মিয়ানমারের দাঙ্গা-গণমাধ্যম যা আড়াল করছে by ফ্রান্সিস ওয়াদে
পশ্চিম মিয়ানমারে ছড়িয়ে পড়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কয়েকটি দিক মিডিয়ায় মোটেই আসছে না। এখানে অবশ্যই প্রমাণ যাচাইয়ের বিষয় জড়িত। বিশেষ করে যেখানে প্রচার-প্রচারণায় বিপুল আবেগের বিষয় জড়িত এবং যেখানে ঘটনাস্থলে যোগাযোগ করা কঠিন এবং সংঘাতটি এত বিস্ফোরক। তা সত্ত্বেও কয়েকটি বিষয় আলোচনায় আসা উচিত।
বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারে সংবাদ প্রতিবেদনে বর্ণবাদী হিংসার ভাষায় কেউ কিছু মনে করে না। তবুও এই অশান্তির বর্ণবাদী উপাদানগুলোর বিষয়ে বৌদ্ধ বার্মিজ এবং আরাকানদের দায়িত্বশীল হওয়া উচিত। কারণ, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে গণমাধ্যমের ওপর তাদের প্রভাব অনেক বেশি হওয়ায় জনমতের ওপর প্রভাবটাও বেশি।
রোহিঙ্গাদের প্রতি এই হিংসাত্মক মনোভাব প্রকাশে মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেতৃত্ব, যাঁরা নিজেদের পরিবর্তনের শক্তি হিসেবে দাবি করেন, তাঁরাও মোটেই পিছিয়ে নেই। প্রখ্যাত গণতন্ত্রপন্থী নেতা কো কো গাইয়ি বলেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি মিয়ানমারের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি।’ রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের মুসলিম সংখ্যালঘু এবং তারাই মূলত এই দাঙ্গার শিকার। আমার এক বন্ধু জানিয়েছে, গতকাল তার কাছে সু চির অনুসারী এক সাবেক রাজবন্দীর একটি ই-মেইল এসেছে। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘পশ্চিমা জাতিগুলো যদি সত্যিই মানবাধিকারে বিশ্বাস করে, তাহলে তাদের উচিত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া।’ এদিকে অং সান সু চিও রোহিঙ্গাদের দুর্ভাগ্যের বিষয়ে বেশি উচ্চবাচ্য করছেন না। দাঙ্গা উপদ্রুত আরাকান রাজ্যে যাওয়ার বদলে তিনি পূর্বনির্ধারিত ইউরোপ সফরের সিদ্ধান্তেই অটল রয়েছেন। দাঙ্গা মোকাবিলায় তিনি সরকারের ওপরই পরিপূর্ণ আস্থা রাখছেন।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা বারবার জাতিগত শুদ্ধি অভিযানের শিকার হয়েছে। একবার ষাটের দশকের জাতীয়তাবাদী জয়জয়কারের সময়, একবার আশির দশকের গোড়ায় এবং নব্বইয়ের দশকের শুরুতে। প্রতিবারই সেনাবাহিনীর হাতে অজস্র রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে এবং বাদবাকিরা হয়েছে বিতাড়িত। এবারের দাঙ্গায় নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকার বিষয়ে গণমাধ্যমে তেমন আলোকপাত করা হয়নি। যাঁদের এ ব্যাপারে সজাগ থাকার কথা, সেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের মুখপাত্র বলেছেন, ‘আমাদের বিশ্বাস, নিরাপত্তা বাহিনী এই কঠিন সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পরিস্থিতি সঠিকভাবেই মোকাবিলা করছে।’ কিন্তু স্থানীয় পর্যায় থেকে যেসব খবর পাচ্ছি, তা তাঁর এই নিশ্চিন্ত মনোভাবের সঙ্গে একেবারেই খাপ খায় না।
অন্তত চারজন আমাকে বলেছেন, পুলিশ বাহিনী আরাকানদের সঙ্গে মিলে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ঘরবাড়িতে আগুন লাগাচ্ছে। আরও কয়েকটি প্রতিবেদন জানাচ্ছে, পুলিশ মুসলমান জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করেছে। খেয়াল করতে হবে, মুসলমানরা মিয়ানমারের পুলিশ বাহিনী বা সেনাবাহিনীতে নিষিদ্ধ। দাঙ্গা মোকাবিলার বিষয়ে এই ব্যাপারটা খেয়াল করতে হবে। গত পরশু রাতে সিত্তুউয়িতে গ্রেপ্তার হওয়া এক রাজনীতিবিদকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় এক এনজিওকর্মী। ওদিকে এএফপি বলছে, বার্মিজ পুলিশের গুলিতে আহত এক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে মৃত্যুবরণ করেছেন।
জাতিসংঘ সাধারণত এ ধরনের জটিল পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সহিংসতায় জড়িত থাকার খবর ছাড়া হস্তক্ষেপ করে না। কিন্তু মুশকিল হলো ঘটনা যেখানে ঘটছে, সেখানে সাংবাদিকেরা না থাকায় বোঝা যাচ্ছে না, মৃত্যুগুলোর জন্য আসলে কে দায়ী। ওই এলাকা থেকে জাতিসংঘ তাদের কর্মীদের সরিয়ে নিলেও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সরকারের কাছে পর্যবেক্ষকদের প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার জন্য বলেছে।
এই দাঙ্গায় মুসলমান গোষ্ঠীগুলো অবশ্যই দর্শকের ভূমিকায় নেই। অনেক ক্ষেত্রে তারাও পাল্টা সহিংসতা ঘটাচ্ছে। কিন্তু যেভাবে এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে মুসলমানদের দায়ী করা হচ্ছে তা সঠিক নয়। একটা ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, নিহত মুসলিমদের মাথা মুড়িয়ে, গেরুয়া পোশাক পরিয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা হয়েছে। এরপর তাদের ছবি বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়ে অভিযোগ করা হবে যে মুসলমানরা এসব ব্যক্তিকে হত্যা করেছে।
মিয়ানমারের অতীতের মুসলিমবিরোধী জ্বরের দৃষ্টান্তগুলো মনে রাখলে দেখা যাবে যে এ রকম সময়ে অনেকের যুক্তি-বুদ্ধি একেবারে লোপ পায়। অনেকেই এই পরিস্থিতিকে ব্যবহার করে ফায়দা লোটায় ব্যস্ত। বিশেষত, মিয়ানমারের কট্টরপন্থী সামরিক কর্তারা দাঙ্গাকে ব্যবহার করে ক্ষমতার মূল মঞ্চে আবার ফিরে আসার জন্য কলকাঠি নাড়ছেন। পাশাপাশি, এই অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকেও জটিল করে তুলছে এই সংঘাত।
এশিয়ান করেসপনডেন্ট ডট কম থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
ফ্রান্সিস ওয়াদে: মিয়ানমার ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক প্রতিবেদক।
রোহিঙ্গাদের প্রতি এই হিংসাত্মক মনোভাব প্রকাশে মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেতৃত্ব, যাঁরা নিজেদের পরিবর্তনের শক্তি হিসেবে দাবি করেন, তাঁরাও মোটেই পিছিয়ে নেই। প্রখ্যাত গণতন্ত্রপন্থী নেতা কো কো গাইয়ি বলেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি মিয়ানমারের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি।’ রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের মুসলিম সংখ্যালঘু এবং তারাই মূলত এই দাঙ্গার শিকার। আমার এক বন্ধু জানিয়েছে, গতকাল তার কাছে সু চির অনুসারী এক সাবেক রাজবন্দীর একটি ই-মেইল এসেছে। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘পশ্চিমা জাতিগুলো যদি সত্যিই মানবাধিকারে বিশ্বাস করে, তাহলে তাদের উচিত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া।’ এদিকে অং সান সু চিও রোহিঙ্গাদের দুর্ভাগ্যের বিষয়ে বেশি উচ্চবাচ্য করছেন না। দাঙ্গা উপদ্রুত আরাকান রাজ্যে যাওয়ার বদলে তিনি পূর্বনির্ধারিত ইউরোপ সফরের সিদ্ধান্তেই অটল রয়েছেন। দাঙ্গা মোকাবিলায় তিনি সরকারের ওপরই পরিপূর্ণ আস্থা রাখছেন।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা বারবার জাতিগত শুদ্ধি অভিযানের শিকার হয়েছে। একবার ষাটের দশকের জাতীয়তাবাদী জয়জয়কারের সময়, একবার আশির দশকের গোড়ায় এবং নব্বইয়ের দশকের শুরুতে। প্রতিবারই সেনাবাহিনীর হাতে অজস্র রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে এবং বাদবাকিরা হয়েছে বিতাড়িত। এবারের দাঙ্গায় নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকার বিষয়ে গণমাধ্যমে তেমন আলোকপাত করা হয়নি। যাঁদের এ ব্যাপারে সজাগ থাকার কথা, সেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের মুখপাত্র বলেছেন, ‘আমাদের বিশ্বাস, নিরাপত্তা বাহিনী এই কঠিন সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পরিস্থিতি সঠিকভাবেই মোকাবিলা করছে।’ কিন্তু স্থানীয় পর্যায় থেকে যেসব খবর পাচ্ছি, তা তাঁর এই নিশ্চিন্ত মনোভাবের সঙ্গে একেবারেই খাপ খায় না।
অন্তত চারজন আমাকে বলেছেন, পুলিশ বাহিনী আরাকানদের সঙ্গে মিলে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ঘরবাড়িতে আগুন লাগাচ্ছে। আরও কয়েকটি প্রতিবেদন জানাচ্ছে, পুলিশ মুসলমান জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করেছে। খেয়াল করতে হবে, মুসলমানরা মিয়ানমারের পুলিশ বাহিনী বা সেনাবাহিনীতে নিষিদ্ধ। দাঙ্গা মোকাবিলার বিষয়ে এই ব্যাপারটা খেয়াল করতে হবে। গত পরশু রাতে সিত্তুউয়িতে গ্রেপ্তার হওয়া এক রাজনীতিবিদকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় এক এনজিওকর্মী। ওদিকে এএফপি বলছে, বার্মিজ পুলিশের গুলিতে আহত এক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে মৃত্যুবরণ করেছেন।
জাতিসংঘ সাধারণত এ ধরনের জটিল পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সহিংসতায় জড়িত থাকার খবর ছাড়া হস্তক্ষেপ করে না। কিন্তু মুশকিল হলো ঘটনা যেখানে ঘটছে, সেখানে সাংবাদিকেরা না থাকায় বোঝা যাচ্ছে না, মৃত্যুগুলোর জন্য আসলে কে দায়ী। ওই এলাকা থেকে জাতিসংঘ তাদের কর্মীদের সরিয়ে নিলেও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সরকারের কাছে পর্যবেক্ষকদের প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার জন্য বলেছে।
এই দাঙ্গায় মুসলমান গোষ্ঠীগুলো অবশ্যই দর্শকের ভূমিকায় নেই। অনেক ক্ষেত্রে তারাও পাল্টা সহিংসতা ঘটাচ্ছে। কিন্তু যেভাবে এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে মুসলমানদের দায়ী করা হচ্ছে তা সঠিক নয়। একটা ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, নিহত মুসলিমদের মাথা মুড়িয়ে, গেরুয়া পোশাক পরিয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা হয়েছে। এরপর তাদের ছবি বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়ে অভিযোগ করা হবে যে মুসলমানরা এসব ব্যক্তিকে হত্যা করেছে।
মিয়ানমারের অতীতের মুসলিমবিরোধী জ্বরের দৃষ্টান্তগুলো মনে রাখলে দেখা যাবে যে এ রকম সময়ে অনেকের যুক্তি-বুদ্ধি একেবারে লোপ পায়। অনেকেই এই পরিস্থিতিকে ব্যবহার করে ফায়দা লোটায় ব্যস্ত। বিশেষত, মিয়ানমারের কট্টরপন্থী সামরিক কর্তারা দাঙ্গাকে ব্যবহার করে ক্ষমতার মূল মঞ্চে আবার ফিরে আসার জন্য কলকাঠি নাড়ছেন। পাশাপাশি, এই অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকেও জটিল করে তুলছে এই সংঘাত।
এশিয়ান করেসপনডেন্ট ডট কম থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
ফ্রান্সিস ওয়াদে: মিয়ানমার ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক প্রতিবেদক।
No comments