গণিত শিক্ষার মান by ইলিয়াস উদ্দীন বিশ্বাস
মানবসভ্যতার প্রতিটি ক্ষেত্রেই গণিতের অবদান সর্বজনবিদিত। বিশেষ করে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রযাত্রায় গণিতের কোনো বিকল্প নেই। প্রকৃত গণিতচর্চার অভাবে আমাদের দেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রযাত্রায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় পিছিয়ে আছে। আমাদের দেশে জ্ঞানার্জন ক্রমান্বয়ে মুখস্থ বিদ্যার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
গণিতচর্চা শিক্ষার্থীদের মেধাকে শানিত করে অথচ বর্তমানে প্রকৃত গণিতচর্চা হয় না। এটাও আজ মুখস্থ বিদ্যায় পরিণত হয়েছে। এটা কেবল শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতাই নষ্ট করে না, তাদের মেধা বিকাশেও অন্তরায়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'শিক্ষার বাহনে' বলেন, 'মুখস্থ করিয়া পাস করাই তো চৌর্যবৃত্তি। যে ছেলে পরীক্ষাশালায় গোপনে বই লইয়া যায় তাকে খেদাইয়া দেওয়া হয়; আর যে ছেলে তার চেয়েও লুকাইয়া লয়, অর্থাৎ চাদরের মধ্যে না লইয়া মগজের মধ্যে লইয়া যায়, সেই বা কম কী করিল? অতএব যারা বই মুখস্থ করিয়া পাস করে তারা অসভ্য রকমে চুরি করে, অথচ সভ্যতার যুগে পুরস্কার পাইবে তারাই?' মাদকাসক্ত মানুষ যেমন সমাজের কোনো কাজে লাগে না, তেমনি চিন্তাশক্তি বিবর্জিত মুখস্থ বিদ্যার মাধ্যমে ডিগ্রিধারী মানুষও সমাজ ও দেশের তেমন কোনো কাজে লাগে না। তাই প্রথম থেকেই মুখস্থ বিদ্যার কবল থেকে শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করে প্রকৃত জ্ঞানার্জনে আগ্রহী করে গড়ে তুলতে হবে।
ব্রিটিশ আমলের শিক্ষাব্যবস্থাকে কেরানি তৈরির শিক্ষাব্যবস্থা বলে এর বহু সমালোচনা শুনেছি। অথচ সেই শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়েই স্যার জগদীশচন্দ্র বসু, স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, সত্যেন্দ্রনাথ বোস, মেঘনাথ সাহা প্রমুখ বিশ্বখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানীর আবির্ভাব ঘটে। স্যার জগদীশচন্দ্র বসু প্রমাণ করলেন উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে। তিনি ১৮৯৫ সালে কলকাতায় ঘোষণা দিলেন বিনা তারেই বাতাসের মধ্য দিয়ে রেডিও তরঙ্গ পাঠানোর যন্ত্র আবিষ্কারের কথা। কিন্তু এ বিষয়ে তাঁর পেটেন্ট না থাকায় ১৮৯৭ সালে রেডিও আবিষ্কার করে মার্কোনি পেয়ে যান আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। ভারতবর্ষের আধুনিক রসায়ন শিল্পের জনক স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায় আমাদের এ মাটির সন্তান। তাঁদেরই সুযোগ্য ছাত্র সত্যেন্দ্রনাথ বোস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিকস প্রবর্তন করেন। বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের সব কণাকে দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। যেসব কণা বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিকস মেনে চলে এদের বলা হয় বোসন। আর বাকি কণাকে বলা হয় ফার্মিয়ন। বোসন নামটি এসেছে সত্যেন্দ্রনাথ বোসের নাম থেকে। এ বছরের ৪ জুলাই সিএমএস এবং এটিএলএএস গবেষকদল স্বতন্ত্রভাবে ১৯৬৪ সালে পিটার হিগসের প্রস্তাবিত হিগস বোসন কণার অস্তিত্ব নিশ্চিত করেছেন। হিগস বোসন কণার অস্তিত্ব নিশ্চিত হওয়ায় বিশ্বময় শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে সত্যেন্দ্রনাথ বোসের নাম। 'সাহা তাপ আয়নায়ন' তত্ত্ব প্রবর্তন করে পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন ঢাকার ছেলে বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা। উভয়েই প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে গণিতে এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। পরাধীন জাতির এসব সন্তান সাফল্য অর্জন করলে স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও তাঁদের উত্তরসূরি আমাদের শিক্ষা ও গবেষণার মান আজ হতাশাব্যঞ্জক। এর কারণ বের করার জন্য কোনো গবেষণার প্রয়োজন পড়ে না। চারপাশে দৃষ্টি রেখে একটু চিন্তা করলেই শিক্ষার যে দৈন্যদশা তার প্রকৃত কারণ বের হয়ে আসে।
শিশুদের স্কুলমুখী ও শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী করে গড়ে তোলাই হচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। তা করতে শিক্ষকদের ভূমিকাই প্রধান। এ জন্য তাঁদের হতে হয় নিবেদিতপ্রাণ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিগ্রিধারী শিক্ষক থাকলেও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকের বড় অভাব। দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় প্রয়োজনের তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা অনেক কম। কর্মরত শিক্ষকদের শ্রেণীকক্ষে পাঠদান ছাড়াও অফিশিয়াল কাজ করতে হয়। শিক্ষার্থীদের যথেষ্ট সময় দেওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। তা ছাড়া একগাদা বই চাপিয়ে কোমলমতি শিশুদের ভারাক্রান্ত করা হয়। ফলে শিশুরা শিক্ষাকে আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ না করে ভীতির বিষয় বলে মনে করে। এতে শিশুর মেধা বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিটি স্তরেই প্রকৃত জ্ঞানার্জনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ মানবিক গুণাবলিও অর্জন করে। শিক্ষার্থীদের পরস্পরের মধ্যে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব, ভ্রাতৃত্ব ও মমত্ববোধ। তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে সততা, শৃঙ্খলাবোধ ও নিয়মানুবর্তিতা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে বর্তমানে শিক্ষার্থীরা বিশেষ করে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না গিয়ে প্রাইভেট টিউটরের কাছে ও কোচিং সেন্টারে গিয়ে ভিড় জমায়। কারণ হলো কম পরিশ্রমে বেশি নম্বর পাওয়া। একটি খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষার্থীকে তার কলেজের গণিত বিভাগের প্রধানের নাম জিজ্ঞেস করে উত্তর পেয়েছি, 'আমি তো হেড স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ি না, অন্য স্যারের কাছে পড়ি।' দেশের প্রায় প্রতিটি কলেজে একই চিত্র। আজকাল শিক্ষার্থীরা প্রতিটি বিষয়েই প্রাইভেট পড়ে। যেসব শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ে তাঁদের ছাড়া অন্য শিক্ষকদের চেনে না। ফলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে এমনকি শিক্ষার্থীদের নিজেদের মধ্যেও সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে না। তারা মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন হয় না, যা উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থিরতার অন্যতম কারণ। শিক্ষার্থীদের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে প্রকৃত শিক্ষার্জনের মাধ্যমে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য নিজেদের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হয়। সে জন্য শিক্ষকের সহযোগিতা প্রয়োজন; তবে শিক্ষার্থীদের পরনির্ভরশীল হলে চলবে না। পরনির্ভরশীলতার কারণেই শিক্ষার্থীরা আত্মশক্তি অর্জন করতে পারে না। প্রাইভেট টিউটর বা কোচিং সেন্টারের শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার সাজেশনভিত্তিক বাছাই করা সমস্যার সমাধান নিজ হাতে করে দেন। সমস্যা সমাধানের কোনো কৌশল না শিখে শিক্ষার্থীরা টিউটরের দেওয়া সমাধান বারবার চর্চার মাধ্যমে তা আয়ত্ত করে। কয়েক বছর আগে বিটিভিতে একজন শিক্ষককে 'টিভি কোচিং' নামক এক অনুষ্ঠানে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের জ্যামিতি প্রশিক্ষণ দিতে দেখেছি। প্রশিক্ষণের একপর্যায়ে তিনি বললেন, 'এ বছর পরীক্ষায় এই অধ্যায় থেকে ৩ নম্বর অথবা ৭ নম্বর উপপাদ্য পরীক্ষায় আসবে- কাজেই এ দুটি উপপাদ্য ছাড়া এ অধ্যায় থেকে আর কোনো উপপাদ্য শেখার প্রয়োজন নেই।' ৩ নম্বর অথবা ৭ নম্বর উপপাদ্য বুঝতে হলে যে অন্যান্য উপপাদ্য শেখার প্রয়োজন, তা কি তিনি জানেন না? বর্তমানে ওই শিক্ষকের নামে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে কোচিং সেন্টার গড়ে উঠেছে। এ প্লাস পাওয়ার শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে কোচিং সেন্টারগুলোর পোস্টার চোখে পড়ে বিভিন্ন শহরের দেয়ালে দেয়ালে। শিক্ষার্থীদের মনে শক্তি সঞ্চার করাই শিক্ষকের কাজ। অথচ তাদের মনে শক্তি সঞ্চার করার পরিবর্তে পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের নিশ্চয়তা দিয়ে অর্থ উপার্জনে ব্যস্ত থাকেন অনেকেই। শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার অর্থ হচ্ছে একটি আদর্শকে বেছে নেওয়া। অর্থ-বিত্তের আশায় শিক্ষকতাকে গ্রহণ করা উচিত নয়।
গৎবাঁধা প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করে পরীক্ষা নেওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা অনেক অধ্যায় সম্পর্কে কোনো জ্ঞানার্জন না করেই পূর্ণ নম্বরের উত্তর করার নিশ্চয়তা পায়। ফলে শিক্ষার্থীরা প্রায় অর্ধেক অধ্যায় বাদ দিয়ে থাকে। আর যে অধ্যায়গুলো পরীক্ষার জন্য বেছে নেই সেগুলো সাজেশনভিত্তিক পড়াশোনা করে। ফলে তাদের পরীক্ষায় গণিত বিষয়ের ফলাফল ভালো হলেও গণিতে প্রকৃত জ্ঞানার্জন হয় না। তাদের মেধার বিকাশ ঘটে না। এইচএসসি পরীক্ষায় গণিতে এ প্লাস পাওয়া অনেক শিক্ষার্থীকেও ভর্তি পরীক্ষায় গণিতে শূন্য পেতে দেখা গেছে। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা গণিতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য প্রকৃতভাবে উপযোগী হয় না। উচ্চশিক্ষার উপযোগী না হলেও যেহেতু অধিকাংশ শিক্ষার্থীর অবস্থা একই, কাজেই প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে তারা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম তাদের কাছে দুর্বোধ্য হয়ে দাঁড়ায়। পাঠক্রম দুর্বোধ্য থাকলেও তারা ক্লাসে প্রশ্ন করে তা বোঝার চেষ্টাও করে না। মোটকথা তারা ক্লাসে মনোযোগী হয় না। তারা লাইব্রেরিতে বইপুস্তক নিয়ে পড়াশোনা না করে ক্লাস নোট অথবা সিনিয়র ভাইদের কাছ থেকে নোট সংগ্রহ করে পড়াশোনা করে। প্রায় সব সমস্যার সমাধান করা থাকে এমন দেশি ও ভারতীয় বই পাওয়া যায়, যা ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনা করে। নিজে নিজে কোনো সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করে না। এখানেও অধিকাংশ শিক্ষার্থী প্রকৃত জ্ঞানার্জন না করে মুখস্থ করে পরীক্ষা পাসের মাধ্যমে ডিগ্রি অর্জন করে। ফলে শিক্ষার্থীরা নিজস্ব চিন্তাশক্তি বিবর্জিত হয়ে গড়ে ওঠে।
বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে জ্ঞান সৃষ্টি ও বিতরণের কেন্দ্র। একমাত্র গবেষণার মাধ্যমেই জ্ঞান সৃষ্টি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাই গবেষণা করে থাকেন। এ জন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের হতে হয় চিন্তাশক্তির অধিকারী ও আত্মপ্রত্যয়ী। এ ছাড়া প্রয়োজন মনোরম পরিবেশ ও গবেষণা উপকরণ। সবচেয়ে প্রতিভাবান বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছেন, 'জ্ঞানের চেয়ে চিন্তাশক্তি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জ্ঞান সীমিত আর চিন্তাশক্তি বিশ্বব্যাপী।' চিন্তাশক্তি বিবর্জিত মানুষের কাছ থেকে কোনোভাবেই উন্নতমানের গবেষণা আশা করা যায় না। দেশে শিক্ষিতের হার অর্থাৎ সংখ্যা বেড়েছে, তবে শিক্ষার মানের অবনতি ঘটেছে। এককভাবে কোনো একটি গ্রুপকে এর জন্য দায়ী করা যায় না। শিক্ষার মানোন্নয়ন বা অবনতি নির্ভর করে সরকার, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের ওপর। সরকারের শিক্ষা ক্ষেত্রের প্রতি উদাসীনতা, অভিভাবকদের অসচেতনতা, শিক্ষকদের দায়িত্বহীনতা ও শিক্ষার্থীদের পরনির্ভরশীলতা মূলত শিক্ষার মানের ক্রমাবনতির জন্য দায়ী। কলুষিত ছাত্ররাজনীতির কারণেও আমাদের শিক্ষার মানের ক্রমাবনতি ঘটেছে। অতীতে প্রতিটি ন্যায়সংগত দাবি আদায়ে ছাত্রসমাজের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে ব্যক্তিস্বার্থে ছাত্ররাজনীতি পরিচালিত হচ্ছে। শিক্ষক রাজনীতিও এর জন্য কম দায়ী নয়। গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞান সৃষ্টি এবং সেই গবেষণালব্ধ জ্ঞান শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে না পারলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে গুরুত্ব দেওয়ার ফলেই ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, জাপান প্রভৃতি দেশ উন্নয়নের শীর্ষে পৌঁছে গেছে। দেশের উন্নয়নের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তর থেকেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানার্জনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
পরীক্ষায় গৎবাঁধা প্রশ্ন দিয়ে পরীক্ষা নেওয়া বন্ধ করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। প্রাইভেট পড়ানো বন্ধ করে শিক্ষকদের ক্লাসে পড়ানোর জন্য মনোযোগী করতে হবে। এ জন্য অবশ্যই শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাড়ানো প্রয়োজন। কোচিং ব্যবসা বন্ধ করতে হবে। গণিতের তত্ত্ব শেখার পাশাপাশি এর প্রয়োগ শেখালে শিক্ষার্থীদের গণিত শেখাটাও মজার হবে।
লেখক : অধ্যাপক, গণিত বিভাগ ও কোষাধ্যক্ষ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
ব্রিটিশ আমলের শিক্ষাব্যবস্থাকে কেরানি তৈরির শিক্ষাব্যবস্থা বলে এর বহু সমালোচনা শুনেছি। অথচ সেই শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়েই স্যার জগদীশচন্দ্র বসু, স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, সত্যেন্দ্রনাথ বোস, মেঘনাথ সাহা প্রমুখ বিশ্বখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানীর আবির্ভাব ঘটে। স্যার জগদীশচন্দ্র বসু প্রমাণ করলেন উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে। তিনি ১৮৯৫ সালে কলকাতায় ঘোষণা দিলেন বিনা তারেই বাতাসের মধ্য দিয়ে রেডিও তরঙ্গ পাঠানোর যন্ত্র আবিষ্কারের কথা। কিন্তু এ বিষয়ে তাঁর পেটেন্ট না থাকায় ১৮৯৭ সালে রেডিও আবিষ্কার করে মার্কোনি পেয়ে যান আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। ভারতবর্ষের আধুনিক রসায়ন শিল্পের জনক স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায় আমাদের এ মাটির সন্তান। তাঁদেরই সুযোগ্য ছাত্র সত্যেন্দ্রনাথ বোস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিকস প্রবর্তন করেন। বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের সব কণাকে দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। যেসব কণা বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিকস মেনে চলে এদের বলা হয় বোসন। আর বাকি কণাকে বলা হয় ফার্মিয়ন। বোসন নামটি এসেছে সত্যেন্দ্রনাথ বোসের নাম থেকে। এ বছরের ৪ জুলাই সিএমএস এবং এটিএলএএস গবেষকদল স্বতন্ত্রভাবে ১৯৬৪ সালে পিটার হিগসের প্রস্তাবিত হিগস বোসন কণার অস্তিত্ব নিশ্চিত করেছেন। হিগস বোসন কণার অস্তিত্ব নিশ্চিত হওয়ায় বিশ্বময় শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে সত্যেন্দ্রনাথ বোসের নাম। 'সাহা তাপ আয়নায়ন' তত্ত্ব প্রবর্তন করে পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন ঢাকার ছেলে বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা। উভয়েই প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে গণিতে এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। পরাধীন জাতির এসব সন্তান সাফল্য অর্জন করলে স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও তাঁদের উত্তরসূরি আমাদের শিক্ষা ও গবেষণার মান আজ হতাশাব্যঞ্জক। এর কারণ বের করার জন্য কোনো গবেষণার প্রয়োজন পড়ে না। চারপাশে দৃষ্টি রেখে একটু চিন্তা করলেই শিক্ষার যে দৈন্যদশা তার প্রকৃত কারণ বের হয়ে আসে।
শিশুদের স্কুলমুখী ও শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী করে গড়ে তোলাই হচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। তা করতে শিক্ষকদের ভূমিকাই প্রধান। এ জন্য তাঁদের হতে হয় নিবেদিতপ্রাণ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিগ্রিধারী শিক্ষক থাকলেও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকের বড় অভাব। দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় প্রয়োজনের তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা অনেক কম। কর্মরত শিক্ষকদের শ্রেণীকক্ষে পাঠদান ছাড়াও অফিশিয়াল কাজ করতে হয়। শিক্ষার্থীদের যথেষ্ট সময় দেওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। তা ছাড়া একগাদা বই চাপিয়ে কোমলমতি শিশুদের ভারাক্রান্ত করা হয়। ফলে শিশুরা শিক্ষাকে আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ না করে ভীতির বিষয় বলে মনে করে। এতে শিশুর মেধা বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিটি স্তরেই প্রকৃত জ্ঞানার্জনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ মানবিক গুণাবলিও অর্জন করে। শিক্ষার্থীদের পরস্পরের মধ্যে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব, ভ্রাতৃত্ব ও মমত্ববোধ। তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে সততা, শৃঙ্খলাবোধ ও নিয়মানুবর্তিতা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে বর্তমানে শিক্ষার্থীরা বিশেষ করে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না গিয়ে প্রাইভেট টিউটরের কাছে ও কোচিং সেন্টারে গিয়ে ভিড় জমায়। কারণ হলো কম পরিশ্রমে বেশি নম্বর পাওয়া। একটি খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষার্থীকে তার কলেজের গণিত বিভাগের প্রধানের নাম জিজ্ঞেস করে উত্তর পেয়েছি, 'আমি তো হেড স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ি না, অন্য স্যারের কাছে পড়ি।' দেশের প্রায় প্রতিটি কলেজে একই চিত্র। আজকাল শিক্ষার্থীরা প্রতিটি বিষয়েই প্রাইভেট পড়ে। যেসব শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ে তাঁদের ছাড়া অন্য শিক্ষকদের চেনে না। ফলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে এমনকি শিক্ষার্থীদের নিজেদের মধ্যেও সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে না। তারা মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন হয় না, যা উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থিরতার অন্যতম কারণ। শিক্ষার্থীদের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে প্রকৃত শিক্ষার্জনের মাধ্যমে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য নিজেদের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হয়। সে জন্য শিক্ষকের সহযোগিতা প্রয়োজন; তবে শিক্ষার্থীদের পরনির্ভরশীল হলে চলবে না। পরনির্ভরশীলতার কারণেই শিক্ষার্থীরা আত্মশক্তি অর্জন করতে পারে না। প্রাইভেট টিউটর বা কোচিং সেন্টারের শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার সাজেশনভিত্তিক বাছাই করা সমস্যার সমাধান নিজ হাতে করে দেন। সমস্যা সমাধানের কোনো কৌশল না শিখে শিক্ষার্থীরা টিউটরের দেওয়া সমাধান বারবার চর্চার মাধ্যমে তা আয়ত্ত করে। কয়েক বছর আগে বিটিভিতে একজন শিক্ষককে 'টিভি কোচিং' নামক এক অনুষ্ঠানে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের জ্যামিতি প্রশিক্ষণ দিতে দেখেছি। প্রশিক্ষণের একপর্যায়ে তিনি বললেন, 'এ বছর পরীক্ষায় এই অধ্যায় থেকে ৩ নম্বর অথবা ৭ নম্বর উপপাদ্য পরীক্ষায় আসবে- কাজেই এ দুটি উপপাদ্য ছাড়া এ অধ্যায় থেকে আর কোনো উপপাদ্য শেখার প্রয়োজন নেই।' ৩ নম্বর অথবা ৭ নম্বর উপপাদ্য বুঝতে হলে যে অন্যান্য উপপাদ্য শেখার প্রয়োজন, তা কি তিনি জানেন না? বর্তমানে ওই শিক্ষকের নামে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে কোচিং সেন্টার গড়ে উঠেছে। এ প্লাস পাওয়ার শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে কোচিং সেন্টারগুলোর পোস্টার চোখে পড়ে বিভিন্ন শহরের দেয়ালে দেয়ালে। শিক্ষার্থীদের মনে শক্তি সঞ্চার করাই শিক্ষকের কাজ। অথচ তাদের মনে শক্তি সঞ্চার করার পরিবর্তে পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের নিশ্চয়তা দিয়ে অর্থ উপার্জনে ব্যস্ত থাকেন অনেকেই। শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার অর্থ হচ্ছে একটি আদর্শকে বেছে নেওয়া। অর্থ-বিত্তের আশায় শিক্ষকতাকে গ্রহণ করা উচিত নয়।
গৎবাঁধা প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করে পরীক্ষা নেওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা অনেক অধ্যায় সম্পর্কে কোনো জ্ঞানার্জন না করেই পূর্ণ নম্বরের উত্তর করার নিশ্চয়তা পায়। ফলে শিক্ষার্থীরা প্রায় অর্ধেক অধ্যায় বাদ দিয়ে থাকে। আর যে অধ্যায়গুলো পরীক্ষার জন্য বেছে নেই সেগুলো সাজেশনভিত্তিক পড়াশোনা করে। ফলে তাদের পরীক্ষায় গণিত বিষয়ের ফলাফল ভালো হলেও গণিতে প্রকৃত জ্ঞানার্জন হয় না। তাদের মেধার বিকাশ ঘটে না। এইচএসসি পরীক্ষায় গণিতে এ প্লাস পাওয়া অনেক শিক্ষার্থীকেও ভর্তি পরীক্ষায় গণিতে শূন্য পেতে দেখা গেছে। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা গণিতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য প্রকৃতভাবে উপযোগী হয় না। উচ্চশিক্ষার উপযোগী না হলেও যেহেতু অধিকাংশ শিক্ষার্থীর অবস্থা একই, কাজেই প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে তারা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম তাদের কাছে দুর্বোধ্য হয়ে দাঁড়ায়। পাঠক্রম দুর্বোধ্য থাকলেও তারা ক্লাসে প্রশ্ন করে তা বোঝার চেষ্টাও করে না। মোটকথা তারা ক্লাসে মনোযোগী হয় না। তারা লাইব্রেরিতে বইপুস্তক নিয়ে পড়াশোনা না করে ক্লাস নোট অথবা সিনিয়র ভাইদের কাছ থেকে নোট সংগ্রহ করে পড়াশোনা করে। প্রায় সব সমস্যার সমাধান করা থাকে এমন দেশি ও ভারতীয় বই পাওয়া যায়, যা ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনা করে। নিজে নিজে কোনো সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করে না। এখানেও অধিকাংশ শিক্ষার্থী প্রকৃত জ্ঞানার্জন না করে মুখস্থ করে পরীক্ষা পাসের মাধ্যমে ডিগ্রি অর্জন করে। ফলে শিক্ষার্থীরা নিজস্ব চিন্তাশক্তি বিবর্জিত হয়ে গড়ে ওঠে।
বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে জ্ঞান সৃষ্টি ও বিতরণের কেন্দ্র। একমাত্র গবেষণার মাধ্যমেই জ্ঞান সৃষ্টি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাই গবেষণা করে থাকেন। এ জন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের হতে হয় চিন্তাশক্তির অধিকারী ও আত্মপ্রত্যয়ী। এ ছাড়া প্রয়োজন মনোরম পরিবেশ ও গবেষণা উপকরণ। সবচেয়ে প্রতিভাবান বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছেন, 'জ্ঞানের চেয়ে চিন্তাশক্তি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জ্ঞান সীমিত আর চিন্তাশক্তি বিশ্বব্যাপী।' চিন্তাশক্তি বিবর্জিত মানুষের কাছ থেকে কোনোভাবেই উন্নতমানের গবেষণা আশা করা যায় না। দেশে শিক্ষিতের হার অর্থাৎ সংখ্যা বেড়েছে, তবে শিক্ষার মানের অবনতি ঘটেছে। এককভাবে কোনো একটি গ্রুপকে এর জন্য দায়ী করা যায় না। শিক্ষার মানোন্নয়ন বা অবনতি নির্ভর করে সরকার, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের ওপর। সরকারের শিক্ষা ক্ষেত্রের প্রতি উদাসীনতা, অভিভাবকদের অসচেতনতা, শিক্ষকদের দায়িত্বহীনতা ও শিক্ষার্থীদের পরনির্ভরশীলতা মূলত শিক্ষার মানের ক্রমাবনতির জন্য দায়ী। কলুষিত ছাত্ররাজনীতির কারণেও আমাদের শিক্ষার মানের ক্রমাবনতি ঘটেছে। অতীতে প্রতিটি ন্যায়সংগত দাবি আদায়ে ছাত্রসমাজের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে ব্যক্তিস্বার্থে ছাত্ররাজনীতি পরিচালিত হচ্ছে। শিক্ষক রাজনীতিও এর জন্য কম দায়ী নয়। গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞান সৃষ্টি এবং সেই গবেষণালব্ধ জ্ঞান শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে না পারলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে গুরুত্ব দেওয়ার ফলেই ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, জাপান প্রভৃতি দেশ উন্নয়নের শীর্ষে পৌঁছে গেছে। দেশের উন্নয়নের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তর থেকেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানার্জনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
পরীক্ষায় গৎবাঁধা প্রশ্ন দিয়ে পরীক্ষা নেওয়া বন্ধ করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। প্রাইভেট পড়ানো বন্ধ করে শিক্ষকদের ক্লাসে পড়ানোর জন্য মনোযোগী করতে হবে। এ জন্য অবশ্যই শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাড়ানো প্রয়োজন। কোচিং ব্যবসা বন্ধ করতে হবে। গণিতের তত্ত্ব শেখার পাশাপাশি এর প্রয়োগ শেখালে শিক্ষার্থীদের গণিত শেখাটাও মজার হবে।
লেখক : অধ্যাপক, গণিত বিভাগ ও কোষাধ্যক্ষ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
No comments