সময়ের প্রতিধ্বনি-গভীর সংকটে মহাজোট সরকার by মোস্তফা কামাল

একটি অঘটনের রেশ কাটতে না কাটতেই আরেকটি অঘটন! এটাই যেন এ দেশটির নিয়তি! কেউ কেউ অবশ্য বলেন, একটি অঘটনকে ধামাচাপা দিতে আরেকটি বড় অঘটন পরিকল্পিতভাবে ঘটানো হয়। এর নায়ক কখনো উপদেষ্টা, কখনো মন্ত্রী কিংবা আমলা আবার কখনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অথবা ছাত্রলীগ। কারো চেয়ে কেউ কম যায় না।


বর্তমান সরকারের আমলে দুর্নীতির দায়ে একাধিক মন্ত্রী-উপদেষ্টা ফেঁসে গেছেন। সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী, অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা মোদাচ্ছের আলীসহ সরকারের উচ্চপর্যায়ের অনেকেই দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত। সাম্প্রতিক সময়ে কুইক রেন্টাল ও হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনা দেশে-বিদেশে আলোচনার ঝড় তোলে। আর এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে দুজন উপদেষ্টার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তাঁরা দুর্নীতি করুন বা না করুন, এর দায় তাঁরা এড়াতে পারবেন না। সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকে দেশি-বিদেশি গোয়েন্দা নজরদারিতে আছেন বলে আমরা জানি। অনেকের ফাইলপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করা হচ্ছে। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মন্ত্রী-এমপি হঠাৎ কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে গেলেন কিভাবে, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তাঁদের নিয়ে সরকার বড় ধরনের বিপদে আছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে নানামুখী তৎপরতা চালালেও সংকট যেন সরকারের পিছু ছাড়ছে না।
পদ্মা সেতু নিয়ে এত নাটক হলো! অথচ এখনো এর যবনিকাপাত ঘটানো গেল না। এ ইস্যুতে আরো কত নাটকীয় ঘটনা ঘটে কে জানে! এখন নাটকের দৃশ্যপটে আছেন ড. মসিউর রহমান। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। এর আগে বলতে চাই, এখন সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ শুরু করা; কিন্তু বিশ্বব্যাংকের অর্থ ছাড়া এ প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এ কারণেই সরকার বিশ্বব্যাংকের শর্ত মেনে অর্থের আবেদন জানিয়েই যাচ্ছে; কিন্তু বিশ্বব্যাংক এখনো গোঁ ধরে আছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, আরো কিছু শর্ত না মানলে তাদের পক্ষে ঋণ দেওয়া সম্ভব নয়। এই শর্তের মধ্যে ড. মসিউর রহমানের পদত্যাগের বিষয়টি রয়েছে। অথচ ড. মসিউর পদত্যাগ করছেন না। তিনি পদ আঁকড়ে বসে আছেন। তিনি নাকি দুর্নীতির দায় নিয়ে পদত্যাগ করবেন না। সৈয়দ আবুল হোসেন সরে গিয়ে দেশপ্রেমিক হয়েছেন। মসিউর রহমানও তো দেশপ্রেমিকের খাতায় নাম লেখাতে পারেন! দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্যই তো তিনি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে দায়িত্ব পালন করছেন! তাঁর পদত্যাগে যদি দেশের স্বার্থ রক্ষা হয়, তাহলে পদত্যাগ করতে বাধা কোথায়? সরকারের হৃত ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করতে হলে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছাতেই হবে।
ড. মসিউর রহমানের বোঝা উচিত, শেষ পর্যন্ত যদি বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে ঋণ দিতে রাজি না হয়, তাহলে অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাও মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে। তাতে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে। বিষয়টি সরকারও নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পারছে। তা না হলে নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার ঘোষণা দিয়েও কেন বারবার বিশ্বব্যাংকের কাছেই ধরনা দেওয়া হচ্ছে? অর্থমন্ত্রী তো রীতিমতো কাকুতি-মিনতি করছেন। এর পরও যদি বিশ্বব্যাংকের ঋণ পাওয়া যায়, তাহলে হয়তো সরকারের মুখ রক্ষা হবে।
পদ্মা সেতু ইস্যুতে অবশ্য সরকারের পক্ষে এখন যুক্তরাষ্ট্রও দূতিয়ালি করছে। যুক্তরাষ্ট্রও চাচ্ছে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পদ্মা বহুমুখী সেতু বাস্তবায়ন হোক। এ প্রকল্পে মালয়েশিয়া কিংবা চীনের আসা ঠেকাতেও যুক্তরাষ্ট্র সতর্ক রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এ উদ্যোগের কারণে সরকার কিছুটা হালে পানি পেয়েছে। সরকারপক্ষের কেউ কেউ ধারণা করছেন, যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন জোটের পক্ষেই থাকবে। তবে খালেদা জিয়ার সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার একান্ত বৈঠকের পর বিএনপির পক্ষের লোকেরা বেশ আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। কেউ কেউ মনে করছেন, আগামীতে বিএনপিই ক্ষমতায় আসছে। সে জন্য বিএনপি কঠোর কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি দেয়নি। এখন তারা নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করবে। বেগম জিয়া শিগগিরই সারা দেশ সফর করবেন। প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়াও এখন থেকেই নাকি শুরু হবে।

২.
গর্ব করার মতো খুব কম প্রতিষ্ঠানই আছে আমাদের দেশে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালের (বুয়েট) বিশেষ সুনাম এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতি রয়েছে। অথচ এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিও আজ নানা ষড়যন্ত্রের শিকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি-প্রোভিসির পদত্যাগের দাবিতে ঈদের আগে বেশ কিছুদিন শিক্ষকরা আন্দোলনে ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকায় ঈদের পর থেকে সাধারণ ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করেন। সেই আন্দোলন দমাতে মাঠে নামানো হয় ছাত্রলীগকে। এরা কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র তা আমরা জানি না। তবে বুয়েটে ছাত্রলীগের কোনো কমিটিই নেই বলে জানি। তাহলে কি একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র চলছে? নাকি এর পেছনে কোনো রাজনীতি রয়েছে?
বিশ্ববিদ্যালয়কে সার্বিকভাবে পরিচালনার দায়িত্ব উপাচার্যের। তিনি যদি চালাতে না পারেন, তাহলে দায়িত্ব ছেড়ে চলে যাবেন। সরকারের সহায়তা নিয়ে যদি তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে হয়, তাহলে তাঁকে সরিয়ে দেওয়াই শ্রেয় নয় কি! এর আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছিলেন সেখানকার শিক্ষকরা। আন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। বুয়েটেও একই প্রক্রিয়ায় আন্দোলন শুরু হয়।
এর আগে বিএনপির আমলেও রাজনৈতিক বিবেচনায় ভিসি-প্রোভিসি নিয়োগ হয়েছে। আর এটাই এখানকার স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। আগে কখনোই এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। এখন কেন হবে? বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এর পেছনে কোনো ধরনের উস্কানি আছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখা জরুরি। কেউ কেউ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থিরতার পেছনে রাজনীতির গন্ধ পাচ্ছেন। যদি সে ধরনের কিছু থেকেই থাকে, তাহলে তা খুঁজে বের করে কার্যকর ব্যবস্থা সরকারকেই নিতে হবে। ভিসিকে সরানো হবে- শিক্ষামন্ত্রীর এ আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্ররা আবার ক্লাসে যেতে সম্মত হয়েছেন। শনিবার থেকে ক্লাস শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রীর আশ্বাস বাস্তবায়িত না হলে আবার অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে। কাজেই ছাত্রদের সঙ্গে ছলাকলা না করাই ভালো।
এদিকে মেডিক্যালে ভর্তি পদ্ধতি নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া সিদ্ধান্তে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, এ বছর জিপিএ ৫-এর ভিত্তিতে মেডিক্যালে ভর্তি করানো হবে। নতুন শিক্ষা পদ্ধতির কারণে দেশে জিপিএ ৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা হাজার হাজার। তাদের সবাই কি মেডিক্যালে পড়ার সুযোগ পাবে? নিশ্চয়ই নয়। সংগত কারণেই পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তি করাতে হবে। সেটাই উত্তম পন্থা। অথচ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় শুধু শুধু পরিস্থিতি ঘোলাটে করল। অনেক অভিভাবককে বলতে শুনেছি, মেডিক্যালে ছাত্র ভর্তি করিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্যই নতুন পদ্ধতি চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তা ছাড়া মেডিক্যালে ভর্তির উদ্ভট নিয়ম চালুর উদ্যোগ নিয়ে ছাত্রদের হাতে নতুন ইস্যু তুলে দেওয়া হলো। স্বাস্থ্যমন্ত্রী কার স্বার্থরক্ষায় এ উদ্যোগ নিয়েছিলেন? নাকি তিনিও পকেট ভারী করার মওকা খুঁজছিলেন।

৩.
আগামী জাতীয় নির্বাচন কোন ব্যবস্থায় হবে তা নিয়ে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে; তা নিরসনের উদ্যোগ নিয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। এরই মধ্যে ইউরোপীয় কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতরা বিএনপির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেছেন। বৈঠকে দুটি প্রধান দলের সংলাপের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। রাষ্ট্রদূতরা মনে করছেন, তত্ত্বাবধায়ক, নাকি অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে, তা সংলাপের মাধ্যমেই ঠিক করতে হবে। এ জন্য অবিলম্বে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সংলাপে বসা উচিত বলে রাষ্ট্রদূতরা উল্লেখ করেছেন। তাঁরা ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গেও বৈঠক করবেন বলে জানিয়েছেন। শুধু বিদেশি রাষ্ট্রদূতরাই নন, দেশের সব মহল থেকেই বলা হচ্ছে, প্রধান দুই দল, বিশেষ করে দুই নেত্রীর সংলাপের কোনো বিকল্প নেই।
শোনা যায়, আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয় দলকেই ধারণা দেওয়া হয়েছে, তারা সংলাপে বসে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হলে দেশে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠবে। আর এর সুযোগ নেবে অরাজনৈতিক তৃতীয় শক্তি। আবার দেশের চাকা উল্টা দিকে ঘুরবে। আবার দেশ পিছিয়ে পড়বে। বলা হয়ে থাকে, ২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেনের ঘটনা দেশকে বিশ বছর পিছিয়ে দিয়েছে।
আসলে ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। ওয়ান-ইলেভেনের ঘটনার পর দেশে কী ঘটেছিল! দেশ থমকে দাঁড়িয়েছিল। দুর্নীতিবিরোধী অভিযান পরিচালনার নামে দেশে রাজনীতিবিদদের দমনের যে অভিযান শুরু হয়েছিল, তা যদি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হতো, তাহলে দেশে রাজনীতি শব্দটিও উচ্চারণ করা নিষিদ্ধ হয়ে যেত। অথচ সেই করুণ অবস্থার কথাও আমাদের রাজনীতিবিদরা ভুলে গেছেন। ওয়ান-ইলেভেন থেকে শিক্ষা নিলে আজকের এ পরিস্থিতির উদ্ভব হতো না।
উভয় রাজনৈতিক দলেরই উপলব্ধি করা উচিত, আবার সেই ওয়ান-ইলেভেনের প্রেক্ষাপট তৈরির জন্য একটি পক্ষ বেশ তৎপর রয়েছে। টক-শো, আলোচনা, বৈঠকে তৃতীয় শক্তি আছে বলে ভয় দেখানো হচ্ছে। দুই প্রধান দলের নেত্রীদ্বয়ের মধ্যে সমঝোতা না হলেই বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করা হবে। তাই যেকোনো মূল্যে সমঝোতা হতেই হবে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.