সপ্তাহের হালচাল- মারি তো গন্ডার লুটি তো ভান্ডার by আব্দুল কাইয়ুম

একশ্রেণীর লোক ভাবে, লুটপাট করলে বড় দাঁও মারাই ভালো, আর শিকার করতে হলে গন্ডারই উত্তম, কারণ তাতে আয় বেশি। এরা সমাজ ও ক্ষমতাসীন সরকারের জন্য ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনে। সরকারের বড় বড় চাঁইদের হাত করে নিজেরা তো লুটপাট করেই, সেই সঙ্গে সরকারেরও বারোটা বাজায়।


সম্প্রতি সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনাটি এ রকমই একটা ব্যাপার। এতে সরকারের চেহারা আরেকটু কালিমালিপ্ত হয়েছে। গণমাধ্যমে এসব নিয়ে যে সংবাদ পরিবেশিত হচ্ছে, তা সরকারের জন্য বিব্রতকর হতে পারে, কিন্তু ঘটনা তো সত্য।
আচ্ছা বলুন তো, সরকারের চেহারাটা যদি খারাপ হয়, আয়নায় কি তাকে সুন্দর দেখাবে? আয়নার অক্ষমতা হলো, সে খারাপের ভালো প্রতিফলন ঘটাতে পারে না। কিন্তু সরকার অনেক সময় মনে করে, খারাপ দিকগুলোকে তুলে ধরার দরকার কী? এখানে আয়না মানে গণমাধ্যম। আর গণমাধ্যম যখন সরকারের সমালোচনা করে, খারাপ কাজগুলো করে প্রচার করে, তখন সরকার অখুশি হয়। বলে, পত্রিকাগুলো সরকারের পিছে লেগেছে!
আমরা তা হলে অর্থমন্ত্রীর সর্বশেষ উপলব্ধিটি কীভাবে ব্যাখ্যা করব? তাঁর মতে, হলমার্ক কেলেঙ্কারির সঙ্গে শুধু সোনালী ব্যাংকের লোকেরা নন, অনেক লোকই এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত (প্রথম আলো, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১২)। ঠিক এই কথাটি অন্তত আড়াই মাস আগে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছিল। প্রথম আলো ব্যাংক খাতের অব্যবস্থাপনা নিয়ে তদন্ত করতে গিয়ে এর সন্ধান পায় এবং খোঁজখবর নিয়ে কেলেঙ্কারির বিষয়ে নিশ্চিত হয়। এর পরই কেবল খবরটি শিরোনাম হয়ে প্রথম আলোয় প্রথম প্রকাশিত হয়। বলা হয়, সোনালী ব্যাংকের এই ঋণ কেলেঙ্কারির পেছনে সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তির প্রভাব রয়েছে। এরপর তো এই গরম খবরটি দাবানলের মতো সব পত্রিকা ও রেডিও-টেলিভিশনে ছড়িয়ে পড়ে। চারদিকে হইচই পড়ে গেলে অর্থমন্ত্রী প্রথম দিকে একে গণমাধ্যমের বাড়াবাড়ি বলে মন্তব্য করেন। কিন্তু পরে দেখা গেল, গণমাধ্যমে প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি তিনি সাংবাদিকদের কাছে নতুনভাবে বেশ জোর দিয়ে উপস্থিত করেন।
অর্থমন্ত্রী প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিলেন, সংবাদমাধ্যম আসলে আয়নার মতো। এই কথাটিই আকবর আলি খান ৯ সেপ্টেম্বর প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বলেছিলেন। তিনি বলেন, দোষটা আয়নার (গণমাধ্যম) না, দোষটা সরকারের। আয়না যেমন একজনের চেহারা অবিকল তুলে ধরে, গণমাধ্যমও তা-ই করে। এ জন্য গণমাধ্যমকে দোষ দিয়ে লাভ নেই।
সরকার বা তাদের লোকজন এক-একটা কেলেঙ্কারি ঘটাবে, তো গণমাধ্যম কি সেগুলোর মুখে প্রসাধনের প্রলেপ দিয়ে সাজিয়েগুছিয়ে প্রকাশ করবে? এটা কি সংবাদমাধ্যমের কাজ?
গণমাধ্যমে নিজের সুন্দর চেহারা দেখতে হলে সরকারকে ভালো কাজের উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে। এখন অর্থমন্ত্রী বলছেন, কেউ যেন পালাতে না পারে সে ব্যবস্থা হচ্ছে। এক অর্থে এটা ভালো। সবকিছু অস্বীকার না করে সমস্যাটা যে সত্যিই আছে এবং তার প্রতিকারে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যে ধরপাকড় চালাতে হবে, এই উপলব্ধি ভালো। প্রভাবশালীসহ দু-চারজনকে ফাটকে ঢুকিয়ে দেখুন না সরকারের চেহারা কত সহজে সুন্দর করে তোলা যায়।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ পর্যন্ত খুব কম সরকারই নিজেদের অপকীর্তির বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নিতে পেরেছে। সরকারের পরিবর্তনের পরই কেবল অন্য সরকার এসে ব্যবস্থা নেয়। তখন রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিযোগ ওঠে, হইচই শুরু হয়ে যায়।
ব্যাংক বা অন্য যেকোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানে যখন প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়, তখন প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের তা অজানা থাকে না। কিন্তু তাঁরা সহজে কিছু বলতে চান না। এই দুর্মূল্যের বাজারে কে চাকরি হারাতে চায়? সোনালী ব্যাংকের এই ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় একজন কর্মকর্তা আপত্তি করলে তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে দূরের এক জেলায় বদলি করে দেওয়া হয়েছিল। পরিবার-পরিজন নিয়ে তাঁকে বিপদে পড়তে হয়।
কিন্তু ওই কর্মকর্তার সামনে একটা বিকল্প ছিল। তিনি সরকারের ‘জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন’-এর সুযোগ নিতে পারতেন। আইনটি মাত্র গত বছরের ২২ জুন জাতীয় সংসদে গ্রহণ করা হয়। ইংরেজিতে এটি ‘হুইসেল ব্লোয়ারস অ্যাক্ট’ নামে পরিচিত। কেউ যদি সুনির্দিষ্টভাবে জানতে পারেন যে তাঁদের কর্মক্ষেত্রে দুর্নীতি হচ্ছে, তা হলে তিনি সাক্ষ্য-প্রমাণসহ বিষয়টি গোপনে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে জানাতে পারবেন। আইনটির বিধান অনুযায়ী তাঁর পরিচয় গোপন থাকবে, তাঁর বিরুদ্ধে কোনো হয়রানিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। তাঁকে বদলি বা তাঁর বিরুদ্ধে কোনো বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। এমনকি আদালতে তাঁকে সাক্ষী হিসেবে রাখা যাবে না। এসব সুরক্ষা তিনি পাবেন। তবে কেউ যদি উদ্দেশ্যমূলকভাবে, কারও ক্ষতি করার জন্য মিথ্যা অভিযোগ আনেন, তা হলেই কেবল অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে এ রকম একটি শক্ত আইন থাকা সত্ত্বেও কেউ ও পথ মাড়ায় না কেন, সেটা ভেবে দেখতে হবে। কেউ ঝামেলায় জড়াতে চায় না। কারণ, তারা জানে, এ দেশে আইনের যথাযথ প্রয়োগ প্রায় ক্ষেত্রেই হয় না। সরকারের একটা ভালো আইনের সদ্ব্যবহার কেউ করতে চায় না, এটা সরকারেরই দুর্বলতার লক্ষণ। কারণ, সরকার এর প্রচার করে না।
বেশ কয়েকটা মন্ত্রণালয়ের কাজে দুর্নীতির প্রচুর অভিযোগ রয়েছে। সরকারি ব্যাংকের বিষয়টা তো এখন সামনেই আছে। এ ছাড়া ভূমি ব্যবস্থাপনা, রাজস্ব বিভাগ, থানা-পুলিশ—কোথায় দুর্নীতি নেই? এসব মন্ত্রণালয়ের সচিব-মন্ত্রী থেকে শুরু করে সবাই যদি শুধু ঘুষ-দুর্নীতির গোপন তথ্য প্রকাশকারীর সুরক্ষার আইনের কথাটি প্রচার করেন, তা হলেই সৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভরসা পাবেন।
দু-একটা দৃষ্টান্ত দেখাতে পারলেও তো সরকারের চেহারাটা একটু উজ্জ্বল হয়। কোনো একটি সরকারি কার্যালয়ে চাঞ্চল্যকর কোনো দুর্নীতির ঘটনা উদ্ঘাটন করে, গোপন তথ্যদাতার পরিচয় গোপন রেখে যদি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তা হলে দেশে নাটকীয় পরিবর্তনের সূচনা ঘটবে।
কিন্তু সেটা কি কখনো হবে? সরকার মুখে সব সময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে চলেছে। দুদক নাকি স্বাধীন। দেশে নাকি দুর্নীতির লেশমাত্র অবশিষ্ট থাকবে না। ইত্যাদি। এসব কথায় বিশ্বাস করে কেউ যদি গোপন তথ্য প্রকাশের উদ্যোগ নেয় এই আশায় যে আইনে তো তার সুরক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে, তা হলে তার ভাগ্যে কী ঘটবে কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। এখানেই সমস্যা।
এ প্রসঙ্গে কেনিয়ার একটি ঘটনার উল্লেখ করতে হয়। আফ্রিকার এই উন্নয়নশীল দেশটি দুর্নীতিতে ছেয়ে গিয়েছিল। তখন প্রেসিডেন্ট মাওয়াই কিবাকি ক্ষমতায় এসে দুর্নীতির বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি ২০০২ সালে কেনিয়ার সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের অগ্রদূত বলে পরিচিত জন গিথঙ্গোকে নৈতিকতা ও সুশাসনবিষয়ক মন্ত্রী (পারমানেন্ট সেক্রেটারি) নিযুক্ত করেন। দেশের প্রেসিডেন্ট তাঁকে দুর্নীতি উচ্ছেদের সার্বিক ক্ষমতা দিয়ে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে বলেন। গিথঙ্গো তো সরল মনে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেন। কিন্তু অচিরেই আবিষ্কার করেন, সরকারের কোটি কোটি ডলারের কেনাকাটায় পুকুর চুরি চলছে। অস্তিত্বহীন কোম্পানির সঙ্গে কেনাবেচা চলছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে তাঁর ওপর জীবনের হুমকি আসতে থাকে। শেষ পর্যন্ত তিনি লন্ডনে পালিয়ে বাঁচেন। তাঁর অভিজ্ঞতা নিয়ে ব্রিটিশ সাংবাদিক ও লেখিকা মিশেলা রঙ এখন আমাদের খাওয়ার পালা নামে একটি সাড়া জাগানো বই লেখেন।
এক-একটা সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই যে ‘আমাদের খাওয়ার পালা’ শুরু হয়, সেটা বাংলাদেশ বা কেনিয়ার মতো দেশ, এমনকি থাইল্যান্ডেও আছে। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট বেনিগনো অ্যাকুইনো দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যাপক কর্মসূচি নেন। কিন্তু সম্প্রতি তাঁর সরকার বেশ কিছু বিতর্কিত পদক্ষেপ নিয়েছে।
এই যে কেনিয়ার এত কাহিনি আমরা শুনলাম, তার পরও দেখুন কেনিয়া সম্প্রতি বিশ্ব গণমাধ্যমে একটি বড় সাফল্যের জন্য আলোচনার প্রথম সারিতে উঠে এসেছে। সেখানে ২০০৭ সাল থেকে সাফারিকম মোবাইল টেলিফোন কোম্পানি চালু করেছে এম-পেসা, আমাদের দেশে যেমন চালু হয়েছে মোবাইল-মানি। কেনিয়ায় এম-পেসার মাধ্যমে গ্রামের গরিব মানুষ অনায়াসে তাদের টাকা লেনদেন করতে পারছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে যে কেনিয়ার সাধারণ মানুষ অনেক হয়রানি ও দুর্নীতির হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে।
বাংলাদেশে হলমার্ক কেলেঙ্কারির মতো আরও কত দুর্নীতি, টাকা পাচার সরকারি ব্যাংকে ঘটছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নেবে কি না, তা অনেকাংশে নির্ভর করে বিদ্যমান আইনের যথার্থ প্রয়োগের ওপর।
তবে সবচেয়ে আগে প্রয়োজন সরকারের কিছু মন্ত্রী-নেতার নামে যেসব অভিযোগ উঠছে, তার ব্যাপারে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া। দল ও সরকারের ভেতর দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্তদের রেখে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের অঙ্গীকার হাস্যকর। কাঁকর বিছানো পথে খালি পায়েও হাঁটা যায়। কিন্তু জুতার ভেতর যদি সামান্য কাঁকর থাকে, এক কদম হাঁটাও কঠিন। সরকারকে তাই বুঝতে হবে, সমাজে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার সত্ত্বেও হয়তো ক্রমান্বয়ে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব, কিন্তু দল ও সরকারের মধ্যে অভিযুক্ত দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিদের রেখে কিছু করা যাবে না।
বক্তৃতায় দুর্নীতি দূর হবে না। দুর্নীতির তথ্য প্রকাশকারীর সুরক্ষার জন্য যত আইনই করা হোক না কেন, কোনো কাজেই লাগবে না, যদি এসব ব্যাপারে সরকারের কথা ও কাজে মিল না থাকে। কাঠের বিড়াল কখনো ইঁদুর মারে না। এটা একজন বোকাও বোঝে।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক
quayum@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.