লাতিন আমেরিকা-কিউবায় পিরিস্ত্রোইকা by মশিউল আলম

১৯৮৭ সালে আমরা যখন উচ্চশিক্ষার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নে যাই, তার বছর দুয়েক আগে মিখাইল গর্বাচভের নেতৃত্বে দেশটিতে শুরু হয়েছিল পিরিস্ত্রোইকা। ১৯৮৮ সাল নাগাদ সোভিয়েত ব্যবস্থার এক আমূল রূপান্তর দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল এবং ১৯৯০ সালের মাঝ নাগাদ পরিষ্কার বোঝা গিয়েছিল যে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা আর থাকছে না।


সে সময় মস্কোর বিভিন্ন উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে টাকা-পয়সা উপার্জনের যে উৎসাহ দেখা গিয়েছিল, লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ছেলেমেয়েরা ছিল তার বাইরে, অথবা একদমই শেষ সারিতে। অন্তত মস্কোর পাত্রিস লুমুম্বা গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন একজন লাতিন আমেরিকানকেও দেখতে পাইনি, যে ডলার কেনাবেচা করত বা সিঙ্গাপুর-ইস্তাম্বুল গিয়ে জিনিসপত্র কিনে এনে মস্কোতে বিক্রি করে কাঁচা পয়সা বানানোর ইঁদুর-দৌড়ে শামিল হয়েছিল। শুধু তাই নয়, লক্ষ করেছি, সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের রূপান্তর বা গ্লাসনোস্ত-পিরিস্ত্রোইকার প্রতি লাতিন আমেরিকার ছেলেমেয়েদের সায় ছিল না। শুধু সমাজতান্ত্রিক কিউবা আর নিকারাগুয়ার ছেলেমেয়েরা নয়, মেক্সিকো, চিলি, আর্জেটিনা, বলিভিয়া, ভেনেজুুয়েলা, কোস্তারিকা, হন্ডুরাস, ইকুয়েডর প্রভৃতি পুঁজিতান্ত্রিক দেশের ছেলেমেয়েরাও পিরিস্ত্রোইকাকে দেখত সন্দেহের চোখে। এবং অন্য অনেকের আগেই যেন তারা টের পেয়ে গিয়েছিল, পিরিস্ত্রোইকার মধ্য দিয়ে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে।
১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হয়েছে। তারপর পৃথিবীতে আর কোনো সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে, এটা ভাবা যায়নি। সমাজতান্ত্রিক শিবিরভুক্ত পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে আজ আর সমাজতন্ত্রের ছিটেফোঁটাও নেই। সমাজতান্ত্রিক পূর্ব জার্মানি মিশে গেছে পুঁজিতান্ত্রিক পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে। রোমহর্ষক রক্তপাতের মধ্য দিয়ে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে যুগোস্লাভিয়া; সেই চেকোস্লোভাকিয়া, আলবেনিয়াও আর অটুট নেই। পোল্যান্ড এখন এক কট্টর ক্যাথলিক পুঁজিতান্ত্রিক দেশ। সর্বত্রই মুক্তকচ্ছ পুঁজিবাদ। পৃথিবীর অন্য পুঁজিবাদী দেশগুলো থেকে ওই দেশগুলোর আজ আর কোনো পার্থক্য নেই।
তারপর প্রায় দুই দশক হতে চলল; পৃথিবীর সমস্ত দেশ থেকে আলাদা করে চেনার মতো একটি দেশ এখনো রয়ে গেছে: লাতিন আমেরিকার ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র কিউবা। সারা পৃথিবীর একক মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায়, তাদের নিরবচ্ছিন্ন শত্রুতা (ফিদেল কাস্ত্রোর অভিযোগ, সিআইএ তাঁকে হত্যার চেষ্টা করেছে ৬৩৮ বার), অর্থনৈতিক অবরোধ ইত্যাদির মুখে ওই ছোট্ট দরিদ্র দেশটি এখনো চলছে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায়। কিউবা আজ একটা প্রতীকের মতো। সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আত্মমর্যাদা ও সার্বভৌমত্বের সঙ্গে বেঁচে থাকার ও এগিয়ে চলার অনন্য দৃষ্টান্ত কিউবা।
সেই কিউবার সরকার গত সপ্তাহে ঘোষণা করেছে, আগামী বছরের এপ্রিলের মধ্যে পাঁচ লাখ লোককে সরকারি চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হবে। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম এই সংবাদ লুফে নিয়ে বলা শুরু করল: কিউবায় সমাজতন্ত্র শেষ, মুক্তবাজার অর্থনীতি শুরু হয়ে গেছে। এর সপ্তাহখানেক আগে যুক্তরাষ্ট্রের দি আটলান্টিক ম্যাগাজিনে জিওফ্রে গোল্ডবার্গ নামের এক মার্কিন সংবাদিক ফিদেল কাস্ত্রোকে উদ্ধৃত করে লেখেন, কাস্ত্রো তাঁকে বলেছেন, অর্থনীতির ক্ষেত্রে কিউবার মডেলটি আর কাজ করছে না। কাস্ত্রো এর প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, তিনি এটা বোঝাতে চাননি বরং বোঝাতে চেয়েছেন যে আমেরিকান পুঁজিবাদী মডেলই আর কাজ করছে না। পশ্চিমা পণ্ডিতদের একটা বড় অংশ এটা প্রমাণ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন যে কাস্ত্রো আসলে ওই কথাই বলেছেন, কিউবান মডেল আর কাজ করছে না। কেউ কেউ এমন কথাও বলছেন, কথাটা বলে ফেলার পর কাস্ত্রো সেটা অস্বীকার করেছেন হুগো শাভেজের চাপে। কেউ কেউ বলছেন, কিউবান মডেল যে আর কাজ করছে না এমন কথা কাস্ত্রো আগেও বলেছেন। অন্যরা বলছেন, কাস্ত্রো ভ্রাতৃদ্বয় বা কিউবার কমিউনিস্টরা স্বীকার করুক বা না করুক, কিউবার কেন্দ্রীভূত, নিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। ওটা দিয়ে আর চলছে না।
কিউবার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যে সমস্যা রয়েছে, তা সবচেয়ে বেশি করে উপলব্ধি করেন কিউবার নেতারাই। সে জন্য নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত শিবিরের পতনের পর থেকে কিউবান সমাজতন্ত্র নিজেকে নানাভাবে বদলে নেওয়ার চেষ্টা করে এসেছে। ২০০৫ সালে অসুস্থ ফিদেল কাস্ত্রো হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিউবান বিপ্লবকে পরাস্ত করতে পারেনি বটে, কিন্তু কিউবান বিপ্লব নিজেই নিজের দূষণ ও ভুলভ্রান্তির কারণে ব্যর্থ হতে পারে।
২০০৬ সালে ফিদেল কাস্ত্রোর অনুজ রাউল কাস্ত্রো দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নানা রকম সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকাধীন কিছু ছোট শিল্পকারখানা সমবায় সমিতির হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে; কিছু কিছু খাসজমি ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে করে কৃষিকাজে নতুন প্রণোদনা সৃষ্টি হয়। চুল কাটার সেলুন, ট্যাক্সি সার্ভিস ইত্যাদি সেবা খাতেও বেসরকারি উদ্যোগ বাড়ানোর কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। এখন এসব ক্ষেত্রে আরও কিছু সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেমন, আগে সমবায় সমিতিগুলোতে সরকার থেকে প্রশাসক নিয়োগ করা হতো; এখন সরকার বলছে, সরকারি প্রশাসক আর থাকবে না, সমবায় সমিতিগুলো নিজেরাই নিজেদের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করবে। আগে ব্যক্তি-কৃষকের উৎপাদিত ফসল সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে বিক্রি করতে হতো, এখন সরকার বলছে কৃষকেরা বাজারমূল্যে তা বিক্রি করতে পারবে। আরও বেশিসংখ্যক বেসরকারি ট্যাক্সির লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে, আরও বেশিসংখ্যক ছোট দোকানপাট ও ব্যবসায় উদ্যোগ খোলার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট রাউল কাস্ত্রো বলেছেন, কিউবার সরকারি খাতে নিয়োজিত ৫১ লাখ জনবলের মধ্যে ১০ লাখ হচ্ছে অতিরিক্ত। এই অতিরিক্ত জনবলকে ধাপে ধাপে সরকারি খাতের বাইরে নিয়ে আত্মকর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিতে হবে। এই উদ্যোগে তাঁর সঙ্গে আছে কিউবান ওয়ার্কার্স কনফেডারেশন। তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনৈতিক সংস্কারের মডেলটি অনুসরণ করবে না; সোভিয়েত ইউনিয়নে বিরাষ্ট্রীয়করণ শুরু হলে কলকারখানা, খনিসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছিলেন বড় আমলারা। কিউবায় যেসব প্রতিষ্ঠান বিরাষ্ট্রীয়করণ করা হবে, সেগুলোর মালিক হবে সেখানে কর্মরত শ্রমিকেরাই, কো-অপারেটিভ গঠনের মধ্য দিয়ে তাদের যৌথ মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা হবে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে সরকার এখন আর নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করবে না, তদারকি করবে।
লন্ডন মেট্রোপলিটান ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর ক্যারিবিয়ান অ্যান্ড ল্যাটিন আমেরিকান রিসার্চ অ্যান্ড কনসালট্যান্সির গবেষক-বিশ্লেষক স্টিফেন উইলকিনসন বলছেন, কিউবায় ধাপে ধাপে সরকারি কর্মী ছাঁটাইয়ের উদ্যোগ যুক্তরাজ্যের বর্তমান সরকারের বাজেট সংকোচনের ফলে লোকজনের চাকরি হারানোর চেয়ে কম মর্মান্তিক। যুক্তরাজ্যে হাজার হাজার লোক হঠাৎ জীবিকাহীন হয়ে পড়েছে, কেউ তাদের দায়িত্ব নেয়নি। কিন্তু কিউবায় ব্যাপারটা সেভাবে ঘটবে না: আকস্মিকভাবে তো নয়ই, বরং কিউবার সরকার প্রায় চার বছর ধরে এ নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছে, ট্রেড ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা-পরামর্শ করে সরকারি খাতের বাড়তি লোকবল কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে। ৩০ লাখ শ্রমিকের সংগঠন কিউবান ওয়ার্কার্স কনফেডারেশন সে দেশের জাতীয় সংবাদমাধ্যমে এক বিবৃতিতে সরকারের এই উদ্যোগের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। শ্রমিকেরা জানে, সরকারি চাকরি থেকে ছাঁটাই হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা বেকার হয়ে পড়বে এমন নয়। একই ধরনের কাজ তারা চালিয়ে যাবে, কিন্তু তাদের বেতন আর সরকার দেবে না, সমবায় সমিতি গঠন করে ছোট ছোট উৎপাদন ও সেবাক্ষেত্র রাষ্ট্রীয় প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণের বাইরে নেওয়া হবে।
এই সব সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে কিউবার অর্থনীতির স্থবিরতা কাটানোর লক্ষ্যে। রাজনীতির ক্ষেত্রে দেশটি তেমন কোনো পরিবর্তনের কথা আপাতত ভাবছে না। সোভিয়েত পিরিস্ত্রোইকায় যেমন তথাকথিত উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত মনে করা হয়েছিল, কিউবার নেতারা তা মনে করছেন না। তাঁরা বরং এ ক্ষেত্রে চীনা মডেলটি অনুসরণের চেষ্টা করছেন, যেখানে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতৃত্ব থাকবে এককভাবে কমিউনিস্ট পার্টির হাতে। কিউবায় সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চীনা বিনিয়োগ ব্যাপকভাবে বেড়েছে; ভেনেজুয়েলার হুগো শাভেজ, যিনি কিউবান বিপ্লবকে মনে করেন লাতিন আমেরিকার মুক্তিসংগ্রামের জননী, তিনি কিউবাকে জ্বালানি তেল দিচ্ছেন বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে। কিউবা ভেনেজুুয়েলার সঙ্গে একটি অর্থনৈতিক ইউনিয়ন গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে।
সোভিয়েত ইউনিয়নে অধ্যয়নরত লাতিন আমেরিকান ছাত্রছাত্রীদের কথা স্মরণ করে এ লেখা শুরু করেছিলাম। তারা পিরিস্ত্রোইকা সমর্থন করেনি, কারণ গর্বাচভের ওই কর্মসূচিকে সমর্থন জুগিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আমাদের এক বলিভীয় সহপাঠীর কথা মনে পড়ছে; সে একদিন ক্লাসে সোভিয়েত শিক্ষককে বলেছিল, আমেরিকা পিরিস্ত্রোইকা সমর্থন করছে, তার মানে বুঝতে হবে পিরিস্ত্রোইকা আপনাদের ধ্বংস ডেকে আনবে। কিউবায় সূচিত অর্থনৈতিক সংস্কারকে পিরিস্ত্রোইকা বলা যায় কি না জানি না, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু মনে করছে সে রকমই একটা ব্যাপার শুরু হয়েছে তাদের নিকট-প্রতিবেশী দ্বীপ দেশটিতে। সে জন্য ওবামা প্রশাসন কিউবার ব্যাপারে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে। তারা কিউবার জনগণের ‘মুক্তি ও আত্মনিয়ন্ত্রণ’ প্রতিষ্ঠার নতুন কৌশল হিসেবে কিউবার সঙ্গে সাংস্কৃতিক-কূটনৈতিক সম্পর্ক বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। মার্কিন প্রশাসন মনে করছে কিউবান বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিকেরাই তাদের ‘বেস্ট অ্যাম্বাসেডরস ফর ফ্রিডম ইন কিউবা’।
গত বছর ওবামা প্রশাসন কিউবায় মার্কিনিদের ভ্রমণের ওপর থেকে বিধিনিষেধ তুলে নিয়েছে, কিউবান বংশোদ্ভূত আমেরিকানদের কিউবায় টাকা পাঠানোরও অনুমতি দিয়েছে। ফলে তিন লাখ কিউবান আমেরিকান এর মধ্যে কিউবা ভ্রমণ করেছে, ছয় কোটির বেশি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স আকারে পৌঁছেছে কিউবায়। কিন্তু আমার লাতিন বন্ধুদের মতো পুরো লাতিন আমেরিকার মানুষ সম্ভবত মনে করে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের ‘মুক্তি ও আত্মনিয়ন্ত্রণ’-এর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়, এটা অবিশ্বাস্য। আমেরিকার যেকোনো ধরনের হস্তক্ষেপকেই তারা সন্দেহের চোখে দেখে। বলিভিয়া থেকে ইকুয়েডর পর্যন্ত সমগ্র লাতিন আমেরিকান জনগণের কাছে কিউবা মার্কিন আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে নিরন্তর প্রতিরোধের এক মূর্ত প্রতীক।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.