বিদ্যুতের বর্তমান উৎপাদন দিয়েও ভালো থাকা সম্ভব by আবু তাহের খান
বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের সময় দেশে বিদ্যুতের স্থাপিত উৎপাদন ক্ষমতা ছিল পাঁচ হাজার ২৬২ মেগাওয়াট এবং এর বিপরীতে সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল চার হাজার ১৩০ মেগাওয়াট। গত তিন বছরের ব্যবধানে বর্তমানে সে উৎপাদন ক্ষমতা উন্নীত হয়েছে ছয় হাজার ৬৫৮ মেগাওয়াটে এবং এর বিপরীতে সর্বোচ্চ উৎপাদন এখন চার হাজার ৬৯৯ মেগাওয়াট (তথ্যসূত্র : বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১২)।
কিন্তু এর পরও যে মানুষ বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ে অহরহ খাবি খাচ্ছে, তার মূল কারণ অবশ্যই চাহিদার দ্রুত ক্রমবর্ধমানতা এবং এটা খুবই স্বাভাবিক, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিসর বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিদ্যুতের চাহিদাও বাড়বে। আর সে ক্ষেত্রে বিদ্যুতের উৎপাদনকে চাহিদার সমপর্যায়ে নিয়ে যেতে পারাটাই সমস্যার সর্বোত্তম সমাধান। কিন্তু তাই বলে সে পর্যায়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এ ক্ষেত্রে মানুষের কষ্ট ও ভোগান্তির কিছুটা হলেও লাঘব বা উপশম হওয়ার কি কোনোই উপায় নেই? আমার ধারণা, সেটা সম্ভব এবং কিভাবে তা সম্ভব, তা নিয়েই এ ছোট্ট পরিসরের আয়োজন।
আলোচনার শুরুতেই বলে নেওয়া ভালো যে, বিদ্যুৎ খাতে প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাঠামোগত সংস্কারের নামে ৪০ বছরের বিভিন্ন সময়ে এত বেশি গিনিপিগ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে যে বাংলাদেশের অন্য কোনো খাতে এরূপ দ্বিতীয় কোনো উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। আর সে গিনিপিগ পরীক্ষার জন্য মূলত দায়ী হচ্ছে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ ও অবাঞ্ছিত খবরদারি। হলফ করে বলা যায়, বিশ্বব্যাংকের অবাঞ্ছিত খবরদারি ও হস্তক্ষেপের বাইরে থেকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারলে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের পরিস্থিতি আরো বহু আগেই এর চেয়ে অনেক বেশি ভালো থাকতে পারত।
বিদ্যুতের বিতরণ ব্যবস্থায় বর্তমানে যেসব ত্রুটি রয়েছে, সেগুলোর অন্যতম হচ্ছে ব্যাপক হারে অবৈধ সংযোগ বহাল থাকা, লোডশেডিংয়ের ক্ষেত্রে সময় ও এলাকা নির্বাচনে বৈষম্য ও পরিকল্পনাহীনতা, বিল কারচুপি ইত্যাদি। এগুলোর ব্যাপারে এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বহু আলাপ-আলোচনা ও সুপারিশ তৈরি হলেও আজ পর্যন্ত এসবের কোনোটিই বন্ধ হয়নি। বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় এসব ক্ষেত্রে হঠাৎ করে বড় ধরনের কোনো অগ্রগতি হবে বলেও আশা করা যায় না। তবে বিদ্যুতের যথাযথ ব্যবহার ও ভোক্তার এ-সংক্রান্ত আচরণকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ ও পরিধারণ করতে পারলে বর্তমান উৎপাদন দিয়েও আরো বেশি মানুষকে আরো অধিক সময় ধরে বিদ্যুৎ-সুবিধা দেওয়া সম্ভব বলে মনে করি। দু-একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোয় রাত ৮টার পর দোকানপাট বন্ধ থাকার কথা। কিন্তু এটা এখন সবার চোখের সামনে নিত্যদিনের ঘটনা যে এসব শহরের বহু দোকানপাট উলি্লখিত সময়ের পরও খোলা থাকে। আর এসব দোকানপাটে যত সংখ্যক বাতি ব্যবহার করলে চলে, বাস্তবে ব্যবহার করা হয় তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি ঘটা করে করা হয় এ জন্য যে, তাদের তেমন কোনো বাড়তি বিল পরিশোধ করতে হয় না। আর এ বাড়তি বিল যাতে পরিশোধ করতে না হয়, তা অতি দক্ষতার সঙ্গে নিশ্চিত করে বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট 'নিষ্ঠাবান' কর্মীবাহিনী। এ ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীবাহিনীকে নিরস্ত করে যথাযথ বিল আদায়ের বিষয়টি নিশ্চিত করা গেলে বিদ্যুতের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার বা অপচয় অনেকখানিই কমে আসত বলে ধারণা করা চলে। তদুপরি অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করেও এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিদ্যুৎ যে সাশ্রয় করা সম্ভব, তা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায় এবং তা বোঝার জন্য মোটেও বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের জন্য সময় ও এলাকা নির্বাচনের ক্ষেত্রে বর্তমানে ব্যাপক মাত্রার ত্রুটি ও বৈষম্য রয়েছে; এবং সে বৈষম্য শহর ও গ্রামের মধ্যে যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে শহরের মধ্যকার তথাকথিত অভিজাত ও অনভিজাত এলাকার মধ্যেও। দেশের বেশির ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে এবং তাদের অধিকাংশই আবার উৎপাদনের (কৃষি উৎপাদন) সঙ্গে জড়িত। কিন্তু বিদ্যুতের সিংহভাগ লোডশেডিংই হয় গ্রামাঞ্চলে। অন্যদিকে রাজধানীসহ বড় শহরগুলোর ধনী অভিজাত এলাকায় লোডশেডিং হয় খুবই সামান্য বা তুলনামূলক অনেক কম। অথচ ওইসব এলাকার অধিকাংশ বাড়িঘরেই নিজস্ব জেনারেটর বা নিদেনপক্ষে আইপিএস রয়েছে। ফলে ওইসব এলাকায় লোডশেডিং হলেও তেমন বড় ধরনের কোনো অসুবিধা নেই। কারণ বিকল্প ব্যবস্থায় নিজেদের আলোকিত রাখার সামর্থ্য তাদের রয়েছে। আর ওইসব এলাকায় জনবসতিও অনেক কম। অন্যদিকে রাজধানী ও বড় শহরগুলোর যেসব এলাকায় ঘন ঘন লোডশেডিং হয়, সেসব এলাকায় তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি লোকের বসবাস এবং তাদের অধিকাংশেরই বিকল্প পন্থায় বিদ্যুৎ সংগ্রহের ব্যবস্থা বা সামর্থ্য নেই।
তাহলে বিষয়টি দাঁড়াচ্ছে এই যে দেশের অধিকাংশ মানুষ ও বেশির ভাগ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ক্ষতিগ্রস্ত করে উৎপাদিত বিদ্যুতের সিংহভাগ চলে যাচ্ছে বিত্তবান মানুষের ঘরে, যাদের প্রায় প্রত্যেকেরই বিকল্প পন্থায় বিদ্যুৎ সংগ্রহের সামর্থ্য রয়েছে। আর যাদের বিকল্প পন্থায় বিদ্যুৎ সংগ্রহের সামর্থ্য নেই এবং যেসব এলাকায় বিদ্যুতের সরবরাহ বন্ধ থাকলে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ অধিক হারে বেড়ে যায়, বিদ্যুতের সর্বাধিক লোডশেডিং বেশি হচ্ছে সেসব এলাকাতেই। এ বৈষম্য ও যুক্তিহীন বিতরণ ও ব্যবহার ব্যবস্থাপনা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে শুধু বছর বছর বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে শিগগিরই এর সুফল পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। অন্যদিকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাও এতে দারুণভাবে বাধাগ্রস্ত হবে ও ক্ষতির মুখে পড়বে।
গত তিন বছরে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। তবে তা দ্রুততর করতে গিয়ে বিদ্যুতের মূল্যও হয়তো বেশ ঘন ঘন বাড়াতে হয়েছে, যা নিয়ে সরকারকে প্রতিনিয়তই নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। কিন্তু এতটা উৎপাদন বাড়া সত্ত্বেও বিদ্যুৎ নিয়ে মানুষের অসন্তুষ্টি এত বেশি কেন? সে কি শুধু ক্রমবর্ধমান চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম বলে, নাকি এর জন্য বিদ্যুতের বিতরণ ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিদ্যমান ত্রুটিগুলোর ভূমিকাও রয়েছে? অভিজ্ঞ মহলের অভিমত এই যে শেষোক্ত কারণটিই উলি্লখিত অসন্তুষ্টির জন্য অধিক দায়ী।
বস্তুত বিদ্যুতের বিতরণ, যথাযথ ব্যবহার ও ভোক্তার আচরণ সঠিকভাবে পরিধারণ করা গেলে এবং ওই পরিধারণ প্রক্রিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও ফলাফলের ভিত্তিতে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া গেলে বিদ্যুতের বর্তমান উৎপাদন দিয়েই এর চেয়ে অনেক বেশি ভালো থাকা সম্ভব। আর সে ভালো থাকার জন্য উলি্লখিত পরিধারণ ব্যবস্থাকে জোরদার করার পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈষম্যগুলোও দূর করতে হবে। সংবিধানের ১৯(১) নং অনুচ্ছেদে স্পষ্টতই বলা আছে, 'সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন।' আর সতর্কতা অবলম্বনের জন্য এ কথা বলে শেষ করছি যে বিদ্যুৎ বিতরণের সিদ্ধান্তগুলো যতটা বিশ্বব্যাংকের মতো দাতাদের হস্তক্ষেপ ও খবরদারির বাইরে থেকে নেওয়া যাবে, এ খাতের উন্নয়ন ততটাই ত্বরান্বিত হবে।
লেখক : পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন
atkhan56@gmail.com
আলোচনার শুরুতেই বলে নেওয়া ভালো যে, বিদ্যুৎ খাতে প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাঠামোগত সংস্কারের নামে ৪০ বছরের বিভিন্ন সময়ে এত বেশি গিনিপিগ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে যে বাংলাদেশের অন্য কোনো খাতে এরূপ দ্বিতীয় কোনো উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। আর সে গিনিপিগ পরীক্ষার জন্য মূলত দায়ী হচ্ছে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ ও অবাঞ্ছিত খবরদারি। হলফ করে বলা যায়, বিশ্বব্যাংকের অবাঞ্ছিত খবরদারি ও হস্তক্ষেপের বাইরে থেকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারলে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের পরিস্থিতি আরো বহু আগেই এর চেয়ে অনেক বেশি ভালো থাকতে পারত।
বিদ্যুতের বিতরণ ব্যবস্থায় বর্তমানে যেসব ত্রুটি রয়েছে, সেগুলোর অন্যতম হচ্ছে ব্যাপক হারে অবৈধ সংযোগ বহাল থাকা, লোডশেডিংয়ের ক্ষেত্রে সময় ও এলাকা নির্বাচনে বৈষম্য ও পরিকল্পনাহীনতা, বিল কারচুপি ইত্যাদি। এগুলোর ব্যাপারে এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বহু আলাপ-আলোচনা ও সুপারিশ তৈরি হলেও আজ পর্যন্ত এসবের কোনোটিই বন্ধ হয়নি। বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় এসব ক্ষেত্রে হঠাৎ করে বড় ধরনের কোনো অগ্রগতি হবে বলেও আশা করা যায় না। তবে বিদ্যুতের যথাযথ ব্যবহার ও ভোক্তার এ-সংক্রান্ত আচরণকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ ও পরিধারণ করতে পারলে বর্তমান উৎপাদন দিয়েও আরো বেশি মানুষকে আরো অধিক সময় ধরে বিদ্যুৎ-সুবিধা দেওয়া সম্ভব বলে মনে করি। দু-একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোয় রাত ৮টার পর দোকানপাট বন্ধ থাকার কথা। কিন্তু এটা এখন সবার চোখের সামনে নিত্যদিনের ঘটনা যে এসব শহরের বহু দোকানপাট উলি্লখিত সময়ের পরও খোলা থাকে। আর এসব দোকানপাটে যত সংখ্যক বাতি ব্যবহার করলে চলে, বাস্তবে ব্যবহার করা হয় তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি ঘটা করে করা হয় এ জন্য যে, তাদের তেমন কোনো বাড়তি বিল পরিশোধ করতে হয় না। আর এ বাড়তি বিল যাতে পরিশোধ করতে না হয়, তা অতি দক্ষতার সঙ্গে নিশ্চিত করে বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট 'নিষ্ঠাবান' কর্মীবাহিনী। এ ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীবাহিনীকে নিরস্ত করে যথাযথ বিল আদায়ের বিষয়টি নিশ্চিত করা গেলে বিদ্যুতের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার বা অপচয় অনেকখানিই কমে আসত বলে ধারণা করা চলে। তদুপরি অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করেও এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিদ্যুৎ যে সাশ্রয় করা সম্ভব, তা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায় এবং তা বোঝার জন্য মোটেও বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের জন্য সময় ও এলাকা নির্বাচনের ক্ষেত্রে বর্তমানে ব্যাপক মাত্রার ত্রুটি ও বৈষম্য রয়েছে; এবং সে বৈষম্য শহর ও গ্রামের মধ্যে যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে শহরের মধ্যকার তথাকথিত অভিজাত ও অনভিজাত এলাকার মধ্যেও। দেশের বেশির ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে এবং তাদের অধিকাংশই আবার উৎপাদনের (কৃষি উৎপাদন) সঙ্গে জড়িত। কিন্তু বিদ্যুতের সিংহভাগ লোডশেডিংই হয় গ্রামাঞ্চলে। অন্যদিকে রাজধানীসহ বড় শহরগুলোর ধনী অভিজাত এলাকায় লোডশেডিং হয় খুবই সামান্য বা তুলনামূলক অনেক কম। অথচ ওইসব এলাকার অধিকাংশ বাড়িঘরেই নিজস্ব জেনারেটর বা নিদেনপক্ষে আইপিএস রয়েছে। ফলে ওইসব এলাকায় লোডশেডিং হলেও তেমন বড় ধরনের কোনো অসুবিধা নেই। কারণ বিকল্প ব্যবস্থায় নিজেদের আলোকিত রাখার সামর্থ্য তাদের রয়েছে। আর ওইসব এলাকায় জনবসতিও অনেক কম। অন্যদিকে রাজধানী ও বড় শহরগুলোর যেসব এলাকায় ঘন ঘন লোডশেডিং হয়, সেসব এলাকায় তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি লোকের বসবাস এবং তাদের অধিকাংশেরই বিকল্প পন্থায় বিদ্যুৎ সংগ্রহের ব্যবস্থা বা সামর্থ্য নেই।
তাহলে বিষয়টি দাঁড়াচ্ছে এই যে দেশের অধিকাংশ মানুষ ও বেশির ভাগ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ক্ষতিগ্রস্ত করে উৎপাদিত বিদ্যুতের সিংহভাগ চলে যাচ্ছে বিত্তবান মানুষের ঘরে, যাদের প্রায় প্রত্যেকেরই বিকল্প পন্থায় বিদ্যুৎ সংগ্রহের সামর্থ্য রয়েছে। আর যাদের বিকল্প পন্থায় বিদ্যুৎ সংগ্রহের সামর্থ্য নেই এবং যেসব এলাকায় বিদ্যুতের সরবরাহ বন্ধ থাকলে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ অধিক হারে বেড়ে যায়, বিদ্যুতের সর্বাধিক লোডশেডিং বেশি হচ্ছে সেসব এলাকাতেই। এ বৈষম্য ও যুক্তিহীন বিতরণ ও ব্যবহার ব্যবস্থাপনা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে শুধু বছর বছর বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে শিগগিরই এর সুফল পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। অন্যদিকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাও এতে দারুণভাবে বাধাগ্রস্ত হবে ও ক্ষতির মুখে পড়বে।
গত তিন বছরে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। তবে তা দ্রুততর করতে গিয়ে বিদ্যুতের মূল্যও হয়তো বেশ ঘন ঘন বাড়াতে হয়েছে, যা নিয়ে সরকারকে প্রতিনিয়তই নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। কিন্তু এতটা উৎপাদন বাড়া সত্ত্বেও বিদ্যুৎ নিয়ে মানুষের অসন্তুষ্টি এত বেশি কেন? সে কি শুধু ক্রমবর্ধমান চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম বলে, নাকি এর জন্য বিদ্যুতের বিতরণ ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিদ্যমান ত্রুটিগুলোর ভূমিকাও রয়েছে? অভিজ্ঞ মহলের অভিমত এই যে শেষোক্ত কারণটিই উলি্লখিত অসন্তুষ্টির জন্য অধিক দায়ী।
বস্তুত বিদ্যুতের বিতরণ, যথাযথ ব্যবহার ও ভোক্তার আচরণ সঠিকভাবে পরিধারণ করা গেলে এবং ওই পরিধারণ প্রক্রিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও ফলাফলের ভিত্তিতে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া গেলে বিদ্যুতের বর্তমান উৎপাদন দিয়েই এর চেয়ে অনেক বেশি ভালো থাকা সম্ভব। আর সে ভালো থাকার জন্য উলি্লখিত পরিধারণ ব্যবস্থাকে জোরদার করার পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈষম্যগুলোও দূর করতে হবে। সংবিধানের ১৯(১) নং অনুচ্ছেদে স্পষ্টতই বলা আছে, 'সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন।' আর সতর্কতা অবলম্বনের জন্য এ কথা বলে শেষ করছি যে বিদ্যুৎ বিতরণের সিদ্ধান্তগুলো যতটা বিশ্বব্যাংকের মতো দাতাদের হস্তক্ষেপ ও খবরদারির বাইরে থেকে নেওয়া যাবে, এ খাতের উন্নয়ন ততটাই ত্বরান্বিত হবে।
লেখক : পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন
atkhan56@gmail.com
No comments