ভারত-সশস্ত্র বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা ও কাশ্মীর by কুলদীপ নায়ার

প্রণয়নের প্রথম দিন থেকেই সশস্ত্র বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইনটি (এএফএসপিএ) প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আসছে। নাগরিক অধিকার সংগঠনগুলো ছাড়াও আরও অনেকেই মনে করেন, বিক্ষুব্ধ এলাকায় মোতায়েন সেনাবাহিনীর হাতে এত ক্ষমতা দেওয়া খুবই কর্তৃত্ববাদী ও বিপর্যয়কর কাজ।


এই আইনে অন্য অনেক কিছুর মধ্যে সেনাবাহিনীকে অশান্ত এলাকায় কেবল সন্দেহের বশে কাউকে হত্যা করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে তাদের কোনো ব্যাখ্যা দিতে হবে না এবং ধরে নেওয়া হবে, জরুরি পরিস্থিতিতেই সেটা করা হয়েছে। এই ক্ষমতা রদ করার সরকারি প্রস্তাব আসায় বিতর্কটি আবার নতুন করে উঠেছে। প্রস্তাবটি বাস্তবায়িত হলে বোঝা যাবে যে সরকারই সিদ্ধান্তের মালিক।
নির্বাচিত সরকারকে সংসদে জবাবদিহি করতে হয়। গণতান্ত্রিক কাঠামোয় সেনাবাহিনী সরকারের অধীনস্থ এবং সরকারি সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলার অধিকার তাদের থাকে না। কিন্তু আমি অবাক হয়ে গেলাম, যখন দেখলাম, সেনাপ্রধান ভি এন সিং বললেন, আইনটি ছাড়া সেনাবাহিনী কাজ করতে পারবে না। এমনকি অবসরপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান মালিকও জানালেন, সেনাবাহিনীকে দিয়ে কাজ করাতে চাইলে তাদের বিশেষ ক্ষমতার বিধানও রাখতে হবে।
এখন সরকারের তরফে এএফএসপিএ বাতিল করা বা সংস্কার যা-ই করার চিন্তা থাক না কেন, সেটা একান্তই তাদের বিষয়। কিন্তু তারা যখন পরিস্থিতির চাহিদা আমলে না নিয়ে সেনাকর্মকর্তাদের কথা শোনে, তখন বুঝতে হয় সরকারি সিদ্ধান্তের মালিক সরকার নিজে নয়। গণতন্ত্রে জনগণই সর্বময় ক্ষমতার মালিক; এর মানে এই নয় যে তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সেনাবাহিনী ও অন্যান্য বাহিনীর দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে থাকবেন।
এ ধরনের আপস থেকেই অনেক দেশে এমন সেনাশাসন বা সেনা-আধিপত্য কায়েম হয়েছে যে তারা এখন আর গণতন্ত্রের মুক্ত স্রোতে সাঁতরে যেতে পারছে না। নয়াদিল্লি কীভাবে এমন আচরণ করছে?
আমার ধারণা, মন্ত্রিসভা জন্মু ও কাশ্মীরের কিছু এলাকা থেকে এএফএসপিএ উঠিয়ে নেওয়া প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। একদল বলছে, এটা করলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যাবে। শেষে বিষয়টি আরও নিবিড়ভাবে খতিয়ে দেখার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং এ ব্যাপারে সর্বদলীয় বৈঠকও হয়েছে। আমাকে সবচেয়ে যা বিস্মিত করে, এসব প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী কেউই বলছে না যে, উত্তর-পূর্ব ভারতে ৫০ বছর ধরে এবং কাশ্মীরে ১০ বছর ধরে এই আইন বহাল রাখার কোনো কার্যকারিতা রয়েছে।
দৃশ্যত সেনাবাহিনী তার বিশেষ ক্ষমতা হারাতে চায় না এবং সরকারও তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতে চায় না। তাদের কাছে বিষয় হলো, স্থানীয় পরিস্থিতি বিবেচনা করে কোন এলাকায় কত দিনের জন্য এই বিশেষ ক্ষমতার চর্চা করা হবে, তা ঠিক করা। তাহলেও, সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে বাস্তবতার নিরিখে, সেনাবাহিনীর আপত্তির ভয়ে নয়।
তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হলো, সেখানে এই আইন আদৌ থাকা উচিত কি না। আইনটির কার্যকারিতা তামাদি হয়ে গেছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে সরকার বিচারপতি জেওয়ান রেড্ডির নেতৃত্বে একটি কমিটি করে দিয়েছিল। কমিটি পাঁচ বছর আগে সর্বসম্মতভাবে সুপারিশ করে যে আইনটি বিলুপ্ত করে দেওয়া উচিত। কিন্তু সশস্ত্র বাহিনীগুলো তাদের এই নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ছাড়তে রাজি না হওয়ায় আইনটি বহালই রয়েছে। সরকার তার নিযুক্ত কমিটির কথা না শুনে সেনাবাহিনীর কথাই রেখেছে।
এ থেকে দুটো প্রশ্ন উঠে আসে। প্রথমত, এ ধরনের আইনের আদৌ প্রয়োজন রয়েছে কি না এবং দ্বিতীয়ত, বিক্ষুব্ধ এলাকায় সেনাবাহিনীর হাতে এমন কঠোর ক্ষমতা দেওয়া উচিত কি না? সবচেয়ে ভালো হয় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামলাতে সশস্ত্র বাহিনীগুলোকে না ডাকা। কেননা, তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় সীমান্ত রক্ষার জন্য, তাই যে কাজ তারা ভালো পারে, সেই কাজেই তাদের সীমাবদ্ধ থাকা উচিত।
তার পরও, দেশের ভেতরের বিদ্রোহের পরিস্থিতি যদি সেনা মোতায়েনের প্রয়োজন তুলে ধরে, তাহলেও সরকারকে কী কী করতে হবে, সেটা তারা ঠিক করে দিতে পারে না। বিষয়টা দাঁড়াল এমন, দীর্ঘ সময় ধরে সেনাবাহিনী যে ক্ষমতা ভোগ করে আসছে, তা বজায় রাখতে হলে এএফএসপিএকে চিরস্থায়ী করতে হবে। এটা মহা বিপজ্জনক। এই আইন ছাড়া অশান্ত এলাকায় সেনারা লড়াই করতে পারবে না, সেনাবাহিনীর এমন মনোভাব বোধগম্য নয়। এটা নির্বাচিত সরকারকে হুকুম করার শামিল।
সমস্যা হলো, ছয় বছর বৈরী পরিস্থিতির মধ্যে থেকে বিজেপির আচরণও দায়িত্বহীন হয়ে পড়েছে। এমনকি সর্বদলীয় বৈঠকের আগে এল কে আদভানি বলেছিলেন, কালো আইনটি না থাকলে দেশের প্রতিরক্ষা দুর্বল হয়ে পড়বে। একই নিঃশ্বাসে তিনি সেনাসদস্যদের আত্মত্যাগের প্রশংসা করেন। ভারত যখন অনেক সমস্যায় কাহিল, তখন এ ধরনের কথাবার্তা সরকারের করণীয়কে সীমিত করে আনে। সেনাবাহিনীর ওপর বিজেপির কোনো বিশেষ অধিকার থাকতে পারে না। তাদের বিতর্কের মধ্যে টেনে আনায় না বিজেপি, না ভারতের কোনো লাভ আছে। দলটিকে বুঝতে হবে, এ ধরনের স্পর্শকাতর বিষয়ে সেনাবাহিনীকে জড়িত করার পরিণতি অনাকাঙ্ক্ষিত হতে পারে। ক্ষমতায় আসা যেকোনো রাজনৈতিক দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তাদের মনে রাখতে হবে, সেটা করতে গিয়ে তারা যাতে গণতান্ত্রিক কাঠামোর ক্ষতি না করে বা এমন পদ্ধতিকে প্রশ্রয় না দেয়, যার জন্য দেশকে একদিন ভুগতে হয়।
বেশি দিন আগের কথা নয়, গণ-অসন্তোষ দমনের জন্য সশস্ত্র বাহিনীর ভেতর থেকে রাষ্ট্রীয় রাইফেল নামে একটি সংস্থা গঠন করা হয়। তাদের দেওয়া হয় ভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ। এ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ব্যর্থ হলে অন্য বিকল্পে যাওয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু এএফএসপিএকে চিরস্থায়ী করা কোনো সমাধান নয়।
কাশ্মীর বা উত্তর-পূর্ব ভারতে যা ঘটছে, তা আমাদের সমাজকে আরও সহিংস করে তুলতে পারে। এতে গণতন্ত্র তার শক্তি হারিয়ে ফেলবে। শাসকেরা তখন হয়তো আতঙ্কিত অবস্থায় শাসন করবে এবং খাকি পোশাকধারীদের হাতে তুলে দেবে বিশেষ ক্ষমতা। কিন্তু আইন ন্যায্য ও বিধিবদ্ধ শাসনের জন্য। যাঁরা সন্দেহের বশে নির্যাতন ও হত্যাকে বৈধতা দেন, গণতান্ত্রিক সমাজে তাঁদের ঠাঁই হতে পারে না, এমনকি অল্প দিনের জন্য হলেও।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
কুলদীপ নায়ার: ভারতের প্রবীণ সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.