আরেক আলোকে-বিএনপির কর্মসূচি ও সরকারের করণীয় by ইনাম আহমদ চৌধুরী
সরকারি দলেরই মঙ্গল বা উচিত হবে যত শিগগিরই সম্ভব নির্দলীয় সরকারের অধীনে কীভাবে নির্বাচন হতে পারে, তা আলোচনা বা সংলাপের মাধ্যমে স্থির করার উদ্যোগ নেওয়া। বিরোধীদলীয় নেতা এর আহ্বান ইতিমধ্যে দিয়েছেন। সুতরাং তাকে আর দোষ দেওয়া যাবে না। আন্তর্জাতিক মহলে সব পক্ষ কিন্তু একই কথা বলছে।
ব্যাপারটি হয়েছে কি যে, এখন 'সময়' আওয়ামী লীগের পরিপন্থী। যত দিন যাবে ততই নতুন ইস্যু সৃষ্টি হবে এবং বিদ্যমান সমস্যার সমাধান খুব কমই হবে
১১ জুনের সমাবেশে_ যাকে গণউপস্থিতির সংখ্যার বিচারে মহাসমাবেশ বলা মোটেই অত্যুক্তি হবে না_ বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ১২ মার্চের নয়াপল্টনের মহাসমাবেশে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দলের ভবিষ্যৎ কর্মসূচির ঘোষণা দেন। এ নিয়ে দেশ-বিদেশে উৎসাহ-কৌতূহল, উত্তেজনা-উদ্বেগ ছিল অফুরন্ত। কিন্তু প্রবল ক্রোধোদ্দীপক, উত্তেজনা সৃষ্টিকারী পরিস্থিতি এবং উপস্থিত জনসমুদ্রের উচ্চারিত তীব্র সমর্থন সত্ত্বেও খালেদা জিয়া সংযত ভাষায় বিশ্লেষণভিত্তিক ভাষণ দিয়ে বিরোধীদলীয় কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি হরতাল, অবরোধ, অসহযোগিতার আহ্বান না জানিয়ে ইস্যুভিত্তিক পাঁচ দিনের বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের পর সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি প্রদানের ঘোষণা দেন। আর সরকারের কাছে শালীন ভাষায় পরিষ্কার দাবি জানান_ 'আলোচনার মাধ্যমে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিন। আশা করি, সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে।' তিনি আরও বলেন, 'দাবি আদায় না হলে আন্দোলন ক্রমান্বয়ে জোরদার হবে। অপ্রতিরোধ্য করতে আন্দোলন বিস্তৃত করা হবে।' মনে রাখার বিষয়, ঘোষণার আগে জনসমুদ্র থেকে হুঙ্কার আসছিল 'হরতাল হরতাল', 'রাজপথ ছাড়ব না' ইত্যাদি। সভায় যোগদানে বাধা ও প্রকাশ্য সরকারি প্রতিকূলতা, পুলিশি নিগ্রহ, অত্যাচার, হয়রানি, এমনকি অ্যারেস্ট সরকারি কুমন্ত্রণায় যানবাহনের দুষ্প্রাপ্যতা, জনতার দুর্ভোগ_ এসবের কারণে সৃষ্ট মানুষের উত্তেজনায় প্রভাবিত না হয়ে শান্ত কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে নেত্রীর এ ঘোষণা অনেককেই অবাক এবং সবাইকে চমৎকৃত করেছিল।
আওয়ামী লীগের মুখপাত্র এ ঘোষণাকে 'দুর্বলতা' ভাবার চেষ্টা করে বললেন, 'বিএনপি রণে ভঙ্গ দিল উপায়ান্তর না দেখে।' কিন্তু আসলে হয়েছিল ঠিক তার উল্টো। এই বিরাট জনসমাবেশের সাফল্য নেত্রীকে এনে দিয়েছিল গভীর সন্তুষ্টি, আত্মবিশ্বাস এবং ক্রান্তিলগ্নে সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। পাঠক-পাঠিকা ভেবে দেখুন_
ক. বেগম জিয়া যে পাঁচটি যৌক্তিক কারণনির্ভর ইস্যুর উল্লেখ করেছেন এবং তা নিয়ে পাঁচ দিন দেশব্যাপী বিক্ষোভের আহ্বান জানিয়েছেন, সে বিষয়গুলো সম্পর্কে দেশে দ্বিমতের খুব কমই অবকাশ আছে। এ ইস্যুগুলোতে বিএনপি সমর্থক ছাড়াও সাধারণ দেশবাসীর সমর্থন থাকবে এবং তাতে বিএনপির সমর্থনের ব্যাপ্তি প্রসারের সমূহ সম্ভাবনা।
খ. এই ইস্যুগুলো শুধু রাজনৈতিক কর্মী বা সচেতন লোকের মধ্যেই সাড়া জাগাবে না। বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত এবং নির্দলীয় জনগণের মধ্যে একটি আবেদনের সৃষ্টি করবে, যা পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে বিএনপি সমর্থনেরই রূপ নেবে এবং ইস্যুগুলোকে জিইয়ে রাখবে।
গ. গত ১২ মার্চ এবং ১১ জুন বিরোধী দল হরতাল ডাকেনি। সরকারি সংস্থা ও আওয়ামী লীগ হামলা-মামলা, ধরপাকড়, রাজধানীমুখী যানবাহন এবং ফেরি চলাচলে ব্যাঘাত সৃষ্টি, আবাসিক হোটেল, এমনকি অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সেও অতিথি আসা বা থাকার ওপর নিষেধাজ্ঞা, রাজধানী শহরের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট চলাচলে, এমনকি প্রাইভেট গাড়ি ইত্যাদিতে তল্লাশি ও জাতীয় বিঘ্নতা করে বিরাট জনদুর্ভোগ ঘটিয়ে হরতালের পরিবেশ সৃষ্টি করল। অর্থাৎ বিরোধী দল হরতাল না ডেকেও জনজীবন অকেজো করিয়ে রাজধানীকে অচল বানিয়ে দিল এবং সরকার ও সরকারি দল নিজের কাঁধে স্বেচ্ছায় এ বিপুল জনদুর্ভোগের দায়িত্ব নিয়ে নিল। বিএনপির জন্য এটি একটি অবিশ্বাস্য অর্জন বা বিজয়।
ঘ. তাছাড়া এবার ১১ জুনের সমাবেশে মার্চের জনসমাবেশ সফল করার মতো কোনোই সাংগঠনিক তৎপরতা ছিল না। নেতাদের দেশব্যাপী সফর, প্রস্তুতিমূলক সভা-সমিতি বা যাতায়াতের ব্যবস্থা করার মতো কোনো উদ্যোগ ছিল না। স্থানে স্থানে কিছু 'লিফলেট' বিতরণ হয়েছে শুধু। সভায় যোগদানকারীদের জন্য কোনো রকম সহায়তা বা সুবিধা দেওয়া হয়নি বা দেওয়ার আয়োজনও হয়নি। তবুও এতসব প্রতিকূলতার মধ্যেও ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় ঝুঁকি নিয়ে এবং প্রভূত কষ্ট স্বীকার করে এই যে লাখ লাখ লোকের মহাসমাবেশ ঘটল, তা বিরোধীদলীয় নেতার জন্য পরম আশ্বস্তির ব্যাপার। অর্থাৎ তার আন্দোলন আর নেতানির্ভর রইল না। মহাসচিব এবং অন্য বহু সিনিয়র নেতা জেলে বা হামলার শিকার হয়ে থাকলেও স্বতঃস্ফূর্তভাবেই জনগণ এগিয়ে আসবে, এ বিশ্বাস এখন তার মধ্যে গ্রথিত হয়েছে। সব নেতাকে ধরে রেখে, হামলা-মামলা করলেও আন্দোলনের বিস্তৃতি বা জোরের কমতি হবে না। বরং তা সহানুভূতির রূপ নিয়ে আরও বেড়ে যাবে_ এ সত্যটি প্রতিষ্ঠিত হলো।
ঙ. এ অবস্থাকে আওয়ামী লীগ দুর্বলতা ভেবে খুবই ভুল করল। বরং তাদের উচিত হতো, বিএনপির এ গণআবেদন লক্ষ্য করে নতুন স্ট্র্যাটেজি বিবেচনা করা। বস্তুতপক্ষে সরকারি দলের এটি এখন ভালোভাবেই উপলব্ধির প্রয়োজন যে, দলীয় সরকারের অধীনে কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে না, হবে না। সুতরাং সংলাপের মাধ্যমে একটি দলনিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা কর্তৃপক্ষ বা সরকার কী করে সৃষ্টি করতে পারে তা নির্ণয় করতে সচেষ্ট হওয়া। বিরোধী দলের নেত্রী তো আহ্বান দিয়েই দিলেন_ 'আলোচনার মাধ্যমে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিন' এবং এ আলোচনা বা সংলাপ তো আর সংসদে হতে পারে না। বিশেষ আয়োজনের মাধ্যমে হতে হবে। সরকারি দল নির্বাচিত সরকার অর্থাৎ তাদের নিজস্ব শাসনামল ছাড়া নির্বাচনের জন্য রাজি না থাকলে কী নিয়ে সংলাপ হবে? বাংলাদেশের সংবিধানে যে পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়েছে অর্থাৎ পার্লামেন্ট থাকবে, মন্ত্রী-মন্ত্রণালয়-দলীয় প্রশাসন থাকবে আর এর মধ্যে নির্বাচন হবে_ এটি কিন্তু বিলেত বা ভারত কিংবা অন্যান্য পার্লামেন্টারি গণতান্ত্রিক দেশে নেই। ওসব দেশেও পার্লামেন্টের বিলুপ্তি ঘটে, শুধু বিদায়প্রাপ্ত ক্যাবিনেট 'কেয়ারটেকার' হিসেবেই (এবং অনির্বাচিত অবস্থায়) রুটিন কর্তব্য সমাধা করে। ওসব দেশে প্রশাসনযন্ত্রও সম্পূর্ণ নির্দলীয় এবং প্রভাবমুক্ত।
বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রশ্নই ওঠে না। এখানে পুলিশ বিচারককে পেটাচ্ছে, এমপি-চিফ হুইপকে অর্ধনগ্ন করে নিগ্রহ-নির্যাতন করছে, বিচারবহির্ভূত খুন-লোপাট সরকারি সংস্থা করছে, রাজনৈতিক নেতা গুম হচ্ছে_ কোনো কূলকিনারা নেই, সত্য প্রকাশে আগ্রহী সাংবাদিকদের হত্যা-নির্যাতন করা হচ্ছে, সাগর-রুনির হত্যা, বিদেশি কূটনীতিক হত্যা, ইলিয়াস-আলম গুম ইত্যাদির কারণ জানা সত্ত্বেও কোনো সুরাহা হচ্ছে না। আদালত-সংসদে দ্বন্দ্ব হচ্ছে, প্রশাসন বা সংসদ অধ্যাপক ইউনূস বা আবু সায়ীদের মতো সর্বজন শ্রদ্ধেয় লোককে অপমানের চেষ্টা করে, আসিফ নজরুলের মতো অধ্যাপককে স্বচ্ছ মতামত প্রকাশ করতে বিঘ্নের সৃষ্টি করে। প্রশাসনের প্রতিটি যন্ত্র যখন সম্পূর্ণভাবে দলীয়কৃত, টেন্ডারবাজির জন্য যখন কোনো সরকারি কাজই করা যায় না, খোদ সরকার যখন বিশ্বব্যাংক জাতীয় আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে দুর্নীতির জন্য অভিযুক্ত, সেখানে দলীয় প্রশাসনের অধীনে সাধারণ নির্বাচন করার চিন্তাই তো এক অর্বাচীন বাতুলতা।
সুতরাং সরকারি দলেরই মঙ্গল বা উচিত হবে যত শিগগিরই সম্ভব নির্দলীয় সরকারের অধীনে কীভাবে নির্বাচন হতে পারে, তা আলোচনা বা সংলাপের মাধ্যমে স্থির করার উদ্যোগ নেওয়া। বিরোধীদলীয় নেতা এর আহ্বান ইতিমধ্যে দিয়েছেন। সুতরাং তাকে আর দোষ দেওয়া যাবে না। আন্তর্জাতিক মহলে সব পক্ষ কিন্তু একই কথা বলছে। ব্যাপারটি হয়েছে কি যে, এখন 'সময়' আওয়ামী লীগের পরিপন্থী। যত দিন যাবে ততই নতুন ইস্যু সৃষ্টি হবে এবং বিদ্যমান সমস্যার সমাধান খুব কমই হবে। তাছাড়া বহু মন্ত্রী-নেতা যেসব বক্তব্য মাঝে মধ্যে দিচ্ছেন, তাতে সবাই উত্তরোত্তর চটে যাচ্ছে, তা শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগকরী বা এসইসি হোক, ব্যবসায়ী-রফতানিকারক হোক, সাংবাদিক-অধ্যাপক-পেশাজীবী হোক বা সাধারণ এনজিও কর্মী হোক। সরকার ইতিমধ্যে গ্রামীণ ব্যাংক-ব্র্যাকের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের এবং এদের অনুসারীদের আস্থা হারিয়ে ফেলছে, সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফের নির্দয় হত্যা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন বেড়েই চলেছে। শিক্ষাঙ্গনে চরম উচ্ছৃঙ্খলতা ও নৈরাজ্যের উপস্থিতি, সাধারণ আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি, সামাজিক অসহিষ্ণুতা ও নিষ্ঠুরতা বৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় ঊর্ধ্বগতি, দুর্নীতি, বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানি সরবরাহের অপ্রতুলতা_ এসবের মধ্যে যদি থাকে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং সাধারণ নির্বাচনের নামে সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি, তাহলে দেশের কী অবস্থা হবে?
অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ-মিয়ানমার একটি সমুদ্রসীমা বিরোধে আন্তর্জাতিক আদালতের রায় কিছুটা বাংলাদেশের অনুকূল হয়েছে। একে বন্ধুজনোচিত স্বাভাবিকতায় মেনে না নিয়ে তাকে 'সমুদ্র বিজয়' আখ্যা দিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে একটি কাল্পনিক যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টির পরিণতি বোধহয় আমরা আরাকানে রোহিঙ্গাবিরোধী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রত্যক্ষ করছি। 'সমুদ্র বিজয়' ইত্যাদি বলে দুই দেশ ও জনগণের মধ্যে একটি বৈরী ভাব সৃষ্টির কি কোনো প্রয়োজনীয়তা ছিল? অবিবেচনাপ্রসূত একটি সামান্য রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের অপচেষ্টার কী ফল হতে পারে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে আজ আমরা তা প্রত্যক্ষ করছি। মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে বলে তাকে বন্ধু ও প্রতিবেশীসুলভ অভিনন্দন বা ধন্যবাদ না জানিয়ে 'যুদ্ধ বিজয়' ঘোষণা নেহাত অবিবেচনাপ্রসূত দায়িত্বজ্ঞানহীনতা।
বিনয়াবনতচিত্তে আজ আমি সরকারকে অনুরোধ জানাব, যা প্রায় একই ভাষায় গতকালের 'সমকাল'-এর সম্পাদকীয়ের শেষ দুই বাক্যে রয়েছে। সংলাপ বা আলোচনা হোক খোলামেলা পরিবেশে (সংসদে বিতর্কের মধ্য দিয়ে নয়) এবং একটাই লক্ষ্য থাকবে_ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একটি উপযুক্ত পরিচালনা কর্তৃপক্ষ নির্বাচন এবং তা অবশ্যই হবে নির্দলীয় ও দলীয় প্রভাবমুক্ত।
আর নির্বাচন কমিশনকে সুস্পষ্ট ভাষায় জানাতে চাই_ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের সম্ভাব্যতার কথা বলে অযথা আরও বিতর্কিত এবং অগ্রহণযোগ্য হবেন না। বরং আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্য সমাধানে অবদান রাখার চেষ্টা সম্ভব হলে করুন।
রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করতে না পারলে ক্ষতি আওয়ামী লীগেরই অনেক বেশি হবে। বাজেট বাস্তবায়নযোগ্য এবং জনদুর্ভোগ কমাতে সহায়ক হবে না বলে ধরা হচ্ছে। অর্থনীতিতে মন্দাবস্থা এসেছে। ভালো বিদেশি বিনিয়োগ নেই। এর মধ্যে ট্রানজিট দেওয়া এবং বিতর্কিত ভারতীয় 'সাহারা' কোম্পানিকে সার্বভৌম গ্যারান্টি দিয়ে লাখ লাখ একর জমি তুলে দেওয়া (যেখানে দেশি আবাসন শিল্প বিপর্যয়ের মুখোমুখি) সরকারকে অজনপ্রিয়ই করে তুলবে।
তাই সরকারকে এখন এবং অনতিবিলম্বে আসল সমস্যার মুখোমুখি হয়ে স্বীকৃত সমাধানের পথে এগোতে হবে। শুভস্য শিঘ্রম।
ইনাম আহমদ চৌধুরী : সাবেক সচিব ও কলাম লেখক
১১ জুনের সমাবেশে_ যাকে গণউপস্থিতির সংখ্যার বিচারে মহাসমাবেশ বলা মোটেই অত্যুক্তি হবে না_ বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ১২ মার্চের নয়াপল্টনের মহাসমাবেশে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দলের ভবিষ্যৎ কর্মসূচির ঘোষণা দেন। এ নিয়ে দেশ-বিদেশে উৎসাহ-কৌতূহল, উত্তেজনা-উদ্বেগ ছিল অফুরন্ত। কিন্তু প্রবল ক্রোধোদ্দীপক, উত্তেজনা সৃষ্টিকারী পরিস্থিতি এবং উপস্থিত জনসমুদ্রের উচ্চারিত তীব্র সমর্থন সত্ত্বেও খালেদা জিয়া সংযত ভাষায় বিশ্লেষণভিত্তিক ভাষণ দিয়ে বিরোধীদলীয় কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি হরতাল, অবরোধ, অসহযোগিতার আহ্বান না জানিয়ে ইস্যুভিত্তিক পাঁচ দিনের বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের পর সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি প্রদানের ঘোষণা দেন। আর সরকারের কাছে শালীন ভাষায় পরিষ্কার দাবি জানান_ 'আলোচনার মাধ্যমে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিন। আশা করি, সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে।' তিনি আরও বলেন, 'দাবি আদায় না হলে আন্দোলন ক্রমান্বয়ে জোরদার হবে। অপ্রতিরোধ্য করতে আন্দোলন বিস্তৃত করা হবে।' মনে রাখার বিষয়, ঘোষণার আগে জনসমুদ্র থেকে হুঙ্কার আসছিল 'হরতাল হরতাল', 'রাজপথ ছাড়ব না' ইত্যাদি। সভায় যোগদানে বাধা ও প্রকাশ্য সরকারি প্রতিকূলতা, পুলিশি নিগ্রহ, অত্যাচার, হয়রানি, এমনকি অ্যারেস্ট সরকারি কুমন্ত্রণায় যানবাহনের দুষ্প্রাপ্যতা, জনতার দুর্ভোগ_ এসবের কারণে সৃষ্ট মানুষের উত্তেজনায় প্রভাবিত না হয়ে শান্ত কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে নেত্রীর এ ঘোষণা অনেককেই অবাক এবং সবাইকে চমৎকৃত করেছিল।
আওয়ামী লীগের মুখপাত্র এ ঘোষণাকে 'দুর্বলতা' ভাবার চেষ্টা করে বললেন, 'বিএনপি রণে ভঙ্গ দিল উপায়ান্তর না দেখে।' কিন্তু আসলে হয়েছিল ঠিক তার উল্টো। এই বিরাট জনসমাবেশের সাফল্য নেত্রীকে এনে দিয়েছিল গভীর সন্তুষ্টি, আত্মবিশ্বাস এবং ক্রান্তিলগ্নে সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। পাঠক-পাঠিকা ভেবে দেখুন_
ক. বেগম জিয়া যে পাঁচটি যৌক্তিক কারণনির্ভর ইস্যুর উল্লেখ করেছেন এবং তা নিয়ে পাঁচ দিন দেশব্যাপী বিক্ষোভের আহ্বান জানিয়েছেন, সে বিষয়গুলো সম্পর্কে দেশে দ্বিমতের খুব কমই অবকাশ আছে। এ ইস্যুগুলোতে বিএনপি সমর্থক ছাড়াও সাধারণ দেশবাসীর সমর্থন থাকবে এবং তাতে বিএনপির সমর্থনের ব্যাপ্তি প্রসারের সমূহ সম্ভাবনা।
খ. এই ইস্যুগুলো শুধু রাজনৈতিক কর্মী বা সচেতন লোকের মধ্যেই সাড়া জাগাবে না। বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত এবং নির্দলীয় জনগণের মধ্যে একটি আবেদনের সৃষ্টি করবে, যা পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে বিএনপি সমর্থনেরই রূপ নেবে এবং ইস্যুগুলোকে জিইয়ে রাখবে।
গ. গত ১২ মার্চ এবং ১১ জুন বিরোধী দল হরতাল ডাকেনি। সরকারি সংস্থা ও আওয়ামী লীগ হামলা-মামলা, ধরপাকড়, রাজধানীমুখী যানবাহন এবং ফেরি চলাচলে ব্যাঘাত সৃষ্টি, আবাসিক হোটেল, এমনকি অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সেও অতিথি আসা বা থাকার ওপর নিষেধাজ্ঞা, রাজধানী শহরের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট চলাচলে, এমনকি প্রাইভেট গাড়ি ইত্যাদিতে তল্লাশি ও জাতীয় বিঘ্নতা করে বিরাট জনদুর্ভোগ ঘটিয়ে হরতালের পরিবেশ সৃষ্টি করল। অর্থাৎ বিরোধী দল হরতাল না ডেকেও জনজীবন অকেজো করিয়ে রাজধানীকে অচল বানিয়ে দিল এবং সরকার ও সরকারি দল নিজের কাঁধে স্বেচ্ছায় এ বিপুল জনদুর্ভোগের দায়িত্ব নিয়ে নিল। বিএনপির জন্য এটি একটি অবিশ্বাস্য অর্জন বা বিজয়।
ঘ. তাছাড়া এবার ১১ জুনের সমাবেশে মার্চের জনসমাবেশ সফল করার মতো কোনোই সাংগঠনিক তৎপরতা ছিল না। নেতাদের দেশব্যাপী সফর, প্রস্তুতিমূলক সভা-সমিতি বা যাতায়াতের ব্যবস্থা করার মতো কোনো উদ্যোগ ছিল না। স্থানে স্থানে কিছু 'লিফলেট' বিতরণ হয়েছে শুধু। সভায় যোগদানকারীদের জন্য কোনো রকম সহায়তা বা সুবিধা দেওয়া হয়নি বা দেওয়ার আয়োজনও হয়নি। তবুও এতসব প্রতিকূলতার মধ্যেও ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় ঝুঁকি নিয়ে এবং প্রভূত কষ্ট স্বীকার করে এই যে লাখ লাখ লোকের মহাসমাবেশ ঘটল, তা বিরোধীদলীয় নেতার জন্য পরম আশ্বস্তির ব্যাপার। অর্থাৎ তার আন্দোলন আর নেতানির্ভর রইল না। মহাসচিব এবং অন্য বহু সিনিয়র নেতা জেলে বা হামলার শিকার হয়ে থাকলেও স্বতঃস্ফূর্তভাবেই জনগণ এগিয়ে আসবে, এ বিশ্বাস এখন তার মধ্যে গ্রথিত হয়েছে। সব নেতাকে ধরে রেখে, হামলা-মামলা করলেও আন্দোলনের বিস্তৃতি বা জোরের কমতি হবে না। বরং তা সহানুভূতির রূপ নিয়ে আরও বেড়ে যাবে_ এ সত্যটি প্রতিষ্ঠিত হলো।
ঙ. এ অবস্থাকে আওয়ামী লীগ দুর্বলতা ভেবে খুবই ভুল করল। বরং তাদের উচিত হতো, বিএনপির এ গণআবেদন লক্ষ্য করে নতুন স্ট্র্যাটেজি বিবেচনা করা। বস্তুতপক্ষে সরকারি দলের এটি এখন ভালোভাবেই উপলব্ধির প্রয়োজন যে, দলীয় সরকারের অধীনে কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে না, হবে না। সুতরাং সংলাপের মাধ্যমে একটি দলনিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা কর্তৃপক্ষ বা সরকার কী করে সৃষ্টি করতে পারে তা নির্ণয় করতে সচেষ্ট হওয়া। বিরোধী দলের নেত্রী তো আহ্বান দিয়েই দিলেন_ 'আলোচনার মাধ্যমে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিন' এবং এ আলোচনা বা সংলাপ তো আর সংসদে হতে পারে না। বিশেষ আয়োজনের মাধ্যমে হতে হবে। সরকারি দল নির্বাচিত সরকার অর্থাৎ তাদের নিজস্ব শাসনামল ছাড়া নির্বাচনের জন্য রাজি না থাকলে কী নিয়ে সংলাপ হবে? বাংলাদেশের সংবিধানে যে পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়েছে অর্থাৎ পার্লামেন্ট থাকবে, মন্ত্রী-মন্ত্রণালয়-দলীয় প্রশাসন থাকবে আর এর মধ্যে নির্বাচন হবে_ এটি কিন্তু বিলেত বা ভারত কিংবা অন্যান্য পার্লামেন্টারি গণতান্ত্রিক দেশে নেই। ওসব দেশেও পার্লামেন্টের বিলুপ্তি ঘটে, শুধু বিদায়প্রাপ্ত ক্যাবিনেট 'কেয়ারটেকার' হিসেবেই (এবং অনির্বাচিত অবস্থায়) রুটিন কর্তব্য সমাধা করে। ওসব দেশে প্রশাসনযন্ত্রও সম্পূর্ণ নির্দলীয় এবং প্রভাবমুক্ত।
বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রশ্নই ওঠে না। এখানে পুলিশ বিচারককে পেটাচ্ছে, এমপি-চিফ হুইপকে অর্ধনগ্ন করে নিগ্রহ-নির্যাতন করছে, বিচারবহির্ভূত খুন-লোপাট সরকারি সংস্থা করছে, রাজনৈতিক নেতা গুম হচ্ছে_ কোনো কূলকিনারা নেই, সত্য প্রকাশে আগ্রহী সাংবাদিকদের হত্যা-নির্যাতন করা হচ্ছে, সাগর-রুনির হত্যা, বিদেশি কূটনীতিক হত্যা, ইলিয়াস-আলম গুম ইত্যাদির কারণ জানা সত্ত্বেও কোনো সুরাহা হচ্ছে না। আদালত-সংসদে দ্বন্দ্ব হচ্ছে, প্রশাসন বা সংসদ অধ্যাপক ইউনূস বা আবু সায়ীদের মতো সর্বজন শ্রদ্ধেয় লোককে অপমানের চেষ্টা করে, আসিফ নজরুলের মতো অধ্যাপককে স্বচ্ছ মতামত প্রকাশ করতে বিঘ্নের সৃষ্টি করে। প্রশাসনের প্রতিটি যন্ত্র যখন সম্পূর্ণভাবে দলীয়কৃত, টেন্ডারবাজির জন্য যখন কোনো সরকারি কাজই করা যায় না, খোদ সরকার যখন বিশ্বব্যাংক জাতীয় আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে দুর্নীতির জন্য অভিযুক্ত, সেখানে দলীয় প্রশাসনের অধীনে সাধারণ নির্বাচন করার চিন্তাই তো এক অর্বাচীন বাতুলতা।
সুতরাং সরকারি দলেরই মঙ্গল বা উচিত হবে যত শিগগিরই সম্ভব নির্দলীয় সরকারের অধীনে কীভাবে নির্বাচন হতে পারে, তা আলোচনা বা সংলাপের মাধ্যমে স্থির করার উদ্যোগ নেওয়া। বিরোধীদলীয় নেতা এর আহ্বান ইতিমধ্যে দিয়েছেন। সুতরাং তাকে আর দোষ দেওয়া যাবে না। আন্তর্জাতিক মহলে সব পক্ষ কিন্তু একই কথা বলছে। ব্যাপারটি হয়েছে কি যে, এখন 'সময়' আওয়ামী লীগের পরিপন্থী। যত দিন যাবে ততই নতুন ইস্যু সৃষ্টি হবে এবং বিদ্যমান সমস্যার সমাধান খুব কমই হবে। তাছাড়া বহু মন্ত্রী-নেতা যেসব বক্তব্য মাঝে মধ্যে দিচ্ছেন, তাতে সবাই উত্তরোত্তর চটে যাচ্ছে, তা শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগকরী বা এসইসি হোক, ব্যবসায়ী-রফতানিকারক হোক, সাংবাদিক-অধ্যাপক-পেশাজীবী হোক বা সাধারণ এনজিও কর্মী হোক। সরকার ইতিমধ্যে গ্রামীণ ব্যাংক-ব্র্যাকের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের এবং এদের অনুসারীদের আস্থা হারিয়ে ফেলছে, সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফের নির্দয় হত্যা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন বেড়েই চলেছে। শিক্ষাঙ্গনে চরম উচ্ছৃঙ্খলতা ও নৈরাজ্যের উপস্থিতি, সাধারণ আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি, সামাজিক অসহিষ্ণুতা ও নিষ্ঠুরতা বৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় ঊর্ধ্বগতি, দুর্নীতি, বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানি সরবরাহের অপ্রতুলতা_ এসবের মধ্যে যদি থাকে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং সাধারণ নির্বাচনের নামে সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি, তাহলে দেশের কী অবস্থা হবে?
অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ-মিয়ানমার একটি সমুদ্রসীমা বিরোধে আন্তর্জাতিক আদালতের রায় কিছুটা বাংলাদেশের অনুকূল হয়েছে। একে বন্ধুজনোচিত স্বাভাবিকতায় মেনে না নিয়ে তাকে 'সমুদ্র বিজয়' আখ্যা দিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে একটি কাল্পনিক যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টির পরিণতি বোধহয় আমরা আরাকানে রোহিঙ্গাবিরোধী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রত্যক্ষ করছি। 'সমুদ্র বিজয়' ইত্যাদি বলে দুই দেশ ও জনগণের মধ্যে একটি বৈরী ভাব সৃষ্টির কি কোনো প্রয়োজনীয়তা ছিল? অবিবেচনাপ্রসূত একটি সামান্য রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের অপচেষ্টার কী ফল হতে পারে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে আজ আমরা তা প্রত্যক্ষ করছি। মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে বলে তাকে বন্ধু ও প্রতিবেশীসুলভ অভিনন্দন বা ধন্যবাদ না জানিয়ে 'যুদ্ধ বিজয়' ঘোষণা নেহাত অবিবেচনাপ্রসূত দায়িত্বজ্ঞানহীনতা।
বিনয়াবনতচিত্তে আজ আমি সরকারকে অনুরোধ জানাব, যা প্রায় একই ভাষায় গতকালের 'সমকাল'-এর সম্পাদকীয়ের শেষ দুই বাক্যে রয়েছে। সংলাপ বা আলোচনা হোক খোলামেলা পরিবেশে (সংসদে বিতর্কের মধ্য দিয়ে নয়) এবং একটাই লক্ষ্য থাকবে_ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একটি উপযুক্ত পরিচালনা কর্তৃপক্ষ নির্বাচন এবং তা অবশ্যই হবে নির্দলীয় ও দলীয় প্রভাবমুক্ত।
আর নির্বাচন কমিশনকে সুস্পষ্ট ভাষায় জানাতে চাই_ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের সম্ভাব্যতার কথা বলে অযথা আরও বিতর্কিত এবং অগ্রহণযোগ্য হবেন না। বরং আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্য সমাধানে অবদান রাখার চেষ্টা সম্ভব হলে করুন।
রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করতে না পারলে ক্ষতি আওয়ামী লীগেরই অনেক বেশি হবে। বাজেট বাস্তবায়নযোগ্য এবং জনদুর্ভোগ কমাতে সহায়ক হবে না বলে ধরা হচ্ছে। অর্থনীতিতে মন্দাবস্থা এসেছে। ভালো বিদেশি বিনিয়োগ নেই। এর মধ্যে ট্রানজিট দেওয়া এবং বিতর্কিত ভারতীয় 'সাহারা' কোম্পানিকে সার্বভৌম গ্যারান্টি দিয়ে লাখ লাখ একর জমি তুলে দেওয়া (যেখানে দেশি আবাসন শিল্প বিপর্যয়ের মুখোমুখি) সরকারকে অজনপ্রিয়ই করে তুলবে।
তাই সরকারকে এখন এবং অনতিবিলম্বে আসল সমস্যার মুখোমুখি হয়ে স্বীকৃত সমাধানের পথে এগোতে হবে। শুভস্য শিঘ্রম।
ইনাম আহমদ চৌধুরী : সাবেক সচিব ও কলাম লেখক
No comments