাধী শনাক্ত দুরূহ হয়ে পড়ে (সত্যিই কি তাই, না অন্য কিছু!)। দেশে ডিএনএ পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকার পরও অপরাধী শনাক্তে খুব একটা সাফল্য আসছে না। এ থেকে একটি বিষয় উপলব্ধিতে আসেÑ অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশী আইন এবং পুলিশকে সময়োপযোগী
করে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। উন্নত মেধার সঙ্গে উন্নত প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটছে না। মেধাসম্পন্ন পুলিশ কর্মকর্তারা তদন্তে মেধার বিকাশ ঘটাতে পারেন না কখনও উর্ধতনের কখনও রাজনৈতিক নেতার চাপের কারণে। একই কারণে তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে কাজ করতেও তারা ভয় পান। ফলে মেধাসম্পন্ন কর্মকর্তারাও গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেন। এদিকে থানার পুলিশকে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও তদন্তের বাইরে বাড়তি নানা ডিউটি করতে হয়। পরীক্ষার ডিউটি, মন্ত্রী, পদস্থ কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদদের প্রটোকল ডিউটি, কোন ঘটনার আগে পরে সতর্কতা ডিউটিসহ অনেক কিছু। উন্নত বিশ্বে পোশাকধারী পুলিশের চেয়ে সাদা পোশাকের ইনটেলিজেন্স অফিসারদের তৎপরতা বেশি। যাদের সাধারণ লোক চেনে না। এ দেশে ইনটেলিজেন্স ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা অনেকের কাছে পরিচিত। ফলে গভীরের অনেক তদন্ত আগেই ফাঁস হয়ে যায়। অনেক সময় অপরাধীকে সজাগও করা হয়। দেশে অনেক শিক্ষিত ও ইনটেলিজেন্ট অফিসার থাকার পরও পুলিশকে প্রযুক্তির গতিতে মেধাসম্পন্ন করে আনা যাযনি। এর অন্যতম কারণ, বেনিয়া ব্রিটিশদের ফর্মেটের পুলিশই উন্নয়নশীল দেশগুলোর পুলিশ হয়ে আছে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে পুলিশ সেই সরকারেরই ‘ওবিডিয়েন্ট সার্ভেন্ট’ হয়ে যায়। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রযুক্তি ও মেধার সমন্বয়ের পুলিশ দেখা যায় না। পুলিশের জন্য সময়োপযোগী নীতিমালা তৈরি হয়নি। দেশে আধুনিক পুলিশ গড়ে তোলার প্রথম উদ্যোগ নেয়া হয় ১৯৯৬ সালে। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর (অব) রফিকুল ইসলাম সুদূরপ্রসারী ভাবনায় পুলিশকে আধুনিকায়নের পথে এগিয়ে নিতে দেশের সকল স্তরের মানুষের কাছ থেকে পরামর্শ ও মতামত চেয়ে কয়েক পাতার প্রশ্নমালা বিতরণ করেন। নির্দিষ্ট সময়ে তা মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর অনুরোধ জানানো হয়। সৃষ্টিশীল সৃজনশীল চিন্তাশীল সমাজসচেতন মানুষ, গবেষক, মনস্তাত্ত্বি¡ক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ওই ফরম পূরণ করে পাঠান। আধুনিকায়নের লক্ষ্যে সহকারী সাব-ইন্সপেক্টর থেকে সর্বোচ্চ র্যাঙ্কের কর্মকর্তা প্রত্যেকের কম্পিউটার শেখা বাধ্যতামূলক করে প্রত্যেক থানায় কম্পিউটার ইনস্টল করে আইনকে সময়পোযোগী করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ষোল বছর পর বর্তমানে অনেক থানায় কম্পিউটার বসেছে। অনেক কর্মকর্তা কম্পিউটারে বসে কাজও করেন। তারপরও মান্ধাতা আমলের অনেক কার্যক্রম এখনও রয়েই গেছে। ওপরওয়ালার হুকুম পালন ছাড়া মেধা ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে কাজ হয় সামান্যই, যা কোন কাজে আসে না। বাংলাদেশের পুলিশ ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বিভিন্ন দেশে পিস কিপিং মিশনে গিয়ে সুনাম অর্জন করছে। এমনকি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে ব্রিটিশ পুলিশদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অপরাধ দমনে সুনাম অর্জন করছে। অথচ নিজের দেশে পুলিশ তা করতে পারছে না। ‘পুলিশ তা করতে পারছে না’ কথাটির সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে সমাজ বিজ্ঞানের এক অধ্যাপক বললেন, ‘বাংলাদেশের পুলিশ অনেক মেধাবী ও চৌকস। পুলিশকে নিউট্রালি কাজ করতে দিলে সীমিত সাধ্যের মধ্যেই তারা প্রমাণ করবে ক্রাইম কিভাবে কন্ট্রোল করতে হয়।’
No comments