সময়ের প্রতিবিম্ব-আদালত অবমাননা নিয়ে বিভ্রান্তি by এবিএম মূসা
আমাদের বিচারব্যবস্থার সর্বোচ্চ পীঠস্থান সুপ্রিম কোর্ট একটি দৈনিকের ‘ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক’ ও একজন সাংবাদিককে অবমাননার দায়ে কারাদণ্ড দিয়েছেন। আমার অর্ধশতাব্দীর অধিককালের সাংবাদিকতা জীবনে কোনো দিন কোনো সম্পাদক বা সাংবাদিকের আদালতের অবমাননার দায়ে কারাদণ্ড হয়েছে, এমন কোনো নজির মনে পড়ছে না।
অন্তত এই উপমহাদেশে নয়। এর মানে এই নয়, অতীতে কোনো সম্পাদক, প্রকাশক-মুদ্রাকর আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত হননি। হয়েছেন এবং তাঁরা নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে পার পেয়েছেন। কোনো মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন করেননি, প্রকাশিত বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি আদালতে পেশ করেননি। এর কারণ, তাঁরা মনে করতেন, আদালতের সব পদক্ষেপ প্রশ্নাতীত, তাঁদের এতদসম্পর্কীয় এখতিয়ার একতরফা। একজন ‘ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক’ যৌক্তিক অথবা অযৌক্তিক বক্তব্য দিয়ে এই ধারণার ব্যতিক্রম ঘটিয়ে জেলে গেছেন। যাঁরা আদালতের চরম সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়েছেন, তাঁরাও কিন্তু সেই পত্রিকায় আদালতের মতে অবমাননাকর প্রতিবেদনের যৌক্তিকতা অথবা যথার্থ সম্পর্কে কোনো বক্তব্য দেননি। তাঁরা শুধু আদালতের দণ্ডদানের সীমারেখা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
প্রসঙ্গত বলছি, বিদেশে বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্রে আদালত অবমাননার দায়ে প্রতিবেদকের জেলে যাওয়ার দু-একটি নজির আছে। তবে সে প্রেক্ষাপট ভিন্ন এবং যাঁরা কারাবরণ করেছেন, তাঁদের প্রতি বিশ্বের সাংবাদিক-সমাজের নৈতিক সমর্থন ছিল। তাঁরা কারাগারে গিয়েছেন, কারণ, পরিবেশিত সংবাদের সূত্র জানাননি, সোর্স ডিসক্লোজ করেননি। তাঁরা সগর্বে বলেছেন, মিথ্যা সংবাদ ছাপেননি, ঢালাও মন্তব্য করেননি। কোনো বিচারককে বা বিশেষ বিচারব্যবস্থাকে সমালোচনা করেননি, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করেছেন। বিদেশি কোনো আদালত এ বক্তব্য গ্রহণ করেননি। তাঁদের মতে, ‘তাঁরা সিজারস ওয়াইফ’ সমস্ত সমালোচনার ঊর্ধ্বে। সম্প্রতি যে ‘ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক’ ও একজন পেশাজীবী সাংবাদিক দণ্ডিত হয়েছেন, তাঁরা সরাসরি বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগসংবলিত প্রতিবেদন ছেপেছেন। প্রতিবেদন এবং আদালতের বিচার-প্রক্রিয়ার রায় আংশিক পড়ে আমার এই ধারণা। অভিযুক্ত হয়ে ‘ভারপ্রাপ্ত’ সম্পাদক আদালতে বক্তব্য দিয়েছেন, তাঁর পত্রিকায় প্রকাশিত মন্তব্যসংবলিত প্রতিবেদনের সাফাই গেয়েছেন, কিন্তু পূর্ণ তথ্য-উপাত্ত ও উদাহরণ দিয়ে প্রতিবেদনটির সত্যতা প্রতিষ্ঠিত করছেন কি? কিংবা আদালত তাঁকে কি সেই সুযোগ দিয়েছিলেন? এ প্রশ্নটিই এখন সব আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে। সর্বমহলে খটকা বেঁধেছে। কোনো আদালতের বিচার-প্রক্রিয়ায় ‘কিছু শুনতে চাই না’ প্রত্যাখ্যান পদ্ধতি কি ন্যায়বিচারের পর্যায়ে পড়ে?
একজন কর্তব্য পালনকারী পেশাজীবী সাংবাদিকের দণ্ডাদেশও তাঁদের মনে শঙ্কিত প্রশ্নের উদ্ভব ঘটিয়েছে। কারণ, যেসব আইন দ্বারা সংবাদপত্র প্রকাশনা ও মুদ্রণ নিয়ন্ত্রিত হয়, তা সম্পাদক, প্রকাশক ও মুদ্রাকরের ক্ষেত্রেই প্রধানত প্রযোজ্য। একজন রিপোর্টার বা সাব এডিটর সংবাদ সংগ্রহ অথবা পরিমার্জনা করেন। কোনো সংবাদ বা প্রতিবেদন প্রকাশনার বা ছাপানোর দায় তাঁর নেই। তবে ‘চেম্বার জজ’-সম্পর্কীয় আমার দেশ-এর শীর্ষ প্রতিবেদনটি কি একটি তথ্যভিত্তিক রিপোর্ট; নাকি সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক কর্তৃক ব্রিফিং করা, ছক বেঁধে দেওয়া মন্তব্য প্রতিবেদন—সে প্রশ্নও উঠতে পারে। সে ক্ষেত্রে কে দণ্ড পাবেন, সংবাদপত্র প্রকাশনা-সম্পর্কীয় আইনবলে সম্পাদক, প্রকাশক ও মুদ্রাকর দায়ী, প্রতিবেদক নন। এ কারণেই আমি প্রতিবেদক-রিপোর্টারের জেলে যাওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছি। দণ্ডপ্রাপ্ত ‘বাই চান্স’ সম্পাদককেও প্রশ্ন, তিনি আদালতে গর্বভরে অতীতের সর্বজনমান্য সম্পাদকদের প্রসঙ্গ বক্তব্যে আনলেন। কিন্তু তাঁরা যে অধীন সাংবাদিকদের ছায়া দিতেন সেই কথাটি বলেননি।
আদালত কাকে দণ্ড দেবেন, আর কে ক্ষমাপ্রাপ্ত হবেন, সে বিবেচনা করার কোনো সুযোগ আছে কি না, সংবিধানের আদালত অবমাননা-সম্পর্কীয় অনুচ্ছেদ ১০৮-এ স্পষ্ট নয়। শুধু বলা হয়েছে, ‘সাবজেক্ট টু ল’ আইনের বিধান অনুযায়ী। এ বিধানটি সম্পর্কে জনগণের, এমনকি গণমাধ্যমেরও সুস্পষ্টভাবে জানা নেই। আমাদের মহামান্য আদালত কোনো সময় সেই ব্যাখ্যাটি দেননি বলেই গণমাধ্যম এ ব্যাপারে ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। প্রায় ১০০ বছর আগের ১৯২৬ সালের একটি আইনের কথা শুনেছি, দীর্ঘ ৫৫ বছরে কোনো দিন তার খোঁজ করিনি। সেই আইনটিও নাকি আদালতের এখতিয়ার-সম্পর্কীয়, অবমাননার ব্যাখ্যাসংবলিত নয়। মাহমুদুর রহমানের মামলায় আমাদের উচ্চতম আদালত সেই ব্যাখ্যাটি দিয়ে নজির সৃষ্টি করতে পারতেন। গণমাধ্যম একটি সাইডলাইন বা নির্দেশনা পেত। তাই রায়টি স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে হচ্ছে না বলে সাংবাদিক মহল এবং গণমাধ্যম অঙ্গনে একধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। কী লিখব, আর লিখব না, সেই সীমারেখাটি উচ্চতম আদালত নির্ধারণ করে দিতে পারেন না।
আলোচিত মামলার রায় যে উদ্বেগের উদ্ভব ঘটিয়েছে, তা হলো, আদালত ও গণমাধ্যমের তথা সাংবাদিকদের মধ্যে একটি দূরত্বসূচক সম্পর্ক সৃষ্টি করেছে। অথচ স্বৈরাচারবিরোধী অবস্থান গ্রহণে, মানবাধিকার রক্ষায় এবং জনমত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে বিগত দিনে একমাত্র এই দুটি প্রতিষ্ঠান, দু-একটি ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে পরস্পর সহযোগী ও সম্পূরকের ভূমিকা পালন করেছে। আজকে একটি মামলার কারণে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই সম্পর্কে চিড় ধরেছে।
প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় আদালত অবমাননার বিষয়টি প্রকৃতপক্ষে সম্পূর্ণ আইনি বা বৈচারিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সংবাদপত্রে আলোচিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞ আলোচকেরা শাহ্দীন মালিক, আসিফ নজরুল ও মিজানুর রহমান খান বিষয়টি নিয়ে একাধিক নিবন্ধ লিখেছেন। সব কটি পড়ে আমার ধারণা হয়েছে, তাঁরা আমার দেশ পত্রিকার ‘ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক’ যে আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন, আলোচকেরা বিচার-প্রক্রিয়া নয়, তাঁর শাস্তি নিয়েই অধিকতর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আমার আইনি জ্ঞান অত্যন্ত সীমাবদ্ধ, তাই ধারণাটি যদি ভুল হয়ে থাকে, বিশেষজ্ঞ আলোচকদের কাছে ক্ষমা চাই। আমিও সাধারণ জ্ঞান নিয়ে ‘ভারপ্রাপ্ত’ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিচার-প্রক্রিয়াটি দীর্ঘদিনের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতার আলোকে আলোচনা করব। পাঠক বোধ হয় লক্ষ করেছেন, আমি মাহমুদুর রহমানের নামের আগে প্রতিবার কোট-আনকোট করে ‘ভারপ্রাপ্ত’ শব্দটি ব্যবহার করেছি।
ইতিপূর্বে আভাস দিয়েছি, যে দুটি প্রধান আইন দ্বারা সংবাদপত্র প্রকাশনা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে, তা হচ্ছে ‘সংবাদপত্র প্রকাশনা মুদ্রণ আইন’ এবং ‘পেশাজীবী সাংবাদিক ও সংবাদপত্র কর্মচারী কার্যপ্রণালি আইন’। ইংরেজিতে খোলাসা করে বলতে হয়, একটি ‘প্রিন্টিং প্রেস ও নিউজপেপার পাবলিকেশন’ এবং অন্যটি ‘ওয়ার্কিং জার্নালিস্ট ও নিউজপেপার এমপ্লয়িজ ওয়ার্কিং কন্ডিশন আইন’। দ্বিতীয়টির পার্শ্ব উৎপাদন বা বাই প্রডাক্ট হচ্ছে ওয়েজ বোর্ড অ্যাক্ট। বস্তুত, তিনটিই পাকিস্তান আমলের। আমরা যাঁরা সাংবাদিকদের ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলাম, তাঁরা প্রেস অর্ডিন্যান্সটি বাতিল প্রায় ৬০ বছর আগে করেছিলাম ১৯৬২ সালে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রকাশনা নিয়ন্ত্রণ আইনটি পুনরায় কার্যকর করা হয়। বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সেই আইন অনেকখানি সংশোধিত হলেও বাতিল হয়নি। আইনগুলো উল্লেখ করছি একটি তথ্য দেওয়ার জন্য। বর্তমানে এ বিধানটি সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হওয়ার কারণেই অনেকে বৈধ-অবৈধ পন্থায় বিত্ত অর্জন করে সর্বস্তরে ক্ষমতাশালী হওয়ার জন্য রাতারাতি সম্পাদক বনে যাচ্ছেন। জেলা প্রশাসকের দপ্তরে ‘সম্পাদক’ পদমর্যাদা অর্জনের আবেদন জানিয়ে ‘ভারপ্রাপ্ত’ শব্দ যোগ করেই নিশ্চিন্ত থাকেন। জেলা প্রশাসনও কেন জানি না বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখে। যে কারণে এই ভার তাঁরা অনাদিকাল বহন করেন। কোনো পেশাজীবী বহুল আকাঙ্ক্ষিত এই পদে অধিষ্ঠিত হতে পারেন না। এই ‘ভারপ্রাপ্ত’ শব্দটিকে আমাদের একজন মহামান্য বিচারপতি মাহমুদুর রহমানের মামলার শুনানিকালে কৌতুকী ও মজাদার একটি সংজ্ঞা দিয়েছেন, ‘বাই চান্স’ সম্পাদক। বর্তমানকালের ‘এমবেডেড জার্নালিস্ট’ তথা বশংবদ সাংবাদিকতার সংজ্ঞায় একটি নতুন শব্দ চয়নের জন্য মহামান্য বিচারককে ধন্যবাদ জানাই।
আদালত অবমাননায় বিষয়টি আলোচনায় এসেছে ‘বাই চান্সের’, স্ব-আরোপিত সম্পাদকের সম্পাদনায় প্রকাশিত সংবাদপত্রের প্রতিবেদন। তিনি নিজে সোর্স লিখেননি। অথচ এর আগে অনেক সাহসী ও বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন তিনি তাঁর পত্রিকায় ছেপেছেন, এ জন্য তাঁকে অভিনন্দনও জানিয়েছি। যেদিন তাঁর জেল হলো, সে রাতে এ নিয়ে মন্তব্য করার ও মতামত দেওয়ার দায়টি আমার কাঁধে চাপিয়ে দিলেন ‘চ্যানেল আই’-এর মতিউর রহমান চৌধুরী। তাঁর একটি কৌশল হচ্ছে, বিব্রতকর অথবা বিতর্কিত কোনো বিষয় আলোচনার প্রয়োজন হলে আমাকেই ক্যামেরার সামনে হাজির করেন। যা-ই হোক, সেদিন আলোচনাপর্বে আমন্ত্রিত হয়েই আমি এ নিয়ে প্রথমে আমার প্রিয়ভাজন সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কাজী এবাদুল হকের সঙ্গে টেলিফোনে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করলাম। সংবিধানের সংশ্লিষ্ট ধারাটি বুঝে নিলাম, ১৯২৬ সালের আদালত অবমাননা-সম্পর্কীয় আইনটি সম্পর্কে অবগত হলাম। আমার দেশ পত্রিকা ‘চেম্বার জজ’ সম্পর্কে একটি ‘ঢালাও’ মন্তব্য করেছেন, তা নিয়ে আলোচনা করলাম। আমার মূল বক্তব্য ছিল, সংশ্লিষ্ট শীর্ষ খবরটি প্রকৃতপক্ষে একটি মন্তব্য প্রতিবেদন ছিল, যাকে নির্ভেজাল সংবাদ বলা হয়, সেই সংজ্ঞায় পড়ে না। আলোচ্য আদালতের কার্যপদ্ধতি-সম্পর্কীয় প্রতিবেদনটিতে আমি সব পক্ষের বক্তব্য পেলাম না। চেম্বার জজ কী করেছেন, তার বিবরণ আছে। কোন ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্বের কারণে কী করেননি, সেই বিবরণ খুঁজে পেলাম না। অথচ সাংবাদিকতার নীতিমালা অনুসারে পক্ষে-বিপক্ষের সব মহলের মতামতসংবলিত না করে কোনো ঢালাও মন্তব্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
রায়ের সমালোচকদের প্রতিবেদন পড়ে মনে হয়েছে, আদালত তা মানতেও চাননি। এ কারণে একজন সম্পাদক বা সাংবাদিকের সামারি ট্রায়াল বা একতরফা বিচার হয়েছে, এমন একটি ধারণাই সব মহলে আলোচিত হচ্ছে। এই আলোচনা যে মহামান্য বিচারকদেরও বিড়ম্বিত করেছে, তা আমি উচ্চতম মহল থেকে জানতে পেরেছি। আদালতের ত্বরিত রায় প্রদান, সাংবাদিকতার স্বাধীনতা, সর্বোপরি সম্পাদকের দায়িত্ববোধ, শুধু মন্তব্যসংবলিত সংবাদ, সামগ্রিকভাবে আমার চিন্তায় জট পাকিয়ে গেছে।
প্রসঙ্গক্রমে যা জানতে পেরেছি, তা হলো, সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদে ‘সাবজেক্ট টু ল’ আইনের অনুসরণে শব্দ কটির পরিপূর্ণ প্রতিফলনও রায়ে স্পষ্ট নয়। পত্রিকায় আইনি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ প্রতিবেদকেরাও ১৯২৬ সালের একটি আইনে অবমাননা বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে আদালতের অবাধ ক্ষমতার কোনো হদিস পাননি বলে মনে হচ্ছে। এ কারণেই গণমাধ্যম, বিশেষত, সংবাদপত্রের জন্য ‘আদালত অবমাননা’র সংজ্ঞা সম্পর্কে একটি দিকনির্দেশনা প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের উচ্চতম আদালতের কাছে এটিই আমার প্রার্থনা। কারণ, কথিত অবমাননা মামলার আলোচনায় সব বিশেষজ্ঞ আলোচক সাংবিধানিক ধারাটি নিয়েই আলোচনা করেছেন। মাহমুদুর রহমানকে অভিযোগ থেকে সম্পূর্ণ রেহাই দেননি। অনেকের আপত্তি হচ্ছে ‘লঘু পাপে গুরুদণ্ড’। তার মানে ‘অপরাধী’ পাপ করেছেন বটে, তবে সেটি লঘু ছিল, দণ্ডটি গুরু হয়েছে, তা হলে ব্যাপারটি কী দাঁড়াল? অবমাননা, নাকি দণ্ডাদেশ—কোনটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে?
আগেই বলেছি, আলোচিত অবমাননা মামলার আইনি বা বৈচারিক বিষয়টি সম্পর্কে মতামত দেওয়ার জ্ঞান আমার নেই। আমি সাংবাদিকতার মানদণ্ডে এবং সাংবাদিকের এথিকস বা নীতিমালা অনুসরণে একটি বিশেষ ‘আদালত অবমাননা’ মামলার রায়ের পর্যালোচনা করেছি। সর্বশেষ (১) আদালতসংশ্লিষ্ট বা বিচারকদের আচরণ-সম্পর্কীয় সংবাদ পরিবেশনে সাংবাদিকতার ‘নীতিমালা’ অনুযায়ী ‘আদার সাইড অব দি স্টোরি’ অপর পক্ষের মতামত গ্রহণের সুযোগ আছে কি না, এ নিয়েও আমি বিভ্রান্ত। (২) মাহমুদুর রহমানকে মামলার শুনানির দণ্ডাদেশ, মাহমুদুর রহমানের ‘জবানবন্দি’ আমার বা অন্যদের বিভ্রান্তি দূর করতে পারেনি। (৩) আদালতের অসীম ক্ষমতা নিয়েও রয়েছে সীমাহীন জিজ্ঞাসা। এ তিনটি কারণে আজ একটি আদালত অবমাননা মামলা আদালতপাড়ায় ও গণমাধ্যমে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে।
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
প্রসঙ্গত বলছি, বিদেশে বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্রে আদালত অবমাননার দায়ে প্রতিবেদকের জেলে যাওয়ার দু-একটি নজির আছে। তবে সে প্রেক্ষাপট ভিন্ন এবং যাঁরা কারাবরণ করেছেন, তাঁদের প্রতি বিশ্বের সাংবাদিক-সমাজের নৈতিক সমর্থন ছিল। তাঁরা কারাগারে গিয়েছেন, কারণ, পরিবেশিত সংবাদের সূত্র জানাননি, সোর্স ডিসক্লোজ করেননি। তাঁরা সগর্বে বলেছেন, মিথ্যা সংবাদ ছাপেননি, ঢালাও মন্তব্য করেননি। কোনো বিচারককে বা বিশেষ বিচারব্যবস্থাকে সমালোচনা করেননি, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করেছেন। বিদেশি কোনো আদালত এ বক্তব্য গ্রহণ করেননি। তাঁদের মতে, ‘তাঁরা সিজারস ওয়াইফ’ সমস্ত সমালোচনার ঊর্ধ্বে। সম্প্রতি যে ‘ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক’ ও একজন পেশাজীবী সাংবাদিক দণ্ডিত হয়েছেন, তাঁরা সরাসরি বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগসংবলিত প্রতিবেদন ছেপেছেন। প্রতিবেদন এবং আদালতের বিচার-প্রক্রিয়ার রায় আংশিক পড়ে আমার এই ধারণা। অভিযুক্ত হয়ে ‘ভারপ্রাপ্ত’ সম্পাদক আদালতে বক্তব্য দিয়েছেন, তাঁর পত্রিকায় প্রকাশিত মন্তব্যসংবলিত প্রতিবেদনের সাফাই গেয়েছেন, কিন্তু পূর্ণ তথ্য-উপাত্ত ও উদাহরণ দিয়ে প্রতিবেদনটির সত্যতা প্রতিষ্ঠিত করছেন কি? কিংবা আদালত তাঁকে কি সেই সুযোগ দিয়েছিলেন? এ প্রশ্নটিই এখন সব আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে। সর্বমহলে খটকা বেঁধেছে। কোনো আদালতের বিচার-প্রক্রিয়ায় ‘কিছু শুনতে চাই না’ প্রত্যাখ্যান পদ্ধতি কি ন্যায়বিচারের পর্যায়ে পড়ে?
একজন কর্তব্য পালনকারী পেশাজীবী সাংবাদিকের দণ্ডাদেশও তাঁদের মনে শঙ্কিত প্রশ্নের উদ্ভব ঘটিয়েছে। কারণ, যেসব আইন দ্বারা সংবাদপত্র প্রকাশনা ও মুদ্রণ নিয়ন্ত্রিত হয়, তা সম্পাদক, প্রকাশক ও মুদ্রাকরের ক্ষেত্রেই প্রধানত প্রযোজ্য। একজন রিপোর্টার বা সাব এডিটর সংবাদ সংগ্রহ অথবা পরিমার্জনা করেন। কোনো সংবাদ বা প্রতিবেদন প্রকাশনার বা ছাপানোর দায় তাঁর নেই। তবে ‘চেম্বার জজ’-সম্পর্কীয় আমার দেশ-এর শীর্ষ প্রতিবেদনটি কি একটি তথ্যভিত্তিক রিপোর্ট; নাকি সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক কর্তৃক ব্রিফিং করা, ছক বেঁধে দেওয়া মন্তব্য প্রতিবেদন—সে প্রশ্নও উঠতে পারে। সে ক্ষেত্রে কে দণ্ড পাবেন, সংবাদপত্র প্রকাশনা-সম্পর্কীয় আইনবলে সম্পাদক, প্রকাশক ও মুদ্রাকর দায়ী, প্রতিবেদক নন। এ কারণেই আমি প্রতিবেদক-রিপোর্টারের জেলে যাওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছি। দণ্ডপ্রাপ্ত ‘বাই চান্স’ সম্পাদককেও প্রশ্ন, তিনি আদালতে গর্বভরে অতীতের সর্বজনমান্য সম্পাদকদের প্রসঙ্গ বক্তব্যে আনলেন। কিন্তু তাঁরা যে অধীন সাংবাদিকদের ছায়া দিতেন সেই কথাটি বলেননি।
আদালত কাকে দণ্ড দেবেন, আর কে ক্ষমাপ্রাপ্ত হবেন, সে বিবেচনা করার কোনো সুযোগ আছে কি না, সংবিধানের আদালত অবমাননা-সম্পর্কীয় অনুচ্ছেদ ১০৮-এ স্পষ্ট নয়। শুধু বলা হয়েছে, ‘সাবজেক্ট টু ল’ আইনের বিধান অনুযায়ী। এ বিধানটি সম্পর্কে জনগণের, এমনকি গণমাধ্যমেরও সুস্পষ্টভাবে জানা নেই। আমাদের মহামান্য আদালত কোনো সময় সেই ব্যাখ্যাটি দেননি বলেই গণমাধ্যম এ ব্যাপারে ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। প্রায় ১০০ বছর আগের ১৯২৬ সালের একটি আইনের কথা শুনেছি, দীর্ঘ ৫৫ বছরে কোনো দিন তার খোঁজ করিনি। সেই আইনটিও নাকি আদালতের এখতিয়ার-সম্পর্কীয়, অবমাননার ব্যাখ্যাসংবলিত নয়। মাহমুদুর রহমানের মামলায় আমাদের উচ্চতম আদালত সেই ব্যাখ্যাটি দিয়ে নজির সৃষ্টি করতে পারতেন। গণমাধ্যম একটি সাইডলাইন বা নির্দেশনা পেত। তাই রায়টি স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে হচ্ছে না বলে সাংবাদিক মহল এবং গণমাধ্যম অঙ্গনে একধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। কী লিখব, আর লিখব না, সেই সীমারেখাটি উচ্চতম আদালত নির্ধারণ করে দিতে পারেন না।
আলোচিত মামলার রায় যে উদ্বেগের উদ্ভব ঘটিয়েছে, তা হলো, আদালত ও গণমাধ্যমের তথা সাংবাদিকদের মধ্যে একটি দূরত্বসূচক সম্পর্ক সৃষ্টি করেছে। অথচ স্বৈরাচারবিরোধী অবস্থান গ্রহণে, মানবাধিকার রক্ষায় এবং জনমত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে বিগত দিনে একমাত্র এই দুটি প্রতিষ্ঠান, দু-একটি ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে পরস্পর সহযোগী ও সম্পূরকের ভূমিকা পালন করেছে। আজকে একটি মামলার কারণে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই সম্পর্কে চিড় ধরেছে।
প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় আদালত অবমাননার বিষয়টি প্রকৃতপক্ষে সম্পূর্ণ আইনি বা বৈচারিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সংবাদপত্রে আলোচিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞ আলোচকেরা শাহ্দীন মালিক, আসিফ নজরুল ও মিজানুর রহমান খান বিষয়টি নিয়ে একাধিক নিবন্ধ লিখেছেন। সব কটি পড়ে আমার ধারণা হয়েছে, তাঁরা আমার দেশ পত্রিকার ‘ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক’ যে আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন, আলোচকেরা বিচার-প্রক্রিয়া নয়, তাঁর শাস্তি নিয়েই অধিকতর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আমার আইনি জ্ঞান অত্যন্ত সীমাবদ্ধ, তাই ধারণাটি যদি ভুল হয়ে থাকে, বিশেষজ্ঞ আলোচকদের কাছে ক্ষমা চাই। আমিও সাধারণ জ্ঞান নিয়ে ‘ভারপ্রাপ্ত’ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিচার-প্রক্রিয়াটি দীর্ঘদিনের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতার আলোকে আলোচনা করব। পাঠক বোধ হয় লক্ষ করেছেন, আমি মাহমুদুর রহমানের নামের আগে প্রতিবার কোট-আনকোট করে ‘ভারপ্রাপ্ত’ শব্দটি ব্যবহার করেছি।
ইতিপূর্বে আভাস দিয়েছি, যে দুটি প্রধান আইন দ্বারা সংবাদপত্র প্রকাশনা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে, তা হচ্ছে ‘সংবাদপত্র প্রকাশনা মুদ্রণ আইন’ এবং ‘পেশাজীবী সাংবাদিক ও সংবাদপত্র কর্মচারী কার্যপ্রণালি আইন’। ইংরেজিতে খোলাসা করে বলতে হয়, একটি ‘প্রিন্টিং প্রেস ও নিউজপেপার পাবলিকেশন’ এবং অন্যটি ‘ওয়ার্কিং জার্নালিস্ট ও নিউজপেপার এমপ্লয়িজ ওয়ার্কিং কন্ডিশন আইন’। দ্বিতীয়টির পার্শ্ব উৎপাদন বা বাই প্রডাক্ট হচ্ছে ওয়েজ বোর্ড অ্যাক্ট। বস্তুত, তিনটিই পাকিস্তান আমলের। আমরা যাঁরা সাংবাদিকদের ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলাম, তাঁরা প্রেস অর্ডিন্যান্সটি বাতিল প্রায় ৬০ বছর আগে করেছিলাম ১৯৬২ সালে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রকাশনা নিয়ন্ত্রণ আইনটি পুনরায় কার্যকর করা হয়। বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সেই আইন অনেকখানি সংশোধিত হলেও বাতিল হয়নি। আইনগুলো উল্লেখ করছি একটি তথ্য দেওয়ার জন্য। বর্তমানে এ বিধানটি সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হওয়ার কারণেই অনেকে বৈধ-অবৈধ পন্থায় বিত্ত অর্জন করে সর্বস্তরে ক্ষমতাশালী হওয়ার জন্য রাতারাতি সম্পাদক বনে যাচ্ছেন। জেলা প্রশাসকের দপ্তরে ‘সম্পাদক’ পদমর্যাদা অর্জনের আবেদন জানিয়ে ‘ভারপ্রাপ্ত’ শব্দ যোগ করেই নিশ্চিন্ত থাকেন। জেলা প্রশাসনও কেন জানি না বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখে। যে কারণে এই ভার তাঁরা অনাদিকাল বহন করেন। কোনো পেশাজীবী বহুল আকাঙ্ক্ষিত এই পদে অধিষ্ঠিত হতে পারেন না। এই ‘ভারপ্রাপ্ত’ শব্দটিকে আমাদের একজন মহামান্য বিচারপতি মাহমুদুর রহমানের মামলার শুনানিকালে কৌতুকী ও মজাদার একটি সংজ্ঞা দিয়েছেন, ‘বাই চান্স’ সম্পাদক। বর্তমানকালের ‘এমবেডেড জার্নালিস্ট’ তথা বশংবদ সাংবাদিকতার সংজ্ঞায় একটি নতুন শব্দ চয়নের জন্য মহামান্য বিচারককে ধন্যবাদ জানাই।
আদালত অবমাননায় বিষয়টি আলোচনায় এসেছে ‘বাই চান্সের’, স্ব-আরোপিত সম্পাদকের সম্পাদনায় প্রকাশিত সংবাদপত্রের প্রতিবেদন। তিনি নিজে সোর্স লিখেননি। অথচ এর আগে অনেক সাহসী ও বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন তিনি তাঁর পত্রিকায় ছেপেছেন, এ জন্য তাঁকে অভিনন্দনও জানিয়েছি। যেদিন তাঁর জেল হলো, সে রাতে এ নিয়ে মন্তব্য করার ও মতামত দেওয়ার দায়টি আমার কাঁধে চাপিয়ে দিলেন ‘চ্যানেল আই’-এর মতিউর রহমান চৌধুরী। তাঁর একটি কৌশল হচ্ছে, বিব্রতকর অথবা বিতর্কিত কোনো বিষয় আলোচনার প্রয়োজন হলে আমাকেই ক্যামেরার সামনে হাজির করেন। যা-ই হোক, সেদিন আলোচনাপর্বে আমন্ত্রিত হয়েই আমি এ নিয়ে প্রথমে আমার প্রিয়ভাজন সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কাজী এবাদুল হকের সঙ্গে টেলিফোনে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করলাম। সংবিধানের সংশ্লিষ্ট ধারাটি বুঝে নিলাম, ১৯২৬ সালের আদালত অবমাননা-সম্পর্কীয় আইনটি সম্পর্কে অবগত হলাম। আমার দেশ পত্রিকা ‘চেম্বার জজ’ সম্পর্কে একটি ‘ঢালাও’ মন্তব্য করেছেন, তা নিয়ে আলোচনা করলাম। আমার মূল বক্তব্য ছিল, সংশ্লিষ্ট শীর্ষ খবরটি প্রকৃতপক্ষে একটি মন্তব্য প্রতিবেদন ছিল, যাকে নির্ভেজাল সংবাদ বলা হয়, সেই সংজ্ঞায় পড়ে না। আলোচ্য আদালতের কার্যপদ্ধতি-সম্পর্কীয় প্রতিবেদনটিতে আমি সব পক্ষের বক্তব্য পেলাম না। চেম্বার জজ কী করেছেন, তার বিবরণ আছে। কোন ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্বের কারণে কী করেননি, সেই বিবরণ খুঁজে পেলাম না। অথচ সাংবাদিকতার নীতিমালা অনুসারে পক্ষে-বিপক্ষের সব মহলের মতামতসংবলিত না করে কোনো ঢালাও মন্তব্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
রায়ের সমালোচকদের প্রতিবেদন পড়ে মনে হয়েছে, আদালত তা মানতেও চাননি। এ কারণে একজন সম্পাদক বা সাংবাদিকের সামারি ট্রায়াল বা একতরফা বিচার হয়েছে, এমন একটি ধারণাই সব মহলে আলোচিত হচ্ছে। এই আলোচনা যে মহামান্য বিচারকদেরও বিড়ম্বিত করেছে, তা আমি উচ্চতম মহল থেকে জানতে পেরেছি। আদালতের ত্বরিত রায় প্রদান, সাংবাদিকতার স্বাধীনতা, সর্বোপরি সম্পাদকের দায়িত্ববোধ, শুধু মন্তব্যসংবলিত সংবাদ, সামগ্রিকভাবে আমার চিন্তায় জট পাকিয়ে গেছে।
প্রসঙ্গক্রমে যা জানতে পেরেছি, তা হলো, সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদে ‘সাবজেক্ট টু ল’ আইনের অনুসরণে শব্দ কটির পরিপূর্ণ প্রতিফলনও রায়ে স্পষ্ট নয়। পত্রিকায় আইনি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ প্রতিবেদকেরাও ১৯২৬ সালের একটি আইনে অবমাননা বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে আদালতের অবাধ ক্ষমতার কোনো হদিস পাননি বলে মনে হচ্ছে। এ কারণেই গণমাধ্যম, বিশেষত, সংবাদপত্রের জন্য ‘আদালত অবমাননা’র সংজ্ঞা সম্পর্কে একটি দিকনির্দেশনা প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের উচ্চতম আদালতের কাছে এটিই আমার প্রার্থনা। কারণ, কথিত অবমাননা মামলার আলোচনায় সব বিশেষজ্ঞ আলোচক সাংবিধানিক ধারাটি নিয়েই আলোচনা করেছেন। মাহমুদুর রহমানকে অভিযোগ থেকে সম্পূর্ণ রেহাই দেননি। অনেকের আপত্তি হচ্ছে ‘লঘু পাপে গুরুদণ্ড’। তার মানে ‘অপরাধী’ পাপ করেছেন বটে, তবে সেটি লঘু ছিল, দণ্ডটি গুরু হয়েছে, তা হলে ব্যাপারটি কী দাঁড়াল? অবমাননা, নাকি দণ্ডাদেশ—কোনটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে?
আগেই বলেছি, আলোচিত অবমাননা মামলার আইনি বা বৈচারিক বিষয়টি সম্পর্কে মতামত দেওয়ার জ্ঞান আমার নেই। আমি সাংবাদিকতার মানদণ্ডে এবং সাংবাদিকের এথিকস বা নীতিমালা অনুসরণে একটি বিশেষ ‘আদালত অবমাননা’ মামলার রায়ের পর্যালোচনা করেছি। সর্বশেষ (১) আদালতসংশ্লিষ্ট বা বিচারকদের আচরণ-সম্পর্কীয় সংবাদ পরিবেশনে সাংবাদিকতার ‘নীতিমালা’ অনুযায়ী ‘আদার সাইড অব দি স্টোরি’ অপর পক্ষের মতামত গ্রহণের সুযোগ আছে কি না, এ নিয়েও আমি বিভ্রান্ত। (২) মাহমুদুর রহমানকে মামলার শুনানির দণ্ডাদেশ, মাহমুদুর রহমানের ‘জবানবন্দি’ আমার বা অন্যদের বিভ্রান্তি দূর করতে পারেনি। (৩) আদালতের অসীম ক্ষমতা নিয়েও রয়েছে সীমাহীন জিজ্ঞাসা। এ তিনটি কারণে আজ একটি আদালত অবমাননা মামলা আদালতপাড়ায় ও গণমাধ্যমে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে।
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
No comments