নরওয়ের পথে-প্রান্তরে by চৌধুরী সাদিদ আলম

‘হাতের মুঠোয় বিশ্ব’—কথাটা আমরা শুধু এত দিন শুনেই এসেছি। কিন্তু নরওয়ে গিয়ে বুঝলাম, মুঠোফোনেই জীবনের প্রায় সব প্রয়োজন মেটানো সম্ভব। ওদের জীবনযাপনের সবকিছুই প্রযুক্তিনির্ভর। বাংলাদেশে আমরা যে মুঠোফোন ব্যবহার করি তা টু-জি, আর ওদেরগুলো থ্রি-জি। মুঠোফোনের এই পার্থক্য ওদের জীবনকে অনেক গতিশীল করেছে।


ওদের ইন্টারনেট খুবই দ্রুতগতিসম্পন্ন। ফাঁকা রাস্তা বাদে সব খানেই ওয়াইফাই। ওখানে কোনো ঠিকানা খুঁজতে বেগ পেতে হয় না। মুঠোফোন দিয়ে গুগল ম্যাপে গেলেই সব সহজ হয়ে যায়। এমনকি চাইলে, হাঁটার সময় নিজের অবস্থান বদলও নিমেষেই পর্দায় খুঁজে পাওয়া সম্ভব। আসলে এসবই সম্ভব হয়েছে ওদের থ্রি-জির উচ্চগতির ইন্টারনেটের কারণে।
নরওয়ে ভ্রমণটি ছিল আমার জীবনের অনেক ‘প্রথম’-এর সমাহার। প্রথমবারের মতো প্লেনে চড়ার অভিজ্ঞতা। জীবনের প্রথম বিদেশ সফর। প্রথমবার পরিবার ছাড়া একা একা চলা—কত কিছু যে ঘটে গেল এ কদিনে। ২৬ আগস্ট থেকে ৫ সেপ্টেম্বর, নরওয়ে ঘুরে এলাম আমি। এই সুযোগে বলে নিই, আমি সবে এ বছর গোপালগঞ্জের সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজ থেকে জিপিএ-৫ নিয়ে এইচএসসি পাস করেছি।
গত বছরের একটি ঘটনা আমার জীবনটাই পাল্টে দিয়েছে, সেটি হচ্ছে ইন্টারনেট উৎসব ২০১১। গত বছর, যখন সারা দেশের প্রায় ১০ হাজার প্রতিযোগীকে হারিয়ে আইজিনিয়াস গ্র্যান্ডমাস্টার নির্বাচিত হয়েছিলাম তখনই জানানো হয়েছিল, যে আইজিনিয়াস গ্র্যান্ডমাস্টার হবে সে পাবে নরওয়ে ভ্রমণের সুযোগ।
ছোট্ট দেশ নরওয়ে। লোকসংখ্যা মাত্র ৪৯ লাখ। পুরো দেশটাই ছবির মতো সাজানো। যানজটের বালাই নেই। ধুলোবালি আর ময়লা খুঁজে পাওয়া ভার। সবকিছুই চলে নিয়ম মেনে। ওদের দেশে এক মিনিটেরও গুরুত্ব আছে। এক দিনের কথা মনে পড়ছে। মাত্র দুই মিনিট দেরি হওয়ার কারণে একটা ভ্রমণ মিস করলাম। আমাকে ছেড়ে গাড়ি চলে গেছে। আমাদের দেশে এটা ভাবাই যায় না। মনে হলো, এখান থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। সময়ের প্রতি সচেতন হওয়াটা কত জরুরি তা-ও শিখেছি এ সফরে।
২৬ আগস্ট। মেঘের সঙ্গে মিতালি করে অসাধারণ এক যাত্রা শেষে পৌঁছালাম নিশিথ সূর্যের দেশ নরওয়েতে। টেলিনরের পক্ষ থেকে সব ব্যবস্থা করাই ছিল। মাত্র কদিনের সফর। সময় নষ্ট করার সময় কোথায়? তাই একবার করে হলেও ঢুঁ মেরেছি নরওয়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব পর্যটনকেন্দ্রে। এখনো স্মৃতিতে দাগ কেটে আছে নরওয়ের রাজপ্রাসাদ, ভিগিল্যান্ড পার্ক, ন্যাশনাল থিয়েটার, নোবেল পিস সেন্টার।
নরওয়ে ভ্রমণের সবচেয়ে মজার সময় ছিল ‘নরওয়ে ইন আ নাটশেল’ ট্যুর। ব্রিগেগন নামক তাদের ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ঘুরে দেখলাম। বারগেন শহরের সৌন্দর্যে আমি সবচেয়ে মুগ্ধ! পাহাড়ের মধ্যে সুন্দর সুন্দর বাড়িগুলো দেখতে দেখতে পাহাড়ে উঠতে লাগলাম। ওপর থেকে দেখা সেসব দৃশ্য ভাষায় প্রকাশ সম্ভব নয়।
এ সফরে পূর্বনির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী সারা দিন অপেরা সফটওয়্যারের হেডকোয়ার্টার পরিদর্শন করেছি। আমাকে দেখানো ও জানানো হলো অপেরার ইতিহাস এবং তাদের অগ্রযাত্রার নানান ধাপ। পরদিন ছিল টেলিনর কার্যালয় পরিদর্শন। এত বড় আর এত সুন্দর ভবন আগে কখনো দেখেছি বলে মনে হয় না। সমুদ্রের পাশে অসাধারণ পরিবেশে তৈরি করা হয়েছে এটি। সেখানে একটি গাইড ট্যুরের মাধ্যমে টেলিনরের পুরো এলাকা ও তাদের কর্মকাণ্ড দেখার ও বোঝার সুযোগ হলো আমার। অনুভূতিটা সত্যিই অসাধারণ! প্রথমবারের মতো থ্রিডি ছবি দেখলাম। আমাকে নেওয়া হলো টেলিনরের ইনোভেটিভ সেন্টারে। সেখানে গিয়ে তাদের অন্য রকম কাজগুলো দেখে আমি অনেক অবাক হলাম। সেদিনের বিকেলটা ছিল সবচেয়ে উপভোগ্য। কারণ, সেদিন ছিল ৮-১০ জন বাংলাদেশির সঙ্গে একটি কফি-সেশন।
শেষ দিনে ছিল একটি প্রতিযোগিতা। বিদেশে প্রতিযোগিতা বলেই হয়তো একটু নার্ভাস ছিলাম। ফাইনালে প্রথম প্রশ্নের উত্তর তো দিতেই পারলাম না। কিন্তু পরের তিনটি প্রশ্নের উত্তর খুব তাড়াতাড়ি দিলাম। কী আশ্চর্য! শেষ পর্যন্ত আমিই জিতে গেলাম, চ্যাম্পিয়ন হলাম। এ সফরের এটিই ছিল আমার জন্য সেরা প্রাপ্তি। এভাবেই আমার ভ্রমণ সফলভাবে শেষ হলো। অনেক শেখা আর জানার অভিজ্ঞতা নিয়েই ঢাকার পথে বিমানে উঠলাম। ৫ সেপ্টেম্বর ভোরে যখন আমার জন্মভূমিতে আবার পা রাখলাম, তখন মনে হলো, বাংলাদেশের মাটির চেয়ে প্রিয় কিছু নেই।

No comments

Powered by Blogger.