রিও সম্মেলন-টেকসই উন্নয়নের পথে আরেক ধাপ by কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ
জাতীয় বাজেট থেকে বরাদ্দ দিয়ে আমরা যেভাবে বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছি, তা অনেক দেশের কাছেই উদাহরণ। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক বৈশ্বিক সমঝোতা প্রক্রিয়ায়ও বাংলাদেশ যথেষ্ট তৎপর। বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষকে কেন্দ্রে রেখে আমরা টেকসই উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
রিও সম্মেলনের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তা নতুন মাত্রা পাবে বলে আশা করা যায়। এটা সত্য, উন্নয়ন নিজেদের তাগিদেই করতে হয়। কিন্তু আমাদের মতো দেশের পক্ষে সেটা একা করা কঠিন। এ ধরনের বৈশ্বিক সম্মেলনের মধ্য দিয়ে যৌথতা প্রতিষ্ঠিত হয়
চলতি মাসের ২০-২২ তারিখে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে টেকসই উন্নয়ন বিষয়ে জাতিসংঘ শীর্ষ সম্মেলন (ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট)। তবে বিশেষজ্ঞ মহলে জনপ্রিয়তা পেয়েছে 'রিও প্লাস ২০' কথাটি। কারণ এখন থেকে ঠিক ২০ বছর আগে এই রিওতেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল ধরিত্রী সম্মেলন। শতাধিক সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধানসহ বিশ্বের সব দেশের প্রতিনিধি সেখানে একত্র হয়েছিলেন যে কীভাবে ধরিত্রীকে সংকটে না ফেলেই উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি অক্ষুণ্ন রাখা যায়। এ লক্ষ্যে সেখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল প্রণীত এবং স্বাক্ষরের জন্য উন্মুক্ত হয়। এর প্রধান তিনটি হচ্ছে কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি (সিবিডি), ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (ইউএনএফসিসিসি) এবং এজেন্ডা টোয়েন্টি ওয়ান। এগুলোর মাধ্যমে যথাক্রমে জীববৈচিত্র্য তথা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবেলা এবং টেকসই উন্নয়নের কর্মপরিকল্পনা নির্ধারিত হয়েছিল। রিও সম্মেলনে গৃহীত বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও কর্মপরিকল্পনা অগ্রগতি পর্যালোচনায় পরবর্তী পাঁচ ও দশ বছরে রিও প্লাস ফাইভ, রিও প্লাস টেন প্রভৃতি সম্মেলন হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, বিশ্বের সব দেশের প্রতিনিধি আবারও রিওতে একত্র হবেন এবং টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে গত ২০ বছরের চিত্র পর্যালোচনা এবং পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবেন।
বলাবাহুল্য, এই সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকেও প্রতিনিধি দল অংশ নিচ্ছে। টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি ও অবস্থান জানাতে ইতিমধ্যে 'বাংলাদেশ ন্যাশনাল রিপোর্ট অন সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট' প্রণীত হয়েছে। গত কয়েক মাস ধরে আমরা এ নিয়ে কাজ করেছি। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, টেকসই উন্নয়নের তিনটি স্তম্ভেই_ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত দিক থেকে বেশ অগ্রগতি সাধন করতে সক্ষম হয়েছে।
অর্থনীতির কথা যদি বলি, প্রথম রিও সম্মেলন যখন অনুষ্ঠিত হয়, সেই নব্বই দশকেও আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির বার্ষিক হার ছিল চার থেকে সাড়ে চার শতাংশ। এমনকি একুশ শতকের গোড়ার দিকেও আমরা পাঁচ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পার করতে পারিনি। গত তিন বছর ধরে আমরা ছয় থেকে সাড়ে ছয় শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলছি। ২০১০-১১ অর্থবছরে এই হার ছিল ৬.৭ শতাংশ। মনে রাখতে হবে, আমরা এই প্রবৃদ্ধি এমন সময় অর্জন করছি, যখন ২০০৮ সালে বিশ্বজুড়ে সূচিত অর্থনৈতিক মন্দা চলছিল। আর ইউরো জোনের অর্থনৈতিক সংকট এখন প্রকট হয়েছে।
বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ও এখন ৮৪৮ ডলারে দাঁড়িয়েছে। কয়েক বছর আগেও এতটা আয় প্রত্যাশা করা যায়নি। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আশা করতে পারি, এই দশকের মধ্যেই আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে পারব। অবশ্য কেবল মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়াই বড় কথা নয়। আমরা আসলে জীবনযাপনের দিক থেকে মধ্যম মানের একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়তে চাই।
রিও প্লাস টোয়েন্টি সম্মেলন প্রক্রিয়ায় সবুজ অর্থনীতি একটি বড় বিষয়। এই লক্ষ্যে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ রয়েছে। আমাদের মতো দেশের জন্য সে ক্ষেত্রে উদ্বেগও থাকবে। অর্থনীতি সবুজ করতে গিয়ে এর প্রভাব কি প্রবৃদ্ধিতে পড়বে কি-না, ভাববার বিষয়। দারিদ্র্য নিরসন কার্যক্রমেও ব্যাঘাত ঘটবে কি-না আমাদের চিন্তা-ভাবনা করে দেখতে হবে। অর্থনীতি সবুজ করতেও কিন্তু অর্থ ও প্রযুক্তি প্রয়োজন হয়। তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের জন্য সেই অর্থ নিজে নিজে জোগান দেওয়া সহজ নয়। অর্থনীতির সবুজায়ন যদি বৈশ্বিক বাণিজ্যের শর্ত হয়ে দাঁড়ায়, তা হলে আমাদের বাণিজ্য সম্ভাবনা ব্যাহত হবে। সবুজায়নের সিদ্ধান্তই-বা কে নেবে? আরও দশটা বিষয়ের মতো উন্নত বিশ্ব সিদ্ধান্ত দেবে আর আমরা খালি পালন করে যাব? সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নিজেদেরই মূল ভূমিকা পালন করতে হবে। উন্নত বিশ্ব অর্থ ও প্রযুক্তি দিয়ে সহায়তা করতে পারে কেবল।
টেকসই উন্নয়নের দ্বিতীয় স্তম্ভ বা সামাজিক দিকটি বিবেচনা করতে হলে অর্থনৈতিক বণ্টন সুষম হচ্ছে কি-না, সেটা জানাও জরুরি। অনুমান করা কঠিন নয় যে, গত ২০ বছরে সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যানও সেটা সমর্থন করে। তবে চলতি অর্থবছরে দেখা যাচ্ছে যে, অর্থনৈতিক বৈষম্য আগের হারে বাড়েনি; বরং স্থিতিশীল হয়েছে। কিন্তু সে জন্য খুব খুশি হওয়ার অবকাশ নেই। কারণ ইতিমধ্যেই এই বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। টেকসই উন্নয়ন চাইলে এই বৈষম্য কমাতেই হবে।
সামগ্রিকভাবে সামাজিক ক্ষেত্রে আমরা বেশ ভালো করেছি। ইতিমধ্যেই সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যের বেশ কয়েকটি সামাজিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে। শিশুমৃত্যুর হার কমানোর ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য ২০১০ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘ পুরস্কারও পেয়েছে। সামাজিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে আমরা যে ভারতসহ বিভিন্ন সার্ক দেশের তুলনায় এগিয়ে আছি, সেটাও বিভিন্ন সময়ে বৈশ্বিক বিভিন্ন সূচকে প্রমাণ হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা এবং সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে উৎসাহব্যঞ্জক উদাহরণ।
দারিদ্র্য বিমোচনে গত ২০ বছরে বাংলাদেশের সাফল্য উল্লেখযোগ্য। নব্বই দশকের গোড়ার দিকে এই অনুপাত ছিল ৬০ শতাংশের কাছাকাছি। ২০০৫ সালে সেটা ৪০ শতাংশে নেমে আসে। ২০১০ সালের হিসেবে দেখা যাচ্ছে দারিদ্র্যের অনুপাত ৩১.৫ শতাংশ। সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে ২০১৫ সালের মধ্যে এই হার ২৯ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। আমি মনে করি, বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে নির্ধারিত সময়ের আগেই ওই লক্ষ্য পূরণ হবে। দারিদ্র্য নিরসনে জনসংখ্যা বৃদ্ধি একটি বড় বাধা। ২০১১ সালের আদমশুমারিতে দেখা যাচ্ছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩২ শতাংশে নেমে এসেছে। এটা আরও কমাতে হবে।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে যে অগ্রগতির কথা আমরা ভেবে থাকি, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা না গেলে তা অর্জন ও ধরে রাখা কঠিন। যে কারণে টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে পরিবেশগত বিবেচনা হচ্ছে তৃতীয় স্তম্ভ। ২০ বছর আগে সেখানে ইউএনএফসিসিসি প্রণীত হয় এবং তার ভিত্তিতে গত ২০ বছরে অনেক আলাপ-আলোচনা, পরিকল্পনা ও কাজ হয়েছে। ১৯৯২ সালের ধরিত্রী সম্মেলনে যদিও কেউ কেউ সন্দেহগ্রস্ত ছিলেন, এখন সবাই মানেন যে জলবায়ু পরিবর্তন ইতিমধ্যেই ঘটছে এবং এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া মোকাবেলা করা না গেলে কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না।
জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিভিন্ন বিবেচনায় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। একই সঙ্গে এই দুর্যোগ মোকাবেলায় আমাদের নীতি ও কাঠামোগত প্রস্তুতিও খুবই ভালো। আমরা ইতিমধ্যে নাপা (ন্যাশনাল এডাপ্টেশন প্লান অব অ্যাকশন) এবং পরে, ২০০৯ সালের জুলাইতে বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্লান (বিসিসিএসএপি) প্রণয়ন করেছি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ আমাদের অনুসরণ করছে। জাতীয় বাজেট থেকে বরাদ্দ দিয়ে আমরা যেভাবে বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছি, তা অনেক দেশের কাছেই উদাহরণ। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক বৈশ্বিক সমঝোতা প্রক্রিয়ায়ও বাংলাদেশ যথেষ্ট তৎপর।
বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষকে কেন্দ্রে রেখে আমরা টেকসই উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। রিও সম্মেলনের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তা নতুন মাত্রা পাবে বলে আশা করা যায়। এটা সত্য, উন্নয়ন নিজেদের তাগিদেই করতে হয়। কিন্তু আমাদের মতো দেশের পক্ষে সেটা একা করা কঠিন। এ ধরনের বৈশ্বিক সম্মেলনের মধ্য দিয়ে যৌথতা প্রতিষ্ঠিত হয়।
কেউ কেউ এ ধরনের বৈশ্বিক আয়োজনের এই বলে সমালোচনা করে থাকেন যে, এগুলোতে কেবল প্রতিশ্রুতিই সার। কাজ হয় খুব কম। এই সমালোচনায় যথেষ্ট সত্যতা আছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি মনে করি, সেটা ভেবে বসে থাকা হবে আত্মঘাতী। বিভিন্ন বাধা ও হতাশা কাটিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেমন তৎপর থাকতে হবে, তেমনই অভ্যন্তরীণভাবে নিজেদের সীমিত সম্পদ দিয়ে কাজ করে যেতে হবে। বস্তুত বসবাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে হলে আলোচনা ও ঐক্যের বিকল্প নেই। রিও সম্মেলনে সেই কাজটিই আমরা করতে যাচ্ছি।
ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ :অর্থনীতিবিদ চেয়ারম্যান পিকেএসএফ পরিচালনা পর্ষদ
চলতি মাসের ২০-২২ তারিখে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে টেকসই উন্নয়ন বিষয়ে জাতিসংঘ শীর্ষ সম্মেলন (ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট)। তবে বিশেষজ্ঞ মহলে জনপ্রিয়তা পেয়েছে 'রিও প্লাস ২০' কথাটি। কারণ এখন থেকে ঠিক ২০ বছর আগে এই রিওতেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল ধরিত্রী সম্মেলন। শতাধিক সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধানসহ বিশ্বের সব দেশের প্রতিনিধি সেখানে একত্র হয়েছিলেন যে কীভাবে ধরিত্রীকে সংকটে না ফেলেই উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি অক্ষুণ্ন রাখা যায়। এ লক্ষ্যে সেখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল প্রণীত এবং স্বাক্ষরের জন্য উন্মুক্ত হয়। এর প্রধান তিনটি হচ্ছে কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি (সিবিডি), ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (ইউএনএফসিসিসি) এবং এজেন্ডা টোয়েন্টি ওয়ান। এগুলোর মাধ্যমে যথাক্রমে জীববৈচিত্র্য তথা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবেলা এবং টেকসই উন্নয়নের কর্মপরিকল্পনা নির্ধারিত হয়েছিল। রিও সম্মেলনে গৃহীত বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও কর্মপরিকল্পনা অগ্রগতি পর্যালোচনায় পরবর্তী পাঁচ ও দশ বছরে রিও প্লাস ফাইভ, রিও প্লাস টেন প্রভৃতি সম্মেলন হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, বিশ্বের সব দেশের প্রতিনিধি আবারও রিওতে একত্র হবেন এবং টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে গত ২০ বছরের চিত্র পর্যালোচনা এবং পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবেন।
বলাবাহুল্য, এই সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকেও প্রতিনিধি দল অংশ নিচ্ছে। টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি ও অবস্থান জানাতে ইতিমধ্যে 'বাংলাদেশ ন্যাশনাল রিপোর্ট অন সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট' প্রণীত হয়েছে। গত কয়েক মাস ধরে আমরা এ নিয়ে কাজ করেছি। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, টেকসই উন্নয়নের তিনটি স্তম্ভেই_ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত দিক থেকে বেশ অগ্রগতি সাধন করতে সক্ষম হয়েছে।
অর্থনীতির কথা যদি বলি, প্রথম রিও সম্মেলন যখন অনুষ্ঠিত হয়, সেই নব্বই দশকেও আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির বার্ষিক হার ছিল চার থেকে সাড়ে চার শতাংশ। এমনকি একুশ শতকের গোড়ার দিকেও আমরা পাঁচ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পার করতে পারিনি। গত তিন বছর ধরে আমরা ছয় থেকে সাড়ে ছয় শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলছি। ২০১০-১১ অর্থবছরে এই হার ছিল ৬.৭ শতাংশ। মনে রাখতে হবে, আমরা এই প্রবৃদ্ধি এমন সময় অর্জন করছি, যখন ২০০৮ সালে বিশ্বজুড়ে সূচিত অর্থনৈতিক মন্দা চলছিল। আর ইউরো জোনের অর্থনৈতিক সংকট এখন প্রকট হয়েছে।
বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ও এখন ৮৪৮ ডলারে দাঁড়িয়েছে। কয়েক বছর আগেও এতটা আয় প্রত্যাশা করা যায়নি। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আশা করতে পারি, এই দশকের মধ্যেই আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে পারব। অবশ্য কেবল মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়াই বড় কথা নয়। আমরা আসলে জীবনযাপনের দিক থেকে মধ্যম মানের একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়তে চাই।
রিও প্লাস টোয়েন্টি সম্মেলন প্রক্রিয়ায় সবুজ অর্থনীতি একটি বড় বিষয়। এই লক্ষ্যে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ রয়েছে। আমাদের মতো দেশের জন্য সে ক্ষেত্রে উদ্বেগও থাকবে। অর্থনীতি সবুজ করতে গিয়ে এর প্রভাব কি প্রবৃদ্ধিতে পড়বে কি-না, ভাববার বিষয়। দারিদ্র্য নিরসন কার্যক্রমেও ব্যাঘাত ঘটবে কি-না আমাদের চিন্তা-ভাবনা করে দেখতে হবে। অর্থনীতি সবুজ করতেও কিন্তু অর্থ ও প্রযুক্তি প্রয়োজন হয়। তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের জন্য সেই অর্থ নিজে নিজে জোগান দেওয়া সহজ নয়। অর্থনীতির সবুজায়ন যদি বৈশ্বিক বাণিজ্যের শর্ত হয়ে দাঁড়ায়, তা হলে আমাদের বাণিজ্য সম্ভাবনা ব্যাহত হবে। সবুজায়নের সিদ্ধান্তই-বা কে নেবে? আরও দশটা বিষয়ের মতো উন্নত বিশ্ব সিদ্ধান্ত দেবে আর আমরা খালি পালন করে যাব? সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নিজেদেরই মূল ভূমিকা পালন করতে হবে। উন্নত বিশ্ব অর্থ ও প্রযুক্তি দিয়ে সহায়তা করতে পারে কেবল।
টেকসই উন্নয়নের দ্বিতীয় স্তম্ভ বা সামাজিক দিকটি বিবেচনা করতে হলে অর্থনৈতিক বণ্টন সুষম হচ্ছে কি-না, সেটা জানাও জরুরি। অনুমান করা কঠিন নয় যে, গত ২০ বছরে সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যানও সেটা সমর্থন করে। তবে চলতি অর্থবছরে দেখা যাচ্ছে যে, অর্থনৈতিক বৈষম্য আগের হারে বাড়েনি; বরং স্থিতিশীল হয়েছে। কিন্তু সে জন্য খুব খুশি হওয়ার অবকাশ নেই। কারণ ইতিমধ্যেই এই বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। টেকসই উন্নয়ন চাইলে এই বৈষম্য কমাতেই হবে।
সামগ্রিকভাবে সামাজিক ক্ষেত্রে আমরা বেশ ভালো করেছি। ইতিমধ্যেই সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যের বেশ কয়েকটি সামাজিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে। শিশুমৃত্যুর হার কমানোর ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য ২০১০ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘ পুরস্কারও পেয়েছে। সামাজিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে আমরা যে ভারতসহ বিভিন্ন সার্ক দেশের তুলনায় এগিয়ে আছি, সেটাও বিভিন্ন সময়ে বৈশ্বিক বিভিন্ন সূচকে প্রমাণ হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা এবং সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে উৎসাহব্যঞ্জক উদাহরণ।
দারিদ্র্য বিমোচনে গত ২০ বছরে বাংলাদেশের সাফল্য উল্লেখযোগ্য। নব্বই দশকের গোড়ার দিকে এই অনুপাত ছিল ৬০ শতাংশের কাছাকাছি। ২০০৫ সালে সেটা ৪০ শতাংশে নেমে আসে। ২০১০ সালের হিসেবে দেখা যাচ্ছে দারিদ্র্যের অনুপাত ৩১.৫ শতাংশ। সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে ২০১৫ সালের মধ্যে এই হার ২৯ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। আমি মনে করি, বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে নির্ধারিত সময়ের আগেই ওই লক্ষ্য পূরণ হবে। দারিদ্র্য নিরসনে জনসংখ্যা বৃদ্ধি একটি বড় বাধা। ২০১১ সালের আদমশুমারিতে দেখা যাচ্ছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩২ শতাংশে নেমে এসেছে। এটা আরও কমাতে হবে।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে যে অগ্রগতির কথা আমরা ভেবে থাকি, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা না গেলে তা অর্জন ও ধরে রাখা কঠিন। যে কারণে টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে পরিবেশগত বিবেচনা হচ্ছে তৃতীয় স্তম্ভ। ২০ বছর আগে সেখানে ইউএনএফসিসিসি প্রণীত হয় এবং তার ভিত্তিতে গত ২০ বছরে অনেক আলাপ-আলোচনা, পরিকল্পনা ও কাজ হয়েছে। ১৯৯২ সালের ধরিত্রী সম্মেলনে যদিও কেউ কেউ সন্দেহগ্রস্ত ছিলেন, এখন সবাই মানেন যে জলবায়ু পরিবর্তন ইতিমধ্যেই ঘটছে এবং এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া মোকাবেলা করা না গেলে কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না।
জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিভিন্ন বিবেচনায় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। একই সঙ্গে এই দুর্যোগ মোকাবেলায় আমাদের নীতি ও কাঠামোগত প্রস্তুতিও খুবই ভালো। আমরা ইতিমধ্যে নাপা (ন্যাশনাল এডাপ্টেশন প্লান অব অ্যাকশন) এবং পরে, ২০০৯ সালের জুলাইতে বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্লান (বিসিসিএসএপি) প্রণয়ন করেছি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ আমাদের অনুসরণ করছে। জাতীয় বাজেট থেকে বরাদ্দ দিয়ে আমরা যেভাবে বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছি, তা অনেক দেশের কাছেই উদাহরণ। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক বৈশ্বিক সমঝোতা প্রক্রিয়ায়ও বাংলাদেশ যথেষ্ট তৎপর।
বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষকে কেন্দ্রে রেখে আমরা টেকসই উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। রিও সম্মেলনের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তা নতুন মাত্রা পাবে বলে আশা করা যায়। এটা সত্য, উন্নয়ন নিজেদের তাগিদেই করতে হয়। কিন্তু আমাদের মতো দেশের পক্ষে সেটা একা করা কঠিন। এ ধরনের বৈশ্বিক সম্মেলনের মধ্য দিয়ে যৌথতা প্রতিষ্ঠিত হয়।
কেউ কেউ এ ধরনের বৈশ্বিক আয়োজনের এই বলে সমালোচনা করে থাকেন যে, এগুলোতে কেবল প্রতিশ্রুতিই সার। কাজ হয় খুব কম। এই সমালোচনায় যথেষ্ট সত্যতা আছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি মনে করি, সেটা ভেবে বসে থাকা হবে আত্মঘাতী। বিভিন্ন বাধা ও হতাশা কাটিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেমন তৎপর থাকতে হবে, তেমনই অভ্যন্তরীণভাবে নিজেদের সীমিত সম্পদ দিয়ে কাজ করে যেতে হবে। বস্তুত বসবাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে হলে আলোচনা ও ঐক্যের বিকল্প নেই। রিও সম্মেলনে সেই কাজটিই আমরা করতে যাচ্ছি।
ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ :অর্থনীতিবিদ চেয়ারম্যান পিকেএসএফ পরিচালনা পর্ষদ
No comments