ব দ লে যা ও ব দ লে দা ও মি ছি ল ব দ লে যা ও মি ছি ল-আসুন, ইভ টিজিং নামক আগাছা দূর করি by আফছানা বেগম

‘বদলে যাও বদলে দাও মিছিল’ ব্লগে দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা ও নির্বাচিত চারটি ইস্যু নিয়ে অব্যাহত আলোচনা হচ্ছে। আজ ইভ টিজিংমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার একটি বিশ্লেষণাত্মক অভিমতসহ আরও তিনজন লেখকের নির্বাচিত মন্তব্য ছাপা হলো।


নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে প্রতিনিয়ত চলছে আন্দোলন, যার সূত্রপাত ঘটে নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার লেখনীশক্তির মাধ্যমে। বিশেষ করে সুলতানার স্বপ্ন ও অবরোধবাসিনী গল্পের মাধ্যমে আমরা নারীর অধিকার উপলব্ধি করতে পারি। অনেক প্রতিকূলতা জয় করে বাংলাদেশে নারীরা আধুনিক চ্যালেঞ্জিং পেশায় এগিয়ে আসছেন। নারী এখন চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী, বিসিএস অফিসার, আইনজীবী, সাংবাদিক, সেনা অফিসার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ বিভিন্ন পেশায় কাজ করে নিজেদের দক্ষতার প্রমাণ দিচ্ছেন। এত পরিবর্তন আর অগ্রগতির মধ্যেও নারী নির্যাতনের ধরনও হচ্ছে নতুন নতুন। এমনই এক নির্যাতনের রূপ হচ্ছে, ইভ টিজিং বা যৌন উত্ত্যক্তকরণ ও যৌননিপীড়ন। ইভ টিজিং হলো, জনসম্মুখে কোনো ছেলে বা পুরুষ কর্তৃক নারীদের ওপর আকার-ইঙ্গিত করা অথবা শব্দ করা অথবা গায়ে হাত দেওয়া অথবা অন্য কোনো উপায়ে যৌননিপীড়ন করা। বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে কোনো ধরনের সুস্পষ্ট রক্ষাকবচ নেই, যা আমাদের সংবিধানে উল্লিখিত নারী-পুরুষ সমতাকে সমুন্নত রাখতে পারে। ফলে প্রতিনিয়ত যৌন হয়রানিমূলক ঘটনা ঘটছে। সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সঙ্গে মূল্যবোধের অবক্ষয়ই এর প্রধান কারণ।
পরিবারের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় নৈতিক শিক্ষার অভাব, হতাশা আর নোংরা মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বখাটেরা মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে। ভদ্র সমাজের ব্যক্তিরাও এটা নানা কৌশলে করে থাকেন। ইভ টিজিংয়ের কারণে মেয়েদের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়া। যে কারণে তাঁরা আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। আর তাই এর প্রতিরোধে আইন প্রণয়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখনো এ অপরাধের সাজা সামান্য জেল-জরিমানা। অপরাধী দ্রুত জামিনে বের হয়ে আসতে পারছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সংশোধনী এনে যুগোপযোগী কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে এবং ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো, আইনের যথাযথ প্রয়োগ। আইন প্রণয়ণের আগে জনমত জরিপ একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ভুক্তভোগীরা কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন, কীভাবে তাদের বিচার প্রাপ্তি বাধাগ্রস্ত হয় এবং কী ধরনের ব্যবস্থায় এর উত্তরণ সম্ভব তা যাচাই করে আইন প্রণয়ন করতে হবে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। তাঁদের প্রশিক্ষণ পাঠ্যসূচিতে মৌলিক বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
বেগম রোকেয়া তাঁর সুলতানার স্বপ্ন গল্পে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন ১৯০৫ সালে, তা স্বপ্নই থেকে যাবে, যদি কিশোরীদের প্রতি বখাটেদের অত্যাচার বন্ধ না হয়। সমাজ থেকে এই আগাছা দূর করতে হলে প্রথমত পারিবারিকভাবে নৈতিকতা শিক্ষার প্রয়োজন। একজন মানুষের প্রথম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তার পরিবার। এই প্রাথমিক শিক্ষাই তার সমগ্র জীবনে বড় প্রভাব সৃষ্টি করে। তারপর সামাজিক ও ধর্মীয় শিক্ষা, যা তাকে নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন করে আদর্শ মানবরূপে সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। এরপর আসে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, যা শিক্ষার্থীর মনে আলোক শিখা প্রজ্বলিত করে এবং নিজের মধ্যে মূল্যবোধ গড়ে তুলতে সহায়তা করে। সঠিক শিক্ষা নারীকে শিশুকাল থেকেই আত্মপ্রত্যয়ী করে তুলবে। সব সমস্যা একা মোকাবিলা করা হয়তো যায় না, কিন্তু যেকোনো অঘটন মোকাবিলার ব্যক্তিগত আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা জরুরি। ছোটকালে পড়েছিলাম, চীন-জাপানের বাচ্চারা ছোটবেলা থেকেই নাকি কুংফু-কারাতেতে পারদর্শী। ভারতে বেশ কয়েক বছর ধরে স্কুটি বলে পরিচিত ভেসপা মোটরসাইকেলগুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে নারীদের কাছে। এতে বাসের পেছনে ছোটা ও বাসের অনাকাঙ্ক্ষিত ভিড় এড়াতে পারছেন তাঁরা সহজেই। ফলে বাসে যৌন হয়রানির হার কমে আসবে। মালয়েশিয়ায় মুসলিম নারীরা বাস এড়াতে মোটরসাইকেল ব্যবহার করেন নিজস্ব পর্দাপ্রথা মেনে চলেই। আমরা বোনের লাশ নিয়ে মাতম করতে পারি, কিন্তু আত্মরক্ষার্থে বোনকে কুংফু-কারাতে শেখার সুযোগ করে দেওয়ার কথা আমাদের মস্তিষ্কে একবারও আসে না। আর আমাদের বোনেরা বা নারীরা ভেসপা চালালে তো জাত-সম্মান চলে যাবে, এমনটাই ভাবি আমরা। ইভ টিজিং প্রতিরোধে আন্দোলনের যে জোয়ার বইছে, এই জোয়ার যেন পূর্ণ কার্যকারিতা আনে। এমন যেন না হয়—আমরা রাজপথ কাঁপিয়ে তুলছি সুসজ্জিত ব্যানারে আর ওদিকে ইভ টিজারদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে!
প্রথম আলোর ‘বদলে যাও বদলে দাও মিছিল’ কর্মসূচিটি এক অসাধারণ সময়োপযোগী উদ্যোগ। এমন নাগরিকমঞ্চ আমাদের মতো তরুণদের দিনবদলের সংগ্রামে শামিল হতে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করছে। এ দেশে নারীদের সমস্যার যেন শেষ নেই। পরিবর্তনশীল পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হলে নারীদের দেশের সব কর্মযজ্ঞে নিয়ে আসতে হবে। আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারী হন পুরুষের ইচ্ছার অধীন। যখন কোনো নারী তাঁর এ ইচ্ছায় আপত্তি তোলেন, তখন তা আঘাত করে পুরুষের অহমে। ফলে পুরুষ তাঁর স্বভাবসিদ্ধ বৈশিষ্ট্যে এর প্রতিশোধ নিতে চান। তখনই উদ্ভব হয় এই যৌননিপীড়নের। আমাদের সমাজকাঠামো যা আছে, তা-ই থাক না। শুধু প্রয়োজন পরস্পরের প্রতি সম্মানসূচক দৃষ্টিভঙ্গি। তবেই যৌননিপীড়ন নামক সমাজের এ আগাছা ঝেড়ে ফেলে দেওয়া সম্ভব।
আফছানা বেগম, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ab.orthy@yahoo.com
যোগ দিন ফেসবুক পেজে : www.facebook.com/bjbdmichil

No comments

Powered by Blogger.