সুশাসন-সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার বিপদ by জিয়াউদ্দিন তারেক আলী

'৭১-উত্তর বাংলাদেশের গায়ে যদি সাম্প্রদায়িকতার কালিমা একবার লেগে যায়, তবে সেই কালিমা মুছে ফেলতে আরও অর্ধশতাব্দী লেগে যাবে_ যেমনটি দেখছি আমরা গুজরাটে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এর পরিণাম হবে ভয়াববর্তমান সরকারের ইতিবাচক পদক্ষেপগুলোর প্রথমটি হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার।


একাত্তরে পাকিস্তানি প্ররোচনায় ৩০ লাখ মানুষকে বিনা দোষে, বিনা বিচারে হত্যা ছাড়াও বাংলার শাশ্বত এবং অসাম্প্রদায়িক যে জীবনধারা, তার মোড় ঘুরিয়ে দিতে চেয়েছিল তারা। এই সংস্কৃতির হননকেও জেনোসাইড হিসেবে গণ্য করা যায়। ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে যদি গণতান্ত্রিক এবং জবাবদিহিতার বাংলাদেশ হিসেবে দাঁড়াতে হয় তবে এই জেনোসাইডের বিচার ৪২ বছর পর হলেও করতেই হবে। বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত বিচারক এবং আইনজীবীরা যে কতটা অযোগ্য তা প্রমাণ করার জন্যও ১৮ দলের কলাকুশলী এবং বিদেশি সাহায্যপুষ্ট কনসালট্যান্ট প্যানেল উঠেপড়ে লেগেছে। কিন্তু নুরেমবার্গ এবং টোকিও ট্রাইব্যুনাল ছাড়া অন্যান্য ট্রাইব্যুনালের তুলনায় আমাদের ট্রাইব্যুনাল পেশাগত দক্ষতা এবং সক্ষমতার যে প্রমাণ সম্প্রতি রাখতে শুরু করেছেন, সে তথ্যও জনসাধারণকে জানানো দরকার। এতকিছু সত্ত্বেও আমরা ভাগ্যবান যে, ১৮ দলীয় জোট এ কারণে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে পারবে না। তাছাড়া এই বিচার ঠেকানোর প্রধান পৃষ্ঠপোষক পাকিস্তান নিজেই নাজুক অবস্থায় রয়েছে এবং এর জন্য বাংলাদেশে অন্তর্ঘাতমূলক কোনো কর্মকাণ্ডে সে আর্থিক, নৈতিক বা বাস্তব সমর্থন দিতে সাহস পাবে না। আর পাকিস্তানের নেটওয়ার্ক ব্যতিরেকে আরব বিশ্বের সমর্থন বাংলাদেশে ফলপ্রসূভাবে বিতরণ করাও সম্ভব নয়। তাই ১৮ দলীয় জোট তাদের চরম অস্ত্রটি প্রয়োগ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে ধারণা করা যায়। সাম্প্রদায়িকতাই হলো তাদের সেই চরম অস্ত্র। এর আলামত আমরা হাটহাজারী, সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ, জামালপুর এবং নাটোরে ইতিমধ্যেই দেখেছি এবং সেখানে যে ভাড়াটে দল ব্যবহার করেই সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটানোর চেষ্টা চালানো হয়েছিল, সেটা এখন সাধারণেরও জানা। তাই দেশের নাগরিক সামাজের উচিত হবে বাংলাদেশের প্রতিটি স্কুল-কলেজে আগামী এক-দুই মাস ধরে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের কথা এবং ঐতিহাসিকভাবে তার সর্বমতসহিষ্ণুতার কথা জোর দিয়ে প্রচার করা। এমনকি সরকারও যদি একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে এ কাজটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রচার করতে বলে, তবে দোষের কিছু হবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, '৭১-উত্তর বাংলাদেশের গায়ে যদি সাম্প্রদায়িকতার কালিমা একবার লেগে যায়, তবে সেই কালিমা মুছে ফেলতে আরও অর্ধশতাব্দী লেগে যাবে_ যেমনটি দেখছি আমরা গুজরাটে। যেহেতু আমরা অনিবার্যভাবে একটি গ্গ্নোবালাইজড সমাজের দিকে ধাবিত হচ্ছি, সে কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এর পরিণাম হবে ভয়াবহ। তখন সুদীর্ঘকালের জন্য আমরা আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে হয়ে পড়ব। দেশে বিদেশি সহায়তা, বিনিয়োগ সীমিত হয়ে যাবে এবং দেশের উন্নয়ন কার্যক্রমও গতি হারাবে। বাংলাদেশকে আগামী দশ-পনের বছরের মধ্যে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করাটা স্বপ্নই থেকে যাবে।
এদিকে কয়েক দিন আগেই 'স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর'-এর যে 'ইকোনমিক ইন্ডিকেটর' প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশকে এশিয়ার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় চারটি দেশের একটি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং অন্য একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, গার্মেন্ট শিল্প আগামী ৫ বছরে দ্বিগুণ হয়ে যাবে, যার প্রধান কারণ হচ্ছে বিদ্যুতের ঘাটতি আগামী এক বছরের মধ্যেই কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসবে।
নতুন কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার এবং কৃষি-ইনপুট সঠিক সরবরাহের ফলে ২৫ কোটি মানুষ নিয়েও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া যে বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব, সেই আশার আলো বর্তমান সরকার দেখাতে পেরেছে। তবে খাদ্যশস্যের উপযুক্ত মূল্য যাতে কৃষকের কাছেই যায় সে ব্যবস্থা অবশ্যই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করতে হবে।
দেশের প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পাঠ্যক্রমের মধ্যে এই প্রথমবারের মতো যে পরিবর্তনের সূচনা সবেমাত্র শুরু হচ্ছে, সেখানে একুশ শতকের বাস্তবতানির্ভর, নিয়মানুবর্তী মানসিকতা গড়ার ব্যাপারে সহায়ক, বিজ্ঞানমনস্ক, বিশ্লেষণমনস্ক এবং আধুনিক জনগোষ্ঠী গড়ে উঠবে। এ কাজটি সম্পন্ন করতে পারলে একটি আলোকিত এবং ভবিষ্যৎমুখী সমাজ গড়ে উঠবে এবং সেদিন মহাজোট বা আওয়ামী লীগ সরকারে না থাকলেও চলবে। তখন কারও আর সাধ্য থাকবে না দেশের ভবিষ্যৎকে তালেবানি পথে পরিচালিত করা। ভারতে কংগ্রেসের ভূমিকা আজ সংকুচিত হয়ে গেলেও ভারতীয় সমাজ যেভাবে ৬৫ বছর আগে কংগ্রেসের আদর্শিক ভিত্তিগুলোর ওপর ভর করে এগিয়ে যাচ্ছে, আমাদের দেশেও তাই হবে।
তবে আমাদের সব অর্জনই ম্লান হয়ে যাবে, যদি দেশে ওত পেতে থাকা সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী হাঙ্গামা সৃষ্টিতে সফল হয়। তাই প্রাণপণে তাদের ভিত্তি ধ্বংস করে দেওয়া এ মুহূর্তে আমাদের প্রধান কর্তব্য বলে মনে করছি।

জিয়াউদ্দিন তারেক আলী : যুগ্ম সমন্বয়ক, সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গিবাদবিরোধী মঞ্চ
 

No comments

Powered by Blogger.