সপ্তম নৌবহর-বঙ্গোপসাগর এবং এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল প্রসঙ্গ by ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.)
হুজুগে বাঙালি বলে বহুকাল থেকে একটি কথা প্রচলিত আছে। আমার মনে হয় না যে এটা কথার কথা মাত্র। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমরা তা-ই। যেমন- হঠাৎ করে কোনো বিদেশি মিডিয়ায় অবিশ্বাস্য, অযৌক্তিক অথবা কোনো ধরনের প্রমাণাদি ছাড়াই বাংলাদেশকে জড়িয়ে কোনো জনগুরুত্বপূর্ণ সংবাদ পরিবেশন করলে আমরা আগাগোড়া বিশ্লেষণ না করেই বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য,
বিশ্লেষণ, ধারাবাহিক প্রবন্ধ লিখন, টক শোতে তুলাধুনা করে ছাড়ি। আর একবার কেউ কোনো বিতর্কিত বিষয়ের সূত্রপাত করলে, সেই বিষয়টি নিয়ে সবাই মতামত দিতে কুণ্ঠিত হই না।
তবে সেসব মতামত যৌক্তিক কি না তার কোনো জবাবদিহিতা যখন নেই, তখন আমরা সবাই এ রকমই মতামত দিয়ে থাকি। আমার এ লেখার উদ্দেশ্য এই বিষয়ে তত্ত্বকথন নয়। আমি সূচনা বক্তব্যে এই কথাগুলো এ কারণে উল্লেখ করলাম যে বেশ কিছুদিন ধরে আমাদের জাতীয় পত্রিকাগুলোতে ভারতের অন্যতম বিখ্যাত দৈনিক সংবাদপত্র 'দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া'র অনলাইন সংস্করণ 'টাইমস নাউ' (Times Now)-তে বাংলাদেশে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের জন্য ঘাঁটি তৈরির প্রক্রিয়া যুক্তরাষ্ট্র শুরু করেছে বলে ১ জুন একটি অনুমানভিত্তিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকেই এ বিষয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে।
সপ্তম নৌবহরের বাংলাদেশে ঘাঁটি গাড়ার বিষয় নিয়ে ওই সংস্থাটি যে প্রতিবেদন বের করেছে, সেখানে দ্ব্যর্থহীনভাবে চট্টগ্রামের কথা উল্লেখ ছিল। এই সংবাদ পরিবেশক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী (Secretary of state) হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফর এবং এ প্রসঙ্গে সরকারের সঙ্গে গোপন আলোচনার উদ্ধৃতিও করেছে। হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়াকে তাদের পরিবেশিত সংবাদের যুক্তি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। যদিও ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ধরনের সংবাদ এবং সম্ভাবনাকে নাকচ করেছে, তথাপি দেশের জনমনে যথেষ্ট সন্দেহ রয়ে গেছে। সন্দেহ থাকারই কথা। কারণ একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ায় আগ্রাসী নীতি প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ববাসী। অযৌক্তিক অজুহাতে ইরাককে তছনছ করা, আফগানিস্তানে সন্ত্রাসী যুদ্ধের নামে সে দেশটি দখলে রাখার প্রচেষ্টা এবং মধ্যপ্রাচ্যে তথাকথিত আরব-বসন্তকে উসকে দিয়ে ওই অঞ্চলের নকশা বদলে দেওয়ার প্রচেষ্টায় রত থাকা ইত্যাদি কারণে এ দেশের জনগণের মনে মার্কিন উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ তিরোহিত হয়নি। অবশ্য বিষয়টি যখন সপ্তম নৌবহরের উপস্থিতি নিয়ে, সেখানে আমাদের অনুভূতিটি অন্য রকম হবেই। কারণ মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের বিতর্কিত ভূমিকা এবং বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠানোর খবর ওই সময়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা হিসেবে আজও চিহ্নিত রয়েছে। কাজেই এ ধরনের খবরে উৎকণ্ঠা থাকাটা স্বাভাবিক। তবে সে উৎকণ্ঠা কতটা যৌক্তিক, সেটাই উপলব্ধি করার বিষয়। আমি এই সংবাদের উদ্দেশ্য ও যৌক্তিকতার বিষয়ের ওপরই যৎসামান্য মন্তব্য করতে চাই।
আমি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে পরিবেশিত প্রতিবেদন এবং আমাদের বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়ার যৌক্তিকতা আলোচনা করার আগে মার্কিন সপ্তম নৌবহর নিয়ে আলোচনা করতে চাই এবং একই সঙ্গে চীন সাগর অথবা এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে উত্তেজনার বিশদ বিবরণে না গিয়ে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাই। প্রথমেই ওই প্রতিবেদনের মূল শিরোনামে আসি- 'চট্টগ্রামে সপ্তম নৌবহরের জন্য সম্ভাব্য ঘাঁটি গড়ে তোলার মার্কিনি অভিপ্রায়'।
ওই শিরোনামের তাৎপর্য প্রসঙ্গে প্রথমেই বলতে হয়, এ ধরনের সংবাদের উদ্দেশ্য যা-ই থাকুক, আমি কোনো যৌক্তিকতা দেখছি না। কারণ সপ্তম নৌবহরের গঠন, বিশালতা, কার্যক্ষেত্র (দায়িত্বপূর্ণ এলাকা বা AOR) এবং কার্যপরিধি সম্পর্কে অবহিত থাকা। মার্কিন সপ্তম নৌবহর বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় নৌবহর। এ বহরে রয়েছে পারমাণবিক শক্তিচালিত একের অধিক জঙ্গি বিমানবাহী যুদ্ধ জাহাজ, প্রায় ৬০টি বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধ জাহাজ, ৩৬০টি জঙ্গি বিমান এবং ৬০ হাজার মেরিন সেনা। এই বহর গঠিত হয়েছিল ১৯৪৩ সালের ১৫ মার্চ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে। যুদ্ধের পর কলেবর বৃদ্ধি পেয়ে আজকের অবস্থানে এসেছে। এই বহরের বর্তমানের অগ্রগামী ঘাঁটির প্রধান স্থাপনাটি জাপানের ইকোসুকু নৌবন্দরে। আরো রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরে। রয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপাঞ্চল গোয়ামে। ভারত মহাসাগরে তেমন ঘাঁটি না থাকলেও দিয়াগো গার্সিয়া দ্বীপে রয়েছে সরবরাহ, অবসর ও মেরামত ঘাঁটি। জঙ্গি বিমানবাহী যুদ্ধ জাহাজের ডেকে 'রানওয়ে' থাকায় জঙ্গি বিমান পরিচালনার জন্য ঘাঁটির প্রয়োজন হয় না। এই সপ্তম নৌবহরের কার্যপরিধির ব্যাপ্তি জাপান থেকে ভারত-পাকিস্তান পূর্ব সীমান্ত পর্যন্ত। পাকিস্তান থেকে হরমুজ প্রণালি পর্যন্ত পঞ্চম নৌবহরের আওতায়। যদিও ভারত মহাসাগরে মার্কিনিদের তেমন উপস্থিতি নেই, তবে ভবিষ্যতে হবে না তেমনও নয়। হালে সিঙ্গাপুরে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিয়ন প্যানেট্টার এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নৌশক্তি আরো ৬০ শতাংশ বাড়ানোর পরিকল্পনার ঘোষণা দেওয়ার পর ২০২০ সালে ভারত মহাসাগরের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থায় কী পরিবর্তন হবে, সেটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে হবে এ অঞ্চলের দেশগুলোকে।
বাংলাদেশ দূরবর্তী হলেও ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী দেশ, তবে ওই মহাসাগরের উত্তরে সবচেয়ে বড় উপসাগর বঙ্গোপসাগরের সবচেয়ে উত্তরের দেশ। বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশসহ আরো তিনটি দেশ দ্বারা বেষ্টিত। পশ্চিমে ভারতের পূর্ব তীর, পূর্বে মিয়ানমার বা বার্মার দীর্ঘ পশ্চিম তীর এবং মিয়ানমারের আরাকান তট থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার পশ্চিমে ভূ-কৌশলগত দিক থেকে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ মহা নিকোবর ও আন্দামান এবং আন্দামানের উত্তরে ছোট অথচ বর্তমানে ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অতি গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ কোকো দ্বীপ (Great coco Island)। কোকো দ্বীপ এবং আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ৮০ কিলোমিটার প্রস্থ আলেকজান্ডার চ্যানেল দ্বারা বিভাজিত। বাংলাদেশ ব্যতীত দক্ষিণে শ্রীলঙ্কাসহ বাকি তিনটি দেশই সরাসরি ভারত মহাসাগরীয় তীরবর্তী দেশ। এসব দেশের মধ্যে ভারত সর্ববৃহৎ ও সামরিক শক্তির দিক থেকে সবচেয়ে শক্তিধর দেশ হিসেবে ভারত মহাসাগরকে নিজের প্রভাব বলয়ে রাখতেই বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ নৌবাহিনী তৈরি করেছে। এবং এর কলেবর উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ভারত মহাসাগরকে নিজের প্রভাব বলয়ে রাখতে ভারতীয় নৌবাহিনী ক্রমেই নীল পানির (Blue water) নৌশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। মাত্র কয়েক মাস আগে ভারতীয় নৌবাহিনীতে যোগ হয়েছে রাশিয়ার প্রযুক্তি ও সহযোগিতায় নিজস্ব তৈরি প্রথম পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন বা ডুবোজাহাজ। নৌশক্তি প্রদর্শনের জন্য ভারতের পশ্চিম তটে মুম্বাই থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার উত্তরে 'সি-বার্ড' (Sea bird) প্রকল্পাধীন এশিয়ার সর্ববৃহৎ নৌ ঘাঁটি এবং পূর্ব তটে বঙ্গোপসাগর তথা মিয়ানমার উপকূলসহ মালাক্কা প্রণালি পর্যন্ত নিজস্ব প্রভাব বিস্তারের জন্য বিশাখাপত্তম থেকে ৮০ কিলোমিটার উত্তরে আরেকটি নৌ ঘাঁটি তৈরি করেছে। উন্নীত করেছে আন্দামানের পোর্ট-ব্লেয়ার নৌ ঘাঁটি। ভারত সব সময়ই ভারত মহাসাগরকে নিজের প্রভাবাধীন রাখতে সচেতন ছিল। ১৯৬২ সালে চীনের হাতে সামরিক বিপর্যয়ের পর থেকে ভারতীয় সামরিক বাহিনী চীনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে উঠেছে। ১৯৭৪ সালে পারমাণবিক শক্তি সঞ্চয়ের পর থেকে পারমাণবিক অস্ত্র এবং মিসাইলের প্রস্তুতি চীনকে সামনে রেখেই করা হচ্ছে। হালের আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক মিসাইল অগ্নি-৫-এর সফল উৎক্ষেপণ চীনকে অবশ্যই ভাবিয়ে তুলছে। একইভাবে বঙ্গোপসাগরে ভারতীয় নৌবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্য যদিও আন্তর্জাতিক নৌপথকে পাহারা দেওয়ার কথা বলা হয়ে থাকে, তবে বাস্তবে চীনের মিয়ানমার উপস্থিতি, কোকো দ্বীপে কথিত ইলেকট্রনিক নজরদারি এবং আরাকান তটের কিয়াউকাপি বন্দর থেকে চীনের ইউনান প্রদেশের রুলি হয়ে কুনমিং পর্যন্ত তেল-গ্যাস পাইপলাইন এবং ২০১৩ সালের মধ্যে রেললাইন স্থাপন নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন রয়েছে। বর্তমানে ভারতীয় নৌবাহিনীর নজরদারিতে রয়েছে এই অঞ্চল।
বিগত তিন দশকে চীন-মিয়ানমার সম্পর্ক এবং চীন-বাংলাদেশ সামরিক সম্পর্ক নিয়ে ভারতের যথেষ্ট উদ্বেগ ছিল। বিশেষ করে মিয়ানমারের ভূখণ্ড দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব চীনের সঙ্গে আরাকান অঞ্চল হয়ে সিতওয়ে বন্দরের দক্ষিণে কিয়াউকাপি তেল-গ্যাস টার্মিনাল তৈরি ভারতের জন্যও উদ্বেগজনক ছিল সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে উত্তর ও সাহারার দক্ষিণের আফ্রিকার দেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যের তেল দক্ষিণ-পূর্বে নিয়ে যেতে চীন মালাক্কা প্রণালি এড়িয়ে চলতে বঙ্গোপসাগরে মিয়ানমারের এ পথ তৈরি করাকে যুক্তরাষ্ট্রও খুব সহজভাবে গ্রহণ করেনি। মিয়ানমারের বর্তমান অভ্যন্তরীণ রাজনীতির যৎসামান্য পরিবর্তনের অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র তথা ইউরোপ যেভাবে মিয়ানমারে উপস্থিতি বাড়ানোর প্রত্যয় করেছে, তাতে চীনকে কোণঠাসা করার বিশেষ প্রয়াস পরিলক্ষিত। এখানেই ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-কৌশলগত সহাবস্থান প্রমাণিত।
যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ চীন সাগরে চীনা নৌবাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতি এবং শক্তির মহড়ায় যথেষ্ট চিন্তিত। যে কারণে লিয়ন প্যানেট্টা ওই অঞ্চলে শক্তি বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন, যা চীন সহজভাবে নেয়নি। দক্ষিণ চীন সাগরের সীমানা নিয়ে চীনের অনমনীয় দাবিতে শঙ্কিত জাপান, ফিলিপাইন, দক্ষিণ কোরিয়া, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, এমনকি একসময়ের যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী ভিয়েতনামও। ওই অঞ্চলেই যুক্তরাষ্ট্র মিত্র দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে চীনের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েছে। ২০০৭ সালে ডালাস ও তাইওয়ানের মধ্যবর্তী অঞ্চলে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের মহড়ার সময় জঙ্গি বিমানবাহী যুদ্ধ জাহাজ কিটি হকের পাশে হঠাৎ উদয় হওয়া সং শ্রেণীর চীনের (Song class) সাবমেরিনের ঘটনাই ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রকে ওই অঞ্চলে চীনের শক্তি এবং নৌবহরের আধুনিকতার বার্তা দিয়েছিল। সেই ঘটনার পর থেকে চীনের শক্তি নিয়ে যথেষ্ট চিন্তিত যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক নীতিনির্ধারকরা।
অন্যদিকে ভারত মহাসাগরেও চীনের শক্তি প্রদর্শনকে যেমন হালকাভাবে নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র, তেমনি চীনের ব্যাপক উপস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে মরিয়া ভারত। তবে ভারত কখনোই ভারত মহাসাগরে, বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরে স্থায়ী মার্কিন উপস্থিতি সমর্থন করবে না। ভারতের এই মনোভাব মার্কিনিদের কাছে অজানা নয়। বস্তুতপক্ষে দক্ষিণ এশিয়ায় পরিবর্তিত মার্কিন ভূ-কৌশলগত নীতি ভারতকেন্দ্রিক, তাতে সন্দেহ নেই। তথাপি ভারত মহাসাগর নিয়ে দিল্লির উৎকণ্ঠা কম নয়। ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সামরিক বাহিনী প্রত্যাহারের পর ভারতে উপস্থিতি বাড়াতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। মাত্র কয়েক দিন আগেই মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিয়ন প্যানেট্টা ভারত সফরকালে এমনই ইচ্ছা প্রকাশ করেন। বঙ্গোপসাগরে মার্কিন উপস্থিতি যে ভারতের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, তা-ও মার্কিনিদের কাছে গোপনীয় নয়। তথাপি ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভূ-কৌশলগত কারণে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের ওপর যথেষ্ট নির্ভরশীল। কাজেই ভারতের অসম্মতিতে বঙ্গোপসাগরে মার্কিন নৌবহরের স্থায়ী ঘাঁটি গড়ে ওঠার সম্ভাবনা যথেষ্ট কম। তবে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলের প্রতিটি দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র আলাদাভাবে সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী। একই সঙ্গে সম্পর্কের গভীরতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কার ওপর চীনের প্রভাব কমাতে সচেষ্ট যুক্তরাষ্ট্র।
ওপরে বর্ণিত ভূ-কৌশলগত কারণেই বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে চীনের প্রভাব খর্ব করতে একদিকে যেমন ভারতের সঙ্গে ক্রমেই নিবিড় সামরিক সম্পর্ক উন্নয়নের প্রয়াসে যুক্তরাষ্ট্র লিপ্ত, তেমনি মিয়ানমারের ব্যাপক উপস্থিতির ক্ষেত্র প্রস্তুতের নীতি বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর। অন্যদিকে মিয়ানমারের ভূ-কৌশলগত গুরুত্বের পরিপ্রেক্ষিতে এ অঞ্চলে চীনা প্রভাব খর্ব করতে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশকে যুক্ত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের নিতিনির্ধারকরা। সে কারণে বাংলাদেশের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র সীমানা বিরোধ নিরসনের পর মিয়ানমারের তথাকথিত গণতন্ত্রের পথে অগ্রযাত্রা এবং রুদ্ধ দ্বার সম্পূর্ণ খুলে দেওয়ার কারণে প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে। অন্যদিকে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে চীনের বিচরণকে সীমিত রাখতে হলে এই বাংলাদেশেরও যে সহযোগিতার প্রয়োজন, তা হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হয়েছে। ওয়াশিংটন যে বাংলাদেশের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের নীতি গ্রহণ করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। আমি মনে করি, এ কারণেই এ ধরনের বিভ্রান্তিকর প্রতিবেদনের সূত্রপাত ভারতীয় মিডিয়ায়। ওয়াশিংটনের ঢাকার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ অস্বস্তিকর হতে পারে বলে মনে করেন অনেক ভারতীয়। ওপরের সংক্ষিপ্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে ভারতের পত্রিকার যে প্রতিবেদন নিয়ে আমাদের দেশে এত বিতর্ক, তার পেছনে যৌক্তিকতা নেই বলে আমি মনে করি। সপ্তম নৌবহর তো নয়ই, ওই নৌবহরের কোনো টাস্কফোর্সের স্থায়ী ঘাঁটি গড়ার মতো স্থান চট্টগ্রাম অঞ্চলে নেই। এমনকি অনেকে মনে করেন, আমাদের দেশে একমাত্র কোরাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে যুক্তরাষ্ট্র ঘাঁটি গড়তে পারে। সামরিক বিশ্লেষণে ভৌগোলিক অবস্থান, ওই অঞ্চলে বঙ্গোপসাগরের নাব্যতা ইত্যাদি মিলিয়ে এ ধরনের সম্ভাবনার যৌক্তিকতা পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। তবে এ কথা ঠিক, বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব খর্ব করার প্রয়াসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা তীরবর্তী দেশগুলোর সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা বাড়ানোর মধ্য দিয়ে পর্যবেক্ষণের অবস্থান তৈরি করারও যথেষ্ট উদ্যোগ এরই মধ্যে গ্রহণ করেছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনীর সঙ্গে পেন্টাগন তথা প্রশান্ত মহাসাগরীয় কমান্ডের (Pacific command) সঙ্গে যোগাযোগ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, বাংলাদেশের এই দুই বাহিনীর উপসাগরে উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য কারিগরি সহায়তার দ্বার খুলতে শুরু করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তথ্য মোতাবেক, গত কয়েক বছর নৌবাহিনীর মেরিন সেনাদের প্রশিক্ষণে রয়েছে মার্কিন সহায়তা। এ ধরনের সহযোগিতার মাধ্যমেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ উপস্থিতি বাড়বে। সে ক্ষেত্রে চীনের প্রতিক্রিয়া কী হবে, অথবা ভবিষ্যতে আমাদের চীননীতি কোন পথে গড়াবে, তা এখনই অনুধাবন করা সহজ নয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে ভারসাম্য রক্ষাই সময়ের দাবি। দুর্বল এবং নরম দেশ (Soft State) হিসেবে পররাষ্ট্র নীতিতে স্বকীয়তা বজায় রাখা আমাদের দায়িত্ব। পররাষ্ট্র তথা প্রতিরক্ষা নীতি ভাবাবেগ দ্বারা নয়, বাস্তবতা ও যৌক্তিকতার ওপরই রচিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
বর্তমানে দক্ষিণ চীন সাগরে যে উত্তেজনা রয়েছে, তা প্রশমিত হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এ উত্তেজনা ভারত মহাসাগরেও ছড়াবে, তাতে সন্দেহ নেই। ওই উত্তেজনার তাপ থেকে বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী ক্ষুদ্র ও দুর্বল দেশগুলোতে ছড়াবে- তাতে সন্দেহ নেই।
লেখক : সাবেক নির্বাচন কমিশনার, কলাম লেখক, নিরাপত্তা ও ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক
e-mail : hhintlbd@yahoo.com
তবে সেসব মতামত যৌক্তিক কি না তার কোনো জবাবদিহিতা যখন নেই, তখন আমরা সবাই এ রকমই মতামত দিয়ে থাকি। আমার এ লেখার উদ্দেশ্য এই বিষয়ে তত্ত্বকথন নয়। আমি সূচনা বক্তব্যে এই কথাগুলো এ কারণে উল্লেখ করলাম যে বেশ কিছুদিন ধরে আমাদের জাতীয় পত্রিকাগুলোতে ভারতের অন্যতম বিখ্যাত দৈনিক সংবাদপত্র 'দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া'র অনলাইন সংস্করণ 'টাইমস নাউ' (Times Now)-তে বাংলাদেশে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের জন্য ঘাঁটি তৈরির প্রক্রিয়া যুক্তরাষ্ট্র শুরু করেছে বলে ১ জুন একটি অনুমানভিত্তিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকেই এ বিষয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে।
সপ্তম নৌবহরের বাংলাদেশে ঘাঁটি গাড়ার বিষয় নিয়ে ওই সংস্থাটি যে প্রতিবেদন বের করেছে, সেখানে দ্ব্যর্থহীনভাবে চট্টগ্রামের কথা উল্লেখ ছিল। এই সংবাদ পরিবেশক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী (Secretary of state) হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফর এবং এ প্রসঙ্গে সরকারের সঙ্গে গোপন আলোচনার উদ্ধৃতিও করেছে। হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়াকে তাদের পরিবেশিত সংবাদের যুক্তি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। যদিও ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ধরনের সংবাদ এবং সম্ভাবনাকে নাকচ করেছে, তথাপি দেশের জনমনে যথেষ্ট সন্দেহ রয়ে গেছে। সন্দেহ থাকারই কথা। কারণ একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ায় আগ্রাসী নীতি প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ববাসী। অযৌক্তিক অজুহাতে ইরাককে তছনছ করা, আফগানিস্তানে সন্ত্রাসী যুদ্ধের নামে সে দেশটি দখলে রাখার প্রচেষ্টা এবং মধ্যপ্রাচ্যে তথাকথিত আরব-বসন্তকে উসকে দিয়ে ওই অঞ্চলের নকশা বদলে দেওয়ার প্রচেষ্টায় রত থাকা ইত্যাদি কারণে এ দেশের জনগণের মনে মার্কিন উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ তিরোহিত হয়নি। অবশ্য বিষয়টি যখন সপ্তম নৌবহরের উপস্থিতি নিয়ে, সেখানে আমাদের অনুভূতিটি অন্য রকম হবেই। কারণ মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের বিতর্কিত ভূমিকা এবং বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠানোর খবর ওই সময়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা হিসেবে আজও চিহ্নিত রয়েছে। কাজেই এ ধরনের খবরে উৎকণ্ঠা থাকাটা স্বাভাবিক। তবে সে উৎকণ্ঠা কতটা যৌক্তিক, সেটাই উপলব্ধি করার বিষয়। আমি এই সংবাদের উদ্দেশ্য ও যৌক্তিকতার বিষয়ের ওপরই যৎসামান্য মন্তব্য করতে চাই।
আমি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে পরিবেশিত প্রতিবেদন এবং আমাদের বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়ার যৌক্তিকতা আলোচনা করার আগে মার্কিন সপ্তম নৌবহর নিয়ে আলোচনা করতে চাই এবং একই সঙ্গে চীন সাগর অথবা এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে উত্তেজনার বিশদ বিবরণে না গিয়ে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাই। প্রথমেই ওই প্রতিবেদনের মূল শিরোনামে আসি- 'চট্টগ্রামে সপ্তম নৌবহরের জন্য সম্ভাব্য ঘাঁটি গড়ে তোলার মার্কিনি অভিপ্রায়'।
ওই শিরোনামের তাৎপর্য প্রসঙ্গে প্রথমেই বলতে হয়, এ ধরনের সংবাদের উদ্দেশ্য যা-ই থাকুক, আমি কোনো যৌক্তিকতা দেখছি না। কারণ সপ্তম নৌবহরের গঠন, বিশালতা, কার্যক্ষেত্র (দায়িত্বপূর্ণ এলাকা বা AOR) এবং কার্যপরিধি সম্পর্কে অবহিত থাকা। মার্কিন সপ্তম নৌবহর বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় নৌবহর। এ বহরে রয়েছে পারমাণবিক শক্তিচালিত একের অধিক জঙ্গি বিমানবাহী যুদ্ধ জাহাজ, প্রায় ৬০টি বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধ জাহাজ, ৩৬০টি জঙ্গি বিমান এবং ৬০ হাজার মেরিন সেনা। এই বহর গঠিত হয়েছিল ১৯৪৩ সালের ১৫ মার্চ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে। যুদ্ধের পর কলেবর বৃদ্ধি পেয়ে আজকের অবস্থানে এসেছে। এই বহরের বর্তমানের অগ্রগামী ঘাঁটির প্রধান স্থাপনাটি জাপানের ইকোসুকু নৌবন্দরে। আরো রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরে। রয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপাঞ্চল গোয়ামে। ভারত মহাসাগরে তেমন ঘাঁটি না থাকলেও দিয়াগো গার্সিয়া দ্বীপে রয়েছে সরবরাহ, অবসর ও মেরামত ঘাঁটি। জঙ্গি বিমানবাহী যুদ্ধ জাহাজের ডেকে 'রানওয়ে' থাকায় জঙ্গি বিমান পরিচালনার জন্য ঘাঁটির প্রয়োজন হয় না। এই সপ্তম নৌবহরের কার্যপরিধির ব্যাপ্তি জাপান থেকে ভারত-পাকিস্তান পূর্ব সীমান্ত পর্যন্ত। পাকিস্তান থেকে হরমুজ প্রণালি পর্যন্ত পঞ্চম নৌবহরের আওতায়। যদিও ভারত মহাসাগরে মার্কিনিদের তেমন উপস্থিতি নেই, তবে ভবিষ্যতে হবে না তেমনও নয়। হালে সিঙ্গাপুরে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিয়ন প্যানেট্টার এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নৌশক্তি আরো ৬০ শতাংশ বাড়ানোর পরিকল্পনার ঘোষণা দেওয়ার পর ২০২০ সালে ভারত মহাসাগরের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থায় কী পরিবর্তন হবে, সেটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে হবে এ অঞ্চলের দেশগুলোকে।
বাংলাদেশ দূরবর্তী হলেও ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী দেশ, তবে ওই মহাসাগরের উত্তরে সবচেয়ে বড় উপসাগর বঙ্গোপসাগরের সবচেয়ে উত্তরের দেশ। বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশসহ আরো তিনটি দেশ দ্বারা বেষ্টিত। পশ্চিমে ভারতের পূর্ব তীর, পূর্বে মিয়ানমার বা বার্মার দীর্ঘ পশ্চিম তীর এবং মিয়ানমারের আরাকান তট থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার পশ্চিমে ভূ-কৌশলগত দিক থেকে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ মহা নিকোবর ও আন্দামান এবং আন্দামানের উত্তরে ছোট অথচ বর্তমানে ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অতি গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ কোকো দ্বীপ (Great coco Island)। কোকো দ্বীপ এবং আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ৮০ কিলোমিটার প্রস্থ আলেকজান্ডার চ্যানেল দ্বারা বিভাজিত। বাংলাদেশ ব্যতীত দক্ষিণে শ্রীলঙ্কাসহ বাকি তিনটি দেশই সরাসরি ভারত মহাসাগরীয় তীরবর্তী দেশ। এসব দেশের মধ্যে ভারত সর্ববৃহৎ ও সামরিক শক্তির দিক থেকে সবচেয়ে শক্তিধর দেশ হিসেবে ভারত মহাসাগরকে নিজের প্রভাব বলয়ে রাখতেই বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ নৌবাহিনী তৈরি করেছে। এবং এর কলেবর উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ভারত মহাসাগরকে নিজের প্রভাব বলয়ে রাখতে ভারতীয় নৌবাহিনী ক্রমেই নীল পানির (Blue water) নৌশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। মাত্র কয়েক মাস আগে ভারতীয় নৌবাহিনীতে যোগ হয়েছে রাশিয়ার প্রযুক্তি ও সহযোগিতায় নিজস্ব তৈরি প্রথম পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন বা ডুবোজাহাজ। নৌশক্তি প্রদর্শনের জন্য ভারতের পশ্চিম তটে মুম্বাই থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার উত্তরে 'সি-বার্ড' (Sea bird) প্রকল্পাধীন এশিয়ার সর্ববৃহৎ নৌ ঘাঁটি এবং পূর্ব তটে বঙ্গোপসাগর তথা মিয়ানমার উপকূলসহ মালাক্কা প্রণালি পর্যন্ত নিজস্ব প্রভাব বিস্তারের জন্য বিশাখাপত্তম থেকে ৮০ কিলোমিটার উত্তরে আরেকটি নৌ ঘাঁটি তৈরি করেছে। উন্নীত করেছে আন্দামানের পোর্ট-ব্লেয়ার নৌ ঘাঁটি। ভারত সব সময়ই ভারত মহাসাগরকে নিজের প্রভাবাধীন রাখতে সচেতন ছিল। ১৯৬২ সালে চীনের হাতে সামরিক বিপর্যয়ের পর থেকে ভারতীয় সামরিক বাহিনী চীনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে উঠেছে। ১৯৭৪ সালে পারমাণবিক শক্তি সঞ্চয়ের পর থেকে পারমাণবিক অস্ত্র এবং মিসাইলের প্রস্তুতি চীনকে সামনে রেখেই করা হচ্ছে। হালের আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক মিসাইল অগ্নি-৫-এর সফল উৎক্ষেপণ চীনকে অবশ্যই ভাবিয়ে তুলছে। একইভাবে বঙ্গোপসাগরে ভারতীয় নৌবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্য যদিও আন্তর্জাতিক নৌপথকে পাহারা দেওয়ার কথা বলা হয়ে থাকে, তবে বাস্তবে চীনের মিয়ানমার উপস্থিতি, কোকো দ্বীপে কথিত ইলেকট্রনিক নজরদারি এবং আরাকান তটের কিয়াউকাপি বন্দর থেকে চীনের ইউনান প্রদেশের রুলি হয়ে কুনমিং পর্যন্ত তেল-গ্যাস পাইপলাইন এবং ২০১৩ সালের মধ্যে রেললাইন স্থাপন নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন রয়েছে। বর্তমানে ভারতীয় নৌবাহিনীর নজরদারিতে রয়েছে এই অঞ্চল।
বিগত তিন দশকে চীন-মিয়ানমার সম্পর্ক এবং চীন-বাংলাদেশ সামরিক সম্পর্ক নিয়ে ভারতের যথেষ্ট উদ্বেগ ছিল। বিশেষ করে মিয়ানমারের ভূখণ্ড দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব চীনের সঙ্গে আরাকান অঞ্চল হয়ে সিতওয়ে বন্দরের দক্ষিণে কিয়াউকাপি তেল-গ্যাস টার্মিনাল তৈরি ভারতের জন্যও উদ্বেগজনক ছিল সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে উত্তর ও সাহারার দক্ষিণের আফ্রিকার দেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যের তেল দক্ষিণ-পূর্বে নিয়ে যেতে চীন মালাক্কা প্রণালি এড়িয়ে চলতে বঙ্গোপসাগরে মিয়ানমারের এ পথ তৈরি করাকে যুক্তরাষ্ট্রও খুব সহজভাবে গ্রহণ করেনি। মিয়ানমারের বর্তমান অভ্যন্তরীণ রাজনীতির যৎসামান্য পরিবর্তনের অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র তথা ইউরোপ যেভাবে মিয়ানমারে উপস্থিতি বাড়ানোর প্রত্যয় করেছে, তাতে চীনকে কোণঠাসা করার বিশেষ প্রয়াস পরিলক্ষিত। এখানেই ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-কৌশলগত সহাবস্থান প্রমাণিত।
যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ চীন সাগরে চীনা নৌবাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতি এবং শক্তির মহড়ায় যথেষ্ট চিন্তিত। যে কারণে লিয়ন প্যানেট্টা ওই অঞ্চলে শক্তি বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন, যা চীন সহজভাবে নেয়নি। দক্ষিণ চীন সাগরের সীমানা নিয়ে চীনের অনমনীয় দাবিতে শঙ্কিত জাপান, ফিলিপাইন, দক্ষিণ কোরিয়া, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, এমনকি একসময়ের যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী ভিয়েতনামও। ওই অঞ্চলেই যুক্তরাষ্ট্র মিত্র দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে চীনের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েছে। ২০০৭ সালে ডালাস ও তাইওয়ানের মধ্যবর্তী অঞ্চলে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের মহড়ার সময় জঙ্গি বিমানবাহী যুদ্ধ জাহাজ কিটি হকের পাশে হঠাৎ উদয় হওয়া সং শ্রেণীর চীনের (Song class) সাবমেরিনের ঘটনাই ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রকে ওই অঞ্চলে চীনের শক্তি এবং নৌবহরের আধুনিকতার বার্তা দিয়েছিল। সেই ঘটনার পর থেকে চীনের শক্তি নিয়ে যথেষ্ট চিন্তিত যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক নীতিনির্ধারকরা।
অন্যদিকে ভারত মহাসাগরেও চীনের শক্তি প্রদর্শনকে যেমন হালকাভাবে নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র, তেমনি চীনের ব্যাপক উপস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে মরিয়া ভারত। তবে ভারত কখনোই ভারত মহাসাগরে, বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরে স্থায়ী মার্কিন উপস্থিতি সমর্থন করবে না। ভারতের এই মনোভাব মার্কিনিদের কাছে অজানা নয়। বস্তুতপক্ষে দক্ষিণ এশিয়ায় পরিবর্তিত মার্কিন ভূ-কৌশলগত নীতি ভারতকেন্দ্রিক, তাতে সন্দেহ নেই। তথাপি ভারত মহাসাগর নিয়ে দিল্লির উৎকণ্ঠা কম নয়। ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সামরিক বাহিনী প্রত্যাহারের পর ভারতে উপস্থিতি বাড়াতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। মাত্র কয়েক দিন আগেই মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিয়ন প্যানেট্টা ভারত সফরকালে এমনই ইচ্ছা প্রকাশ করেন। বঙ্গোপসাগরে মার্কিন উপস্থিতি যে ভারতের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, তা-ও মার্কিনিদের কাছে গোপনীয় নয়। তথাপি ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভূ-কৌশলগত কারণে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের ওপর যথেষ্ট নির্ভরশীল। কাজেই ভারতের অসম্মতিতে বঙ্গোপসাগরে মার্কিন নৌবহরের স্থায়ী ঘাঁটি গড়ে ওঠার সম্ভাবনা যথেষ্ট কম। তবে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলের প্রতিটি দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র আলাদাভাবে সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী। একই সঙ্গে সম্পর্কের গভীরতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কার ওপর চীনের প্রভাব কমাতে সচেষ্ট যুক্তরাষ্ট্র।
ওপরে বর্ণিত ভূ-কৌশলগত কারণেই বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে চীনের প্রভাব খর্ব করতে একদিকে যেমন ভারতের সঙ্গে ক্রমেই নিবিড় সামরিক সম্পর্ক উন্নয়নের প্রয়াসে যুক্তরাষ্ট্র লিপ্ত, তেমনি মিয়ানমারের ব্যাপক উপস্থিতির ক্ষেত্র প্রস্তুতের নীতি বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর। অন্যদিকে মিয়ানমারের ভূ-কৌশলগত গুরুত্বের পরিপ্রেক্ষিতে এ অঞ্চলে চীনা প্রভাব খর্ব করতে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশকে যুক্ত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের নিতিনির্ধারকরা। সে কারণে বাংলাদেশের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র সীমানা বিরোধ নিরসনের পর মিয়ানমারের তথাকথিত গণতন্ত্রের পথে অগ্রযাত্রা এবং রুদ্ধ দ্বার সম্পূর্ণ খুলে দেওয়ার কারণে প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে। অন্যদিকে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে চীনের বিচরণকে সীমিত রাখতে হলে এই বাংলাদেশেরও যে সহযোগিতার প্রয়োজন, তা হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হয়েছে। ওয়াশিংটন যে বাংলাদেশের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের নীতি গ্রহণ করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। আমি মনে করি, এ কারণেই এ ধরনের বিভ্রান্তিকর প্রতিবেদনের সূত্রপাত ভারতীয় মিডিয়ায়। ওয়াশিংটনের ঢাকার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ অস্বস্তিকর হতে পারে বলে মনে করেন অনেক ভারতীয়। ওপরের সংক্ষিপ্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে ভারতের পত্রিকার যে প্রতিবেদন নিয়ে আমাদের দেশে এত বিতর্ক, তার পেছনে যৌক্তিকতা নেই বলে আমি মনে করি। সপ্তম নৌবহর তো নয়ই, ওই নৌবহরের কোনো টাস্কফোর্সের স্থায়ী ঘাঁটি গড়ার মতো স্থান চট্টগ্রাম অঞ্চলে নেই। এমনকি অনেকে মনে করেন, আমাদের দেশে একমাত্র কোরাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে যুক্তরাষ্ট্র ঘাঁটি গড়তে পারে। সামরিক বিশ্লেষণে ভৌগোলিক অবস্থান, ওই অঞ্চলে বঙ্গোপসাগরের নাব্যতা ইত্যাদি মিলিয়ে এ ধরনের সম্ভাবনার যৌক্তিকতা পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। তবে এ কথা ঠিক, বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব খর্ব করার প্রয়াসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা তীরবর্তী দেশগুলোর সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা বাড়ানোর মধ্য দিয়ে পর্যবেক্ষণের অবস্থান তৈরি করারও যথেষ্ট উদ্যোগ এরই মধ্যে গ্রহণ করেছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনীর সঙ্গে পেন্টাগন তথা প্রশান্ত মহাসাগরীয় কমান্ডের (Pacific command) সঙ্গে যোগাযোগ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, বাংলাদেশের এই দুই বাহিনীর উপসাগরে উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য কারিগরি সহায়তার দ্বার খুলতে শুরু করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তথ্য মোতাবেক, গত কয়েক বছর নৌবাহিনীর মেরিন সেনাদের প্রশিক্ষণে রয়েছে মার্কিন সহায়তা। এ ধরনের সহযোগিতার মাধ্যমেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ উপস্থিতি বাড়বে। সে ক্ষেত্রে চীনের প্রতিক্রিয়া কী হবে, অথবা ভবিষ্যতে আমাদের চীননীতি কোন পথে গড়াবে, তা এখনই অনুধাবন করা সহজ নয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে ভারসাম্য রক্ষাই সময়ের দাবি। দুর্বল এবং নরম দেশ (Soft State) হিসেবে পররাষ্ট্র নীতিতে স্বকীয়তা বজায় রাখা আমাদের দায়িত্ব। পররাষ্ট্র তথা প্রতিরক্ষা নীতি ভাবাবেগ দ্বারা নয়, বাস্তবতা ও যৌক্তিকতার ওপরই রচিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
বর্তমানে দক্ষিণ চীন সাগরে যে উত্তেজনা রয়েছে, তা প্রশমিত হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এ উত্তেজনা ভারত মহাসাগরেও ছড়াবে, তাতে সন্দেহ নেই। ওই উত্তেজনার তাপ থেকে বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী ক্ষুদ্র ও দুর্বল দেশগুলোতে ছড়াবে- তাতে সন্দেহ নেই।
লেখক : সাবেক নির্বাচন কমিশনার, কলাম লেখক, নিরাপত্তা ও ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক
e-mail : hhintlbd@yahoo.com
No comments