শিক্ষাঙ্গন-জাবিতে অস্থিতিশীলতা কাম্য নয় by তারেক শামসুর রেহমান
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি সকল শিক্ষকের প্রতিনিধিত্ব করে। তরুণ শিক্ষকরা যদি মনে করে থাকেন, তাদের অপমান করা হয়েছে, তারা শিক্ষক সমিতির কাছে অভিযোগটি তুলতে পারেন। সমিতি বিষয়টি দেখতে পারে। আমরা তো এভাবেই সমস্যার সমাধান করি। সবচেয়ে বড় কথা, একটি অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে।
এর পেছনে সত্যতা আছে কি নেই, আমরা জানি না। তবে অভিযোগটি বেশ পুরনো। এ ক্ষেত্রে তরুণ শিক্ষকরা দাবি করুক একটি নিরপেক্ষ তদন্তের, যাতে করে প্রকৃত 'সত্য' বেরিয়ে আসবে। আমরা তো তেমনটি চাই। এটা তাদের জন্যও ভালো
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়া উপাচার্য দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে যখন স্থিতিশীলতা ফিরে আসছে, ঠিক তখনই নতুন করে আন্দোলনের একটি খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। এতদিন আন্দোলনে ছিল 'শিক্ষক সমাজ'। এবার আন্দোলনে নামছেন 'মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে আমরা' নামক একটি সংগঠনের ব্যানারে নবনিযুক্ত শিক্ষকরা। এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন ড. হাসিবুর রহমান, যিনি পদত্যাগকারী উপাচার্য শরীফ এনামুল কবিরের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত। তাদের অভিযোগ, 'শিক্ষক সমাজে'র নেতা অধ্যাপক নাসিম আখতার হোসেন আন্দোলন চলাকালীন 'অর্থের বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে' বলে যে দাবি করেছেন, তা মিথ্যা। তারা উপাচার্যের কাছে স্মারকলিপি দিয়ে অধ্যাপক হোসেনের বিচারও দাবি করেছেন। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। 'শিক্ষক সমাজে'র নেতৃবৃন্দ গত ২৬ মে নবনিযুক্ত উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করে এ ঘটনার প্রতিবাদও জানিয়েছেন। এটা কোনো ভালো লক্ষণ নয়। নবনিযুক্ত শিক্ষকদের অভিযোগ থাকতেই পারে। কিন্তু আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা কাম্য হতে পারে না। আমি যতদূর জানি, 'শিক্ষক সমাজে'র নেতা অধ্যাপক নাসিম আখতার হোসেন ঢালাওভাবে নবনিযুক্ত সকল শিক্ষকের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ আনেননি। তিনি কেন, শিক্ষক সমাজের অনেক নেতাই, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব সিনিয়র শিক্ষক, তারা একাধিকবার এই অভিযোগটি তুলেছেন। গণমাধ্যমেও এ ধরনের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। সেদিন যদি এর প্রতিবাদ উঠত, তাহলে অভিযোগটি এত দূর গড়াত না। অভিযোগ অভিযোগই। এর মাঝে সত্যতাও থাকতে পারে, মিথ্যাও হতে পারে। কিন্তু এটা নিয়ে দু'পক্ষ পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাবে, এটা তো কাম্য হতে পারে না। নয়া উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়টিকে বিশ্বমানে উন্নত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তিনি সবাইকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে চান। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক না হলেও, তিনি শিক্ষক সমাজের সমস্যা সম্পর্কে জানেন। দীর্ঘদিন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা সম্পর্কে তিনি অবহিত নন, এটা আমি বিশ্বাস করি না। তিনি জানেন ও বোঝেন। সমস্যা সমাধানে তাকে সময় দিতে হবে। তিনি যখন সবে দায়িত্ব নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে এনেছেন, তখন 'মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে আমরা' একটি কর্মসূচি দিয়ে জাবি প্রশাসনকে একটি বিব্রতকর অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে। কর্মসূচি দেওয়ার তো আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল না। তারা স্মারকলিপি দিয়েছেন, এটা কি যথেষ্ট ছিল না? এভাবে একজন সিনিয়র শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনাটা অশোভন, দৃষ্টিকটু। আমরা কি এতে করে প্রকারান্তরে সিনিয়র-জুনিয়র ব্যবধান তৈরি করছি না? অধ্যাপক নাসিম আখতার হোসেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষকদের একজন। আজ যারা 'মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে আমরা' ব্যানারে সমবেত হয়েছেন, তাদের প্রায় সবাই তার ছাত্রতুল্য, ছাত্রও বটে। এতে করে কি সিনিয়র শিক্ষকদের অসম্মানিত করা হলো না? যে দুইশ' শিক্ষক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন গত তিন বছরে, এটা অস্বাভাবিক। আমাদের অনেক ছাত্র শিক্ষক হয়েছেন। আবার অনেক 'ভালো' ছাত্রও শিক্ষক হতে পারেননি। তাদেরও ক্ষোভ থাকতে পারে। বিভিন্ন সময়ে পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে প্রতিবেদনও দেখেছি। কিন্তু তাতে করে কোনো নিয়োগই বাতিল হয়ে যায় না। অতীতে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ঘটনায় নিয়োগপ্রাপ্ত কোনো শিক্ষকের নিয়োগ বাতিল হয়েছে, এটা আমার জানা নেই। সুতরাং এ বিষয়টি নিয়ে 'জল ঘোলা করার' কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমরা সবাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও থাকব কিছুদিন (আমি ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি ষাট বছরেই অবসরে যাব)। যারা আজ নিয়োগ পেলেন, তারা থাকবেন প্রায় ৪০ বছর, অর্থাৎ ধরে নিচ্ছি ২০৫২ সাল পর্যন্ত। তাদের অনেক পথ যেতে হবে। একুশ শতকের একজন শিক্ষক হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে হবে। 'স্বপ্নের জাহাঙ্গীরনগর' গড়ার যে প্রত্যয় উপাচার্য ব্যক্ত করেছেন, তা বাস্তবে রূপ দেওয়ার দায়িত্ব তরুণ প্রভাষকদের। বিশ্ব জুড়েই তরুণরা পরিবর্তন আনছেন। নিউইয়র্কের 'অকুপাই মুভমেন্ট' ২৫১ দিন অতিক্রম করল গত ২৬ মে। আর এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে আধুনিকমনস্ক তরুণরা। শক্তিশালী পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে তারা দাঁড়িয়ে গেছে। আরব বিশ্বে পরিবর্তনের সূচনা করেছিল এই তরুণরাই। 'আরব বসন্ত' ও তরুণ সমাজের অবদান নিয়ে সারা বিশ্ব আজ সোচ্চার। 'মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে আমরা' ব্যানার তৈরি না করে বরং তরুণ প্রভাষকরা যদি 'পরিবর্তনের পক্ষে আমরা' ব্যানার তৈরি করে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে নিজেদের নিয়োজিত রাখতেন, আমি খুশি হতাশ। কেননা তরুণদের পক্ষেই পরিবর্তন সম্ভব। তারা যে যোগ্য, এটা তাদেরই প্রমাণ করতে হবে। বিদেশে গিয়ে ডিগ্রি নিয়ে প্রমাণ করতে হবে 'আমরাও পারি'। শুধু শুধু আন্দোলনের নাম করে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীলতা কেন? আমরা নিশ্চয়ই এটা স্বীকার করব, ইতিমধ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষের কাছে এই বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। 'শিক্ষক সমাজ' আন্দোলন করেছিলেন একটা যৌক্তিক দাবি তুলে। কিছুটা হলেও সেই দাবি বাস্তবায়িত হয়েছে। ভিসি পদত্যাগ করেছেন। আমরা নয়া ভিসি পেয়েছি। আবার আন্দোলন কেন? এতে করে কি নতুন করে সেশনজট তৈরি হবে না? 'মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে আমরা' কর্মসূচি দিলে শিক্ষক সমাজও নতুন করে কর্মসূচি দেবে। এতে করে লাভ কার? ভিসি মহোদয় কি শিক্ষকদের এই দ্বন্দ্ব নিরসনে ব্যস্ত থাকবেন, নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক উন্নয়নের কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখবেন! আমাদের তো সবার উচিত, নয়া ভিসিকে সহযোগিতা করা, যাতে করে তিনি অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পন্ন করতে পারেন। তার সামনে তো এখন অনেক কাজ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি সকল শিক্ষকের প্রতিনিধিত্ব করে। তরুণ শিক্ষকরা যদি মনে করে থাকেন, তাদের অপমান করা হয়েছে, তারা শিক্ষক সমিতির কাছে অভিযোগটি তুলতে পারেন। সমিতি বিষয়টি দেখতে পারে। আমরা তো এভাবেই সমস্যার সমাধান করি। সবচেয়ে বড় কথা, একটি অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। এর পেছনে সত্যতা আছে কি নেই, আমরা জানি না। তবে অভিযোগটি বেশ পুরনো। এ ক্ষেত্রে তরুণ শিক্ষকরা দাবি করুক একটি নিরপেক্ষ তদন্তের, যাতে করে প্রকৃত 'সত্য' বেরিয়ে আসবে। আমরা তো তেমনটি চাই। এটা তাদের জন্যও ভালো। কেননা আগামী দিনে এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে তাদেরই নেতৃত্ব দিতে হবে। আগামী ৫ থেকে ৭ বছরের মধ্যে সিনিয়র অনেক শিক্ষক অবসরে যাবেন। নাসিম আখতাররাও থাকবেন না তখন। তরুণরাই তো তখন এই বিশ্ববিদ্যালয় চালাবে। এ জন্যই তাদের দাবি হওয়া উচিত ছিল তদন্ত করা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখনও এ কাজটি করতে পারে। নয়া উপাচার্য বলেছেন, ১৯৭৩ সালের জাবি আইন অনুযায়ী একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি এখানে তিনি গড়ে তুলবেন। এটা শুভ লক্ষণ। এ জন্য অনেক কাজ তাকে করতে হবে। সিনেটে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের আগে শিক্ষকদের প্রতিনিধিত্বের নির্বাচন করতে হবে। ডিন নির্বাচনও বাকি। ধারণা করছি, সিন্ডিকেটের কয়েকটি পদেরও নির্বাচন হবে। আমি জানি, উপাচার্য মহোদয় 'কমিটমেন্ট' রক্ষা করার মানুষ। এ সিদ্ধান্তগুলো তিনি একে একে নেবেন। একাডেমিক শৃঙ্খলাও ফিরিয়ে আনবেন তিনি। সামনে প্রথম পর্বের ভর্তি পরীক্ষা। এখানেও প্রস্তুতির ব্যাপার আছে। ৬ জুন বিশ্ববিদ্যালয় খুলছে। ক্লাস শুরু হচ্ছে নতুন করে। এ সময় এমন কোনো কাজ আমাদের করা উচিত নয়, যাতে বিশ্ববিদ্যালয় অস্থিতিশীল হয়। আমরা সবাই সামনের দিকে তাকাতে চাই। পেছনের দিকে নয়। কে যোগ্য, কে অযোগ্য, কে অন্যায় করেছে, কার বিচার আমরা করব_ এসব নিয়ে যদি আমরা ব্যস্ত থাকি, তাহলে মূল কাজ থেকে আমরা পিছিয়ে যাব। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থিতিশীলতা আসছে। আসুন, সবাই মিলে এই স্থিতিশীলতাকে আরও দীর্ঘস্থায়ী করি এবং উপাচার্য মহোদয়কে তার কাজগুলো করতে দিই। তরুণ সমাজের প্রতি আমার আস্থাটা অনেক বেশি। আমরা যা পারিনি, তা তরুণরাই করবে। আমার এই আস্থায় যেন কোনো ঘাটতি না থাকে।
প্রফেসর ড. তারেক শামসুর রেহমান শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
www.tsrahmanbd.blogspot.com
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়া উপাচার্য দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে যখন স্থিতিশীলতা ফিরে আসছে, ঠিক তখনই নতুন করে আন্দোলনের একটি খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। এতদিন আন্দোলনে ছিল 'শিক্ষক সমাজ'। এবার আন্দোলনে নামছেন 'মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে আমরা' নামক একটি সংগঠনের ব্যানারে নবনিযুক্ত শিক্ষকরা। এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন ড. হাসিবুর রহমান, যিনি পদত্যাগকারী উপাচার্য শরীফ এনামুল কবিরের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত। তাদের অভিযোগ, 'শিক্ষক সমাজে'র নেতা অধ্যাপক নাসিম আখতার হোসেন আন্দোলন চলাকালীন 'অর্থের বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে' বলে যে দাবি করেছেন, তা মিথ্যা। তারা উপাচার্যের কাছে স্মারকলিপি দিয়ে অধ্যাপক হোসেনের বিচারও দাবি করেছেন। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। 'শিক্ষক সমাজে'র নেতৃবৃন্দ গত ২৬ মে নবনিযুক্ত উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করে এ ঘটনার প্রতিবাদও জানিয়েছেন। এটা কোনো ভালো লক্ষণ নয়। নবনিযুক্ত শিক্ষকদের অভিযোগ থাকতেই পারে। কিন্তু আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা কাম্য হতে পারে না। আমি যতদূর জানি, 'শিক্ষক সমাজে'র নেতা অধ্যাপক নাসিম আখতার হোসেন ঢালাওভাবে নবনিযুক্ত সকল শিক্ষকের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ আনেননি। তিনি কেন, শিক্ষক সমাজের অনেক নেতাই, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব সিনিয়র শিক্ষক, তারা একাধিকবার এই অভিযোগটি তুলেছেন। গণমাধ্যমেও এ ধরনের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। সেদিন যদি এর প্রতিবাদ উঠত, তাহলে অভিযোগটি এত দূর গড়াত না। অভিযোগ অভিযোগই। এর মাঝে সত্যতাও থাকতে পারে, মিথ্যাও হতে পারে। কিন্তু এটা নিয়ে দু'পক্ষ পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাবে, এটা তো কাম্য হতে পারে না। নয়া উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়টিকে বিশ্বমানে উন্নত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তিনি সবাইকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে চান। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক না হলেও, তিনি শিক্ষক সমাজের সমস্যা সম্পর্কে জানেন। দীর্ঘদিন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা সম্পর্কে তিনি অবহিত নন, এটা আমি বিশ্বাস করি না। তিনি জানেন ও বোঝেন। সমস্যা সমাধানে তাকে সময় দিতে হবে। তিনি যখন সবে দায়িত্ব নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে এনেছেন, তখন 'মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে আমরা' একটি কর্মসূচি দিয়ে জাবি প্রশাসনকে একটি বিব্রতকর অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে। কর্মসূচি দেওয়ার তো আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল না। তারা স্মারকলিপি দিয়েছেন, এটা কি যথেষ্ট ছিল না? এভাবে একজন সিনিয়র শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনাটা অশোভন, দৃষ্টিকটু। আমরা কি এতে করে প্রকারান্তরে সিনিয়র-জুনিয়র ব্যবধান তৈরি করছি না? অধ্যাপক নাসিম আখতার হোসেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষকদের একজন। আজ যারা 'মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে আমরা' ব্যানারে সমবেত হয়েছেন, তাদের প্রায় সবাই তার ছাত্রতুল্য, ছাত্রও বটে। এতে করে কি সিনিয়র শিক্ষকদের অসম্মানিত করা হলো না? যে দুইশ' শিক্ষক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন গত তিন বছরে, এটা অস্বাভাবিক। আমাদের অনেক ছাত্র শিক্ষক হয়েছেন। আবার অনেক 'ভালো' ছাত্রও শিক্ষক হতে পারেননি। তাদেরও ক্ষোভ থাকতে পারে। বিভিন্ন সময়ে পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে প্রতিবেদনও দেখেছি। কিন্তু তাতে করে কোনো নিয়োগই বাতিল হয়ে যায় না। অতীতে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ঘটনায় নিয়োগপ্রাপ্ত কোনো শিক্ষকের নিয়োগ বাতিল হয়েছে, এটা আমার জানা নেই। সুতরাং এ বিষয়টি নিয়ে 'জল ঘোলা করার' কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমরা সবাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও থাকব কিছুদিন (আমি ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি ষাট বছরেই অবসরে যাব)। যারা আজ নিয়োগ পেলেন, তারা থাকবেন প্রায় ৪০ বছর, অর্থাৎ ধরে নিচ্ছি ২০৫২ সাল পর্যন্ত। তাদের অনেক পথ যেতে হবে। একুশ শতকের একজন শিক্ষক হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে হবে। 'স্বপ্নের জাহাঙ্গীরনগর' গড়ার যে প্রত্যয় উপাচার্য ব্যক্ত করেছেন, তা বাস্তবে রূপ দেওয়ার দায়িত্ব তরুণ প্রভাষকদের। বিশ্ব জুড়েই তরুণরা পরিবর্তন আনছেন। নিউইয়র্কের 'অকুপাই মুভমেন্ট' ২৫১ দিন অতিক্রম করল গত ২৬ মে। আর এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে আধুনিকমনস্ক তরুণরা। শক্তিশালী পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে তারা দাঁড়িয়ে গেছে। আরব বিশ্বে পরিবর্তনের সূচনা করেছিল এই তরুণরাই। 'আরব বসন্ত' ও তরুণ সমাজের অবদান নিয়ে সারা বিশ্ব আজ সোচ্চার। 'মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে আমরা' ব্যানার তৈরি না করে বরং তরুণ প্রভাষকরা যদি 'পরিবর্তনের পক্ষে আমরা' ব্যানার তৈরি করে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে নিজেদের নিয়োজিত রাখতেন, আমি খুশি হতাশ। কেননা তরুণদের পক্ষেই পরিবর্তন সম্ভব। তারা যে যোগ্য, এটা তাদেরই প্রমাণ করতে হবে। বিদেশে গিয়ে ডিগ্রি নিয়ে প্রমাণ করতে হবে 'আমরাও পারি'। শুধু শুধু আন্দোলনের নাম করে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীলতা কেন? আমরা নিশ্চয়ই এটা স্বীকার করব, ইতিমধ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষের কাছে এই বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। 'শিক্ষক সমাজ' আন্দোলন করেছিলেন একটা যৌক্তিক দাবি তুলে। কিছুটা হলেও সেই দাবি বাস্তবায়িত হয়েছে। ভিসি পদত্যাগ করেছেন। আমরা নয়া ভিসি পেয়েছি। আবার আন্দোলন কেন? এতে করে কি নতুন করে সেশনজট তৈরি হবে না? 'মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে আমরা' কর্মসূচি দিলে শিক্ষক সমাজও নতুন করে কর্মসূচি দেবে। এতে করে লাভ কার? ভিসি মহোদয় কি শিক্ষকদের এই দ্বন্দ্ব নিরসনে ব্যস্ত থাকবেন, নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক উন্নয়নের কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখবেন! আমাদের তো সবার উচিত, নয়া ভিসিকে সহযোগিতা করা, যাতে করে তিনি অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পন্ন করতে পারেন। তার সামনে তো এখন অনেক কাজ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি সকল শিক্ষকের প্রতিনিধিত্ব করে। তরুণ শিক্ষকরা যদি মনে করে থাকেন, তাদের অপমান করা হয়েছে, তারা শিক্ষক সমিতির কাছে অভিযোগটি তুলতে পারেন। সমিতি বিষয়টি দেখতে পারে। আমরা তো এভাবেই সমস্যার সমাধান করি। সবচেয়ে বড় কথা, একটি অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। এর পেছনে সত্যতা আছে কি নেই, আমরা জানি না। তবে অভিযোগটি বেশ পুরনো। এ ক্ষেত্রে তরুণ শিক্ষকরা দাবি করুক একটি নিরপেক্ষ তদন্তের, যাতে করে প্রকৃত 'সত্য' বেরিয়ে আসবে। আমরা তো তেমনটি চাই। এটা তাদের জন্যও ভালো। কেননা আগামী দিনে এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে তাদেরই নেতৃত্ব দিতে হবে। আগামী ৫ থেকে ৭ বছরের মধ্যে সিনিয়র অনেক শিক্ষক অবসরে যাবেন। নাসিম আখতাররাও থাকবেন না তখন। তরুণরাই তো তখন এই বিশ্ববিদ্যালয় চালাবে। এ জন্যই তাদের দাবি হওয়া উচিত ছিল তদন্ত করা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখনও এ কাজটি করতে পারে। নয়া উপাচার্য বলেছেন, ১৯৭৩ সালের জাবি আইন অনুযায়ী একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি এখানে তিনি গড়ে তুলবেন। এটা শুভ লক্ষণ। এ জন্য অনেক কাজ তাকে করতে হবে। সিনেটে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের আগে শিক্ষকদের প্রতিনিধিত্বের নির্বাচন করতে হবে। ডিন নির্বাচনও বাকি। ধারণা করছি, সিন্ডিকেটের কয়েকটি পদেরও নির্বাচন হবে। আমি জানি, উপাচার্য মহোদয় 'কমিটমেন্ট' রক্ষা করার মানুষ। এ সিদ্ধান্তগুলো তিনি একে একে নেবেন। একাডেমিক শৃঙ্খলাও ফিরিয়ে আনবেন তিনি। সামনে প্রথম পর্বের ভর্তি পরীক্ষা। এখানেও প্রস্তুতির ব্যাপার আছে। ৬ জুন বিশ্ববিদ্যালয় খুলছে। ক্লাস শুরু হচ্ছে নতুন করে। এ সময় এমন কোনো কাজ আমাদের করা উচিত নয়, যাতে বিশ্ববিদ্যালয় অস্থিতিশীল হয়। আমরা সবাই সামনের দিকে তাকাতে চাই। পেছনের দিকে নয়। কে যোগ্য, কে অযোগ্য, কে অন্যায় করেছে, কার বিচার আমরা করব_ এসব নিয়ে যদি আমরা ব্যস্ত থাকি, তাহলে মূল কাজ থেকে আমরা পিছিয়ে যাব। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থিতিশীলতা আসছে। আসুন, সবাই মিলে এই স্থিতিশীলতাকে আরও দীর্ঘস্থায়ী করি এবং উপাচার্য মহোদয়কে তার কাজগুলো করতে দিই। তরুণ সমাজের প্রতি আমার আস্থাটা অনেক বেশি। আমরা যা পারিনি, তা তরুণরাই করবে। আমার এই আস্থায় যেন কোনো ঘাটতি না থাকে।
প্রফেসর ড. তারেক শামসুর রেহমান শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
www.tsrahmanbd.blogspot.com
No comments