ইউ পম গানা? by মাহবুব মোর্শেদ

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ব্লগে বাংলা সিনেমার নায়ক এম এ জলিল অনন্তকে নিয়ে বিপুল হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছে। ঘটনার সূত্রপাত একটি বাংলা টিভি চ্যানেলে অনন্তর সাক্ষাৎকার থেকে। বিগ বাজেটের সিনেমা করে অনন্ত আলোচনায় এসেছেন।


এর আগে নির্মাণ করেছেন 'খোঁজ_ দ্য সার্চ', সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে আরেকটি সিনেমা 'মোস্ট ওয়েলকাম'। নায়ক হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতা শোনাতে গিয়ে টিভি সাক্ষাৎকারে অনন্ত শোনাচ্ছিলেন তার অভিজ্ঞতার কথা। রাজধানীর দামি রেস্টুরেন্টে খাবার খেতে গিয়ে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন অনন্ত। সেখানে খেতে আসা উচ্চবিত্তের আধুনিক ছেলে-মেয়েরা অনন্তকে দেখিয়ে বলেন, ওই দেখ বাংলা সিনেমার নায়ক। বলাবাহুল্য, তাকে দেখেই হাস্যরসের আবহ সৃষ্টি হয়। অনন্ত হাসিরস হজম না করে তাদের দিকে এগিয়ে যান। তাদের উদ্দেশে যা বলেন তা মোটামুটি এইরকম_ ইউ পম গানা? ইউ লিভ বাংলাদেশ, ইউ ইট ফুড ইন বাংলাদেশ, ম্যান ইউ হ্যাভ টু রেসপেক্ট ইন বাংলাদেশ। অনন্ত বলতে চেয়েছেন, তোমরা কি ঘানা থেকে এসেছো? তোমরা বাংলাদেশে থাকো, এখানকার খাবার খাও। বাংলাদেশের প্রতি তোমাদের শ্রদ্ধাবোধ থাকা উচিত। খানিকটা ভুল ও বিচিত্র ইংরেজি উচ্চারণের কারণে সাক্ষাৎকারটি হাস্যরসের জন্ম দেয়। প্রযুক্তির কল্যাণে ইউটিউব, ফেসবুক, ব্লগ মারফত ছড়িয়ে যায়। মুখে মুখে ফিরতে থাকে, ইউ পম গানা? কাউকে পরিহাস করতে এখন হামেশা এই ডায়লগ ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনকি বুয়েটের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা উপাচার্যকে পরিহাস করতে অনন্তের ডায়লগ লেখা প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেছেন বলে খবর বেরিয়েছে। অনন্তকে নিয়ে নানামুখী আলোচনা চলছে, ফান ম্যাগাজিন-কার্টুনের বিষয় হয়েছেন অনন্ত। সঙ্গে অবশ্য কেউ কেউ এ প্রশ্নও তুলছেন, এত হাস্যরসের কারণ কী? ভুল ইংরেজিতে কথা বললেই কি হাসতে হবে? নাকি বাংলা সিনেমার নায়ক বলেই তিনি ভুল বলতে পারবেন না? অবশ্য বাংলা সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের নিয়ে হাস্যরস তৈরির ঘটনা এই প্রথম নয়। মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তের দর্শকরা সাধারণত সিনেমা হলে এফডিসিতে তৈরি বাংলা সিনেমা দেখতে যান না। কেন যান না তার কারণ স্পষ্ট। এই ভোক্তাদের দিকে লক্ষ্য রেখে সিনেমা তৈরি হয় না। ফলে এই শ্রেণীগুলোর সঙ্গে বাংলা সিনেমার এ ধরনের অপরিচয় ও দূরত্ব তৈরি হয়েছে। সে দূরত্ব সত্ত্বেও বাংলা সিনেমার নায়ক-নায়িকারা জনপ্রিয় হচ্ছেন। গরিব সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হচ্ছে। সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা খারাপ। ব্যবসা কমে যাচ্ছে। তবু সিনেমা তৈরি হচ্ছে_ গরিবের বিনোদনের জন্য। মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তের বিনোদনের জগৎ ভিন্ন। বাংলা সিনেমার প্রতি তাদের প্রত্যাখ্যান সহজাত, হাস্যরসও স্বাভাবিক। বাংলা সিনেমার নায়করা জোরে কথা বলেন কেন, নায়িকারা এত মোটা হন কেন, এসব প্রশ্ন ওঠে। সিনেমার নানা গৎবাঁধা ডায়ালগ নিয়েও হাসিঠাট্টা হয়। ফলে অনন্তর প্রতি এই হাস্যরস নতুন নয়। তবে হাস্যরসের ব্যাপ্তিটা লক্ষ্য করার মতো। বাংলা সিনেমার প্রতি বিরাগের পাশাপাশি এই হাসির পেছনে আছে ভাষার শুদ্ধতার জন্য এক ধরনের আহাজারি। বাংলা সিনেমার নায়ক ইংরেজি ডায়লগ কেন দেবে তাও ভুলভাল ইংরেজিতে? বলাবাহুল্য, ভুল ইংরেজিকে এখানে অন্যতম অপরাধ হিসেবে দেখা হচ্ছে। কেউ যদি ভারতীয় লোকসভার অধিবেশন শোনেন, কিংবা ভারতের টিভি চ্যানেলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ বিভিন্ন নেতাদের সাক্ষাৎকার দেখেন তবে বুঝবেন তারা অকপটে কত ভুলভাল ইংরেজি দিয়ে কাজ চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। ভারতে ইংরেজিকে অস্বীকার করার উপায় নেই। সেখানে সেটি যোগাযোগের ভাষা। ফলে না জানলেও বলতে হবে, শিখে নিতে হবে। নতুন প্রজন্মগুলো সেখানে স্বচ্ছন্দে ইংরেজি বলে। শুধু বলে না, ইংরেজিতে লেখে, পড়েও। পূর্বপ্রজন্মের ভুলভাল ইংরেজির ওপর দাঁড়িয়ে আছে পরের প্রজন্মের এই স্মার্ট ইংরেজি। বৈশ্বিক কমিউনিকেশনের জন্য আমরাও ইংরেজির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু নতুন প্রজন্মগুলো এখানে ইংরেজিতে কতটা দক্ষ? যারা অনন্তকে নিয়ে হাসাহাসি করছেন তাদের সবাই ভালো ইংরেজি বলেন তা তো নয়। কিন্তু অধিকাংশই ইংরেজি বলতে সংকোচ বোধ করেন, যদি ভুল হয়ে যায়। কিন্তু এক প্রজন্ম ভুল না বললে পরের প্রজন্ম সঠিক বলবে কী করে?
 

No comments

Powered by Blogger.