কালের পুরাণ-জ্বালানি উপদেষ্টা, দেশপ্রেম কারও সোল এজেন্সি নয় by সোহরাব হাসান
বাংলাদেশ একজন ‘অদ্বিতীয় জ্ঞানী’ এবং ‘অতুলনীয় দেশপ্রেমিক’-এর সন্ধান পেয়েছে, তাঁর নাম তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। নিজের জ্ঞান ও দেশপ্রেম নিয়ে কেউ মশহুর থাকলে অন্যের বলার কিছু থাকতে পারে না। কিন্তু তিনি যদি কথায় কথায় অন্যদের জ্ঞান ও দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহ করেন, তখনই সেই বাংলা প্রবাদটির কথা মনে পড়ে, ‘ঠাকুরঘরে কে রে, আমি কলা খাই না।’
গত ৫ জুন এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার নামের একটি সাময়িকী আয়োজিত কর্মশালায় প্রধানমন্ত্রীর এই স্বনামধন্য জ্বালানি উপদেষ্টা বলেছেন, ‘যারা ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ (কুইক রেন্টাল) পদ্ধতির সমালোচনা করেন, তাঁরা অজ্ঞ। আর অজ্ঞই যদি না হন, তাহলে তাঁরা জ্ঞানপাপী। জ্ঞানপাপী যদি না হন, তাহলে তাঁরা সরকারবিরোধী। আর সরকারবিরোধী যদি না হন, তাহলে তাঁরা দেশবিরোধী।’ (প্রথম আলো, ৬ জুন ২০১২)
একজন ব্যক্তি দেশপ্রেম নয়, আত্মপ্রেমে কতটা আচ্ছন্ন থাকলে এ ধরনের অমার্জিত ও বিদ্বেষপ্রসূত মন্তব্য করতে পারেন। জ্ঞান বা দেশপ্রেম নিশ্চয়ই তৌফিক-ই-ইলাহী সাহেবের সোল এজেন্সি নয় যে এতে অন্যরা ভাগ বসাতে পারবেন না। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মোনেম খান মনে করতেন, যেকোনো মানুষকে আগে থেকে খারাপ ধরে নিতে হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি নিজেকে ভালো প্রমাণ করতে পারেন। আমাদের জ্বালানি উপদেষ্টাও তাঁর মতের বাইরের সবাইকে অজ্ঞ, মতলববাজ, সরকারবিরোধী বা দেশবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করলেন।
তাঁর এই বক্তব্যের মর্মকথা কী? মর্মকথা হলো রেন্টাল বা কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎপদ্ধতির সমালোচনা করা যাবে না। সমালোচনা মানে ভালো-মন্দ বিশ্লেষণ করা। এর আগে মহাজোট সরকার জাতীয় সংসদে আইন করে কুইক রেন্টাল প্রকল্পের দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পথ বন্ধ করে দিয়েছে। এখন তৌফিক-ই-ইলাহী সাহেব সংসদের বাইরে মানুষের মুখ বন্ধ করার ফরমান জারি করেছেন। কুইক রেন্টাল যদি এতই সাধু ও বিশুদ্ধ পদ্ধতির প্রকল্প হবে, তাহলে আইন করে দায়মুক্তি দিতে হলো কেন? আইন করে তখনই দায়মুক্তি দেওয়া হয়, যখন তার মধ্যে দায়ের বিষয়টি বড় হয়ে ওঠে। আমাদের এই জাতীয় সংসদ আরও দুটি বিষয়ে অভিযুক্তদের দায়মুক্তি দিয়েছে। দ্বিতীয় সংসদে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের দায়মুক্তি এবং বিগত বিএনপি সরকারের আমলে অপারেশন ক্লিন হার্টে জড়িতদের দায়মুক্তি। প্রথম দায়মুক্তি অনেক আগেই বাতিল হয়ে গেছে। ঘাতকদের বিচার হয়েছে। দ্বিতীয় দায়মুক্তি নিয়ে এখনো দেশে-বিদেশে বিতর্ক চলছে। কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন নিয়ে যাঁদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে, ভবিষ্যতে অন্য কোনো সরকার এসে সেটি যে আবার দায়বদ্ধ করবে না, তার গ্যারান্টি কী?
জ্বালানি উপদেষ্টা সম্ভবত আইনি দায়মুক্তিতে সন্তুষ্ট না হয়ে এখন মানুষের মুখের ভাষাও বন্ধ করতে চাইছেন। সোমবার জাতীয় সংসদে মহাজোটের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন তাঁর প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছেন, তিনি কুইক রেন্টালের বিরোধিতা করেন। এখন সে জন্য কি তাঁকে অজ্ঞ বা দেশদ্রোহী আখ্যায়িত করা হবে? বোঝা যাচ্ছে না সরকারটি কারা চালাচ্ছেন, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি না অনির্বাচিত উপদেষ্টারা? মেনন সাহেব প্রশ্ন করেছেন, উপদেষ্টাদের লেজ অন্য কোথাও বাঁধা আছে। তাঁদের জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। জবাবদিহি করতে হয় মন্ত্রী-সাংসদদের। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও প্রকারান্তরে কুইক রেন্টালে ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে নিয়েছেন। বলেছেন, এই খাতে যে এত বিপুল ভর্তুকি দিতে হবে, তা আগে বুঝতে পারেননি। নতুন আর কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমতিও দেওয়া হচ্ছে না।
লক্ষণীয়, জ্বালানি উপদেষ্টা কেবল কুইক রেন্টালের বিরোধিতাকারীদের একহাত নেননি, সমালোচকদের দেশবিরোধী বানিয়ে ছেড়েছেন।
বিদ্যুৎসংকট মোকাবিলায় কুইক রেন্টাল জরুরি ছিল কি ছিল না, তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। সরকার পুরোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র নবায়ন ও সংস্কারের চেয়ে কুইক রেন্টাল কেন্দ্র চালু করাকেই ভালো মনে করেছে। আবার জাতীয় সম্পদ রক্ষা কমিটি মনে করেছে, কুইক রেন্টালে আমাদের লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়েছে। মানুষ দেখতে চাইবে কোনটি তাদের সুফল দিয়েছে। জাতীয় সংসদে রাশেদ খান মেননের সমালোচনা করতে গিয়ে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত উপদেষ্টাকেই সমর্থন করেছেন। বামপন্থীদের টিপ্পনী কেটেছেন, একসময় তিনিও বামপন্থী ছিলেন। কিন্তু ডানে ঝুঁকতে ঝুঁকতে বামভীতিতে পেয়ে বসেছে। আমাদের বক্তব্য হলো, দেশপ্রেম কারও একচেটিয়া সম্পত্তি নয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্কের মধ্য দিয়েই উত্তম সিদ্ধান্তটি বেরিয়ে আসে। কিন্তু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও তৌফিক-ই-ইলাহীরা সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না।
কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ নিয়ে জ্বালানি উপদেষ্টা যখন বড়াই করছেন, তখন বাস্তব অবস্থা কী? হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়ার পরও মানুষ লোডশেডিংয়ের দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করছে। কলকারখানাগুলো দিনের প্রায় অর্ধেক সময় বন্ধ থাকছে। কৃষকের সেচকাজও ঠিকমতো চলছে না। ক্ষমতায় আসার পর থেকে সরকার বিদ্যুৎ নিয়ে শুধু আশ্বাসের বাণী শোনাচ্ছে। ২০২১ সালের রূপকল্প দেখাচ্ছে। বর্তমানে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদনক্ষমতা আট হাজার ৩০০ মেগাওয়াট হলেও প্রকৃত উৎপাদন হচ্ছে সাড়ে পাঁচ হাজার মেগাওয়াটের মতো। সরকার বলেছে, ২০১৪ সাল নাগাদ আট হাজার এবং ২০২১ সাল নাগাদ ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে। কিন্তু বাস্তব তা থেকে অনেক দূরে। কুইক রেন্টালকে যদি আমরা সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে মেনেও নিই, গত সাড়ে তিন বছরে স্থায়ী সমাধানে জ্বালানি উপদেষ্টা কী করেছেন? কেন বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ এগোচ্ছে না? কেন বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না?
যাঁরা কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি পেয়েছেন, তাঁরা সবাই সাধুসন্ত নন। মহাবিজ্ঞ উপদেষ্টা হয়েও তিনি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে আট মাস দেরি করলেন কেন? কয়লা ও গ্যাসভিত্তিক যেসব যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে, সেগুলো এই সরকারের মেয়াদে শেষ হবে না। ২০১৩ সালের গ্রীষ্মের মধ্যে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করতে পারবে বলে সরকার যে ঘোষণা দিয়েছিল, তা বাস্তবায়নের কোনো লক্ষণ আছে কি? রামপালে প্রস্তাবিত বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিবেশের জন্য কতটা সহায়ক? কয়লা আসবে কোত্থেকে? এসব নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুললেও কি জ্বালানি উপদেষ্টার ভাষায় তিনি দেশবিরোধী হয়ে যাবেন?
নির্মম সত্য হলো, সরকার ২০১২-১৩ সালের মধ্যে দেশকে বিদ্যুতের সংকটমুক্ত রাখার ঘোষণা দিলেও বর্তমানে তা আরও চেপে বসেছে। জ্বালানি উপদেষ্টা এর দায় কী করে এড়াবেন? অন্যের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলার আগে একবার নিজেকে প্রশ্ন করুন, ক্ষমতায় আসার আগে কী কী ওয়াদা করেছিলেন, কতটুকু রক্ষা করতে পেরেছেন, আর কতটা পারেননি।
তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির দাবি, ১৯৯৭-৯৮ পর্যন্ত জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় শতভাগ গ্যাস উত্তোলন করত। কিন্তু ক্রমান্বয়ে ১৯৯৩-৯৪ ও ১৯৯৭-৯৮ সময়কালে উৎপাদন বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে ১২টি সমৃদ্ধ ব্লক বিদেশি কোম্পানির হাতে চলে যাওয়ায় এখন সেই গ্যাস উৎপাদনে বাংলাদেশের অংশীদারি শতকরা ৫০ ভাগে এসে ঠেকেছে।
মাগুরছড়া ও টেংরাটিলার গ্যাসক্ষেত্র ধ্বংসের জন্য প্রাপ্য পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৩৫ হাজার কোটি টাকা আদায়ের কোনো উদ্যোগ জ্বালানি উপদেষ্টা নিয়েছেন কি?
গত বছর কনোকোফিলিপসের সঙ্গে সমুদ্রবক্ষে গ্যাস উত্তোলনের জন্য সরকার চুক্তি করলে জাতীয় কমিটিসহ বিভিন্ন মহল প্রতিবাদ জানায়। অর্ধদিবস হরতাল পালন করে। রাজনৈতিক দলের বাইরে সেটি ছিল বাংলাদেশের প্রথম হরতাল। আমরা জাতীয় কমিটির সব বক্তব্যের সঙ্গে একমত না হলেও জাতীয় সম্পদ বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার বিরোধিতা করি। আমাদের দেশীয় প্রতিষ্ঠান যে গ্যাস উত্তোলন করতে সক্ষম, সেই গ্যাস উত্তোলনের দায়িত্ব কেন বিদেশিদের হাতে দেওয়া হবে?
বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিকেরা যখন নতুন নতুন তেল ও গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করছেন, তখন তা উত্তোলনের দায়িত্বও তাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। অন্তত স্থলভাগের তেল-গ্যাস উত্তোলনের জন্য বিদেশি কোম্পানি ডেকে আনার প্রয়োজন নেই। গত বছর কনোকোফিলিপসের সঙ্গে চুক্তির বিরোধিতা করার কারণে তেল গ্যাস ও খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতাদের বিদেশি এজেন্ট বলে গালি দিয়েছিলেন একজন প্রতিমন্ত্রী। জাতীয় কমিটির বক্তব্যে ভুল থাকলে সরকার তা খণ্ডন করতে পারত। নিজেদের যুক্তি তুলে ধরতে পারত। সেসব না করে রাস্তায় পুলিশ দিয়ে মারপিট করা কিংবা তাদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন করে সরকার নিজের দেউলিয়াত্বই প্রমাণ করেছে।
২০০৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা উন্মুত্ত খননপদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন নিষিদ্ধ এবং ফুলবাড়ীর জনগণের সঙ্গে তৎকালীন সরকারের ছয় দফা চুক্তি বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছিলেন। কয়লার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী বর্তমান অবস্থান স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘দেশের কয়লা সম্পদ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে দেওয়া হবে।’ কিন্তু এই মুহূর্তে ১৬ কোটি মানুষের বিদ্যুতের চাহিদা কীভাবে মিটবে, তার কোনো দিকনির্দেশনা নেই।
২০০১ সালের নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর শেখ হাসিনা বহুবার বলেছেন, ‘আমি গ্যাস রপ্তানি করতে রাজি হইনি বলেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে জয়ী দেওয়া হয়নি।’ কিন্তু ক্ষমতার সাড়ে তিন বছরের মাথায়ও তাঁর সরকার প্রমাণ করতে পারেনি যে জাতীয় সম্পদ রক্ষায় তারা খুবই সচেষ্ট। বিএনপি সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের অনেক বিষয়ে মতপার্থক্য আছে কিন্তু বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির ক্ষেত্রে কেউ পিছিয়ে নেই, বরং এক সরকারের দায় অন্য সরকার এসে পরিশোধ করছে।
বহুজাতিক কোম্পানিগুলো একসময় বাংলাদেশ গ্যাস ও তেলের ওপর ভাসছে বলে প্রচারণা চালিয়েছিল। এখন দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ গ্যাস রপ্তানি করবে কি, এই মুহূর্তে দেশের যে চাহিদা, তাও পূরণ করতে পারছে না। সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্যাস রপ্তানির বিরোধিতা করলেও তার দলের অনেকেই বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন। তবে বিএনপি সরকারের জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী এ কে মোশাররফ হোসেন যেভাবে নাইকোর দেওয়া কোটি টাকা দামের গাড়ি উৎকোচ হিসেবে নিয়েছিলেন, তা ছিল নজিরবিহীন নির্লজ্জ ঘটনা।
২০০৯ সালের ডিসেম্বরে জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী মহা ঢাকঢোল পিটিয়ে লন্ডন, ওয়াশিংটন ও সিঙ্গাপুরে যে রোড শো করেছিলেন জ্বালানি খাতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আনতে। কিন্তু সেই রোড শোতে রাষ্ট্রের তিন লাখ মার্কিন ডলারের বেশি খরচ করেও একজন বিনিয়োগকারীকেও আনতে পারেননি। এই ব্যর্থতার দায় উপদেষ্টা কীভাবে এড়াবেন?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
একজন ব্যক্তি দেশপ্রেম নয়, আত্মপ্রেমে কতটা আচ্ছন্ন থাকলে এ ধরনের অমার্জিত ও বিদ্বেষপ্রসূত মন্তব্য করতে পারেন। জ্ঞান বা দেশপ্রেম নিশ্চয়ই তৌফিক-ই-ইলাহী সাহেবের সোল এজেন্সি নয় যে এতে অন্যরা ভাগ বসাতে পারবেন না। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মোনেম খান মনে করতেন, যেকোনো মানুষকে আগে থেকে খারাপ ধরে নিতে হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি নিজেকে ভালো প্রমাণ করতে পারেন। আমাদের জ্বালানি উপদেষ্টাও তাঁর মতের বাইরের সবাইকে অজ্ঞ, মতলববাজ, সরকারবিরোধী বা দেশবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করলেন।
তাঁর এই বক্তব্যের মর্মকথা কী? মর্মকথা হলো রেন্টাল বা কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎপদ্ধতির সমালোচনা করা যাবে না। সমালোচনা মানে ভালো-মন্দ বিশ্লেষণ করা। এর আগে মহাজোট সরকার জাতীয় সংসদে আইন করে কুইক রেন্টাল প্রকল্পের দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পথ বন্ধ করে দিয়েছে। এখন তৌফিক-ই-ইলাহী সাহেব সংসদের বাইরে মানুষের মুখ বন্ধ করার ফরমান জারি করেছেন। কুইক রেন্টাল যদি এতই সাধু ও বিশুদ্ধ পদ্ধতির প্রকল্প হবে, তাহলে আইন করে দায়মুক্তি দিতে হলো কেন? আইন করে তখনই দায়মুক্তি দেওয়া হয়, যখন তার মধ্যে দায়ের বিষয়টি বড় হয়ে ওঠে। আমাদের এই জাতীয় সংসদ আরও দুটি বিষয়ে অভিযুক্তদের দায়মুক্তি দিয়েছে। দ্বিতীয় সংসদে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের দায়মুক্তি এবং বিগত বিএনপি সরকারের আমলে অপারেশন ক্লিন হার্টে জড়িতদের দায়মুক্তি। প্রথম দায়মুক্তি অনেক আগেই বাতিল হয়ে গেছে। ঘাতকদের বিচার হয়েছে। দ্বিতীয় দায়মুক্তি নিয়ে এখনো দেশে-বিদেশে বিতর্ক চলছে। কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন নিয়ে যাঁদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে, ভবিষ্যতে অন্য কোনো সরকার এসে সেটি যে আবার দায়বদ্ধ করবে না, তার গ্যারান্টি কী?
জ্বালানি উপদেষ্টা সম্ভবত আইনি দায়মুক্তিতে সন্তুষ্ট না হয়ে এখন মানুষের মুখের ভাষাও বন্ধ করতে চাইছেন। সোমবার জাতীয় সংসদে মহাজোটের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন তাঁর প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছেন, তিনি কুইক রেন্টালের বিরোধিতা করেন। এখন সে জন্য কি তাঁকে অজ্ঞ বা দেশদ্রোহী আখ্যায়িত করা হবে? বোঝা যাচ্ছে না সরকারটি কারা চালাচ্ছেন, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি না অনির্বাচিত উপদেষ্টারা? মেনন সাহেব প্রশ্ন করেছেন, উপদেষ্টাদের লেজ অন্য কোথাও বাঁধা আছে। তাঁদের জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। জবাবদিহি করতে হয় মন্ত্রী-সাংসদদের। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও প্রকারান্তরে কুইক রেন্টালে ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে নিয়েছেন। বলেছেন, এই খাতে যে এত বিপুল ভর্তুকি দিতে হবে, তা আগে বুঝতে পারেননি। নতুন আর কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমতিও দেওয়া হচ্ছে না।
লক্ষণীয়, জ্বালানি উপদেষ্টা কেবল কুইক রেন্টালের বিরোধিতাকারীদের একহাত নেননি, সমালোচকদের দেশবিরোধী বানিয়ে ছেড়েছেন।
বিদ্যুৎসংকট মোকাবিলায় কুইক রেন্টাল জরুরি ছিল কি ছিল না, তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। সরকার পুরোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র নবায়ন ও সংস্কারের চেয়ে কুইক রেন্টাল কেন্দ্র চালু করাকেই ভালো মনে করেছে। আবার জাতীয় সম্পদ রক্ষা কমিটি মনে করেছে, কুইক রেন্টালে আমাদের লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়েছে। মানুষ দেখতে চাইবে কোনটি তাদের সুফল দিয়েছে। জাতীয় সংসদে রাশেদ খান মেননের সমালোচনা করতে গিয়ে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত উপদেষ্টাকেই সমর্থন করেছেন। বামপন্থীদের টিপ্পনী কেটেছেন, একসময় তিনিও বামপন্থী ছিলেন। কিন্তু ডানে ঝুঁকতে ঝুঁকতে বামভীতিতে পেয়ে বসেছে। আমাদের বক্তব্য হলো, দেশপ্রেম কারও একচেটিয়া সম্পত্তি নয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্কের মধ্য দিয়েই উত্তম সিদ্ধান্তটি বেরিয়ে আসে। কিন্তু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও তৌফিক-ই-ইলাহীরা সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না।
কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ নিয়ে জ্বালানি উপদেষ্টা যখন বড়াই করছেন, তখন বাস্তব অবস্থা কী? হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়ার পরও মানুষ লোডশেডিংয়ের দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করছে। কলকারখানাগুলো দিনের প্রায় অর্ধেক সময় বন্ধ থাকছে। কৃষকের সেচকাজও ঠিকমতো চলছে না। ক্ষমতায় আসার পর থেকে সরকার বিদ্যুৎ নিয়ে শুধু আশ্বাসের বাণী শোনাচ্ছে। ২০২১ সালের রূপকল্প দেখাচ্ছে। বর্তমানে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদনক্ষমতা আট হাজার ৩০০ মেগাওয়াট হলেও প্রকৃত উৎপাদন হচ্ছে সাড়ে পাঁচ হাজার মেগাওয়াটের মতো। সরকার বলেছে, ২০১৪ সাল নাগাদ আট হাজার এবং ২০২১ সাল নাগাদ ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে। কিন্তু বাস্তব তা থেকে অনেক দূরে। কুইক রেন্টালকে যদি আমরা সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে মেনেও নিই, গত সাড়ে তিন বছরে স্থায়ী সমাধানে জ্বালানি উপদেষ্টা কী করেছেন? কেন বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ এগোচ্ছে না? কেন বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না?
যাঁরা কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি পেয়েছেন, তাঁরা সবাই সাধুসন্ত নন। মহাবিজ্ঞ উপদেষ্টা হয়েও তিনি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে আট মাস দেরি করলেন কেন? কয়লা ও গ্যাসভিত্তিক যেসব যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে, সেগুলো এই সরকারের মেয়াদে শেষ হবে না। ২০১৩ সালের গ্রীষ্মের মধ্যে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করতে পারবে বলে সরকার যে ঘোষণা দিয়েছিল, তা বাস্তবায়নের কোনো লক্ষণ আছে কি? রামপালে প্রস্তাবিত বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিবেশের জন্য কতটা সহায়ক? কয়লা আসবে কোত্থেকে? এসব নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুললেও কি জ্বালানি উপদেষ্টার ভাষায় তিনি দেশবিরোধী হয়ে যাবেন?
নির্মম সত্য হলো, সরকার ২০১২-১৩ সালের মধ্যে দেশকে বিদ্যুতের সংকটমুক্ত রাখার ঘোষণা দিলেও বর্তমানে তা আরও চেপে বসেছে। জ্বালানি উপদেষ্টা এর দায় কী করে এড়াবেন? অন্যের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলার আগে একবার নিজেকে প্রশ্ন করুন, ক্ষমতায় আসার আগে কী কী ওয়াদা করেছিলেন, কতটুকু রক্ষা করতে পেরেছেন, আর কতটা পারেননি।
তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির দাবি, ১৯৯৭-৯৮ পর্যন্ত জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় শতভাগ গ্যাস উত্তোলন করত। কিন্তু ক্রমান্বয়ে ১৯৯৩-৯৪ ও ১৯৯৭-৯৮ সময়কালে উৎপাদন বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে ১২টি সমৃদ্ধ ব্লক বিদেশি কোম্পানির হাতে চলে যাওয়ায় এখন সেই গ্যাস উৎপাদনে বাংলাদেশের অংশীদারি শতকরা ৫০ ভাগে এসে ঠেকেছে।
মাগুরছড়া ও টেংরাটিলার গ্যাসক্ষেত্র ধ্বংসের জন্য প্রাপ্য পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৩৫ হাজার কোটি টাকা আদায়ের কোনো উদ্যোগ জ্বালানি উপদেষ্টা নিয়েছেন কি?
গত বছর কনোকোফিলিপসের সঙ্গে সমুদ্রবক্ষে গ্যাস উত্তোলনের জন্য সরকার চুক্তি করলে জাতীয় কমিটিসহ বিভিন্ন মহল প্রতিবাদ জানায়। অর্ধদিবস হরতাল পালন করে। রাজনৈতিক দলের বাইরে সেটি ছিল বাংলাদেশের প্রথম হরতাল। আমরা জাতীয় কমিটির সব বক্তব্যের সঙ্গে একমত না হলেও জাতীয় সম্পদ বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার বিরোধিতা করি। আমাদের দেশীয় প্রতিষ্ঠান যে গ্যাস উত্তোলন করতে সক্ষম, সেই গ্যাস উত্তোলনের দায়িত্ব কেন বিদেশিদের হাতে দেওয়া হবে?
বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিকেরা যখন নতুন নতুন তেল ও গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করছেন, তখন তা উত্তোলনের দায়িত্বও তাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। অন্তত স্থলভাগের তেল-গ্যাস উত্তোলনের জন্য বিদেশি কোম্পানি ডেকে আনার প্রয়োজন নেই। গত বছর কনোকোফিলিপসের সঙ্গে চুক্তির বিরোধিতা করার কারণে তেল গ্যাস ও খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতাদের বিদেশি এজেন্ট বলে গালি দিয়েছিলেন একজন প্রতিমন্ত্রী। জাতীয় কমিটির বক্তব্যে ভুল থাকলে সরকার তা খণ্ডন করতে পারত। নিজেদের যুক্তি তুলে ধরতে পারত। সেসব না করে রাস্তায় পুলিশ দিয়ে মারপিট করা কিংবা তাদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন করে সরকার নিজের দেউলিয়াত্বই প্রমাণ করেছে।
২০০৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা উন্মুত্ত খননপদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন নিষিদ্ধ এবং ফুলবাড়ীর জনগণের সঙ্গে তৎকালীন সরকারের ছয় দফা চুক্তি বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছিলেন। কয়লার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী বর্তমান অবস্থান স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘দেশের কয়লা সম্পদ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে দেওয়া হবে।’ কিন্তু এই মুহূর্তে ১৬ কোটি মানুষের বিদ্যুতের চাহিদা কীভাবে মিটবে, তার কোনো দিকনির্দেশনা নেই।
২০০১ সালের নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর শেখ হাসিনা বহুবার বলেছেন, ‘আমি গ্যাস রপ্তানি করতে রাজি হইনি বলেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে জয়ী দেওয়া হয়নি।’ কিন্তু ক্ষমতার সাড়ে তিন বছরের মাথায়ও তাঁর সরকার প্রমাণ করতে পারেনি যে জাতীয় সম্পদ রক্ষায় তারা খুবই সচেষ্ট। বিএনপি সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের অনেক বিষয়ে মতপার্থক্য আছে কিন্তু বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির ক্ষেত্রে কেউ পিছিয়ে নেই, বরং এক সরকারের দায় অন্য সরকার এসে পরিশোধ করছে।
বহুজাতিক কোম্পানিগুলো একসময় বাংলাদেশ গ্যাস ও তেলের ওপর ভাসছে বলে প্রচারণা চালিয়েছিল। এখন দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ গ্যাস রপ্তানি করবে কি, এই মুহূর্তে দেশের যে চাহিদা, তাও পূরণ করতে পারছে না। সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্যাস রপ্তানির বিরোধিতা করলেও তার দলের অনেকেই বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন। তবে বিএনপি সরকারের জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী এ কে মোশাররফ হোসেন যেভাবে নাইকোর দেওয়া কোটি টাকা দামের গাড়ি উৎকোচ হিসেবে নিয়েছিলেন, তা ছিল নজিরবিহীন নির্লজ্জ ঘটনা।
২০০৯ সালের ডিসেম্বরে জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী মহা ঢাকঢোল পিটিয়ে লন্ডন, ওয়াশিংটন ও সিঙ্গাপুরে যে রোড শো করেছিলেন জ্বালানি খাতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আনতে। কিন্তু সেই রোড শোতে রাষ্ট্রের তিন লাখ মার্কিন ডলারের বেশি খরচ করেও একজন বিনিয়োগকারীকেও আনতে পারেননি। এই ব্যর্থতার দায় উপদেষ্টা কীভাবে এড়াবেন?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments