দুই দু’গুণে পাঁচ-ভয়ভীতি সমাচার by আতাউর রহমান
‘অসত্যের কাছে কভু নত নাহি হবে শির/ ভয়ে কাঁপে কাপুরুষ, লড়ে যায় বীর’—একসময় এ দেশের একটি জাতীয় দৈনিকের আপ্তবাক্য হিসেবে এটাই প্রতিদিন মাস্টহেডে ছাপানো হতো। মহাকবি শেক্সপিয়ারও প্রায় অনুরূপ কথা বলেছেন তাঁর একটি নাটকের কুশীলবের মাধ্যমে: ‘ভীতুরা মৃত্যুর আগে বহুবার মরে, সাহসীরা মৃত্যুর স্বাদ একবারই
গ্রহণ করে।’ আর কেবল শেক্সপিয়ারের কথাই বা বলি কেন! স্নায়ুযুদ্ধের যুগে পৃথিবীটা যখন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার নেতৃত্বে যথাক্রমে ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক ব্লকে বিভক্ত ছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি একটা চমকপ্রদ কথা বলেছিলেন: ‘উই শুড নট ফিয়ার টু নিগোশিয়েট; বাট উই শুড নট নিগোশিয়েট আউট অব ফিয়ার।’ অর্থাৎ ‘(রাশিয়ার সঙ্গে) মীমাংসার্থে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যেতে আমাদের ভয় পাওয়া উচিত নয়, কিন্তু আমাদের উচিত নয় ভয়ে ভীত হয়ে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাওয়া।’ তাঁর একজন পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টও বলেছেন, ‘দ্য অনলি থিং উই হ্যাভ টু ফিয়ার ইজ ফিয়ার ইটসেলফ।’ অর্থাৎ ‘স্বয়ং ভয়ই একমাত্র জিনিস, যেটাকে আমাদের ভয় করা উচিত।’
তা দুনিয়ার তাবৎ জ্ঞানী-গুণীই ভয়ভীতি সম্পর্কে বহু মূল্যবান কথা বলে গেছেন। এই যেমন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘প্রবলের ভয় আর দুর্বলের ভয়ে মস্ত একটা তফাৎ আছে। দুর্বল ভয় পায় সে ব্যথা পাবে, আর প্রবল ভয় পায় সে বাধা পাবে বলে।’ জর্জ বার্নার্ড শ বলেছেন, ‘পৃথিবীতে একটাই বিশ্বজনীন আবেগ—ভীতি।’ মহামতি ভলতেয়ার বলেছেন, ‘অপরাধ ভয়ের জন্ম দেয় এবং এটাই অপরাধের শাস্তি।’ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছেন, ‘ভয় হচ্ছে কুসংস্কারের প্রধান উৎস এবং নৃশংসতার অন্যতম প্রধান উৎস। ভয়কে জয় করাই হচ্ছে বিজ্ঞতার সূচনা।’ আর আমাদের উপমহাদেশীয় চাণক্য পণ্ডিত তো কাব্য করে বলেছেন—
ভয়ের কারণটাকে ভয় করা ভালো
যতক্ষণ তাহা অনাগত,
ভয়ের কারণ যদি ঘাড়ে এসে পড়ে
নাশো তারে নির্ভীকের মতো।
সত্যি বলতে কি, ভয়ভীতি দুই ধরনের লোককে বোকা বানায়—যারা কিছুই ভয় করে না, আর যারা সবকিছুকেই ভয় করে; এমনকি তেলাপোকাকেও। ভয় হচ্ছে এক ধরনের ট্যাক্স, যা বিবেক পাপ বা অপরাধকে দিয়ে থাকে। আমরা নিজেরা যখন ভীত হই, তখন বলি, ‘সতর্ক’; অন্যেরা যখন ভীত হয়, তখন বলি, ‘ভীরু’। যে লোক তার অতীত সম্পর্কে ভীত, ভবিষ্যৎ নিয়েও তার ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। আর কেউ যদি গতকাল নিয়ে অনুতপ্ত ও আগামীকাল নিয়ে ভীত না হয়, বুঝতে হবে সে সাফল্যের সড়কেই আছে।
সর্বোপরি, আমরা স্রষ্টাকে কম ভয় পাই বলেই মানুষকে এত বেশি ভয় করি; ভয়ের বিশালত্ব আমাদের ঈমান তথা বিশ্বাসের পঙ্গুত্বকেই প্রমাণ করে। সে যা হোক। বাপ-বেটাতে নিম্নোক্ত কথোপকথন হচ্ছিল—
বাবা, তুমি যখন রাস্তায় গরু দেখো, তখন কি ভয় পাও না?
‘অবশ্যই না।’
তুমি যখন একটি বিরাট পতঙ্গ দেখো, তখন কি ভীত হও না?
‘না, অবশ্যই না।’
তুমি কি বজ্রবৃষ্টি ও তুফান দেখে ভয় পাও না?
‘না রে বাবা, না।’
তুমি কি ভূমিকম্পের সতর্কবাণীতেও ভয় পাও না?
‘না, তাও না।’
বাবা, তাহলে তুমি কি মা ছাড়া আর কাউকে ভয় করো না?
তাই তো, সংসারের অধিকাংশ বিবাহিত পুরুষই তো স্ত্রী ছাড়া আর কাউকে তেমন ভয় বা তোয়াক্কা করেন না। সৈয়দ মুজতবা আলী সাহেবের এ-সম্পর্কিত সেই বহুল কথিত গল্পটি আশা করি সবারই জানা। গল্পটির আধুনিক সংস্করণ, ‘সেই যে আমেরিকান খামখেয়ালি কোটিপতি স্ত্রৈণ স্বামীকে মোরগ ও অপরদের ঘোড়া দেবার নির্দেশ সহকারে তাঁর এক প্রতিনিধিকে গ্রামাঞ্চলে পাঠালেন এবং কোথাও ঘোড়া নেবার যোগ্য কাউকে পাওয়া গেল না।’ সেই গল্পটিও আমি ইতিপূর্বে এই কলামেই উপস্থাপন করেছি। অতএব, এবারে নতুন সংযোজন প্রয়োজন—
গভীর রাতে বিবাহিত ভদ্রলোককে পার্কের ভেতরে ইতস্তত ঘোরাফেরা করতে দেখে পার্কের প্রহরী বললেন, এত রাতে পার্কের ভেতরে একা ঘোরাঘুরি করছেন কেন? কৈফিয়ত দিন। ভদ্রলোক তখন সখেদে প্রত্যুত্তর করলেন, ‘কৈফিয়তই যদি দিতে পারতাম, তাহলে এতক্ষণে বাড়ি চলে যেতাম।’ আরেকজন সার্কাস পার্টিতে বাঘের খেলা দেখান, তাঁর মুখনিঃসৃত নির্দেশ ও ডান হাতস্থ চাবুকের চালনায় বাঘকে সব সময় ভীতসন্ত্রস্ত মনে হয়। তো, এক রাতে সার্কাসের বাঘের খেলা প্রদর্শন শেষে বাড়ি ফিরে ঘরের বাঘিনীর রুদ্রমূর্তি দেখে ভয় পেয়ে ফিরে গিয়ে বাকি রাত বাঘের খাঁচায় বাঘের সঙ্গে সহাবস্থান করে কাটালেন।
আর এবারের ঈদের মৌসুমে একটি জনপ্রিয় টিভি চ্যানেলে সাহিত্যিক-সাংবাদিক আনিসুল হকের লেখা একটি জীবনধর্মী নাটকের শেষাংশ দেখতে গিয়ে আমার তো ভয়ে ভীতসন্ত্রন্ত হওয়ার জোগাড়। বিজ্ঞাপনের দৌরাত্ম্যে আজকাল আর টিভির কোনো প্রোগ্রাম পুরোপুরি দেখা যায় না। এখানেও থেকে যাচ্ছে সেই ‘ভয়’: চ্যানেলের সংখ্যা যত বাড়বে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও ততই বাড়বে; কেননা সব চ্যানেলে প্রচার করতে গিয়ে সর্বমোট যে খরচ পড়বে, সেটা প্রোডাকশন কস্টে জুড়ে দিয়েই পণ্যটার মূল্য নির্ধারিত হবে এবং সেটা বহন করতে হবে কনজ্যুমারদের, অর্থাৎ আমাদের। এটা বোঝার জন্য ড. ফরাসউদ্দিনের মতো অর্থনীতিবিদ হতে হয় না। তা সে যা হোক, বলছিলাম, নাটক দেখে ভিরমি খাওয়ার কথা: দেখলাম, বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া মেয়েরা সমানে তাদের প্রেমিক তথা ছেলেবন্ধুকে সামান্য কারণে গালে চড়-থাপড় দিচ্ছে, আর ওরা তেমন কোনো প্রতিবাদ ব্যতিরেকেই সেটাকে হজম করে যাচ্ছে। এটা কি ভয়ের কারণে, নাকি অন্য কোনো কারণে, সেটা নির্ধারণের ভার পাঠকদের ওপরই ছেড়ে দিলাম। আমি ভয়ে বিশেষ কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত রইলাম।
শেষ করছি ‘ভয়’-সম্পর্কিতই একটি বিদেশি গল্প উপস্থাপনের মাধ্যমে: একজন পাদরি ও একজন খ্রিষ্টান ট্রাকড্রাইভার একই দিনে মৃত্যুমুখে পতিত হলেন। তো সেন্ট পিটার পার্লি গেটে দুজনকে সাদর অভ্যর্থনা করার পর পাদরিকে তিনি বরাদ্দ দিলেন স্বর্গের একটি কক্ষ ও ট্রাকড্রাইভারকে দিলেন একটি প্রাসাদ বরাদ্দ। পাদরি এতে প্রতিবাদ জানালে তাঁকে বলা হলো, ‘গির্জায় আপনার ধর্মোপদেশ শুনে কজন লোক ঈশ্বরকে ভয় করেছে? অথচ ট্রাকড্রাইভার যখন ট্রাক চালাত, তখন রাস্তাঘাটের অন্যান্য গাড়িচালক ও পথচারী ভয়ে অহরহ ঈশ্বরের নাম নিত, যে কারণে তার মর্যাদা অনেক গুণ বেড়ে গেছে।’
অতএব, ভয়কে সব সময় ভয় করতে নেই।
আতাউর রহমান: রম্য লেখক। ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক।
No comments