চার দিক-‘কার কাছোত যামো হামরা?’ by মোছাব্বের হোসেন
‘সোয়াত্তুরের বান দেকচি, সাতাশির বানও দেকচি, কিন্তু এমন বান আর দেখি নাই। এইবারের মতো কোনোবার এত বেশি ভাঙ্গে নাই। এবার ঈদ-ছিন্নি কিচুই নাই, হামার ঈদ বানের পানিত ভাসি গেইচে বাহে...।’ কথাগুলো বন্যায় নদীভাঙা সোবহান আলীর।
লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার সিন্দুর্না ইউনিয়নের আশপাশে এবারও ভয়াবহ ছোবল হেনেছে তিস্তা নদী। তার রুদ্র মূর্তিতে ভাঙনের কবলে পড়েছে এ এলাকার শতাধিক পরিবার। এলাকায় যেতেই চোখে পড়ল নদীভাঙা মানুষের করুণ অবস্থা। রমজান মাসের শুরু থেকেই এই এলাকায় নদীসংলগ্ন ঘড়বাড়ি ভাঙতে শুরু করেছে এবার। ভাঙছে এখনো। তবে এ এলাকার মানুষ বলছে, এবারের ভাঙন অতীতের সব রেকর্ড হার মানিয়েছে।
‘সইন্দায় বাড়ির সামনে হাঁটুপানি, সকাল হইলে নামি যাইবে এই মনে করি ঘুম গেচি। হটাৎ রাইত তিনটায় ঘুম ভাঙ্গি গেল। দেখি চকির কাছোত পানি। এরপর তারাতারি কোনোমতে উচাত উটি জীবনটা বাঁচাইচি।’ নিজের ঘর বন্যার পানিতে ভেসে যাওয়ার করুণ অভিজ্ঞতার কথা এভাবেই বলছিলেন সিন্দুর্নার বাসিন্দা আবদুল কাদের। এক রাতের মধ্যে নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় তাঁর মতো অনেকের দশাই এমন হয়েছে এবার।
চোখের সামনেই নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে এ এলাকার মানুষের বসতবাড়ি, গৃহপালিত পশুপাখি, আবাদি জমিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক কিছু। ঘরভাঙা সেসব মানুষের করুণ আর্তনাদ সামনে থেকে দেখলে বুকটা শুধু হাহাকার করে ওঠে। নিজের ঘর নদীতে ভেঙে ডুবে যাওয়ার দৃশ্য দেখে নাতিকে কোলে নিয়ে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছিলেন আহিমন বেগম নামের এক বৃদ্ধা। তাঁর বোবাকান্নার সঙ্গে শামিল হয়ে তাঁর দুই পুত্রবধূ শেফালি আর আজিমাও অঝোরে কাঁদছেন।
এবারের নদীভাঙন এমন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে এখানকার মানুষ কল্পনাও করতে পারেনি ভাঙন এত দূর পর্যন্ত আসবে। ঘরবাড়ির সঙ্গে ভাঙছে বিস্তীর্ণ বাঁশঝাড় আর প্রকাণ্ড গাছপালা। আধঘণ্টা আগেও যেখানে মানুষের স্বাভাবিক বিচরণ ছিল, সে জায়গাটিও এখন নদীগর্ভে চলে গেছে। আর যাদের খড়ের ঘর তারা যতটা পেরেছে প্রয়োজনীয় জিনিস উদ্ধার করেছে ঘরের মায়া না করে। কিন্তু যাদের টিনের চালওয়ালা বাড়ি তারা পড়েছে উভয় সংকটে। পানিতে প্রায় ডুবে যাওয়া এই ঘর উদ্ধার করতে দরকার পড়ছে বড় নৌকার। আর সুযোগ বুঝে নৌকার মালিকেরাও চড়া দাম হাঁকাচ্ছে। একেকটি ঘর পরিবহনে নিচ্ছে দুই থেকে তিন হাজার টাকা। একে তো সবকিছু নদীতে ডুবে যাচ্ছে, তার ওপর আবার এত টাকা!
তাই এমন অনেকেই আছে যারা সবকিছু নিয়তির হাতে ছেড়ে দিয়ে টাকার অভাবে নিজের ঘরের চালটিও রেখে চলে যাচ্ছে অন্যত্র। অনেকেই জানে এ সময় নদীর হানা দেওয়ার কথা, কিন্তু যেতে চাইলেই তো আর যেতে পারে না। নদীভাঙা এই এলাকার জমি কিনতে চায় না অন্য মানুষ। আর তাই এখানকার মানুষের অন্যত্র চলে যেতে হলে জমির মায়া ত্যাগ করেই যেতে হয়, যা অধিকাংশ মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। ঘর আগে ভেঙেছে এমন ৫০ থেকে ৬০টি পরিবার মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে বেছে নিয়েছে পাশের স্কুলমাঠ। সেখানে এখন মানুষ আর মানুষ। তাই নতুন করে যারা ঘর হারাচ্ছে, তাদের ছুটতে হচ্ছে অনেকটা অনিশ্চয়তা নিয়ে। নদীভাঙনের শিকার মানুষদের সঙ্গে কথা বলার সময় চার দিক থেকে মানুষ এসে ভিড় করে আমাদের সামনে। গোল করে ঘিরে রাখে। সেই মানুষদের ঠেলেও সামনে আসার চেষ্টা করে কেউ কেউ। তারা ভেবেছে, আমরা ত্রাণ নিয়ে এসেছি। স্বপ্নভঙ্গ হওয়া এই মানুষগুলোর মলিন মুখের দিকে খুব বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। খুব কষ্ট হয়। ঘরহারা এই মানুষগুলো তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে এখন প্রায়ই অনাহার বা অর্ধাহারে দিন পার করছে। এই অঞ্চলগুলোতে এখন কাজেরও বড্ড অভাব। জমিজমা আর আবাদি ফসল নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে আগেই। কোথাও কোনো কাজ নেই। একবেলা পেটে দানাপানি পড়বে কি না তারও নিশ্চয়তা নেই। যারা কিছুদিন আগেও বেশ সচ্ছল ছিল, তারা আজ নিঃস্বপ্রায়। কিন্তু চক্ষুলজ্জার ভয়ে মানুষের কাছে গিয়ে হাত পাততেও পারে না তারা। স্বভাবতই এবারের ঈদ এই মানুষগুলোর কাছে আনন্দের ছিল না। প্রতিনিয়ত এক দুঃস্বপ্ন তাড়া করছে তাদের। ‘বাড়ি থাইকলে রিদের (ঈদের) দিন সেমাই, মাছ-মাংস রান্না করনু হয়। ছোয়াগুলা (বাচ্চা) নতুন কাপড় পিন্দিল হয়। এবার কিছুই কইরবার পানু না।’ নিজেদের দুর্দশার কথাগুলো বলতে বলতে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে ছোরতন বেগমের। এমন ঈদ যে তাঁর জীবনে আসবে সে কথা কখনো কল্পনাও করেননি তিনি। আর সে জন্যই তো নিজের ভাগ্যের ঘাড়ে দোষ চাপান আর একহাত কপালে দিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে বিলাপ করে বলতে থাকেন, ‘হামার কপাল বড় খারাপ যে... হামার এলা কী হইবে? কার কাছোত যামো হামরা?’
ছোরতন বেগমের এই প্রশ্নগুলোর উত্তর মেলে না।
‘সইন্দায় বাড়ির সামনে হাঁটুপানি, সকাল হইলে নামি যাইবে এই মনে করি ঘুম গেচি। হটাৎ রাইত তিনটায় ঘুম ভাঙ্গি গেল। দেখি চকির কাছোত পানি। এরপর তারাতারি কোনোমতে উচাত উটি জীবনটা বাঁচাইচি।’ নিজের ঘর বন্যার পানিতে ভেসে যাওয়ার করুণ অভিজ্ঞতার কথা এভাবেই বলছিলেন সিন্দুর্নার বাসিন্দা আবদুল কাদের। এক রাতের মধ্যে নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় তাঁর মতো অনেকের দশাই এমন হয়েছে এবার।
চোখের সামনেই নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে এ এলাকার মানুষের বসতবাড়ি, গৃহপালিত পশুপাখি, আবাদি জমিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক কিছু। ঘরভাঙা সেসব মানুষের করুণ আর্তনাদ সামনে থেকে দেখলে বুকটা শুধু হাহাকার করে ওঠে। নিজের ঘর নদীতে ভেঙে ডুবে যাওয়ার দৃশ্য দেখে নাতিকে কোলে নিয়ে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছিলেন আহিমন বেগম নামের এক বৃদ্ধা। তাঁর বোবাকান্নার সঙ্গে শামিল হয়ে তাঁর দুই পুত্রবধূ শেফালি আর আজিমাও অঝোরে কাঁদছেন।
এবারের নদীভাঙন এমন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে এখানকার মানুষ কল্পনাও করতে পারেনি ভাঙন এত দূর পর্যন্ত আসবে। ঘরবাড়ির সঙ্গে ভাঙছে বিস্তীর্ণ বাঁশঝাড় আর প্রকাণ্ড গাছপালা। আধঘণ্টা আগেও যেখানে মানুষের স্বাভাবিক বিচরণ ছিল, সে জায়গাটিও এখন নদীগর্ভে চলে গেছে। আর যাদের খড়ের ঘর তারা যতটা পেরেছে প্রয়োজনীয় জিনিস উদ্ধার করেছে ঘরের মায়া না করে। কিন্তু যাদের টিনের চালওয়ালা বাড়ি তারা পড়েছে উভয় সংকটে। পানিতে প্রায় ডুবে যাওয়া এই ঘর উদ্ধার করতে দরকার পড়ছে বড় নৌকার। আর সুযোগ বুঝে নৌকার মালিকেরাও চড়া দাম হাঁকাচ্ছে। একেকটি ঘর পরিবহনে নিচ্ছে দুই থেকে তিন হাজার টাকা। একে তো সবকিছু নদীতে ডুবে যাচ্ছে, তার ওপর আবার এত টাকা!
তাই এমন অনেকেই আছে যারা সবকিছু নিয়তির হাতে ছেড়ে দিয়ে টাকার অভাবে নিজের ঘরের চালটিও রেখে চলে যাচ্ছে অন্যত্র। অনেকেই জানে এ সময় নদীর হানা দেওয়ার কথা, কিন্তু যেতে চাইলেই তো আর যেতে পারে না। নদীভাঙা এই এলাকার জমি কিনতে চায় না অন্য মানুষ। আর তাই এখানকার মানুষের অন্যত্র চলে যেতে হলে জমির মায়া ত্যাগ করেই যেতে হয়, যা অধিকাংশ মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। ঘর আগে ভেঙেছে এমন ৫০ থেকে ৬০টি পরিবার মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে বেছে নিয়েছে পাশের স্কুলমাঠ। সেখানে এখন মানুষ আর মানুষ। তাই নতুন করে যারা ঘর হারাচ্ছে, তাদের ছুটতে হচ্ছে অনেকটা অনিশ্চয়তা নিয়ে। নদীভাঙনের শিকার মানুষদের সঙ্গে কথা বলার সময় চার দিক থেকে মানুষ এসে ভিড় করে আমাদের সামনে। গোল করে ঘিরে রাখে। সেই মানুষদের ঠেলেও সামনে আসার চেষ্টা করে কেউ কেউ। তারা ভেবেছে, আমরা ত্রাণ নিয়ে এসেছি। স্বপ্নভঙ্গ হওয়া এই মানুষগুলোর মলিন মুখের দিকে খুব বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। খুব কষ্ট হয়। ঘরহারা এই মানুষগুলো তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে এখন প্রায়ই অনাহার বা অর্ধাহারে দিন পার করছে। এই অঞ্চলগুলোতে এখন কাজেরও বড্ড অভাব। জমিজমা আর আবাদি ফসল নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে আগেই। কোথাও কোনো কাজ নেই। একবেলা পেটে দানাপানি পড়বে কি না তারও নিশ্চয়তা নেই। যারা কিছুদিন আগেও বেশ সচ্ছল ছিল, তারা আজ নিঃস্বপ্রায়। কিন্তু চক্ষুলজ্জার ভয়ে মানুষের কাছে গিয়ে হাত পাততেও পারে না তারা। স্বভাবতই এবারের ঈদ এই মানুষগুলোর কাছে আনন্দের ছিল না। প্রতিনিয়ত এক দুঃস্বপ্ন তাড়া করছে তাদের। ‘বাড়ি থাইকলে রিদের (ঈদের) দিন সেমাই, মাছ-মাংস রান্না করনু হয়। ছোয়াগুলা (বাচ্চা) নতুন কাপড় পিন্দিল হয়। এবার কিছুই কইরবার পানু না।’ নিজেদের দুর্দশার কথাগুলো বলতে বলতে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে ছোরতন বেগমের। এমন ঈদ যে তাঁর জীবনে আসবে সে কথা কখনো কল্পনাও করেননি তিনি। আর সে জন্যই তো নিজের ভাগ্যের ঘাড়ে দোষ চাপান আর একহাত কপালে দিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে বিলাপ করে বলতে থাকেন, ‘হামার কপাল বড় খারাপ যে... হামার এলা কী হইবে? কার কাছোত যামো হামরা?’
ছোরতন বেগমের এই প্রশ্নগুলোর উত্তর মেলে না।
No comments