শ্রমিক লীগের গুলিতে কাঁপল সড়ক ভবন-স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাসহ গুলিবিদ্ধ ৫

টেন্ডারবাজি ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দেশের যোগাযোগ প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সড়ক ভবনে গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে প্রতিপক্ষের গুলিতে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাসহ পাঁচ ব্যক্তি আহত হয়েছেন। গুলিবিদ্ধদের চারজনই বিভিন্ন পর্যায়ের ঠিকাদার। গুলিবিদ্ধ ঠিকাদাররা অভিযোগ করেছেন,


বাংলাদেশ সড়ক ও জনপথ বিভাগের শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও শ্রমিক লীগ নেতা কামাল উদ্দিন খন্দকারের নেতৃত্বে এ গুলির মহড়া হয়েছে।
গুলিবিদ্ধরা হলেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শামীম শাহরিয়ার (৩৬), সড়ক ও জনপথ বিভাগের ঠিকাদার তৌহিদুল ইসলাম (৩৬), মশিউর রহমান রাজেস (৩৫) ও রিপন (৩২) এবং সওজের গাড়িচালক জাকির হোসেন (৪০)। তাঁদের মধ্যে শামীম শাহরিয়ারের শরীরে তিনটি গুলি বিদ্ধ হয়ছে। তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাঁকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করার পর রাতে ল্যাবএইড হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। অন্যদের শরীরে একটি করে গুলিবিদ্ধ হয়। এ ছাড়া একই ঘটনায় আরেকজন ঠিকাদারকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে আহত করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে সওজের লাইসেন্সধারী ঠিকাদার ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শেখ গোলাম আজম মামুন বলেন, গতকাল সকালে তিনিসহ অন্যান্য ঠিকাদার প্রধান প্রকৌশলী বরাবর সড়ক ভবনে দরপত্র জমা দেওয়ার জন্য একটি আবেদন করেন। বিকেলে তাঁরা ঠিকাদার অ্যাসোসিয়েশনসহ আশপাশের এলাকায় অবস্থান করছিলেন। এ অবস্থায় হঠাৎ তাঁদের ওপর হামলা চালানো হয়।
হামলাকারী কামাল উদ্দিন খন্দকার সড়ক ও জনপথ বিভাগের তেজগাঁও এলেনবাড়ি কার্যালয়ের অফিস সহকারী এবং বাংলাদেশ সড়ক ও জনপথ বিভাগের শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। হামলার সময় তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী রফিকসহ তার সন্ত্রাসী বাহিনীকে ব্যবহার করেন তিনি।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্র জানায়, বিকেল ৪টার পর ছয়টি মোটরসাইকেলে ১২ জন ও একটি প্রাইভেট কারে চারজন সড়ক ভবনের ফটকের কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যেই ভেতরে ঢোকে। সে সময় গাড়িতে অবস্থানকারী প্রত্যেকের হাতে পিস্তল ও রিভলবার ছিল। তারা সড়ক ভবনের ভেতরে ঢোকার পরপরই এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। এতে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাসহ ছয়জন গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এর ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে হামলাকারীরা একই গাড়িতে করে গুলি চালাতে চালাতে ফটক ও সুপ্রিম কোর্টের দিকে অবস্থিত সড়ক ভবনের পেছনের দরজা দিয়ে চলে যায়। তবে হামলার আগেই সড়ক ভবনের নিরাপত্তাকর্মীরা বিষয়টি জেনে পুলিশকে খবর দেন। পুলিশ আসার আগেই হামলাকারীরা পালিয়ে যায়।
তবে প্রত্যক্ষদর্শী অন্য একটি সূত্র দাবি করেছে, গতকালের ঘটনার সময় স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মীরাও পাল্টা গুলি চালান।
সড়ক ভবনের ঠিকাদাররা জানান, শ্রমিক লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের দুটি পক্ষের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার ও টেন্ডারবাজিকে কেন্দ্র করেই এ ঘটনা ঘটেছে। হামলাকারী কামাল উদ্দিন খন্দকার সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) তেজগাঁও এলেনবাড়ি কার্যালয়ের অফিস সহকারী এবং বাংলাদেশ সড়ক ও জনপথ বিভাগের শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। এই সংগঠনটি বর্তমানে শ্রমিক লীগ নিয়ন্ত্রণ করছে। কামাল নিজেও শ্রমিক লীগ নেতা। তাঁর গ্রুপের সঙ্গে সড়ক ও জনপথ বিভাগের ঠিকাদার সমিতির নেতা-কর্মীদের টেন্ডারবাজি ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন ধরে কোন্দল চলে আসছে। ঠিকাদার সমিতিকে বর্তমানে স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মীরা নিয়ন্ত্রণ করছে। গত ৩ জুন দুই পক্ষের মধ্যে মারামারির ঘটনায় শাহবাগ থানায় একটি মামলা হয়েছে। ঘটনার তদন্ত চলছিল। ওই সময় দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি ও লাঠালাঠির ঘটনায় ১০ জন আহত হন। এর পর থেকে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ ছিল চূড়ান্ত পর্যায়ে। সেদিন সকাল ১১টার দিকে সড়ক ভবনের হল রুমে একটি বৈঠক চলছিল। এ সময় কামাল ও তাঁর দলবল সড়ক ভবনের মেকানিক্যাল এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের সভাপতি ইকবাল হোসেনকে বেদম মারধর করে। এরপর তারা সড়ক ভবনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী প্রশাসন কাজী মো. আলীকেও মারধর করে। এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলা নম্বর ৩৯।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ঠিকাদার হাবিবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, বিকেল সোয়া ৪টার দিকে সড়ক ও জনপথ বিভাগের ফটকে আনসার সদস্যরা নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন। সে সময় তিনি ফটকের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। তখন ছয়টি মোটরসাইকেল ও একটি প্রাইভেট কারে কমপক্ষে ২০ জন অস্ত্রধারী ভেতরে ঢোকে। তারা স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা শামীম ও ছাত্রলীগ নেতা সেন্টুকে খুঁজতে থাকে। সে সময় প্রায় ৩০ জন ঠিকাদার ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ অবস্থায় প্রাইভেট কার থেকে পাঁচজন ও মোটরসাইকেলে থাকা কমপক্ষে ১৫ জন পিস্তল তাক করে এলোপাতাড়ি গুলি করে। এতে পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হন। গুলির শব্দে মুহূর্তে পুরো এলাকায় ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অস্ত্রধারীরা ১৫ মিনিটের মধ্যে ফিল্মি স্টাইলে গুলি করতে করতে প্রধান গেট ও সুপ্রিম কোর্টের গেট দিয়ে বের হয়ে যায়।
শাহবাগ থানার ওসি সিরাজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, টেন্ডারবাজি ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এ ঘটনা ঘটেছে। ঘটনায় জড়িতদের সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেছে। ঘটনায় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। হামলাকারীদের ফেলে যাওয়া একটি মোটরসাইকেল ও গুলির খোসা জব্দ করা হয়েছে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপপরিচালক (নিরাপত্তা) চৌধুরী রুহুল আমিন কালের কণ্ঠকে বলেন, "বিকেল ৩টা ৫১ মিনিটে অফিসে আমার কাছে একটি মেসেজ পাঠান শ্রমিক লীগ নেতা টুটুল। তিনি মেসেজে লেখেন, 'কামাল উদ্দিন খন্দকার ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী সড়ক ভবনে হামলা করতে আসছে।' আমি তখন দ্রুত গেটে থাকা নিরপত্তাকর্মীদের (আনসার) ফোন করে বিষয়টি জানাই ও সতর্ক করে দিই। এরপর শাহবাগ থানাকে জানাই। এর কিছুক্ষণের মধ্যে গুলির আওয়াজ পাই। বিকেল ৪টা ১ মিনিটে শাহবাগ থানার ওসিকে ফোন করে হামলার কথা জানাই।"
ঘটনার সময় ফটকে থাকা আনসার সদস্য ও সড়ক ভবনের ক্যাম্প ইনচার্জ মো. মিনহাজ বলেন, 'ঘটনার আগে স্যার (চৌধুরী রুহুল আমিন) আমাকে ফোন দিয়ে জানান, সন্ত্রাসীরা সড়ক ভবনের দিকে রওনা দিয়েছে। স্যার আমাদের সতর্ক হতে বলেন। কিন্তু আমরা সব কিছু গুছিয়ে নেওয়ার আগেই ছয়টি মোটরসাইকেল ও একটি প্রাইভেট কারে আসা সন্ত্রাসীরা অস্ত্র তাক করে ভেতরে ঢুকে পড়ে। এরপর তারা এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। তখন পরিস্থিতি আমাদের বিপক্ষে চলে যায়। হামলাকারীরা কমপক্ষে ৪০ রাউন্ড গুলি ছোড়ে। এতে পাঁচজন গুলিবিদ্ধসহ হামলাকারীদের গাড়ির ধাক্কায় আরো অনেকে আহত হয়েছেন।'
পুলিশ জানায়, ঘটনায় রাত ১১টা পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করা যায়নি।
তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি : সড়ক ভবনে গুলির ঘটনা অনুসন্ধানে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। সড়ক ও জনপথ বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আলীকে প্রধান করে এ কমিটি করা হয়েছে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, কমিটিকে আগামী তিন দিনের মধ্যে সড়ক বিভাগ সচিব এম এ এন সিদ্দিকের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.