ভয়াবহ ক্ষতি করতে পারে গাঁজা

১ সেপ্টেম্বর বিকেল পাঁচটায় ধানমন্ডির ডব্লিউভিএ মিলনায়তনে পরামর্শ সহায়তা ২৯-এর আসর অনুষ্ঠিত হয়। এ আসরে উপস্থিত ছিলেন মনোরোগ চিকিৎসক মোহিত কামাল, আহমেদ হেলাল, অভ্রদাস ভৌমিক, ব্রাদার রোনাল্ড ড্রাহোজাল, মেখলা সরকার ও আহ্ছানিয়া মিশনের পরিচালক ইকবাল মাসুদ।


এখানে পরামর্শ সহায়তায় আলোচিত বিষয়গুলো তুলে ধরা হলো। প্রশ্ন: পাঁচ বছর ধরে ইয়াবা নিয়েছি। চার মাস হলো ছেড়ে দিয়েছি। এখন আমার কিছু সমস্যা হচ্ছে। সকাল হলে একটা কথা বারবার বলি। কারও সহযোগিতা পাচ্ছি না। এখন করণীয় কী?
পরামর্শ: আপনাকে সব সময় ভালো কাজের মধ্যে থাকতে হবে। ঘরে বসেও ভালো কাজ করা যায়। যেমন, মহামানবের জীবনী ও অন্যান্য ভালো বই পড়া, লেখালেখি ও ছবি আঁকার চেষ্টা করা, ছোট ভাইবোনদের পড়ানো, ভালো গান শোনা ও সিনেমা দেখা ইত্যাদি। কোনো না কোনোভাবে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্কুল-কলেজের ভালো বন্ধুদের সঙ্গে মেশা যেতে পারে। মাদক গ্রহণের ফলে পরিবার ও অন্যদের সঙ্গে সম্পর্কের যে অবনতি হয়েছে, সে সম্পর্ক ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। আপনি নিজেই ভালো হয়েছেন। কিন্তু এখন ভালো থাকার জন্য কোনো ডাক্তারের সঙ্গে নিয়মিত পরামর্শ নিতে হবে। ১০ টাকা দিয়ে টিকিট করে মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে আসতে পারেন। এখানে আপনাদের মতো রোগীদের পরামর্শ দেওয়া হয়।
প্রশ্ন: আমি একজন শিক্ষক। প্রায়ই লক্ষ করি, কিছু ছাত্র ক্লাসে অনুপস্থিত থাকে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, তারা মাদকের সঙ্গে জড়িত। বড়লোক বন্ধুরা বিনা পয়সায় মাদক দিয়ে তাদের আসক্ত করেছে। আবার মাদক কেনাবেচার কাজে ব্যবহার করছে। এ বিষয়ে কী করা যেতে পারে?
পরামর্শ: মাদক একটি সামাজিক ব্যাধি। সমাজে এর ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে। সমাজের সব শ্রেণীর মানুষকে এ ব্যাপারে কাজ করতে হবে। কিন্তু পুলিশের দিক থেকে যথেষ্ট উদ্যোগ দেখি না। পুলিশ মাদক ব্যবসায়ীদের থেকে মাদক সেবনকারীদের বেশি ধরে। অর্থের কাছে স্কুলের শিক্ষার্থী, তরুণ প্রজন্ম, দেশ-জাতি—সবকিছু মূল্যহীন হয়ে যাচ্ছে। অর্থের জন্য মাদক ব্যবসায়ীরা কৌশলে স্কুলের শিক্ষার্থীদের মাদকাসক্ত করছে। তাদের ব্যবসার কাজে ব্যবহার করছে। আমরা ডাক্তাররা এ ব্যাপারে কাজ করছি। এখন দরকার একটি সামাজিক আন্দোলন।
প্রশ্ন: আমার কাছে একজন দরিদ্র ছাত্রের মা এসে বললেন, তাঁর সন্তানকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। বললেন পুলিশ এত টাকা চায়, যা তাঁর পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। তাঁর ছেলের দুই বছরের সাজা হয়। জেল থেকে বেরিয়ে সে আরও বেপরোয়া হয়ে মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। এগুলো কীভাবে রোধ করা সম্ভব?
পরামর্শ: দেশে সবকিছুর মধ্যে বাণিজ্য ঢুকে গেছে। মানবিকতার কোনো জায়গা নেই। পুলিশকে টাকা দিতে পারলে নিশ্চয়ই আপনার সন্তান ছাড়া পেত। আপনার সন্তান জেলে থাকার সময় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। তাই এক ধরনের দুঃখ এবং হতাশা থেকে আবার মাদকে জড়িয়ে পড়েছে। আমরা তাকে এমন কোনো পরিবেশ দিতে পারিনি, যেখানে সুস্থ থাকার নিশ্চয়তা পাবে। এখন তাকে সুস্থ করে তোলাই বড় কথা। আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে আনলে যথাসম্ভব তাকে কম খরচে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারি।
প্রশ্ন: আমার ছোট ভাই একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করেছে। এখন সে একটি ব্যাংকে চাকরি করছে। কিন্তু সে মারাত্মকভাবে মাদকাসক্ত বলে ব্যাংক তাকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ভালো হয়ে কাজ করার কথা বলেছে। তা না হলে তার চাকরি থাকবে না। এখন কীভাবে আমরা তাকে ভালো করব?
পরামর্শ: অনেক মেধাবী তরুণের জীবন মাদকের জন্য এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আপনার ভাই তাদেরই একজন। তার যে অবস্থার কথা শুনলাম, তাকে অবশ্যই অতি দ্রুত কোনো চিকিৎসকের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। সে যেহেতু অস্বাভাবিক আচরণ করছে, তার মানসিক সমস্যা থাকতে পারে। যদি থাকে, তা হলে আগে তাকে মানসিক সমস্যার চিকিৎসা করতে হবে। পরে ভালো কোনো একটা নিরাময়কেন্দ্রে ভর্তি করতে হবে। প্রথমত, পরিবারের সবাইকে তার সঙ্গে মিশে যেতে হবে। সে যেন বুঝতে পারে, পরিবারের সব মানুষ তার পাশে আছে। মাদকের ক্ষতিকর দিকগুলো গল্পের মতো করে তুলে ধরতে হবে। তার সঙ্গে সবকিছু নিয়ে কথা বললে, তাকে ভালোবাসা দিলে একসময় সে তার ভুলগুলো বুঝতে পারবে। এবং আপনাদের কথা শুনে ভালো হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ হবে। সব চেষ্টার পরও যদি তাকে ভর্তি করানো না যায়, তা হলে পুলিশের সাহায্য নিতে হবে।
প্রশ্ন: আমার সন্তান মাদকাসক্ত। দুইবার নিরাময়কেন্দ্রে দেওয়া হয়েছে। কিছুদিন ভালো থাকার পর আবার মাদকাসক্ত হয়। এবার আবার দেওয়া হয়েছে। হয়তো ছয় মাস পর আনব। তখন আমাদের করণীয় কী?
পরামর্শ: সাধারণত চিকিৎসার পর রোগী এবং অভিভাবকেরা মনে করেন আর কোনো দায়দায়িত্ব নেই। মাদকাসক্ত রোগীদের ক্ষেত্রে চিকিৎসার পরও একটা চিকিৎসা থাকে। দায়দায়িত্ব আরও অনেক বেড়ে যায়। অনেকেই এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেন না। আপনারা জানেন, রোগীদের নিরাময়কেন্দ্র থেকে ছেড়ে দেওয়ার পর তাদের কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়। যেমন: নিয়মিত ওষুধ খাওয়া, নিয়মিত চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করা। বিভিন্ন ধরনের অভ্যাস পরিবর্তন করা, জীবন-পদ্ধতি পরিবর্তন করা। নিয়মিত ঘুমানো। শারীরিক পরিশ্রম করা, আনন্দের মধ্যে থাকা প্রভৃতি। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, প্রথম প্রথম কয়েক দিন মেনে চললেও তারপর আর ঠিকমতো নিয়ম মানা হয় না।
এ ছাড়া রোগীর প্রতি আরও বিশেষ নির্দেশনা থাকে। যেমন: রোগীর নিজেকে সব সময় ভালো থাকার চিন্তা করতে হবে। মাদকাসক্ত বন্ধুদের সঙ্গে মেশা যাবে না। কেউ মাদক নিতে বললে তাকে শক্তি ও সাহসের সঙ্গে না বলতে হবে। মানুষ হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব। এই জীবন সামান্য মাদক গ্রহণ করে ধ্বংস করার জন্য নয়। আমরা দেখেছি, যত বড় মাদকাসক্ত রোগীই হোক না কেন, সে নিজে যদি ভালো হতে ইচ্ছে করে, তা হলে অবশ্যই সে ভালো হতে পারে। সবকিছু নির্ভর করে রোগী কী চায় তার ওপর।
প্রশ্ন: আমি একটি স্কুলের শিক্ষক। স্কুলে অনেক দরিদ্র মাদকাসক্ত শিক্ষার্থী আছে। মাদক নিরাময়কেন্দ্রগুলোর মান কী, সেটা জানি না। কিন্তু এটা জানি যে প্রতিদিন একজন রোগীর খরচ দেড় থেকে দু্ই হাজার টাকা। এত বিশাল পরিমাণ টাকা দরিদ্র বাবা-মায়ের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে কী করণীয়?
পরামর্শ: প্রথমত স্কুলের শিক্ষার্থীরা মাদকাসক্ত, সেটা একেবারেই মেনে নেওয়া যায় না। আমাদের জানামতে, দেশে কিছু ভালো নিরাময়কেন্দ্র আছে। নিরাময়কেন্দ্রে ওষুধ প্রয়োগের পরিবর্তে রোগীর আচরণ পরিবর্তনের মাধ্যমে তাকে ভালো করার ব্যবস্থা করা হয়। আহ্ছানিয়া মিশনের একটি কেন্দ্রে গরিবদের বিনা পয়সায় চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়া জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক কম খরচে চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। যারা দরিদ্র, তারা এখানে এসেও ভালো চিকিৎসা পেতে পারে।
প্রশ্ন: অনেকে মাদক ছেড়ে দেয়। কিন্তু উৎসবের দিন বা বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে গ্রহণ করতে চায়। এ বিষয়টি কতটা সমর্থনযোগ্য?
পরামর্শ: এ বিষয়টি এক শ ভাগের মধ্যে এক ভাগও সমর্থনযোগ্য নয়। যারা মাদক ছেড়ে দিয়েছে, তারা একসময় এই দিনগুলোতে বিশেষ আয়োজন করে মাদক নিত। ফলে সেই দিনগুলো এলে তাদের ব্রেনে মাদক গ্রহণের জন্য এক ধরনের সাড়া তৈরি হয়। যেকোনোভাবেই হোক সে মাদক গ্রহণ করতে চায়। তার মধ্যে নানাবিধ অস্থিরতা তৈরি হয়। নিজেকে আর কোনো রকম নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। এ ক্ষেত্রে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করতে হবে। ব্যায়াম করতে হবে। দৌড়ানো যেতে পারে। ভালো বই পড়া. গান শোনা. সিনেমা দেখা ইত্যাদির মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে। নিজেকে এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যাতে তার কাছে প্রতিটি দিনই হয় উৎসবের। এবং প্রতিটি দিনই নিজেকে মাদক থেকে দূরে রাখার প্রতিজ্ঞা করতে হবে।
প্রশ্ন: আমার বড় ভাই মাদকাসক্ত। সে বিবাহিত ও তার একটি সন্তান আছে। একবার সে প্রতিজ্ঞা করেছিল মাদক নেবে না। কিন্তু আমরা এখন দেখছি যে সে মাদক নিচ্ছে। বর্তমানে তার অবস্থা খুব খারাপ। এখন তার জন্য কী করতে পারি?
পরামর্শ: একজন মানুষ যখন মাদকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তখন সে কোনো প্রতিজ্ঞা রাখতে পারে না। আপনার ভাই প্রতিজ্ঞা করার সময় ঠিকই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে মাদক নেবে না। কিন্তু সে যখনই বন্ধ করেছে, তখন তার কিছু সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। সমস্যা থেকে মুক্ত থাকার জন্য সে আবার মাদকে ফিরে গেছে। প্রথমত, পরিবারের সবাইকে তার সঙ্গে মিশে যেতে হবে। তার সুখ-দুঃখের সঙ্গে মিশতে হবে। সে যেন বুঝতে পারে, পরিবারের সব মানুষ তার পাশে আছে। মাদকের ক্ষতিকর দিকগুলো তার কাছে গল্পের মতো করে তুলে ধরতে হবে। তার সঙ্গে সবকিছু নিয়ে কথা বললে, তাকে ভালোবাসা দিলে, একসময় সে তার ভুলগুলো বুঝতে পারবে। এবং আপনাদের কথা শুনে ভালো হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ হবে। সব চেষ্টার পরও যদি তাকে ভর্তি করানো না যায়, তা হলে জোর করে তাকে চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে।
প্রশ্ন: আমরা কিছুটা বিত্তশালী। আমাদের অবস্থাকে দুর্বল করার জন্য একশ্রেণীর মানুষ আমার ভাইকে মাদকে জড়িয়েছে। এখন তার অবস্থা খুবই খারাপ। মায়ের সাহায্য ছাড়া কোনো কাজই সে করতে পারে না। ভাইয়ের জন্য কী করতে পারি?
পরামর্শ: সাধারণত ধনীর সন্তানেরা দুটি কারণে মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। প্রথমত, বড়লোকদের সন্তানদের মাদকাসক্ত করতে পারলে এদের পয়সায় অন্যদের মাদক গ্রহণের সুযোগ তৈরি হয়। দ্বিতীয়ত, সমাজে তাদের মানসম্মান হেয় করার জন্য পরিকল্পিতভাবে মাদকে জড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। আপনার ভাই যেকোনো একটি ঘটনার শিকার। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, তার বর্তমান অবস্থা খুবই খারাপ। যত দ্রুত সম্ভব তাকে চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে। এখন তার কিছুটা দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার প্রয়োজন।
প্রশ্ন: অনেকে বলেন, গাঁজা খেলে কিছু হয় না। গাঁজা কোনো নেশার পর্যায়ে পড়ে না। এ বিষয়ে আপনাদের অভিমত জানতে চাই।
পরামর্শ: গাঁজা সম্পর্কে যে ধারণার কথা বললেন, এটা খুবই ভ্রান্ত ধারণা। অনেকে এটাকে স্বাভাবিক মাদক বা হালকা হিসেবে দেখে থাকে। এটি একটি ভয়াবহ মাদক। শুনলে আশ্চর্য হবেন যে গাঁজার মধ্যে ৬০ প্রকার কেমিক্যাল এজেন্ট আছে। ধোঁয়ার মাধ্যমে গাঁজা টেনে নেয়। এটা প্রথমে ফুসফুসে যায়। তারপর ব্লাড. ব্লাড থেকে ব্রেন, ব্রেন থেকে কোষে যায়। ৬০ প্রকার কেমিক্যাল এজেন্টের মধ্যে একটা আছে খুবই ভয়ংকর ও বিপজ্জনক। এটাকে বলে টিএইচসি (টেট্রা হাইড্রো ক্যানাবিনওয়েড) একবার স্নায়ুকোষের মধ্যে ঢুকলে এক বছর থাকে। এবং শরীরকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে থাকে। এটা অনেক ধরনের মানসিক সমস্যা তৈরি করে।

No comments

Powered by Blogger.