কালের পুরাণ-তবু সংসদ বর্জন করবেন না by সোহরাব হাসান

এককথায় ফলাফল শূন্য। বিএনপির স্থায়ী কমিটি দুই দিন বৈঠক করেও সংসদে যোগ দেওয়া না-দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। বিষয়টি ছেড়ে দিয়েছে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ওপর। মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন গত বৃহস্পতিবার রাতে সে কথাই জানিয়েছিলেন সাংবাদিকদের।


কিন্তু শুক্রবার সকালে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার বললেন, প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের আচরণ না বদলালে বিএনপি সংসদে যাবে না। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তাঁদের অভিযোগ, তিনি নাকি কথায় কথায় বিএনপিকে গালাগাল করেন, জিয়া পরিবারের নামে মিথ্যা অপবাদ ছড়ান। সংসদের ষষ্ঠ অধিবেশন শুরু হয়েছে ২০ সেপ্টেম্বর। তার আগেই প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যোগ দিতে নিউইয়র্ক চলে গেছেন। প্রধানমন্ত্রীর অপবাদই যদি বিএনপির সংসদে যাওয়ার ক্ষেত্রে একমাত্র অন্তরায় হয়ে থাকে, তাহলে এই কয়েক দিন তাঁরা গরহাজির থাকলেন কেন? তাঁরা তো রাতভর নিষ্ফল বৈঠক না করে সংসদে গিয়ে বলতে পারতেন, আমরা খোলা মনে সংসদে এসেছি। তবে প্রধানমন্ত্রী বিএনপি ও জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বন্ধ না করলে আমরা তাঁর উপস্থিতিতে সংসদে থাকব না। সেসব না করে একেক নেতা একেক কথা বলে জাতিকে বিভ্রান্ত করছেন। ভাবছেন, দেশের সব মানুষ দুগ্ধপোষ্য শিশু, তাদের হক না-হক যা বলা হবে, তা-ই বিশ্বাস করবে।
রাজনীতিকদের সম্পর্কে একটি সাধারণ কথা প্রচলিত আছে। তাঁরা যা বলেন, তা করেন না। যা করেন, তা বলেন না। সংসদে যাওয়া না-যাওয়া নিয়ে বিএনপির নেতাদের লুকোচুরি সেই কথাটিই মনে করিয়ে দিল। আসলে তাঁরাও বুঝতে পারছেন লাগাতার সংসদ বর্জন ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু যখন না করে বসেছেন তখন ফিরে যাবেন কীভাবে? এ ক্ষেত্রে গল্পের সেই অভিমানী বালকের কথাই মনে পড়ল। সে তার মায়ের সঙ্গে রাগ করে বলে ফেলেছে, ভাত খাবে না। এদিকে ক্ষুধায় পেট চোঁ-চোঁ করছে; মনে মনে বলছে আরেকবার বললেই খাব। বিএনপির আরেকবার বলার দায়িত্বটি কে নেবেন? স্পিকার? চিফ হুইপ। না অন্য কেউ?
বিএনপির রাজনৈতিক সংস্কৃতিটিও বড় অদ্ভুত। যে বৈঠকে খালেদা জিয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হলো, সেই বৈঠকে সভাপ্রধানও ছিলেন তিনি। তাহলে তিনি নিজেকেই কি নিজে দায়িত্ব দিলেন? আর খালেদা জিয়ার একক সিদ্ধান্তেই যদি সবকিছু হবে, তাহলে এত বৈঠক, এত কমিটি-কমিটি খেলা কেন? তিনি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। অবশ্য জন্ম (পড়ুন মিজানুর রহমান খানের বিএনপির জন্ম যেভাবে সেনানিবাসে) থেকে দলটির গঠনতন্ত্র এমনভাবে তৈরি যে দলীয় চেয়ারপারসনই সর্বময় ক্ষমতার মালিক। বিএনপির দেখাদেখি আওয়ামী লীগও ওই পথে এগোচ্ছে। অন্য সবার দায়িত্ব হলো হাততালি দেওয়া, মারহাবা বলা।
আসলে বিএনপির নেতারা ভালো করেই জানেন, দেশের মানুষ অব্যাহত সংসদ বর্জন পছন্দ করছে না। এমনকি দলের সাংসদেরাও এটাকে ভালোভাবে নিচ্ছেন না। কেননা, তাঁদের এলাকায় যেতে হয়। বিএনপিতে এখন দুটি স্পষ্ট ধারা রয়েছে—তারেক অনুসারী ও গত শাসনামলে সুবিধাভোগী প্রভাবশালী অংশটি, যাঁরা গত নির্বাচনে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। আর দ্বিতীয় ধারায় আছেন নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নির্বাচিত হয়ে আসা নেতারা। তাঁরা সংসদে যেতে চাইলেও প্রথম অংশ বাদ সাধছে, দেশনেত্রীকে বোঝাচ্ছেন, সংসদের চেয়ে দল বড়। দলের চেয়ে তারেক বড়।
আমাদের সংসদীয় রাজনীতির প্রধান বাধা হচ্ছে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো সাংসদ দলের সিদ্ধান্তের বাইরে সংসদে বক্তব্য রাখতে পারবেন না। ভোট প্রদান কিংবা ভোট দানে বিরত থাকারও সুযোগ নেই। তাঁকে অবশ্যই দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করতে হবে। বিএনপির সাংসদদের কার ঘাড়ে কটি মাথা যে দলীয় চেয়ারপারসনের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করবেন। মেজর আখতারুজ্জামান আম-ছালা দুই-ই খুইয়েছেন। পরবর্তী সময়ে দেশনেত্রী মুক্তি পরিষদ করেও কাজ হয়নি।
আমাদের কথা হলো, নির্বাচিত হয়ে কেন বিরোধীদলীয় সাংসদেরা সংসদে যাবেন না? তাঁরা বলবেন, সংসদে কথা বলতে দেওয়া হয় না। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হয় না। সরকার সারা দেশে সন্ত্রাস, নৈরাজ্য চালাচ্ছে, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা চালাচ্ছে, মামলা দায়ের করছে। সে সবের জন্যও তো বিরোধী দলকে সংসদে যেতে হবে। গণতন্ত্রে সরকারের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে নালিশ জানানো ও প্রতিকার পাওয়ার উপযুক্ত স্থান জাতীয় সংসদ। সরকারি দল যদি জনগণের কাছে দেওয়া ওয়াদা রক্ষা না করে, বিরোধী দলের ওপর দমনপীড়ন চালায়, সেই কথাগুলোও তাদের সংসদে গিয়ে বলতে হবে। দেশবাসীকে জানাতে হবে।
সংসদে বিরোধী দল গরহাজির থাকলে সরকারি দলের সুবিধা। তারা যা খুশি করতে পারে। আমাদের দেশে এক অদ্ভুত রীতি চালু হয়েছে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে আওয়ামী লীগ সংসদে যাবে না এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে বিএনপি গরহাজির থাকবে। এটিই যেন দেশ ও জনগণের ভবিতব্য হয়ে গেছে। ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনর্যাত্রার দুই দশক পরও এই অবস্থা চলে আসছে। এর প্রতিকার কী? এ জন্য কারা দায়ী? এক অর্থে আমরা সাধারণ ভোটাররাও দায়ী? না হলে এমন জনপ্রতিনিধি আমরা নির্বাচিত করব কেন?
বিরোধী দল সংসদে অনুপস্থিত থাকলে কার ক্ষতি? জনগণের। বিরোধী দল সংসদে না গেলে কার লাভ? অবধারিতভাবে সরকারের। কেননা বিরোধী দল সংসদে থাকলে জনজীবনের সমস্যা ও সংকট নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারত। মন্ত্রী ও সাংসদদের দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে আপত্তি জানাতে পারত। এখন তো সরকার একতরফা সবকিছু করছে। বিরোধী দল সংসদে থাকলে তাদের রক্ষণাত্মক খেলতে হতো, এখন একেবারে আক্রমণাত্মক ভূমিকায়।
এই মুহূর্তে বিরোধী দল সংসদে গেলে পাবনার ঘটনা নিয়ে, গোপালগঞ্জ ও পঞ্চগড়ের ঘটনা নিয়ে তোলপাড় হতো। পাবনায় সরকারি কর্মকর্তারা নিরাপত্তাহীনতায় আছেন। সভা করে দেশবাসীর কাছে ফরিয়াদ জানাচ্ছেন। অথচ বিরোধী দল এ নিয়ে একটি কথাও বলছে না। তারা আছে কার আমলে কয়টি মামলা দায়ের ও প্রত্যাহার করা হয়েছে, তাই নিয়ে। মামলার সমস্যাটি জনগণের নয়। তাদের নিজস্ব। আর পাবনা বা গোপালগঞ্জের সমস্যাটি জনগণের। এসব নিয়ে তাঁরা ভাববেন কেন? বলবেন আমরা ক্ষমতায় এলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। হ্যাঁ, ঠিক হবে, তাঁদের ভাগ্য বদলাবে। আজ যাঁরা জেলে বা রিমান্ডে আছেন, তাঁরা মন্ত্রী হবেন। কিংবা আজ যাঁরা ক্ষমতায় আছেন তাঁদের কেউ কেউ জেলে যাবেন। এই সাপ-লুডু খেলা আর কত দিন চলবে? আজ বিরোধী দল সংসদে থাকলে সরকারি দলকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে পারত পাবনা, বরিশাল বা ভোলার ঘটনায়।
বিএনপি সরকারি দলের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এনেছে, তার সবটাই হয়তো ভিত্তিহীন নয়। সংসদ মাছের বাজার হয়ে গেছে বলে স্পিকার নিজেও একবার উষ্মা প্রকাশ করেছেন। তাই বলে অনন্তকাল সংসদ বর্জন করার রাজনীতিও চলতে পারে না। এর একটি প্রতিকার প্রয়োজন। সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যে বেতন-ভাতা বৃদ্ধি, শুল্কমুক্ত গাড়ির সুবিধা, নিজস্ব বাড়ি থাকলেও ন্যাম ফ্ল্যাট বরাদ্দ নিয়ে আত্মীয়স্বজন, দলীয় ক্যাডারকে ব্যবহার করতে দেওয়ার ব্যাপারে কোনো মতানৈক্য নেই। এমনকি বিদেশ ভ্রমণেও তাঁদের মধ্যে মতভেদ লক্ষ করা যায় না। যত বাধা সংসদে যোগদান নিয়ে।
বিএনপির নেতারা বলছেন, সরকারের নীতি বদলাতে হবে। সংসদ নেত্রীকে অসংসদীয় ভাষা পরিহার করতে হবে। সংসদে ব্যক্তিগত কুৎসা রটনা করা যাবে না। তাঁদের এসব বক্তব্যের সঙ্গে আমরা সহমত প্রকাশ করছি। কিন্তু তার অর্থ এ নয় যে, এগুলো পূরণ না হলে সংসদ বর্জন করতে হবে। ক্ষমতায় থাকতে তারাও কুৎসা রটনায় পিছপা ছিলেন না। শেখ হাসিনার সভায় গ্রেনেড হামলার পর বিএনপির নেতারা বলেছিলেন, এটি আওয়ামী লীগ করেছে আন্দোলনের ইস্যু তৈরি করতে।
আপনারা সংসদ বর্জনের যতই অজুহাত দেখান, তা ধোপে টিকবে না। সংসদ সদস্য পদে থাকলে, বেতন-ভাতা নিলে সংসদে যেতে হবে। এভাবে সংসদ বর্জন করলে বিরোধী দলের গোঁয়ার্তুমি ও জেদ রক্ষা পেলেও গণতন্ত্র রক্ষা পাবে না। অতএব সংসদে আসুন।
এ প্রসঙ্গে বিগত আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপির একটি মতবিনিময় সভায় অগ্রজ সাংবাদিক রিয়াজউদ্দিন আহমেদের বক্তব্যটি পুনরুল্লেখ করতে চাই। সেই সভায় জাতীয় গণমাধ্যমের আরও অনেক সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিক ছিলেন। বিএনপি নেতাদের অভিযোগ ছিল, সরকারি দল সংসদে তাঁদের কথা বলতে দেয় না। জবাবে রিয়াজউদ্দিন আহমেদ ফিলিপাইনের উদাহরণ টেনে বলেছিলেন, কথা বলতে না দিলে আপনারা সংসদ ভবনেই অবস্থান ধর্মঘট করুন। দরকার হলে সেখানে রাত কাটান। তবু সংসদ বর্জন করবেন না। রিয়াজউদ্দিন আহমেদ ২০০১ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়ার প্রেস উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বিএনপির নেতারা তাঁর কথাটি মনে রাখলে বাধিত হব।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.