দ্বিতীয় দিনের জবানবন্দিতে সুলতানা কামাল- গোলাম আযম মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মূল করার আহ্বান জানান
জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গতকাল মঙ্গলবার জবানবন্দি শেষ করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের তৃতীয় সাক্ষী সুলতানা কামাল। গতকাল জবানবন্দিতে তিনি বলেন, একাত্তরে গোলাম আযম মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে তাঁদের নির্মূলের আহ্বান জানান।
বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল গত সোমবার দুই ঘণ্টা জবানবন্দি দেন। গতকাল জবানবন্দি শেষে তাঁকে জেরা শুরু করে আসামিপক্ষ। জবানবন্দিকালে আসামির কাঠগড়ায় গোলাম আযম উপস্থিত থাকলেও জেরার সময় তাঁকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কারাকক্ষে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
সুলতানা কামাল গতকাল জবানবন্দিতে বলেন, একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতের ‘অপারেশন সার্চলাইট’ অন্যতম নিকৃষ্ট গণহত্যা এ জন্য যে গণতন্ত্রকামী নিরস্ত্র মানুষের ওপর সশস্ত্র হামলা চালানো হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) জ্বালিয়ে দেওয়া; জগন্নাথ হলে হত্যাকাণ্ড; রোকেয়া হলে হত্যাকাণ্ড; শাঁখারীবাজার, হাটখোলা, ওয়ারি প্রভৃতি হিন্দু-অধ্যুষিত এলাকায় অগ্নিসংযোগ; রাজারবাগে অবরুদ্ধ পুলিশ বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া এবং পিলখানায় রাইফেলসের সদস্যদের ওপর আক্রমণ—একটি ঘৃণ্য গণহত্যার উদাহরণ স্থাপন করে। দেশের প্রতিটি অঞ্চলে ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত গণহত্যা চলতে থাকে। বরিশালের একটি উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, সেখানে বাজারে সমবেত মানুষের ওপর হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হয়, ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ যখন দৌড়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে, লঞ্চে করে পাকিস্তানি সেনারা গুলি করেছে। এসব কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না—সর্বত্রই এমন ঘটনা ঘটেছে। এই ছিল পাকিস্তানি সেনাদের পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার কৌশল এবং এ কৌশলে সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতা যারা করেছে, তারাও একই অপরাধের সমান ভাগিদার। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও বেতারের মাধ্যমে জানা যায়, এই সমর্থন ও সহযোগিতার ‘মাস্টারমাইন্ড’ ছিলেন জামায়াত ও শান্তি কমিটির শীর্ষস্থানীয় নেতা গোলাম আযম। তিনি একাত্তরের ২৩ ও ৩১ আগস্ট পাকিস্তানের লাহোর ও হায়দ্রাবাদে নিজে উপস্থিত থেকে পাকিস্তানি সেনাদের কর্মকাণ্ডকে সমর্থন দেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে তাঁদের নির্মূলের আহ্বান জানান।
রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী বলেন, একাত্তরের সেপ্টেম্বরে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে গঠিত মন্ত্রিসভায় সম্ভবত জামায়াতের দুজনকে সদস্য করা হয়। তাঁদের সংবর্ধনায় গোলাম আযম বলেন, ‘ঠিক যে লক্ষ্যে শান্তি কমিটি ও রাজাকার গঠন করা হয়েছে, একই লক্ষ্যে জামায়াতের সদস্যদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।’ এমনও তথ্য আছে, শান্তি কমিটি কখনো কখনো পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সশস্ত্র অভিযানে অংশ নিয়েছে। রাজাকারদের হাতে অস্ত্র ছিল, এটা সবার জানা। ১ ডিসেম্বর বিজয়ের প্রাক্কালেও ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাতের পর সংবাদ সম্মেলনে গোলাম আযম বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের পরাভূত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’ তিনি দম্ভভরে এ কথাও বলেছেন, ‘সে জন্য রাজাকাররাই যথেষ্ট।’ রাজাকার, আলবদর বাহিনীর মরিয়া ও নৃশংস আচরণ দেখা যায় ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। এটা জানা, রাজাকার, শান্তি কমিটি, আলবদর, আলশামস—এসব বাহিনীর দার্শনিক ও কৌশলগত পরিকল্পনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন গোলাম আযম।
মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল আরও বলেন, একাত্তরের ৯ নভেম্বর তিনি বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল থেকে কলকাতা চলে যান। ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। কলকাতায় থাকতে তিনি ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের খবর শোনেন। ডিসেম্বরের শেষ দিকে তাঁর মা কবি সুফিয়া কামাল অন্য সহকর্মীদের নিয়ে যুদ্ধাক্রান্ত মানুষের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেন। তিনিও এ কাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন, মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রভৃতি বিষয়ে কাজ শুরু করেন। তিনি বলেন, তিনি মুক্তিযুদ্ধে অত্যাচারিত ১৯ জন নারীর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন, যাঁরা পাকিস্তানি সেনাদের ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। ওই নারীদের অনেককেই স্থানীয় দোসররা সেনাদের কাছে হস্তান্তর করেছিল।
জবানবন্দির শেষ পর্যায়ে সুলতানা কামাল বলেন, ‘একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি ট্রাইব্যুনালের কাছে এই প্রত্যাশা করি, পৃথিবীর ইতিহাসে নিকৃষ্টতম গণহত্যার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, যাঁরা নীতিগতভাবে সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে এই গণহত্যাকে সমর্থন জুগিয়েছেন, মাত্র নয় মাসে ৩০ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়েছেন, এক কোটি মানুষকে দেশত্যাগে বাধ্য করেছেন, যাঁরা দেশে ছিলেন, তাঁদের অনবরত ভীতিকর অবস্থায় বাড়ি, ঘর, গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয়ের জন্য ছুটতে বাধ্য করেছেন, দুই লাখ নারীকে ধর্ষণের শিকার এবং আরও লাখ লাখ নারীকে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করেছেন, কোটি কোটি পরিবারকে বিপর্যস্ত করেছেন, তাঁদের বিচার হবে। এই মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁদের যথাযথ শাস্তি হবে।’
সুলতানা কামাল গতকাল প্রায় এক ঘণ্টা জবানবন্দি দেন। এরপর তিনি আসামির কাঠগড়ায় উপস্থিত গোলাম আযমকে শনাক্ত করেন।
পরে সুলতানা কামালকে জেরা শুরু করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম। মুক্তিযুদ্ধকালে রাজাকার, আলবদররা কি সাক্ষীদের বাড়ি গিয়েছিল—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাঁদের বাড়িতে কখনো আলবদর, রাজাকার যায়নি। তবে যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে তাঁর মায়ের (সুফিয়া কামাল) ওপর আলবদরদের হামলার পরিকল্পনার অভিযোগ পাওয়া গিয়েছিল বলে শুনেছেন।
মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘আপনার মা কবি সুফিয়া কামাল দুটি ডায়েরি লিখতেন। একটি দৈনন্দিন বিষয় ও অপরটি কবিতা লেখার জন্য।’ সুলতানা কামাল এ বক্তব্যে সম্মতি জানালে মিজানুল বলেন, সুফিয়া কামালের দৈনন্দিন ডায়েরি পরে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। ওই বইয়ের কোথাও আলবদরদের হামলার পরিকল্পনার বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই। এ কথায় সাক্ষী বলেন, ওই বইয়ের শেষ দিকে আলবদরদের ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ আছে। ষড়যন্ত্রকারী আলবদরদের নাম জানেন কি—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ষড়যন্ত্রকারীদের নাম জানার সুযোগ ছিল না।
একাত্তরের ১৬ জুন ঢাকায় থাকা পর্যন্ত কোনো আলবদর বা রাজাকারের সঙ্গে সাক্ষীর দেখা হয়েছে কি না—আইনজীবীর এ প্রশ্নের জবাবে সাক্ষী বলেন, হয়নি। আলবদর গোপন ‘কিলার ফোর্স’ ছিল, তারা কারও কাছে নিজের নাম প্রকাশ করেনি, যাঁদের হত্যা করা হয়েছে, তাঁদের কাছে কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে গিয়েছে।
আলবদর হিসেবে সর্বপ্রথম কার নাম পত্রিকায় দেখেছেন—এ প্রশ্নের জবাবে সুলতানা কামাল বলেন, তিনি আশির দশকের প্রথম দিকে আলবদর হিসেবে প্রথম মতিউর রহমান নিজামীর নাম পত্রিকায় দেখেন। ওই সময় নিজামী জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ছিলেন। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তিনি কখনো সরাসরি ছাত্ররাজনীতি করেননি।
সুলতানা কামালকে আজ বুধবার আসামিপক্ষ আবার জেরা করবে।
No comments