বাংলাদেশের জন্য তাদের বড় দুঃখ হয় by মুনতাসীর মামুন

দৈনিক জনকণ্ঠে আলবদরদের ইতিহাসের একটি অংশ ছাপা শেষ হলো। এতে কিছু অসঙ্গতি, কিছু পুনরাবৃত্তি থাকতে পারে। জরুরী অনেক তথ্য পুরোপুরি নাও থাকতে পারে। কিন্তু, এটি শেষ হওয়ায় স্বস্তিবোধ করছি। আমার স্ত্রী যখন সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে, তখন তাঁর সঙ্গে থাকার সময় আমি রচনাটি লিখি।


স্ত্রী সঙ্কটাপন্ন অবস্থা অতিক্রম করে খানিকটা সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরলে আমি লেখাটি জনকণ্ঠে দিয়ে দেশের বাইরে চলে যাই। ফিরে এসে দেখেছি লেখাটির শেষাংশ ছাপা হচ্ছে। বই আকারে এর বিস্তৃতি আরও দ্বিগুণ হবে। আশা করি তখন আরেকবার আদ্যোপান্ত লেখাটি দেখে দেয়া যাবে।
এ ভূমিকার কারণ অন্য। সংবাদপত্রে এ্যাডভোকেট সুলতানা কামালের বক্তব্য ছাপ হয়েছে। গত দু’দিন তিনি গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিচ্ছেন। আমরা গত ৪০ বছর ধরে বিভিন্নভাবে যে কথা বলেছি তা অত্যন্ত সংহতভাবে একটি বাক্যে তিনি শেষ করেছেন। তাহলো বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার প্রতীক, গোলাম আযম মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার প্রতীক। ফৌজদারি আদালতের মতো বিভিন্ন প্রশ্ন করে। সাক্ষী কিছু জানেন না বা ভুল বলেছেন অতএব প্রমাণিত হলো গোলাম আযম মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেননিÑ এ ধরনের উপসংহারে পৌঁছে ডিফেন্সের কোন লাভ হবে বলে মনে হয় না। গোলাম আযম রাজাকারীর প্রতীক। গোলাম আযম গণহত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগের প্রতীক। আর সে কারণেই স্বাধীনতাকামীরা জয়ী হলে ভয়ে তিনি পালিয়ে যান এবং রাজাকার বন্ধু জিয়া ক্ষমতায় এলে দেশে ফিরে আসেন। গোলাম আযমের আইনজীবী ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেছেন, সুলতানা কামাল কিছুই প্রমাণ করতে পারেননি। আমি আগেই বলেছি, যিনি সারাদেশে গোলামীর প্রতীক হিসেবে পরিচিত তার বিরুদ্ধে আর কী প্রমাণ করতে হবে? অপরাধী না হলে দীর্ঘদিন কেউ পালিয়ে থাকে না। জামায়াতে ইসলামের মুখপত্র ‘দৈনিক সংগ্রাম’ ১৯৭১ সালে যদি প্রতিদিন মিথ্যা খবর দিয়ে থাকে তাহলো গোলাম আযম-নিজামীরা তখন মুখপত্রটি বন্ধ করে দেননি কেন? গোলাম আযম গংয়ের অপরাধ প্রমাণের জন্য দৈনিক সংগ্রামই যথেষ্ট। আমাদের সাক্ষী প্রদান আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।
‘আলবদর ১৯৭১’-এর শেষ কিস্তিতে লিখেছি “নির্মূল সমন্বয় কমিটির বড় অবদান ঘাতকদের বিরুদ্ধে দুটি গণতদন্ত কমিশন গঠন ও রিপোর্ট প্রকাশ এবং ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণআদালতের প্রতীকই বিচার।’ এতে খানিকটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে। গণতদন্ত কমিশন আলাদা বিষয়, যা গণআদালতের ধারাবাহিকতায় সৃষ্টি। এ প্রসঙ্গে সুফিয়া কামালের কথা উল্লেখ করতে চাই।
সুলতানা কামাল তাঁর জবানবন্দীতে তাঁর মা সুফিয়া কামালের কথা উল্লেখ করেছেন।
১৯৭১ সালের ঘাতকদের বিচার দাবিতে আন্দোলনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। এটা খুবই স্বাভাবিক তাঁর কন্যা প্রধান ঘাতকের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবেন। যে দুটি গণতদন্ত কমিশন হয়েছিল সে দুটির প্রধান ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল।
এই কমিশনের পুরো নাম ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্কে জাতীয় গণতদন্ত কমিশন।’ ২৬ মার্চ ১৯৯৪ সালে ‘জাতীয় গণতদন্ত কমিশন’ তার রিপোর্টের সংক্ষিপ্ত ভাষ্য প্রকাশ করে। এতে উল্লেখ করা হয়Ñ
গত ২৬ মার্চ ১৯৯৩ তারিখে গণআদালতের প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত সমাবেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি পর্যায়ক্রমিকভাবে একাত্তরের শীর্ষস্থানীয় ঘাতক, দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধ উদ্্ঘাটনের কর্মসূচী ঘোষণা করে। প্রথম পর্যায়ে যে আটজন ব্যক্তির অপরাধ সম্পর্কে তদন্তের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় তাঁরা হলেন (১) আব্বাস আলী খান, (২) মতিউর রহমান নিজামী, (৩) মোঃ কামারুজ্জামান, (৪) আবদুল আলীম, (৫) দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী, (৬) মাওলানা আবদুল মান্নান, (৭) আনোয়ার জাহিদ এবং (৮) আবদুল কাদের মোল্লা।
একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে এদের ভূমিকা তদন্ত করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যৌক্তিকতা নিরূপণের জন্য একটি গণতদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। ১১ সদস্যবিশিষ্ট এই গণতদন্ত কমিশন যাঁদের সমন্বয়ে গঠিত তাঁরা হচ্ছেন বেগম সুফিয়া কামাল (চেয়ারপার্সন), সাহিত্যিক-শওকত ওসমান, শিক্ষাবিদ ড. খান সরোয়ার মুরশিদ, বিচারপতি (অব) দেবেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, বিচারপতি (অব) কে, এম, সোবহান, কবি শামসুর রাহমান, অধ্যাপক ড. অনুপম সেন, অধ্যাপক এমএ খালেক, সাংসদ সালাউদ্দিন ইউসুফ, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব) সদরুদ্দিন ও ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ (সমন্বয়কারী)।
১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ২১তম স্বাধীনতার ২১তম বার্ষিকীতে জাহানারা ইমামকে চেয়ারপার্সন করে ১২ জন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত গণআদালত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের প্রতীকী বিচারের মাধ্যমে বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী, ফ্যাসিস্ট, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে যে আন্দোলনের সূচনা করে গণতদন্ত কমিশন সেই আন্দোলনেরই ধারাবাহিকতার ফসল। গণআদালতের মাধ্যমে সৃষ্ট একাত্তরের ঘাতক দালালবিরোধী আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ সোচ্চার হয়ে ওঠেন গোলাম আযমসহ একাত্তরের অন্য ঘাতক, দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে।
গণতদন্ত কমিশন জনগণের এই প্রত্যাশাকে ধারণ করেই তার কাজ শুরু করে। কমিশন বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধী, পাকিস্তানী সামরিক জান্তার দালাল ও ঘাতকচক্রের কর্মকা- পর্যবেক্ষণ করেছে। বর্তমানে একাত্তরের ঘাতক দালালদের দল জামায়াত-শিবির চক্র ও তাদের সহযোগীরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলনরত মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে একাত্তরের নৃশংসতা ও হননস্পৃহা নিয়ে। আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের নাম তালিকাবদ্ধ করে তাদের হত্যার হুমকি দিয়ে, কর্মীদের হত্যা করে, মিটিং মিছিলে সশস্ত্র হামলা চালিয়ে-সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় অর্জন ধ্বংস করার মাধ্যমে এক সুদূরপ্রসারী চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে তারা। এই পরিস্থিতিতে গণতদন্ত কমিশন বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বাংলাদেশের মানুষের নিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থে একাত্তরের নেতৃস্থানীয় ঘাতক, দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো জরুরী মনে করেছে। সেই সঙ্গে এদের বিচারের জন্য সরকারের নৈতিক ও আইনগত দায়িত্ব নির্দেশ করতে চেয়েছে।
গণতদন্ত কমিশন এই লক্ষ্যে আটজন ব্যক্তির অপরাধ সম্পর্কে ব্যাপক তদন্ত চালিয়েছে। যাবতীয় তদন্ত কার্য সম্পাদনে কমিশনকে প্রয়োজনীয় সাহায্য ও সহযোগিতা করেছে ৪০ সদস্যবিশিষ্ট একটি সেক্রেটারিয়েট। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্রসহ মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত গ্রন্থাবলী, একাত্তরের সংবাদপত্র ও প্রচার মাধ্যমে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাঠানো লিখিত তথ্যের ভিত্তিতে এই তদন্ত কার্য পরিচালিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালে এই সকল ব্যক্তির কর্মস্থলে গিয়েও প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, যা ইতোপূর্বে কোথাও প্রকাশিত হয়নি।
তদন্ত কার্য পরিচালনা করতে গিয়ে গণতদন্ত কমিশন কিছু বাস্তব সমস্যা লক্ষ্য করেছে। মুক্তিযুদ্ধের বহু দলিল ও তথ্যাদি বিভিন্ন সময়ে বিনষ্ট করা এবং সংরক্ষিত তথ্যাদি প্রদানে সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সর্বাত্মক অসহযোগিতার কারণে যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কিত অনেক তথ্যই উদ্্ঘাটন করা যায়নি। কমিশন এক্ষেত্রে সবচেয়ে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি লক্ষ্য করেছে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নিজস্ব এলাকায়। এসব এলাকায় স্বাধীনতার ২৩ বছর পরও যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ভীতি মুছে যায়নি, বরং এ সময়ে মানুষের আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতা ক্ষেত্রবিশেষে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দালাল, রাজাকার, আলবদরদের নৃশংস হামলার প্রধান শিকার ছিল হিন্দু সম্প্রদায়, পরবর্তীকালের বৈরী সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ তাদের আরও বেশি ভীতসন্ত্রস্ত জীবনযাপনে বাধ্য করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যাতিত এবং নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বহু হিন্দু পরিবার গত কয়েক বছরে দেশ ত্যাগ করার ফলে তাদের সম্পর্কে প্রতিবেশীদের সাক্ষ্য গ্রহণ করতে হয়েছে। জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তার কারণে নাম-ঠিকানা গোপন রেখে এদের যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কে সাক্ষ্য প্রদান করতে চেয়েছিলেন একাত্তরে শহীদ ও নির্যাতিত বহু পরিবার। অনেকে তা করার সাহসও পায়নি। যার ফলে বর্তমান তদন্তে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধের প্রকৃতি ও মাত্রার একটি অংশমাত্র উদ্্ঘাটিত হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রকৃত অপরাধ আরও বেশি গুরুতর ও বিস্তৃত।
গণতদন্ত কমিশন ৮ জন ঘাতক, দালাল ও যুদ্ধাপরাধী সম্পর্কে তদন্ত রিপোর্ট প্রণয়নের জন্য সেক্রেটারিয়েটের সংগৃহীত তথ্যাদি পর্যালোচনা করেছে। এই সকল তথ্য যদিও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অপরাধের সামান্য অংশ মাত্র তা সত্ত্বেও কমিশনের কাছে সেগুলো তাদের বিচার অনুষ্ঠানের জন্য পর্যাপ্ত প্রতিয়মান হয়েছে।
যাবতীয় তথ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা পর্যালোচনার পর কমিশন অভিযুক্ত ৮ ব্যক্তি সম্পর্কে তদন্ত রিপোর্ট প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেয়। সে অনুযায়ী সংগৃহীত তথ্যাদির ভিত্তিতে শাহরিয়ার কবিরের তত্ত্বাবধানে আসিফ নজরুল, মিজানুর রহমান খান, জুলফিকার আলী মানিক, ফজলুর রহমান, প্রভাষ আমিন, শহীদুজ্জামান, ইমন শিকদার প্রমুখ লেখক ও সাংবাদিকদের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটি তদন্ত রিপোর্ট প্রণয়ন করে। গণতদন্ত কমিশন ৮ জন ঘাতক, দালাল ও যুদ্ধাপরাধী সম্পর্কে উক্ত কমিটি কর্তৃক প্রণীত চূড়ান্ত রিপোর্টটি অনুমোদন করে।
১৯৯৫ সালের ২৬ মার্চ সুফিয়া কামালের নেতৃত্বাধীন। ঐ কমিশন তাদের দ্বিতীয় রিপোর্টের সংক্ষিপ্ত ভাষ্য প্রকাশ করে। রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ীÑ
জাতীয় গণতদন্ত কমিশন প্রথম পর্যায়ে আটজন ব্যক্তির অপরাধ সম্পর্কে তদন্তের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং ২৬ মার্চ ১৯৯৪ তারিখে জাতীয় সমন্বয় কমিটির জনসমাবেশে এই তদন্তের রিপোর্ট প্রকাশ করে। একই সঙ্গে কমিশন আরও আট ব্যক্তি সম্পর্কে তদন্তের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। যাদের ভেতর রয়েছেন (১) এএসএম সোলায়মান, (২) সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, (৩) মাওলানা আবদুস সোবহান, (৪) মাওলানা একেএম ইউসুফ, (৫) মোহাম্মদ আয়েন উদ্দিন, (৮) ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন। এই প্রতিবেদন উক্ত ৮ ব্যক্তি সম্পর্কে জাতীয় গণতদন্ত কমিশনের অনুসন্ধানের সংক্ষিপ্ত ভাষ্য।
জাতীয় গণতদন্ত কমিশন দ্বিতীয় পর্যায়ে ঘোষিত ৮ ব্যক্তির অপরাধ সম্পর্কে প্রকাশিত সংবাদ, দলিলপত্র, ইতিহাস বিষয়কগ্রন্থ এবং সরেজমিনে অনুসন্ধান করে খসড়া রিপোর্ট প্রণয়নের দায়িত্ব লেখক, সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরকে অর্পণ করে। কমিশনের সেক্রেটারিয়েট সদস্যদের ভেতরে এই কাজে সহায়তা করেন তরুণ সাংবাদিক ও আইনজীবীদের একটি দলÑ যাঁদের ভেতর রয়েছেন জুলফিকার আলী মানিক, ইমন শিকদার, মেহেদী হাসান, প্রভাষ আমিন, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, জাভেদ হাসান মাহমুদ, আসাদুজ্জামান, আবু জুনায়েদ সেনেকা, ফায়েজউদ্দিন আহমদ, উম্মে হাবিবা সুমী, ফয়েজ আহমেদ সেতু ও মোহাম্মদ রেজা। ২৩ মার্চ ’৯৫ তারিখে জাতীয় গণতদন্ত কমিশন খসড়া রিপোর্টটি চূড়ান্তভাবে অনুমোদন করেন এবং তা প্রকাশের জন্য জাতীয় সমন্বয় কমিটির স্টিয়ারিং কমিটিকে অর্পণ করেন।
তদন্ত পরিচালনাকালে ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেনের মৃত্যু ঘটায় কমিশনে তাঁর সম্পর্কে মাঠ পর্যায়ে তদন্ত না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সরকারী গেজেট ও ’৭১, ’৭২-এর সংবাদপত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে তাঁর যেসব তৎপরতার বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়েছে তার অংশবিশেষ কমিশনের রিপোর্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাকি ৭ জন সম্পর্কে তদন্ত পরিচালনাকালে জানা গেছে এদের কয়েকজন এখনও বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে নানাবিধ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন এবং নিজেদের এলাকায় ব্যাপকভাবে ভয়ভীতি ও সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম রেখেছেন। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের সময় এঁদের হাতে নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্ত অনেক ব্যক্তি ও পরিবারবর্গ সাক্ষ্য প্রদানের সময় প্রাণনাশের আশঙ্কায় কমিশনকে অনুরোধ করেছেন তাঁদের নাম-ঠিকানা প্রকাশ না করার জন্য।
তদন্ত কর্ম পরিচালনা করতে গিয়ে গণতদন্ত কমিশন আরও লক্ষ্য করেছে-মুক্তিযুদ্ধের বহু দলিল ও তথ্যাদি বিভিন্ন সময়ে বিনষ্ট করা হয়েছে এবং সংরক্ষিত তথ্যাদি প্রদানে সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সর্বাত্মক অসহযোগিতার কারণে যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কিত অনেক তথ্যই উদ্্ঘাটন করা যাচ্ছে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দালাল, রাজাকার, আলবদরদের নৃশংস হামলার প্রধান শিকার ছিল হিন্দু সম্প্রদায়, পরবর্তীকালের বৈরী সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ তাদের আরও বেশি ভীতসন্ত্রস্ত জীবনযাপনে বাধ্য করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যাতিত এবং নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বহু হিন্দু পরিবার গত কয়েক বছরে দেশ ত্যাগ করার ফলে তাঁদের সম্পর্কে প্রতিবেশীদের সাক্ষ্য গ্রহণ করতে হয়েছে। গতবারের মতো বর্তমান তদন্তেও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধের প্রকৃতি ও মাত্রার একটি অংশমাত্র উদ্্ঘাটিত হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রকৃত অপরাধ আরও বেশি গুরুতর ও বিস্তৃত।

(বাকি অংশ আগামীকালের চতুরঙ্গ পাতায়)

No comments

Powered by Blogger.