বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৪২৫ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। শহীদ উল্লাহ, বীর প্রতীক সাহসী যোদ্ধা শীতকাল। রাতে মাঠ-প্রান্তর কুয়াশাচ্ছন্ন এবং অন্ধকার। তীব্র শীত, অন্ধকার ও কুয়াশার বাধা উপেক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে যেতে থাকলেন সামনে।
তাঁরা কয়েকটি দলে বিভক্ত। একটি দলে আছেন শহীদ উল্লাহ। রাত আনুমানিক ১১টা। তাঁরা সমবেত হলেন সিঙ্গারবিলের অদূরে।
চারদিক নিস্তব্ধ। মাঝেমধ্যে ভেসে আসছে ঝিঁঝি পোকার ডাক। একটু পর নির্ধারিত সময়েই (রাত ১১টা ৪৫ মিনিট) পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থানে শুরু হলো গোলাবর্ষণ। এই গোলা আসছে তাঁদের পেছন থেকে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর গোলন্দাজ ব্যাটারি সীমান্ত থেকে দূরপাল্লার কামানের গোলাবর্ষণ করছে। এর প্রচণ্ডতা ও তীব্রতা এমন যে, মুক্তিযোদ্ধাদের পায়ের নিচের মাটি কেঁপে উঠছে। বিকট শব্দে কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার উপক্রম।
গোলাবর্ষণের সহায়তায় শহীদ উল্লাহ এবং তাঁর সহযোদ্ধারা আবার এগিয়ে যেতে থাকলেন। তাঁদের লক্ষ্য সিঙ্গারবিল রেলস্টেশন দখল করা। একটু পর তাঁরা পৌঁছে গেলেন লক্ষ্যস্থলের আনুমানিক ৪০০ গজ দূরে। তখন পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে সীমান্ত এলাকা থেকে গোলাবর্ষণ বন্ধ হয়ে গেল। এদিকে ব্যাপক গোলাবর্ষণে পাকিস্তানি সেনারা ভীতসন্ত্রস্ত। তাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান প্রায় তছনছ। এই সুযোগে মুক্তিযোদ্ধারা ঝাঁপিয়ে পড়লেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপর।
নিমেষে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে শুরু হয়ে গেল মেশিনগান, এলএমজি আর রাইফেলের অবিরাম গোলাগুলি।
কুয়াশা আর শীতের মধ্যে যুদ্ধ করা বেশ কষ্ট। সব উপেক্ষা করে শহীদ উল্লাহ ও তাঁর সহযোদ্ধারা সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকলেন। তাঁদের সাহসিকতায় হতোদ্যম পাকিস্তানি সেনারা ভোররাতে পালিয়ে গেল। মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে এল সিঙ্গারবিল।
এরপর মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে যেতে থাকলেন আজমপুর রেলস্টেশন অভিমুখে। তুমুল যুদ্ধের পর বিকেলের মধ্যে আজমপুর রেলস্টেশনও তাঁরা দখল করে ফেললেন। সেখানে থাকা পাকিস্তানি সেনারাও বিপুল ক্ষয়ক্ষতির মুখে তখন পালিয়ে গেল।
মধ্যরাতে পরিশ্রান্ত মুক্তিযোদ্ধারা কেউ ঘুমিয়ে, কেউ জেগে। এমন সময় হঠাৎ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পাল্টা আক্রমণ। পুনঃসংগঠিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ বেশ জোরালো। মুক্তিযোদ্ধারা বিক্রমের সঙ্গে যুদ্ধ করেও ব্যর্থ হলেন। আজমপুর রেলস্টেশন তাঁদের হাতছাড়া হয়ে গেল।
মুক্তিযোদ্ধারা এতে মনোবল হারালেন না। পরদিন পুনঃসংগঠিত হয়ে আক্রমণ চালালেন সেখানে। তুমুল যুদ্ধের পর আবার দখল করলেন আজমপুর রেলস্টেশন। পাকিস্তানি সেনারা একেবারে পালিয়ে গেল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে। এ ঘটনা ১৯৭১ সালের ১ থেকে ৩ ডিসেম্বর।
শহীদ উল্লাহ চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। ১৯৭১-এ এই রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল জয়দেবপুরে। তখন তাঁর পদবি ছিল ল্যান্স নায়েক। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেওয়ার পর প্রথমে ৩ নম্বর সেক্টরে, পরে ‘এস’ ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য শহীদ উল্লাহকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১০৯।
শহীদ উল্লাহ স্বাধীনতার পর পর্যায়ক্রমে হাবিলদার পদে উন্নীত হয়ে অবসর নেন। ২০০২ সালে মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ফরদাবাদ গ্রামে। তাঁর বাবার নাম আবদুল জলিল। মা আমেনা বেগম। স্ত্রী শায়েস্তা বেগম। তাঁদের দুই মেয়ে, এক ছেলে।
সূত্র: প্রথম আলোর বাঞ্ছারামপুর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি এম মনিরুল ইসলাম এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
চারদিক নিস্তব্ধ। মাঝেমধ্যে ভেসে আসছে ঝিঁঝি পোকার ডাক। একটু পর নির্ধারিত সময়েই (রাত ১১টা ৪৫ মিনিট) পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থানে শুরু হলো গোলাবর্ষণ। এই গোলা আসছে তাঁদের পেছন থেকে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর গোলন্দাজ ব্যাটারি সীমান্ত থেকে দূরপাল্লার কামানের গোলাবর্ষণ করছে। এর প্রচণ্ডতা ও তীব্রতা এমন যে, মুক্তিযোদ্ধাদের পায়ের নিচের মাটি কেঁপে উঠছে। বিকট শব্দে কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার উপক্রম।
গোলাবর্ষণের সহায়তায় শহীদ উল্লাহ এবং তাঁর সহযোদ্ধারা আবার এগিয়ে যেতে থাকলেন। তাঁদের লক্ষ্য সিঙ্গারবিল রেলস্টেশন দখল করা। একটু পর তাঁরা পৌঁছে গেলেন লক্ষ্যস্থলের আনুমানিক ৪০০ গজ দূরে। তখন পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে সীমান্ত এলাকা থেকে গোলাবর্ষণ বন্ধ হয়ে গেল। এদিকে ব্যাপক গোলাবর্ষণে পাকিস্তানি সেনারা ভীতসন্ত্রস্ত। তাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান প্রায় তছনছ। এই সুযোগে মুক্তিযোদ্ধারা ঝাঁপিয়ে পড়লেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপর।
নিমেষে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে শুরু হয়ে গেল মেশিনগান, এলএমজি আর রাইফেলের অবিরাম গোলাগুলি।
কুয়াশা আর শীতের মধ্যে যুদ্ধ করা বেশ কষ্ট। সব উপেক্ষা করে শহীদ উল্লাহ ও তাঁর সহযোদ্ধারা সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকলেন। তাঁদের সাহসিকতায় হতোদ্যম পাকিস্তানি সেনারা ভোররাতে পালিয়ে গেল। মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে এল সিঙ্গারবিল।
এরপর মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে যেতে থাকলেন আজমপুর রেলস্টেশন অভিমুখে। তুমুল যুদ্ধের পর বিকেলের মধ্যে আজমপুর রেলস্টেশনও তাঁরা দখল করে ফেললেন। সেখানে থাকা পাকিস্তানি সেনারাও বিপুল ক্ষয়ক্ষতির মুখে তখন পালিয়ে গেল।
মধ্যরাতে পরিশ্রান্ত মুক্তিযোদ্ধারা কেউ ঘুমিয়ে, কেউ জেগে। এমন সময় হঠাৎ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পাল্টা আক্রমণ। পুনঃসংগঠিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ বেশ জোরালো। মুক্তিযোদ্ধারা বিক্রমের সঙ্গে যুদ্ধ করেও ব্যর্থ হলেন। আজমপুর রেলস্টেশন তাঁদের হাতছাড়া হয়ে গেল।
মুক্তিযোদ্ধারা এতে মনোবল হারালেন না। পরদিন পুনঃসংগঠিত হয়ে আক্রমণ চালালেন সেখানে। তুমুল যুদ্ধের পর আবার দখল করলেন আজমপুর রেলস্টেশন। পাকিস্তানি সেনারা একেবারে পালিয়ে গেল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে। এ ঘটনা ১৯৭১ সালের ১ থেকে ৩ ডিসেম্বর।
শহীদ উল্লাহ চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। ১৯৭১-এ এই রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল জয়দেবপুরে। তখন তাঁর পদবি ছিল ল্যান্স নায়েক। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেওয়ার পর প্রথমে ৩ নম্বর সেক্টরে, পরে ‘এস’ ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য শহীদ উল্লাহকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১০৯।
শহীদ উল্লাহ স্বাধীনতার পর পর্যায়ক্রমে হাবিলদার পদে উন্নীত হয়ে অবসর নেন। ২০০২ সালে মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ফরদাবাদ গ্রামে। তাঁর বাবার নাম আবদুল জলিল। মা আমেনা বেগম। স্ত্রী শায়েস্তা বেগম। তাঁদের দুই মেয়ে, এক ছেলে।
সূত্র: প্রথম আলোর বাঞ্ছারামপুর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি এম মনিরুল ইসলাম এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments