বেগম খালেদা জিয়ার সৌদি কানেকশন by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
পর পর দু’মাসে কিংবা এক বছরের মধ্যে দু’বার কারও ওমরাহ হজ করার দৃষ্টান্ত খুবই বিরল। তবু বাংলাদেশের বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যখন সম্প্রতি পর পর দু’মাসে দু’বার ওমরাহ করতে সৌদি আরবে গেলেন, তখন খবরে বলা হয়েছিল, চিকিৎসার জন্য তাঁকে এত ঘন ঘন সৌদি আরবে যেতে হচ্ছে।
তবে কেউ কেউ বলেছেন, বেগম জিয়ার মধ্যে এখন রাজনৈতিক প্রেরণার চাইতেও আধ্যাত্মিক প্রেরণা এত বেড়ে গেছে যে, তিনি ঘন ঘন পবিত্রস্থানে যেতে পছন্দ করেন।
শারীরিক অথবা আধ্যাত্মিক যে কারণেই বেগম জিয়া ঘন ঘন সৌদি আরবে যান, তাতে কারও আপত্তি করার কিছু নেই। সক্ষম মুসলমান নর-নারী মাত্রই ইচ্ছে মতো তাঁদের পবিত্রস্থানে যেতে পারেন। কিছুকাল আগে বাংলাদেশের দুটি রাজনৈতিক দলের নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মধ্যে প্রতিবছর হজে যাওয়ার একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল। কেউ কেউ বলতেন, এটা তাঁদের আধ্যাত্মিক হজ নয়, রাজনৈতিক হজ। এই অনুমান কতটা সঠিক জানি না, তবে দু’নেত্রীর হজের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য ছিল। শেখ হাসিনা হজ করে এসে কিছুদিন মাথায় হিজাব পরতেন। আর খালেদা জিয়া মাথার ঘোমটা একটু বাড়াতেন।
বেগম জিয়ার এবারের পর পর দু’বার ওমরাহ পালন কতটা শারীরিক কারণে এবং কতটা আধ্যাত্মিক কারণে তা জানি না; কিন্তু তাঁর দু’দু’বারের ওমরাহ পালনের পর বাংলাদেশের কাগজেই যে খবর বেরিয়েছে, তাতে অনুমান করা যায় এত ঘন ঘন ওমরাহ করার মধ্যে শারীরিক কারণের সঙ্গে হয়ত রাজনৈতিক কারণও জড়িত। শারীরিক কারণের চাইতে রাজনৈতিক কারণটাই বড় হতে পারে।
ঢাকার কাগজে ৫ সেপ্টেম্বরের ডেটলাইনে বলা হয়েছে, ‘বিএনপি-চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সৌদি আরব সফরকালে সৌদি গোয়েন্দা প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বলে জানা গেছে। গত জুন মাসের শেষের দিকে তিনি চিকিৎসার জন্য সৌদি আরবে যান। এ সময় তিনি সৌদি আরবের জিআইডি (জেনারেল ইনটেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট) প্রধান প্রিন্স মুখরিনের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেন। বৈঠকের আলোচ্যসূচী সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কিছু জানা না গেলেও পশ্চিমা দেশগুলোসহ বহু দেশের কূটনৈতিক মহলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। সূত্রের খবর অনুযায়ী, সৌদি গোয়েন্দা প্রধানের সঙ্গে খালেদা জিয়ার এই বৈঠকের আয়োজনের পেছনে পাকিস্তানের গোয়েন্দাসংস্থা আইএসআইয়ের ভূমিকা থাকার কথা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এই খবরে আরও বলা হয়েছে, ‘বেগম খালেদা ও সৌদি গোয়েন্দা-প্রধানের মধ্যে কি আলোচনা হয়েছে, তা সঠিকভাবে জানা না গেলেও বাংলাদেশে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াই আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে বলে আভাস পাওয়া গেছে। এই ইস্যুতে বিএনপি তথা খালেদা জিয়া যাতে ব্যাপক আন্দোলনসহ যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি অথবা তাদের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করার জন্য জোরালো ভূমিকা গ্রহণ করেন সৌদি গোয়েন্দাপ্রধান সেই অনুরোধ জানান।’
খবরটি পাঠ করে বাংলাদেশের যে কোন দেশপ্রেমিক নাগরিক শঙ্কিত হবেন এবং বিষয়টি নিয়ে আলোচনা না করে পারবেন না। পৃথিবীর তাবৎ দেশের মুসলমানরা সৌদি আরবকে তাদের প্রাণের তীর্থভূমি মনে করে। এই সৌদিতে মক্কা ও মদিনা শহরেই পবিত্র কাবাশরিফ ও রসুলুল্লাহ্র (স) রওজা শরিফ রয়েছে। প্রতিবছর লাখ লাখ মুসলমান পবিত্র হজ ও ওমরাহ পালন এবং হজরতের রওজা শরিফ জেয়ারতের জন্য যায় সৌদি আরবে। ফলে সারাবিশ্বের মুসলমানের সঙ্গে সৌদি আরবের একটা গভীর ধর্মীয় বাঁধন রয়েছে এবং তাদের ওপর সৌদি বাদশাহদেরও একটা ধর্মীয় প্রভাব রয়েছে।
সৌদি আরবের সঙ্গে বিশ্ব মুসলিমের সম্পর্ক ও বন্ধন বহু শতকের। এই সম্পর্ক ও বন্ধন কোন মুসলিম দেশ ভাঙতে চায় না। কিন্তু হালে যখন দেখা যাচ্ছে, সৌদি বাদশাহরা এই ধর্মীয় প্রভাবের সুযোগ নিয়ে নিজেদের ক্ষমতার স্বার্থে, এমনকি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থে বিভিন্ন আরব দেশসহ অনারব মুসলিম দেশগুলোতেও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার, এমনকি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ঘটাতে চাইছেন তখন সকল গণতান্ত্রিক মুসলিম দেশেরই শঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই। সৌদি বাদশাহদের এই ভূমিকা ইসলামের বরখেলাপ। সৌদি বাদশাহরা যেখানে নিজেদের ‘খাদেমুল হারমাইন’ (পবিত্র কাবাগৃহের সেবক) বলে দাবি করেন, সেখানে সেই নিরপেক্ষ ধর্মীয় অবস্থানকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের কাজে কি করে লাগান, তা ভেবে বিস্মিত হতে হয়।
সৌদি বাদশাহরা শুধু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেরই বিরোধিতা করেননি; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতায় থাকা ও জীবিত থাকা পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেননি। পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশের জন্ম কি ইসলাম ধর্মের কোন বিধান ভঙ্গ করেছে? যদি সৌদি বাদশাহরা তা করেছে বলে মনে করেন, তাহলে শেখ মুজিবকে নির্মমভাবে হত্যা ও তাঁর সরকারকে উচ্ছেদ করার সঙ্গে সঙ্গে সেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেন কেমন করে? তাতে কি মনে হয় না, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করাটা ইসলাম বা মুসলমানের স্বার্থের জন্য নয়, তাদের বিরোধিতাটা ছিল রাজনৈতিক স্বার্থপ্রণোদিত বিরোধিতা। শেখ মুজিব ও তাঁর সরকারের বিরোধিতা। ফলে শেখ মুজিবকে হত্যা করে যখন একদল নারী শিশু হত্যাকারী বর্বর ঘাতক বাংলাদেশে ক্ষমতায় বসেছে, তাদর স্বীকৃতি দিতে সৌদি বাদশাহরা ক্ষণমাত্র বিলম্ব করেননি। এটা কারবালার ময়দানে নবীর দৌহিত্র ইমাম হোসেনকে (রাঃ) হত্যা করে ঘাতক এজিদ নিজেকে খলিফা ঘোষণার পর তাঁকে স্বীকৃতি দেয়ার মতো নয় কি?
১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আলজিরিয়ায় ৭৩ জাতি জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু তদানীন্তন সৌদি বাদশাহ কিং ফয়সলের (তিনিও পরে সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তে নিহত হন) সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতকারের সময় জিজ্ঞাসা করেছিলেন, সারা মধ্যপ্রাচ্যে একটি নয়, অসংখ্য ছোট বড় মুসলিম রাষ্ট্র, তারা এক রাষ্ট্র হতে পারেনি। তাতে আপত্তি না থাকলে ভারত উপমহাদেশে পাকিস্তানের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে বাঙালী মুসলমানরা তাঁদের আলাদা রাষ্ট্র গঠন করলে আপত্তি করার কারণটা কি? সৌদি বাদশাহ উত্তর দেননি। বঙ্গবন্ধু আবারও বলেছিলেন, হিজ এক্সেলেন্সি, আপনি জানেন, পাকিস্তানী সৈন্যের হাতে শুধু অমুসলমান নয়, কত লাখ মুসলমান নিহত এবং কত হাজার মুসলমান নারী ধর্ষিত ও নিহত হয়েছে? আপনি সারাবিশ্ব মুসলমানের অভিভাবক হওয়া সত্ত্বেও এই ব্যাপারে নীরব ছিলেন কি করে? কিং ফয়সল এবারেও নীরব ছিলেন।
ইসলাম ও মুসলমানের স্বার্থরক্ষা নয়, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা শেষ মুসলমান সাম্রাজ্য অটোম্যান এম্পায়ার বচ ও ওসমানিয়া সাম্রাজ্য খ-িত হওয়ার পর ব্রিটিশদের সরাসরি সহায়তায় হাউস অব সউদের প্রতিষ্ঠাতা ইবনে সউদ নেজদ ও হেজাজে ক্ষমতায় বসে তাঁর নাম করেন নিজের নামে সৌদি আরব এবং প্রথমে ব্রিটিশ এবং পরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বস্ত তাঁবেদার রাষ্ট্র হিসেবে সৌদি আরব সারাবিশ্বে পরিচিত হয়। তেল আবিষ্কৃত হওয়ার পর সৌদি বাদশাহরা বিশ্বের সবচাইতে ধনী পরিবারের একটি হয়ে দাঁড়ান।
সৌদি আরবের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার জন্য তাদের কোনকালে কোন ভূমিকা ছিল না এবং এখনও নেই। বরং তেলের টাকায় তারা গরিব আরবদের শোষণকারী একটি স্বৈরাচারী পরিবার হয়ে ওঠেন এবং তাদের মধ্যযুগীয় রাজতন্ত্রের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েন। গত কয়েক দশকের ইতিহাস প্রমাণ দেবে, ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থ ও সম্মান রক্ষার চাইতে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ, এমনকি ইসরাইয়েলের স্বার্থরক্ষার কাজকেই তাঁরা বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন এবং এখনও দিচ্ছেন।
ইরানে ইমাম খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লবের সময় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ মধ্যপ্রাচ্যে এক বড় আঘাত পায়। এই সাম্রাজ্যবাদের ইরানবিরোধী ভূমিকায় সাহায্য যোগাতে সব চাইতে আগে এগিয়ে আসে সৌদি রাজতন্ত্র। পবিত্র মক্কায় হজ পালনের জন্য ইরানীদের গমনের ওপর বিধিনিষেধ আরোপিত হয় এবং এই বিধিনিষেধের পরও কয়েক হাজার ইরানী হজের সময় মক্কায় গিয়ে পবিত্র কাবা প্রাঙ্গণে ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক’ বলে সেøাগান দেয়ায় সৌদি সৈন্যদের গুলিতে চার শ’র মতো ইরানী নিহত হন। মুসলমানের পবিত্র তীর্থ মুসলমানের রক্তে রঞ্জিত হয়।
প্রথম গালফ যুদ্ধের আগে আমেরিকা ইরানের ইসলামী প্রজাতন্ত্র ধ্বংস করার জন্য ইরাকের সাদ্দাম হোসেনকে ইরানের বিরুদ্ধে এক আট বছরব্যাপী যুদ্ধে নামায়। এই মার্কিন যুদ্ধ-চক্রান্তে শামিল হয় সৌদি আরব, কুয়েত এবং আরও কয়েকটি মার্কিন তাঁবেদার আরব দেশ। ইরানের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে ইসরায়েল জড়িত থাকা সত্ত্বেও একটি মুসলমান রাষ্ট্র ধ্বংসের সাম্রাজ্যবাদী প্রচেষ্টায় যুক্ত হতে ‘বিশ্ব মুসলমানের অভিভাবক’ সৌদি আরব দ্বিধা করেনি।
ইরানকে ধ্বংস করা সাদ্দামের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিন্তু এই আট বছরের যুদ্ধে সাদ্দাম মার্কিন অস্ত্রসম্ভার লাভ করে শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। ফলে তিনি ইসরাইয়েলের জন্য একটা বড় হুমকি। আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলো দীর্ঘদিনের প্রস্তুতির পর ইরাক আক্রমণ করে। দেখা গেল, এই যুদ্ধেও মার্কিন শিবিরে শামিল হয়েছে সৌদি আরব। এক সৌদি যুবরাজ সৌদি সৈন্য নিয়ে ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছেন। এই সময় সৌদি আরবে পবিত্র স্থানগুলোতে মার্কিন সৈন্যদের ঘাঁটি গাড়তে দেয়া হয়। মদ ও মেয়ে মানুষ নিয়ে এসব ঘাঁটিতে সৈন্যদের বেলেল্লাপণায় সৌদি নাগরিকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। অনেকে বলেন নিউইয়র্কের নাইন ইলেভেনের জন্ম এই অসন্তোষ থেকে এবং এককালের মার্কিন-মিত্র ওসামা বিন লাদেনের মার্কিন-বিরোধিতায় প্রত্যক্ষ সূত্রপাত ইসলামের পবিত্র স্থানগুলোতে মার্কিন সেনাঘাঁটি প্রতিষ্ঠা এবং তার প্রকাশ্য ব্যভিচারকে কেন্দ্র করে।
প্রথম গালফযুদ্ধে সাদ্দামের পতন ঘটেনি বটে, কিন্তু ইসরাইল শক্তিশালী হয় এবং ফিলিস্তিনে তার নির্যাতন ও বসতি স্থাপনের মাত্রা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। দ্বিতীয় গালফযুদ্ধে সাদ্দামের পতনের পর আমেরিকা ও ইসরাইলের চোখ পড়ে ইরানের দিকে। তখন ইরান পরমাণু শক্তি নিয়ে গবেষণা করছে এবং পরমাণু অস্ত্র তৈরিতে সে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। ইসরাইলের হাতেও পরমাণু বোমা মজুদ আছে। তাতে ক্ষতি নেই। ইরান পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী হলেই নাকি বিশ্ব শান্তি বিপন্ন হবে।
এই অজুহাতে ইরান আক্রমণের পাঁয়তারা করছে আমেরিকা ও ইসরাইল যুক্তভাবে। সিরিয়াকে শায়েস্তা করা গেলেই এবং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শেষ হলেই ইরান আক্রান্ত হতে পারে বলে বিশ্বরাজনীতির পর্যবেক্ষকদের ধারণা।
ইরান একটি মুসলিম দেশ। একমাত্র শিয়া-সুন্নী সম্প্রদায়গত পার্থক্য ছাড়া সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। তারপরও এই মুসলিম দেশটির বিরুদ্ধে মার্কিন-ইসরাইল যুদ্ধ প্রচেষ্টায় শামিল হয়েছে সৌদি কিংডম। খবর ফাঁস হয়ে গেছে, ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোয় বোমা হামলা চালানোর জন্য বার বার আমেরিকাকে অনুরোধ জানিয়েছেন সৌদি বাদশাহ। অসহায় ফিলিস্তিনী মুসলমানদের ইসরাইলের বর্বর হামলা থেকে রক্ষা এবং ফিলিস্তিনীদের ভূমি দখল থেকে ইসরাইলকে নিবৃত্ত করার জন্য আমেরিকার ওপর কার্যকর চাপ প্রয়োগে সৌদি রাজাদের এ রকম উৎসাহী দেখা যায়নি।
সিরিয়ায় আসাদ সরকারকে উচ্ছেদের জন্য গণবিপ্লবের নামে যে যুদ্ধ চালানো হচ্ছে আসলে তা যে আমেরিকা ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের যুদ্ধ সেটা এখন ধরা পড়ে গেছে। বিস্ময়ের কথা, এখানেও একটি মুসলিম রাষ্ট্র ধ্বংসের চক্রান্তে প্রত্যক্ষ সহায়তাদানকারী প্রধান দেশ তিনটি। সৌদি আরব, কাতার ও তুরস্ক। তুরস্কে ঘাঁটি গেড়েই আমেরিকা সিরিয়ার বিদ্রোহীদের হাতে অস্ত্র ও অর্থ চালান দিচ্ছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেরও বিরোধিতা করেছে আমেরিকা।
সঙ্গে ছিল সৌদি আরব। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই দেশটিতে ধর্মীয় প্রভাবের সুযোগ নিয়ে সৌদি আরব রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ শুরু করে। অঢেল অর্থ সাহায্যে তারা বাংলাদেশে জামায়াতীদেরÑ বিশেষ করে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের প্রতিষ্ঠা লাভে সাহায্য যোগায়। এ কাজে তাদের সহযোগী হয় পাকিস্তানের কুখ্যাত সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। এখন তো জানা যায়, বাংলাদেশে জঙ্গী মৌলবাদী সংগঠনগুলোর জন্ম ও বিকাশ এবং তাদের হত্যা ও সন্ত্রাসের রাজনীতির পেছনে প্রধান সংগঠক ছিল পাকিস্তানের আইএসআই এবং সৌদি আরবের জিআইডি (জেনারেল ইনটেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট)। বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নস্যাত করার জন্যও অঢেল অর্থভা-ার নিয়ে প্রচারণা ও অন্যান্য তৎপরতায় সাহায্য যোগাতে ব্যস্ত এই দুটি বিদেশী সংস্থা।
এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সৌদি আরবে দেশটির গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানের সঙ্গে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বৈঠক তাৎপর্যপূর্ণ। এই বৈঠককে উপেক্ষা করা ঠিক হবে না।
স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশে সৌদি কূটনীতি দেশটির রাজনীতি ও আর্থসামাজিক পরিস্থিতিকে কোন্ অশুভ পথে ঠেলে নিচ্ছে সে সম্পর্কে বারান্তরে বিশদ আলোচনার ইচ্ছে রইল।
লন্ডন ১০ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার ॥ ২০১২।
শারীরিক অথবা আধ্যাত্মিক যে কারণেই বেগম জিয়া ঘন ঘন সৌদি আরবে যান, তাতে কারও আপত্তি করার কিছু নেই। সক্ষম মুসলমান নর-নারী মাত্রই ইচ্ছে মতো তাঁদের পবিত্রস্থানে যেতে পারেন। কিছুকাল আগে বাংলাদেশের দুটি রাজনৈতিক দলের নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মধ্যে প্রতিবছর হজে যাওয়ার একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল। কেউ কেউ বলতেন, এটা তাঁদের আধ্যাত্মিক হজ নয়, রাজনৈতিক হজ। এই অনুমান কতটা সঠিক জানি না, তবে দু’নেত্রীর হজের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য ছিল। শেখ হাসিনা হজ করে এসে কিছুদিন মাথায় হিজাব পরতেন। আর খালেদা জিয়া মাথার ঘোমটা একটু বাড়াতেন।
বেগম জিয়ার এবারের পর পর দু’বার ওমরাহ পালন কতটা শারীরিক কারণে এবং কতটা আধ্যাত্মিক কারণে তা জানি না; কিন্তু তাঁর দু’দু’বারের ওমরাহ পালনের পর বাংলাদেশের কাগজেই যে খবর বেরিয়েছে, তাতে অনুমান করা যায় এত ঘন ঘন ওমরাহ করার মধ্যে শারীরিক কারণের সঙ্গে হয়ত রাজনৈতিক কারণও জড়িত। শারীরিক কারণের চাইতে রাজনৈতিক কারণটাই বড় হতে পারে।
ঢাকার কাগজে ৫ সেপ্টেম্বরের ডেটলাইনে বলা হয়েছে, ‘বিএনপি-চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সৌদি আরব সফরকালে সৌদি গোয়েন্দা প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বলে জানা গেছে। গত জুন মাসের শেষের দিকে তিনি চিকিৎসার জন্য সৌদি আরবে যান। এ সময় তিনি সৌদি আরবের জিআইডি (জেনারেল ইনটেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট) প্রধান প্রিন্স মুখরিনের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেন। বৈঠকের আলোচ্যসূচী সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কিছু জানা না গেলেও পশ্চিমা দেশগুলোসহ বহু দেশের কূটনৈতিক মহলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। সূত্রের খবর অনুযায়ী, সৌদি গোয়েন্দা প্রধানের সঙ্গে খালেদা জিয়ার এই বৈঠকের আয়োজনের পেছনে পাকিস্তানের গোয়েন্দাসংস্থা আইএসআইয়ের ভূমিকা থাকার কথা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এই খবরে আরও বলা হয়েছে, ‘বেগম খালেদা ও সৌদি গোয়েন্দা-প্রধানের মধ্যে কি আলোচনা হয়েছে, তা সঠিকভাবে জানা না গেলেও বাংলাদেশে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াই আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে বলে আভাস পাওয়া গেছে। এই ইস্যুতে বিএনপি তথা খালেদা জিয়া যাতে ব্যাপক আন্দোলনসহ যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি অথবা তাদের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করার জন্য জোরালো ভূমিকা গ্রহণ করেন সৌদি গোয়েন্দাপ্রধান সেই অনুরোধ জানান।’
খবরটি পাঠ করে বাংলাদেশের যে কোন দেশপ্রেমিক নাগরিক শঙ্কিত হবেন এবং বিষয়টি নিয়ে আলোচনা না করে পারবেন না। পৃথিবীর তাবৎ দেশের মুসলমানরা সৌদি আরবকে তাদের প্রাণের তীর্থভূমি মনে করে। এই সৌদিতে মক্কা ও মদিনা শহরেই পবিত্র কাবাশরিফ ও রসুলুল্লাহ্র (স) রওজা শরিফ রয়েছে। প্রতিবছর লাখ লাখ মুসলমান পবিত্র হজ ও ওমরাহ পালন এবং হজরতের রওজা শরিফ জেয়ারতের জন্য যায় সৌদি আরবে। ফলে সারাবিশ্বের মুসলমানের সঙ্গে সৌদি আরবের একটা গভীর ধর্মীয় বাঁধন রয়েছে এবং তাদের ওপর সৌদি বাদশাহদেরও একটা ধর্মীয় প্রভাব রয়েছে।
সৌদি আরবের সঙ্গে বিশ্ব মুসলিমের সম্পর্ক ও বন্ধন বহু শতকের। এই সম্পর্ক ও বন্ধন কোন মুসলিম দেশ ভাঙতে চায় না। কিন্তু হালে যখন দেখা যাচ্ছে, সৌদি বাদশাহরা এই ধর্মীয় প্রভাবের সুযোগ নিয়ে নিজেদের ক্ষমতার স্বার্থে, এমনকি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থে বিভিন্ন আরব দেশসহ অনারব মুসলিম দেশগুলোতেও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার, এমনকি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ঘটাতে চাইছেন তখন সকল গণতান্ত্রিক মুসলিম দেশেরই শঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই। সৌদি বাদশাহদের এই ভূমিকা ইসলামের বরখেলাপ। সৌদি বাদশাহরা যেখানে নিজেদের ‘খাদেমুল হারমাইন’ (পবিত্র কাবাগৃহের সেবক) বলে দাবি করেন, সেখানে সেই নিরপেক্ষ ধর্মীয় অবস্থানকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের কাজে কি করে লাগান, তা ভেবে বিস্মিত হতে হয়।
সৌদি বাদশাহরা শুধু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেরই বিরোধিতা করেননি; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতায় থাকা ও জীবিত থাকা পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেননি। পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশের জন্ম কি ইসলাম ধর্মের কোন বিধান ভঙ্গ করেছে? যদি সৌদি বাদশাহরা তা করেছে বলে মনে করেন, তাহলে শেখ মুজিবকে নির্মমভাবে হত্যা ও তাঁর সরকারকে উচ্ছেদ করার সঙ্গে সঙ্গে সেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেন কেমন করে? তাতে কি মনে হয় না, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করাটা ইসলাম বা মুসলমানের স্বার্থের জন্য নয়, তাদের বিরোধিতাটা ছিল রাজনৈতিক স্বার্থপ্রণোদিত বিরোধিতা। শেখ মুজিব ও তাঁর সরকারের বিরোধিতা। ফলে শেখ মুজিবকে হত্যা করে যখন একদল নারী শিশু হত্যাকারী বর্বর ঘাতক বাংলাদেশে ক্ষমতায় বসেছে, তাদর স্বীকৃতি দিতে সৌদি বাদশাহরা ক্ষণমাত্র বিলম্ব করেননি। এটা কারবালার ময়দানে নবীর দৌহিত্র ইমাম হোসেনকে (রাঃ) হত্যা করে ঘাতক এজিদ নিজেকে খলিফা ঘোষণার পর তাঁকে স্বীকৃতি দেয়ার মতো নয় কি?
১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আলজিরিয়ায় ৭৩ জাতি জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু তদানীন্তন সৌদি বাদশাহ কিং ফয়সলের (তিনিও পরে সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তে নিহত হন) সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতকারের সময় জিজ্ঞাসা করেছিলেন, সারা মধ্যপ্রাচ্যে একটি নয়, অসংখ্য ছোট বড় মুসলিম রাষ্ট্র, তারা এক রাষ্ট্র হতে পারেনি। তাতে আপত্তি না থাকলে ভারত উপমহাদেশে পাকিস্তানের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে বাঙালী মুসলমানরা তাঁদের আলাদা রাষ্ট্র গঠন করলে আপত্তি করার কারণটা কি? সৌদি বাদশাহ উত্তর দেননি। বঙ্গবন্ধু আবারও বলেছিলেন, হিজ এক্সেলেন্সি, আপনি জানেন, পাকিস্তানী সৈন্যের হাতে শুধু অমুসলমান নয়, কত লাখ মুসলমান নিহত এবং কত হাজার মুসলমান নারী ধর্ষিত ও নিহত হয়েছে? আপনি সারাবিশ্ব মুসলমানের অভিভাবক হওয়া সত্ত্বেও এই ব্যাপারে নীরব ছিলেন কি করে? কিং ফয়সল এবারেও নীরব ছিলেন।
ইসলাম ও মুসলমানের স্বার্থরক্ষা নয়, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা শেষ মুসলমান সাম্রাজ্য অটোম্যান এম্পায়ার বচ ও ওসমানিয়া সাম্রাজ্য খ-িত হওয়ার পর ব্রিটিশদের সরাসরি সহায়তায় হাউস অব সউদের প্রতিষ্ঠাতা ইবনে সউদ নেজদ ও হেজাজে ক্ষমতায় বসে তাঁর নাম করেন নিজের নামে সৌদি আরব এবং প্রথমে ব্রিটিশ এবং পরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বস্ত তাঁবেদার রাষ্ট্র হিসেবে সৌদি আরব সারাবিশ্বে পরিচিত হয়। তেল আবিষ্কৃত হওয়ার পর সৌদি বাদশাহরা বিশ্বের সবচাইতে ধনী পরিবারের একটি হয়ে দাঁড়ান।
সৌদি আরবের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার জন্য তাদের কোনকালে কোন ভূমিকা ছিল না এবং এখনও নেই। বরং তেলের টাকায় তারা গরিব আরবদের শোষণকারী একটি স্বৈরাচারী পরিবার হয়ে ওঠেন এবং তাদের মধ্যযুগীয় রাজতন্ত্রের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েন। গত কয়েক দশকের ইতিহাস প্রমাণ দেবে, ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থ ও সম্মান রক্ষার চাইতে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ, এমনকি ইসরাইয়েলের স্বার্থরক্ষার কাজকেই তাঁরা বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন এবং এখনও দিচ্ছেন।
ইরানে ইমাম খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লবের সময় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ মধ্যপ্রাচ্যে এক বড় আঘাত পায়। এই সাম্রাজ্যবাদের ইরানবিরোধী ভূমিকায় সাহায্য যোগাতে সব চাইতে আগে এগিয়ে আসে সৌদি রাজতন্ত্র। পবিত্র মক্কায় হজ পালনের জন্য ইরানীদের গমনের ওপর বিধিনিষেধ আরোপিত হয় এবং এই বিধিনিষেধের পরও কয়েক হাজার ইরানী হজের সময় মক্কায় গিয়ে পবিত্র কাবা প্রাঙ্গণে ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক’ বলে সেøাগান দেয়ায় সৌদি সৈন্যদের গুলিতে চার শ’র মতো ইরানী নিহত হন। মুসলমানের পবিত্র তীর্থ মুসলমানের রক্তে রঞ্জিত হয়।
প্রথম গালফ যুদ্ধের আগে আমেরিকা ইরানের ইসলামী প্রজাতন্ত্র ধ্বংস করার জন্য ইরাকের সাদ্দাম হোসেনকে ইরানের বিরুদ্ধে এক আট বছরব্যাপী যুদ্ধে নামায়। এই মার্কিন যুদ্ধ-চক্রান্তে শামিল হয় সৌদি আরব, কুয়েত এবং আরও কয়েকটি মার্কিন তাঁবেদার আরব দেশ। ইরানের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে ইসরায়েল জড়িত থাকা সত্ত্বেও একটি মুসলমান রাষ্ট্র ধ্বংসের সাম্রাজ্যবাদী প্রচেষ্টায় যুক্ত হতে ‘বিশ্ব মুসলমানের অভিভাবক’ সৌদি আরব দ্বিধা করেনি।
ইরানকে ধ্বংস করা সাদ্দামের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিন্তু এই আট বছরের যুদ্ধে সাদ্দাম মার্কিন অস্ত্রসম্ভার লাভ করে শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। ফলে তিনি ইসরাইয়েলের জন্য একটা বড় হুমকি। আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলো দীর্ঘদিনের প্রস্তুতির পর ইরাক আক্রমণ করে। দেখা গেল, এই যুদ্ধেও মার্কিন শিবিরে শামিল হয়েছে সৌদি আরব। এক সৌদি যুবরাজ সৌদি সৈন্য নিয়ে ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছেন। এই সময় সৌদি আরবে পবিত্র স্থানগুলোতে মার্কিন সৈন্যদের ঘাঁটি গাড়তে দেয়া হয়। মদ ও মেয়ে মানুষ নিয়ে এসব ঘাঁটিতে সৈন্যদের বেলেল্লাপণায় সৌদি নাগরিকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। অনেকে বলেন নিউইয়র্কের নাইন ইলেভেনের জন্ম এই অসন্তোষ থেকে এবং এককালের মার্কিন-মিত্র ওসামা বিন লাদেনের মার্কিন-বিরোধিতায় প্রত্যক্ষ সূত্রপাত ইসলামের পবিত্র স্থানগুলোতে মার্কিন সেনাঘাঁটি প্রতিষ্ঠা এবং তার প্রকাশ্য ব্যভিচারকে কেন্দ্র করে।
প্রথম গালফযুদ্ধে সাদ্দামের পতন ঘটেনি বটে, কিন্তু ইসরাইল শক্তিশালী হয় এবং ফিলিস্তিনে তার নির্যাতন ও বসতি স্থাপনের মাত্রা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। দ্বিতীয় গালফযুদ্ধে সাদ্দামের পতনের পর আমেরিকা ও ইসরাইলের চোখ পড়ে ইরানের দিকে। তখন ইরান পরমাণু শক্তি নিয়ে গবেষণা করছে এবং পরমাণু অস্ত্র তৈরিতে সে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। ইসরাইলের হাতেও পরমাণু বোমা মজুদ আছে। তাতে ক্ষতি নেই। ইরান পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী হলেই নাকি বিশ্ব শান্তি বিপন্ন হবে।
এই অজুহাতে ইরান আক্রমণের পাঁয়তারা করছে আমেরিকা ও ইসরাইল যুক্তভাবে। সিরিয়াকে শায়েস্তা করা গেলেই এবং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শেষ হলেই ইরান আক্রান্ত হতে পারে বলে বিশ্বরাজনীতির পর্যবেক্ষকদের ধারণা।
ইরান একটি মুসলিম দেশ। একমাত্র শিয়া-সুন্নী সম্প্রদায়গত পার্থক্য ছাড়া সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। তারপরও এই মুসলিম দেশটির বিরুদ্ধে মার্কিন-ইসরাইল যুদ্ধ প্রচেষ্টায় শামিল হয়েছে সৌদি কিংডম। খবর ফাঁস হয়ে গেছে, ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোয় বোমা হামলা চালানোর জন্য বার বার আমেরিকাকে অনুরোধ জানিয়েছেন সৌদি বাদশাহ। অসহায় ফিলিস্তিনী মুসলমানদের ইসরাইলের বর্বর হামলা থেকে রক্ষা এবং ফিলিস্তিনীদের ভূমি দখল থেকে ইসরাইলকে নিবৃত্ত করার জন্য আমেরিকার ওপর কার্যকর চাপ প্রয়োগে সৌদি রাজাদের এ রকম উৎসাহী দেখা যায়নি।
সিরিয়ায় আসাদ সরকারকে উচ্ছেদের জন্য গণবিপ্লবের নামে যে যুদ্ধ চালানো হচ্ছে আসলে তা যে আমেরিকা ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের যুদ্ধ সেটা এখন ধরা পড়ে গেছে। বিস্ময়ের কথা, এখানেও একটি মুসলিম রাষ্ট্র ধ্বংসের চক্রান্তে প্রত্যক্ষ সহায়তাদানকারী প্রধান দেশ তিনটি। সৌদি আরব, কাতার ও তুরস্ক। তুরস্কে ঘাঁটি গেড়েই আমেরিকা সিরিয়ার বিদ্রোহীদের হাতে অস্ত্র ও অর্থ চালান দিচ্ছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেরও বিরোধিতা করেছে আমেরিকা।
সঙ্গে ছিল সৌদি আরব। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই দেশটিতে ধর্মীয় প্রভাবের সুযোগ নিয়ে সৌদি আরব রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ শুরু করে। অঢেল অর্থ সাহায্যে তারা বাংলাদেশে জামায়াতীদেরÑ বিশেষ করে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের প্রতিষ্ঠা লাভে সাহায্য যোগায়। এ কাজে তাদের সহযোগী হয় পাকিস্তানের কুখ্যাত সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। এখন তো জানা যায়, বাংলাদেশে জঙ্গী মৌলবাদী সংগঠনগুলোর জন্ম ও বিকাশ এবং তাদের হত্যা ও সন্ত্রাসের রাজনীতির পেছনে প্রধান সংগঠক ছিল পাকিস্তানের আইএসআই এবং সৌদি আরবের জিআইডি (জেনারেল ইনটেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট)। বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নস্যাত করার জন্যও অঢেল অর্থভা-ার নিয়ে প্রচারণা ও অন্যান্য তৎপরতায় সাহায্য যোগাতে ব্যস্ত এই দুটি বিদেশী সংস্থা।
এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সৌদি আরবে দেশটির গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানের সঙ্গে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বৈঠক তাৎপর্যপূর্ণ। এই বৈঠককে উপেক্ষা করা ঠিক হবে না।
স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশে সৌদি কূটনীতি দেশটির রাজনীতি ও আর্থসামাজিক পরিস্থিতিকে কোন্ অশুভ পথে ঠেলে নিচ্ছে সে সম্পর্কে বারান্তরে বিশদ আলোচনার ইচ্ছে রইল।
লন্ডন ১০ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার ॥ ২০১২।
No comments