যত চাপ বাংলাদেশের ওপর by মেহেদী হাসান
রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে তেমন কিছুই বলছে
না জাতিসংঘ, বিভিন্ন দাতা সংস্থা বা আন্তর্জাতিক
মহল। রাখাইন রাজ্যের সংঘাতে সরকারি
না জাতিসংঘ, বিভিন্ন দাতা সংস্থা বা আন্তর্জাতিক
মহল। রাখাইন রাজ্যের সংঘাতে সরকারি
বাহিনীর সম্পৃক্ততা নিয়ে প্রশ্নজাতিসংঘের আহ্বানের পরের দিনই সীমান্ত খুলে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে নিউ ইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ)। তাদের আশা, আশ্রয়ের জন্য মিয়ানমার থেকে আসা ব্যক্তিদের জন্য বাংলাদেশ নিজ সীমান্ত খুলে দেবে; মানবিক বিবেচনায় শরণার্থী হিসেবে তাদের আশ্রয় দেবে। তবে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ সীমান্ত খুলে দেওয়া বা শিথিল করার সিদ্ধান্ত এখনো নেয়নি। আগের দিন জাতিসংঘের আহ্বানের পর গতকাল বুধবার এইচআরডাব্লিউ এ আহ্বান জানাল। কূটনৈতিক মহল ও সংশ্লিষ্ট অনেকেই মনে করেন, এসব আসলে বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে, নইলে এর চেয়ে অনেক বেশি চাপ তারা মিয়ানমারের ওপর সৃষ্টি করত।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলেছে, আগেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের ওপর চাপ ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের ওপর যত চাপ তার সিকি ভাগও ছিল না মিয়ানমারের ওপর। দাতা দেশগুলো এ দেশে রোহিঙ্গাদের রাখতে চায়; অথচ তারা যে কারণে এ দেশে চলে আসছে বা আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে, তার কোনো ধরনের প্রতিকারে আগ্রহ দেখায় না। সাম্প্রতিক ঘটনা বিশ্লেষণ করে কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, যারা মিয়ানমার থেকে আসা ব্যক্তিদের জন্য বাংলাদেশকে সীমান্ত খুলে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে, তারা ওই দেশটির (মিয়ানমার) প্রতি তেমন কোনো আহ্বান জানায়নি; পরিস্থিতির ব্যাপারে তেমন উদ্বেগও প্রকাশ করেনি। বরং সংঘাত শুরুর পর নিজেরাই সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলো থেকে কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে।
এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে মিয়ানমারের সাম্প্রতিক দাঙ্গায় সরকারি বাহিনীর সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে। ত্রাস সৃষ্টি করে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে বিতাড়নের কৌশল গ্রহণ করেছে সে দেশের সরকার- বিষয়টিকে এভাবেই দেখছেন অনেকে। প্রশ্ন উঠছে, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশের বিকল্প কি বাংলাদেশ?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক গতকাল বুধবার কালের কণ্ঠকে বলেন, তিন পার্বত্য জেলা ও কক্সবাজারের ব্যাপারে দাতা সংস্থা ও দেশগুলোর বিশেষ আগ্রহ চোখে পড়ার মতো। তারা তাদের সাহায্য কার্যক্রম ওই জেলাগুলো ঘিরেই চালাতে চায়।
ওই কূটনীতিক বলেন, 'মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, দাতা সংস্থা বা মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ ব্যাপারে তেমন উদ্বেগ দেখায় না। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসে অবৈধভাবে অবস্থানকারী কয়েক লাখ রোহিঙ্গার জীবনমান-জীবিকা নিয়েই তাদের যত উদ্বেগ। এমনকি তাদের নাগরিকের মতো সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারেও চাপ রয়েছে বাংলাদেশের ওপর।'
ওই কূটনীতিক বলেন, 'দাতারা প্রায়ই মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে বাংলাদেশের শরণার্থীদের আশ্রয় নেওয়ার কথা বলে রোহিঙ্গাদের এ দেশে থাকতে দেওয়ার জন্য চাপ দেয়। কিন্তু বাংলাদেশের শরণার্থীরা ভারতে কত বছর থেকেছে, আর মিয়ানমার থেকে আসা ব্যক্তিরা ১৬ কোটি জনসংখ্যার ছোট্ট এ দেশে কত বছর ধরে থাকছে?'
তিনি বলেন, 'তিন দশকেও রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে- তেমন আশার আলো দেখা যাচ্ছে না দাতা ও প্রভাবশালী দেশগুলোর দ্বৈতনীতির কারণে। তারা মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে যতটা নীরব, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়াদের জীবন-জীবিকা ও অধিকারের ব্যাপারে ততটাই সরব ভূমিকা পালন করে।'
ওই কূটনীতিক বলেন, 'দাতা দেশগুলো ও কথিত মানবাধিকার সংগঠনগুলো আদৌ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংকট দূর করে রোহিঙ্গাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায় কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তা না হলে কেন সংঘাতের মাত্র কয়েক দিনের মাথায় সীমান্ত খুলে দেওয়ার আহ্বান জানাবে?'
দাঙ্গার খবর ছাপিয়ে গেছে আশ্রয়প্রার্থীদের বাংলাদেশে ঢুকতে না দেওয়ার খবর! : কূটনৈতিক মহল জানিয়েছে, তারা মিয়ানমার ও সীমান্ত পরিস্থিতি যেমন পর্যবেক্ষণ করছে, তেমনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের দিকেও নজর রাখছে। তারা মনে করে, এখন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দাঙ্গার খবর যতটা সংবাদমাধ্যমে আসছে, তার চেয়েও বেশি আসছে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢুকতে না দেওয়ার খবর। বাংলাদেশ এখনো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং আশা করছে, সম্ভাব্য স্বল্পতম সময়ের মধ্যে রাখাইন রাজ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। কিন্তু মানবাধিকার সংগঠন ও দাতা সংস্থাগুলো ওই সময়টুকুও দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। প্রকারান্তরে তারা বলছে, এখনই সীমান্ত খুলে দিতে হবে।
এদিকে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে মিয়ানমারে সাম্প্রতিক সংঘাতে সরকারি বাহিনীর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠার পর অনেকে একে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের কৌশল হিসেবে দেখছে।
কালের কণ্ঠের উখিয়া প্রতিনিধি জানান, যখনই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়, তখনই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংকট সৃষ্টি হয়- স্থানীয় জনগণের মধ্যে এমন ধারণা রয়েছে।
'রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ ও প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদ'-এর আহ্বায়ক অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, মানবিকতার ধুয়া তুলে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য কাজ করছে যেসব বিদেশি বেসরকারি সংস্থা যেমন এসিএফ, এমএসএফ (হল্যান্ড) ও মুসলিম এইড- তাদের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে কঠোর নজরদারির জন্য সম্প্রতি কক্সবাজার জেলা প্রশাসন উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলা প্রশাসনকে নির্দেশনা দিয়েছে। এর কয়েক দিনের মধ্যেই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এর সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনবিরোধী তথাকথিত মানবতাবাদী চক্র, বেসরকারি সংস্থা এবং সশস্ত্র তৎপরতায় লিপ্ত ছিল এমন রোহিঙ্গাদের যোগসূত্র থাকা অমূলক নয়।
অধ্যক্ষ হামিদুল হক বলেন, 'পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি গত মাসে তুর্কমেনিস্তান সফরকালে শরণার্থী সমস্যা সমাধানে ইউএনএইচসিআরের সহযোগিতা চান। এরপর বাংলাদেশ সরকার পূর্ব এশিয়া ও আশিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সমন্বয়ে মালয়েশিয়া কিংবা কক্সবাজারে একটি কর্মপরিকল্পনা বা নীতিনির্ধারণ বিষয়ক বৈঠক আয়োজনের উদ্যোগ নেয়। ঠিক সেই মুহূর্তে রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ঘটনা ঘটছে। কথিত মানবতাবাদীদের ষড়যন্ত্রে মিয়ানমারে এসব ঘটছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে। কারণ রোহিঙ্গা সমস্যা তথাকথিত কিছু মানবতাবাদীর বড় লাভের ব্যবসায় পরিণত হয়েছে।'
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, মিয়ানমারে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের কারণে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটিই হুমকির মুখে পড়বে। এতে দুর্ভোগ বাড়বে বাংলাদেশের। মিয়ানমারের উচিত তার দেশের ভেতর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সংখ্যালঘুদের রক্ষায় ব্যর্থ হলে প্রভাবশালী পশ্চিমা দেশগুলো সংশ্লিষ্ট সরকারকে চাপ দেয়; এমনকি জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের নজিরও আছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে মিয়ানমারের ক্ষেত্রে এসবের কিছুই হয় না। মিয়ানমার নিরাপদ নয় বলে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় হতে পারে না।
এক জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক বলেন, সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ বাড়ানো উচিত। আর তারা যদি সেটা করতে না পারে তাহলে যেন বাংলাদেশকে তার সমস্যা নিজের মতো করে সমাধানের পথ খুঁজতে দেয়।
ওই কূটনীতিক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন গত মাসে ঢাকা সফরের সময় মিয়ানমারে পরিবর্তনের প্রসঙ্গ টেনে শরণার্থী সমস্যা সমাধানে উপায় খোঁজার কাজ শুরু করার কথা বলেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে এরপর তেমন কোনো জোরালো উদ্যোগ দেখা যায়নি। অথচ ওই যুক্তরাষ্ট্রই ২০০৮ সালে ভুটান থেকে ৬০ হাজার নেপালি শরণার্থীকে নিয়ে গেছে। শরণার্থীদের ব্যাপারে মানবিক আরো কয়েকটি দেশ এমনটা করেছে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে যদি সত্যিই উদ্বেগ থাকে, তাহলে তারা সরাসরি নিজেদের দেশে তাদের নিয়ে যায় না কেন? রোহিঙ্গারা এ দেশের নাগরিক নয়। তাই অনন্তকাল এ দেশে তাদের অবস্থানের সুযোগ নেই। তিনি আরো বলেন, মিয়ানমার থেকে বিভিন্ন সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে অনুপ্রবেশের ঘটনার ব্যাপারে সরকার অবগত। কিন্তু সীমান্ত খুলে দেওয়ার অর্থ হলো ওপারের রোহিঙ্গাদের এখানে আসতে আমন্ত্রণ জানানো। এর প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতি এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকার ওপর। আর 'শরণার্থী' মর্যাদা দিলে তো তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো দিন ফেরত পাঠানো যাবে না। এ দেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা দেশে ফিরে যেতে চায় না। ফিরে যাওয়ার প্রশ্ন এলেই এমন শর্ত দেয়, যা পূরণ করা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়।
ওই কূটনীতিক বলেন, দাতা সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের জন্য অর্থ-সাহায্য দিতে চায়। কিন্তু এ যাবৎ মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের সবচেয়ে বড় সাহায্য দিয়েছে বাংলাদেশই। নিজের ভূখণ্ডে রোহিঙ্গাদের বছরের পর বছর থাকতে দিচ্ছে। এভাবে আর কত দিন?
আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার পরামর্শ : রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ আগামী দিনগুলোতে আরো বাড়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে। এ জন্য আগে থেকেই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়ার ব্যাপারে মত দিয়েছেন তাঁরা। সাবেক রাষ্ট্রদূত আশফাকুর রহমান বলেন, 'রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বাংলাদেশ প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে পারে। রোহিঙ্গারা যদি একবার বাংলাদেশে প্রবেশ করে, তবে তাদের বের করা কঠিন হবে।'
বাংলাদেশকে চাপে রাখার কৌশল : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, সীমান্ত শিথিল করার মতো পরিস্থিতি এখনো আসেনি। সাম্প্রতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশকে চাপে রাখার কৌশল এটি।
ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, 'সীমান্তের ওপারে এবারের যে সংকট তা হঠাৎ করেই। এমন নয় যে, তা অনেক দিন ধরে হচ্ছিল; আর পরিস্থিতি সামাল দিতে সীমানা খুলে দিতে হবে বা শিথিল করতে হবে। তাই ওই আহ্বানকে আমি খুব একটা বাস্তবসম্মত মনে করি না।'
শরণার্থী আনতেই আগ্রহী ইউএনএইচসিআর : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান বলেছেন, 'আমি একটি অপ্রিয় সত্যি কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি। ইউএনএইচসিআরের কার্যক্রম বাংলাদেশের স্বার্থের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। বাংলাদেশের সরকার এটা বুঝতে পারছে যে, তারা অস্থিতিশীল একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রাখে। ইউএনএইচসিআর এখন পর্যন্ত এমন কোনো চাপ সৃষ্টি করেনি, এমন কোনো কার্যক্রম নেয়নি, যাতে করে শরণার্থী হিসেবে এ দেশে অবস্থানকারীরা ফেরত যায়। কিন্তু যখনই একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তখনই বাংলাদেশে শরণার্থী ঢোকানোর ব্যাপারে ইউএনএইচসিআর খুব আগ্রহী হয়ে ওঠে।'
কূটনৈতিক সূত্রগুলো মনে করে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সংকটের একটি মানবিক দিক আছে। ওই কথা তুলে সংকটকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন মহল এ দেশে নতুন করে রোহিঙ্গা আনতে চায়। কিন্তু মিয়ানমারের সংকট সমাধানে তারা কতটা আগ্রহী, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
আবারও ঢাকার 'না'
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলেছে, আগেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের ওপর চাপ ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের ওপর যত চাপ তার সিকি ভাগও ছিল না মিয়ানমারের ওপর। দাতা দেশগুলো এ দেশে রোহিঙ্গাদের রাখতে চায়; অথচ তারা যে কারণে এ দেশে চলে আসছে বা আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে, তার কোনো ধরনের প্রতিকারে আগ্রহ দেখায় না। সাম্প্রতিক ঘটনা বিশ্লেষণ করে কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, যারা মিয়ানমার থেকে আসা ব্যক্তিদের জন্য বাংলাদেশকে সীমান্ত খুলে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে, তারা ওই দেশটির (মিয়ানমার) প্রতি তেমন কোনো আহ্বান জানায়নি; পরিস্থিতির ব্যাপারে তেমন উদ্বেগও প্রকাশ করেনি। বরং সংঘাত শুরুর পর নিজেরাই সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলো থেকে কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে।
এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে মিয়ানমারের সাম্প্রতিক দাঙ্গায় সরকারি বাহিনীর সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে। ত্রাস সৃষ্টি করে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে বিতাড়নের কৌশল গ্রহণ করেছে সে দেশের সরকার- বিষয়টিকে এভাবেই দেখছেন অনেকে। প্রশ্ন উঠছে, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশের বিকল্প কি বাংলাদেশ?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক গতকাল বুধবার কালের কণ্ঠকে বলেন, তিন পার্বত্য জেলা ও কক্সবাজারের ব্যাপারে দাতা সংস্থা ও দেশগুলোর বিশেষ আগ্রহ চোখে পড়ার মতো। তারা তাদের সাহায্য কার্যক্রম ওই জেলাগুলো ঘিরেই চালাতে চায়।
ওই কূটনীতিক বলেন, 'মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, দাতা সংস্থা বা মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ ব্যাপারে তেমন উদ্বেগ দেখায় না। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসে অবৈধভাবে অবস্থানকারী কয়েক লাখ রোহিঙ্গার জীবনমান-জীবিকা নিয়েই তাদের যত উদ্বেগ। এমনকি তাদের নাগরিকের মতো সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারেও চাপ রয়েছে বাংলাদেশের ওপর।'
ওই কূটনীতিক বলেন, 'দাতারা প্রায়ই মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে বাংলাদেশের শরণার্থীদের আশ্রয় নেওয়ার কথা বলে রোহিঙ্গাদের এ দেশে থাকতে দেওয়ার জন্য চাপ দেয়। কিন্তু বাংলাদেশের শরণার্থীরা ভারতে কত বছর থেকেছে, আর মিয়ানমার থেকে আসা ব্যক্তিরা ১৬ কোটি জনসংখ্যার ছোট্ট এ দেশে কত বছর ধরে থাকছে?'
তিনি বলেন, 'তিন দশকেও রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে- তেমন আশার আলো দেখা যাচ্ছে না দাতা ও প্রভাবশালী দেশগুলোর দ্বৈতনীতির কারণে। তারা মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে যতটা নীরব, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়াদের জীবন-জীবিকা ও অধিকারের ব্যাপারে ততটাই সরব ভূমিকা পালন করে।'
ওই কূটনীতিক বলেন, 'দাতা দেশগুলো ও কথিত মানবাধিকার সংগঠনগুলো আদৌ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংকট দূর করে রোহিঙ্গাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায় কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তা না হলে কেন সংঘাতের মাত্র কয়েক দিনের মাথায় সীমান্ত খুলে দেওয়ার আহ্বান জানাবে?'
দাঙ্গার খবর ছাপিয়ে গেছে আশ্রয়প্রার্থীদের বাংলাদেশে ঢুকতে না দেওয়ার খবর! : কূটনৈতিক মহল জানিয়েছে, তারা মিয়ানমার ও সীমান্ত পরিস্থিতি যেমন পর্যবেক্ষণ করছে, তেমনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের দিকেও নজর রাখছে। তারা মনে করে, এখন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দাঙ্গার খবর যতটা সংবাদমাধ্যমে আসছে, তার চেয়েও বেশি আসছে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢুকতে না দেওয়ার খবর। বাংলাদেশ এখনো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং আশা করছে, সম্ভাব্য স্বল্পতম সময়ের মধ্যে রাখাইন রাজ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। কিন্তু মানবাধিকার সংগঠন ও দাতা সংস্থাগুলো ওই সময়টুকুও দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। প্রকারান্তরে তারা বলছে, এখনই সীমান্ত খুলে দিতে হবে।
এদিকে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে মিয়ানমারে সাম্প্রতিক সংঘাতে সরকারি বাহিনীর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠার পর অনেকে একে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের কৌশল হিসেবে দেখছে।
কালের কণ্ঠের উখিয়া প্রতিনিধি জানান, যখনই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়, তখনই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংকট সৃষ্টি হয়- স্থানীয় জনগণের মধ্যে এমন ধারণা রয়েছে।
'রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ ও প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদ'-এর আহ্বায়ক অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, মানবিকতার ধুয়া তুলে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য কাজ করছে যেসব বিদেশি বেসরকারি সংস্থা যেমন এসিএফ, এমএসএফ (হল্যান্ড) ও মুসলিম এইড- তাদের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে কঠোর নজরদারির জন্য সম্প্রতি কক্সবাজার জেলা প্রশাসন উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলা প্রশাসনকে নির্দেশনা দিয়েছে। এর কয়েক দিনের মধ্যেই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এর সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনবিরোধী তথাকথিত মানবতাবাদী চক্র, বেসরকারি সংস্থা এবং সশস্ত্র তৎপরতায় লিপ্ত ছিল এমন রোহিঙ্গাদের যোগসূত্র থাকা অমূলক নয়।
অধ্যক্ষ হামিদুল হক বলেন, 'পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি গত মাসে তুর্কমেনিস্তান সফরকালে শরণার্থী সমস্যা সমাধানে ইউএনএইচসিআরের সহযোগিতা চান। এরপর বাংলাদেশ সরকার পূর্ব এশিয়া ও আশিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সমন্বয়ে মালয়েশিয়া কিংবা কক্সবাজারে একটি কর্মপরিকল্পনা বা নীতিনির্ধারণ বিষয়ক বৈঠক আয়োজনের উদ্যোগ নেয়। ঠিক সেই মুহূর্তে রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ঘটনা ঘটছে। কথিত মানবতাবাদীদের ষড়যন্ত্রে মিয়ানমারে এসব ঘটছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে। কারণ রোহিঙ্গা সমস্যা তথাকথিত কিছু মানবতাবাদীর বড় লাভের ব্যবসায় পরিণত হয়েছে।'
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, মিয়ানমারে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের কারণে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটিই হুমকির মুখে পড়বে। এতে দুর্ভোগ বাড়বে বাংলাদেশের। মিয়ানমারের উচিত তার দেশের ভেতর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সংখ্যালঘুদের রক্ষায় ব্যর্থ হলে প্রভাবশালী পশ্চিমা দেশগুলো সংশ্লিষ্ট সরকারকে চাপ দেয়; এমনকি জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের নজিরও আছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে মিয়ানমারের ক্ষেত্রে এসবের কিছুই হয় না। মিয়ানমার নিরাপদ নয় বলে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় হতে পারে না।
এক জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক বলেন, সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ বাড়ানো উচিত। আর তারা যদি সেটা করতে না পারে তাহলে যেন বাংলাদেশকে তার সমস্যা নিজের মতো করে সমাধানের পথ খুঁজতে দেয়।
ওই কূটনীতিক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন গত মাসে ঢাকা সফরের সময় মিয়ানমারে পরিবর্তনের প্রসঙ্গ টেনে শরণার্থী সমস্যা সমাধানে উপায় খোঁজার কাজ শুরু করার কথা বলেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে এরপর তেমন কোনো জোরালো উদ্যোগ দেখা যায়নি। অথচ ওই যুক্তরাষ্ট্রই ২০০৮ সালে ভুটান থেকে ৬০ হাজার নেপালি শরণার্থীকে নিয়ে গেছে। শরণার্থীদের ব্যাপারে মানবিক আরো কয়েকটি দেশ এমনটা করেছে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে যদি সত্যিই উদ্বেগ থাকে, তাহলে তারা সরাসরি নিজেদের দেশে তাদের নিয়ে যায় না কেন? রোহিঙ্গারা এ দেশের নাগরিক নয়। তাই অনন্তকাল এ দেশে তাদের অবস্থানের সুযোগ নেই। তিনি আরো বলেন, মিয়ানমার থেকে বিভিন্ন সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে অনুপ্রবেশের ঘটনার ব্যাপারে সরকার অবগত। কিন্তু সীমান্ত খুলে দেওয়ার অর্থ হলো ওপারের রোহিঙ্গাদের এখানে আসতে আমন্ত্রণ জানানো। এর প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতি এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকার ওপর। আর 'শরণার্থী' মর্যাদা দিলে তো তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো দিন ফেরত পাঠানো যাবে না। এ দেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা দেশে ফিরে যেতে চায় না। ফিরে যাওয়ার প্রশ্ন এলেই এমন শর্ত দেয়, যা পূরণ করা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়।
ওই কূটনীতিক বলেন, দাতা সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের জন্য অর্থ-সাহায্য দিতে চায়। কিন্তু এ যাবৎ মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের সবচেয়ে বড় সাহায্য দিয়েছে বাংলাদেশই। নিজের ভূখণ্ডে রোহিঙ্গাদের বছরের পর বছর থাকতে দিচ্ছে। এভাবে আর কত দিন?
আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার পরামর্শ : রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ আগামী দিনগুলোতে আরো বাড়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে। এ জন্য আগে থেকেই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়ার ব্যাপারে মত দিয়েছেন তাঁরা। সাবেক রাষ্ট্রদূত আশফাকুর রহমান বলেন, 'রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বাংলাদেশ প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে পারে। রোহিঙ্গারা যদি একবার বাংলাদেশে প্রবেশ করে, তবে তাদের বের করা কঠিন হবে।'
বাংলাদেশকে চাপে রাখার কৌশল : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, সীমান্ত শিথিল করার মতো পরিস্থিতি এখনো আসেনি। সাম্প্রতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশকে চাপে রাখার কৌশল এটি।
ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, 'সীমান্তের ওপারে এবারের যে সংকট তা হঠাৎ করেই। এমন নয় যে, তা অনেক দিন ধরে হচ্ছিল; আর পরিস্থিতি সামাল দিতে সীমানা খুলে দিতে হবে বা শিথিল করতে হবে। তাই ওই আহ্বানকে আমি খুব একটা বাস্তবসম্মত মনে করি না।'
শরণার্থী আনতেই আগ্রহী ইউএনএইচসিআর : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান বলেছেন, 'আমি একটি অপ্রিয় সত্যি কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি। ইউএনএইচসিআরের কার্যক্রম বাংলাদেশের স্বার্থের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। বাংলাদেশের সরকার এটা বুঝতে পারছে যে, তারা অস্থিতিশীল একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রাখে। ইউএনএইচসিআর এখন পর্যন্ত এমন কোনো চাপ সৃষ্টি করেনি, এমন কোনো কার্যক্রম নেয়নি, যাতে করে শরণার্থী হিসেবে এ দেশে অবস্থানকারীরা ফেরত যায়। কিন্তু যখনই একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তখনই বাংলাদেশে শরণার্থী ঢোকানোর ব্যাপারে ইউএনএইচসিআর খুব আগ্রহী হয়ে ওঠে।'
কূটনৈতিক সূত্রগুলো মনে করে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সংকটের একটি মানবিক দিক আছে। ওই কথা তুলে সংকটকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন মহল এ দেশে নতুন করে রোহিঙ্গা আনতে চায়। কিন্তু মিয়ানমারের সংকট সমাধানে তারা কতটা আগ্রহী, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
আবারও ঢাকার 'না'
No comments