সাংবিধানিক বিকল্প অনুসন্ধানে আলোচনা চলুক by শামসুল আরেফিন খান

গায়ের রং কালো না সাদা, সেটা বড় কথা নয়, দেখতে হবে বিড়াল ইঁদুর ধরে কি না! এই বহু কথিত মহাজন-বাক্যের অন্তর্নিহিত মাজেজা বোধ করি এই যে- প্রধান বিবেচ্য বিষয় যা, সেটাকে পাশ কাটিয়ে গৌণ বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানো বা মারপ্যাঁচ কষা সংগত নয়।


সিইসি রকিবউদ্দীন আহমদ সম্ভবত সেই ব্যঞ্জনাই প্রকারান্তরে ভিন্ন বাক্যে প্রতিধ্বনিত করেছেন। 'যেকোনো পদ্ধতিতেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব। আমরা আশাবাদী, সব দলের অংশগ্রহণে আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হবে।' ২৭ মে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে সিইসি আরো বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যতই আইন করুন না কেন, তার প্রয়োগ না হলে তাতে সমস্যার কোনো সমাধান হয় না।
এর ঠিক আগের দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেন, 'আগামী সাধারণ নির্বাচন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই হবে। নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন পরিচালনা করবে। এ লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনকে আরো শক্তিশালী করা হবে। নির্বাচনের সময় প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্বাচন কমিশনের অধীনেই ন্যস্ত থাকবে। সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ থাকবে না।'
মন্ত্রিসভার আরেক প্রবীণ সদস্য এটা নিশ্চিত করেছেন যে নির্বাচনের আগেই সরকার পদত্যাগ করবে এবং রাষ্ট্রপতি সংবিধান ও গণতন্ত্রের নির্দেশনা অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা নেবেন।
এ কথা অনস্বীকার্য যে নির্বাচন গণতন্ত্রের এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ। সব ক্ষমতার উৎস ও মালিক জনগণ। জনমতের সঠিক প্রতিফলন ঘটানোর দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। জনলোকে কার অবস্থান কতখানি দৃঢ় বা নড়বড়ে, কে কতটা নন্দিত বা নিন্দিত, তা কেবল নির্বাচনের মাধ্যমেই নির্ণীত, নিরূপিত ও যাচাই হতে পারে। অতীতের নির্বাচনগুলোর ফলাফল বিশ্লেষণ করলেও এ কথা চেতনায় ও উপলব্ধিতে ধারণ করা সম্ভব যে অতীত ঐতিহ্য, বংশগৌরব এবং খানদানি মাহাত্মই জনগণের আস্থা ও ভালোবাসা অটুট রাখার জন্য যথেষ্ট নয়, কর্মফলই মানুষ বিশেষত রাজনীতিকদের চূড়ান্ত অবস্থান ও জয়-পরাজয় নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে দলীয় অবস্থান, জাতীয় চার মূলনীতি অনুমোদন-প্রত্যাখ্যান, জঙ্গি দমন-জঙ্গি লালন, গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, বোমাবাজি-টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, পুড়িয়ে মানুষ হত্যা, গুম, অপহরণ, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, প্রতিপক্ষকে দিগম্বর করা, নারী-লোলুপতা, মিডিয়া দলন, সাংবাদিক খুন, দেদার দুর্নীতি, হামলা-মামলা ও পুলিশি জুলুম, সর্বোপরি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অনুকূল-প্রতিকূল ভূমিকা আগামী নির্বাচনে বিশেষ প্রভাব ফেলবে বলে সুধীজনের ধারণা।
ভারত বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো ১৯৫৪ সালে সবচেয়ে ঘৃণিত ও নিন্দিত ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারের অধীনে। কিন্তু জয়জয়কার হলো যুক্তফ্রন্টের। সারা বিশ্ব দেখল, গোটা পৃথিবী জানল, পূর্ব পাকিস্তানে ব্যালট বিপ্লব হয়েছে। বায়ান্নর মহান ভাষাশহীদদের রক্তে হাত রাঙানো ধিকৃত মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীন নান্দাইল আসনে তরুণ রাজনীতিক খালেক নাওয়াজের কাছে ন্যক্কারজনক পরাজিত হলেন। ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ সেবারই সর্বপ্রথম ক্ষমতার স্বাদ পেল যুক্তফ্রন্টের প্রধান শরিক দল হিসেবে। এরপর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হলো ১৯৬৪ সালে। সম্মিলিত বিরোধী দলের (কপ) মনোনীত প্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহ মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী এবং উদীয়মান বাঙালি জাতির নবীন কাণ্ডারি শেখ মুজিবুর রহমানের নিরন্তর প্রচেষ্টা ও দিনরাত পরিশ্রমে পূর্ব পাকিস্তানে বিপুল বিজয় পেলেন কনভেনশন মুসলিম লীগ মনোনীত প্রার্থী ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে। যদিও মৌলিক গণতন্ত্রের সূক্ষ্ম কারসাজিতে সারা দেশের ফলাফল আইয়ুবের পক্ষেই চলে গেল শেষ পর্যন্ত। কেননা সেনাবাহিনীর প্রয়োজন ছিল সামরিক শাসনের পাপ মোচনের জন্য 'সদরে রিয়াসাত ফিল্ড মার্শাল আইয়ুবের একচ্ছত্র প্রভাবাধীনে একটি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ রাবারস্ট্যাম্প পার্লামেন্ট। এরপর আসা ১৯৭০-এর নির্বাচনের ইতিহাস তরুণ প্রজন্মের কাছেও অজানা বিষয় নয়। তথাপি সেই ঐতিহাসিক নির্বাচনের একটা 'ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন' হাতে থাকা প্রয়োজন বর্তমান সময়ের বিভাজিত জাতির হৃৎস্পন্দন সম্যক অনুভবের জন্য। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নব্য জাতির কাণ্ডারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিভাময় নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ৭৪.৯ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৬০ আসনে নিরঙ্কুশ জয় পেল। এই নির্বাচনে অখণ্ড পাকিস্তানের ধ্যানধারণার পক্ষে অবস্থান নিল পূর্ব পাকিস্তানের মাত্র ২৫.৮ শতাংশ মানুষ। এরাই পরে রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও হন্তারক, ধর্ষক হানাদার বাহিনীর দোসরে পরিণত হলো। [সে মেরুকরণ এখনো অক্ষুণ্ন রয়েছে বিস্ফারিত অবয়বে, ভিন্ন নামে] জনগণের ২৩ বছরের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, স্বাধিকার চেতনা, তীক্ষ্ন স্বাজাত্যবোধ এবং মহান ভাষা আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের তীব্র আবেগ-অনুভূতিকে ধারণ ও লালন করে আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতির প্রতিনিধিত্বকারী সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হলো। পাকিস্তানের ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের মতো '৭৫-পরবর্তী বাংলাদেশে লে. জে. জিয়াউর রহমানেরও প্রয়োজন ছিল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার রাবারস্ট্যাম্প পার্লামেন্ট, সামরিক শাসনের দায়মুক্তির জন্য। সেই ধারায় 'হ্যাঁ-না' ভোট এবং ১৯৭৯ সালের নীলনকশার নির্বাচন অকলঙ্কিত গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ঐতিহ্যকে ম্লান করল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে '৯১-৯৫ মেয়াদে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের গৌরবময় ঐতিহ্যের পটভূমিতে গণতান্ত্রিক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত শালিখা (মাগুরা) উপনির্বাচনে ভোট রাহাজানি, কারচুপি ও তঞ্চকতার সর্বোচ্চ রেকর্ড তৈরি হলো।
এরশাদের অধীনে '৮৬ এবং '৮৮ সালে সৃষ্ট নির্বাচনী কলঙ্কের রেকর্ডও যেন ম্লান হয়ে গেল। ভোট কেলেঙ্কারি এভাবে চলতে থাকায় জনগণ ভোট প্রদানে নিস্পৃহ হয়ে পড়ে।
এই প্রেক্ষাপটে গণদাবির ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত পরপর তিনটি সংসদ নির্বাচনে ভোটদানের প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ ফিরে আসতে দেখা গেছে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের পরিমাণ ছিল ৫৫.৪৫ শতাংশ। ১৯৯৬ সালে প্রদত্ত ভোটের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৭৪.৯৬ শতাংশ। ২০০১ সালে প্রদত্ত ভোটের পরিমাণ ছিল ৭৪.১৬ শতাংশ।
ভোট পর্যালোচনা ও ফলাফল বিশ্লেষণে যে বিষয়গুলো উদ্ভাসিত হয় তা হলো- ১. গণতান্ত্রিক পরিবেশে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা সম্ভব হলে সাধারণ মানুষের ভোটদানের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। ২. সাইলেন্ট মেজরিটি নামে খ্যাত দলীয় প্রভাবমুক্ত জনসাধারণ ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে শুভবুদ্ধি প্রয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ হয়। কিন্তু তাই বলে অনির্বাচিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পরিণত করা যায় না। কারণ- ১. গণতান্ত্রিক নিয়মে অনির্বাচিত সরকারের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া চলে না। ২. নির্বাচিত সরকার জনগণের আবেগ-অনুভূতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনার স্তরকে ধারণায় রেখে এবং মানবিক বিবেচনাকে প্রাধান্য দিয়ে দেশ পরিচালনা ও রাষ্ট্র শাসনে যত্নবান থাকবে বলে আশা করা যায়। ৩. পক্ষান্তরে অগ্রসরমাণ বুদ্ধিজীবী ও উচ্চ মেধাসম্পন্ন আমলা শ্রেণী থেকে চয়ন করা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টারা আইনের কঠোর অনুশাসন ও বাস্তবতাবর্জিত তাত্তি্বক বিশ্লেষণ প্রয়োগ করে প্রশাসনিক বিধির গাণিতিক হিসাব কষে শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারঙ্গম হওয়ায় মানবতা ও জনস্বার্থ লঙ্ঘিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ৪. এই ব্যবস্থাধীনে প্রাচীন অ্যারিস্টোক্রেসি, অলিগারকি এবং প্লুটোক্রেসির ধারণা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। ফলে কতিপয় কেতাদুরস্ত মানুষের তথা কথিত উত্তম শাসনের খোলস থেকে ১/১১-এর মতো স্বৈর দানব উঁকি দিতে পারে। গণমানুষের শতবর্ষের সংগ্রামের ফসল যে গণতন্ত্র, তার জলাঞ্জলি ঘটতে পারে। ৫. এসব কারণে গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় অনির্বাচিত সম্ভ্রান্ত শ্রেণী, তীক্ষ্ন মেধার আমলা এবং ক্ষুরধার বুদ্ধির পণ্ডিতদের (যাঁরা ডিম সেদ্ধ দিতে ঘড়ি সেদ্ধ দেন) হাতে দেশের শাসনভার ন্যস্ত করার কোনো বিধান অনুমোদিত হয়নি। ৬. আমাদের সংবিধানে অনির্বাচিত সরকার গঠনের অনুমতি নেই। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ভারত প্রভৃতি প্রজাতন্ত্রেই যুগ যুগ ধরে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচন করে গণতন্ত্র বিকশিত হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক ধারায়। ৭. পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধ ছাড়া গণতন্ত্র বাঁচতে পারে না।
তবুও আজ যেহেতু প্রধান বিরোধী দল বলছে, তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া নির্বাচনে যাবে না; অন্তর্বর্তী সরকারও মানবে না, সে কারণে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সাংবিধানিক বিকল্প অনুসন্ধানে আলোচনার পথেই চলতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক, ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা

No comments

Powered by Blogger.