যুক্তি তর্ক গল্প-রাজনীতিকদের প্রতি সাংবাদিকের বিনয় ভাষণ by আবুল মোমেন
মার্কিন সংবিধানের মূল প্রণেতা, তৃতীয় মার্কিন রাষ্ট্রপতি টমাস জেফারসনের একটি কথা আজ বিশেষভাবে মনে পড়ছে। তিনি বলেছেন—Were it left to me to decide whether we should have a government without newspapers, or newspapers without a government, I should not hesitate a moment to prefer the latter।
বাংলা করলে তাঁর বক্তব্যটা দাঁড়ায় এ রকম—আমাকে যদি সংবাদপত্রবিহীন সরকার আর সরকারবিহীন সংবাদপত্রের মধ্যে পছন্দ করতে বলা হয়, তবে এক মুহূর্ত দ্বিধা না করে পরেরটাই পছন্দ করব। অর্থাৎ প্রয়োজনে সরকার বাদ দিতে রাজি তিনি, কিন্তু সংবাদপত্র বাদ দেওয়া যাবে না।
টমাস জেফারসন এ কথা এ কারণে বলেননি যে তিনি কোনোভাবে সংবাদপত্রের পক্ষভুক্ত ব্যক্তি। না, তাঁর বিবেচ্য বিষয়টি সংবাদপত্র নয়, গণতন্ত্র। গণতন্ত্রকে গণতন্ত্ররূপে বাঁচাতে হলে স্বাধীন সংবাদপত্র অপরিহার্য। জেফারসনের বক্তব্যে এ কথাটার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
এ কথা অনস্বীকার্য, আমাদের সমাজে গণতন্ত্রচর্চার ঐতিহ্য দীর্ঘও নয়, ততটা পোক্তও নয়। ফলে আদর্শ গণতান্ত্রিক আচরণে—সেটা ঔদার্য-সহিষ্ণুতার দিক থেকে বলুন কিংবা অধিকার-দায়িত্বশীলতার দিক থেকেই বলুন—আমরা এখনো অভ্যস্ত নই। রাজনীতিবিদ এবং সাংবাদিক উভয় দিক থেকেই এ ক্ষেত্রে ঘাটতি ও ভ্রান্তির ভূরি ভূরি প্রমাণ দেওয়া যাবে। কিন্তু এ নিয়ে বাগ্যুদ্ধ বা উভয় পক্ষে স্ব স্ব ক্ষমতা প্রয়োগের ঝোঁক চাপলে লাভ হবে স্বৈরতন্ত্রের। কারণ, এতে মারা পড়বে গণতন্ত্রের দুর্বল চারাটি।
বিষয়টা বস্তুত কার কতটা ক্ষমতা আছে তার নয়, বিষয়টা হলো ভূমিকার। অর্থাৎ কার কী ভূমিকা, সেটা বুঝে নেওয়া ও তা পালনের।
রাজনীতির মূল কাজ দেশসেবা ও জনসেবা। এ কাজ দুটি অবস্থানে থেকে সম্পাদন করতে হয়—
১. রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ ও দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে এবং ২. ক্ষমতার বাইরে জনতার কাতারে থেকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে।
প্রকৃত রাজনীতিবিদদের কেউ কেউ কেবল দ্বিতীয় দায়িত্বটি পালন করেই তৃপ্ত থেকেছেন (যেমন মহাত্মা গান্ধী বা মওলানা ভাসানী), তবে যিনি দুটি দায়িত্বই পালন করেন, তিনিও প্রকৃত রাজনীতিবিদ। কিন্তু আমাদের দেশের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, কেবল প্রথমোক্ত দায়িত্বের মাধ্যমে অনেকেই রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন। এ কথাও আমরা জানি, এই ধারার সূত্রপাত করেছিলেন জেনারেল জিয়া। সেই থেকে ক্ষমতাকেই ধ্যান-জ্ঞান ও লক্ষ্য করে বহু ধরনের মানুষ রাজনীতিতে জাঁকিয়ে বসেছেন। সামরিক স্বৈরাচারেরা এ কাজ করেছেন, তাঁদের সঙ্গে লড়তে গিয়ে আওয়ামী লীগকেও এ রকম কিছু আপস করতে হয়েছে। তাতে রাজনীতিতে এমন অনেক মানুষ যুক্ত হয়েছেন, যাঁদের কাছে ব্যক্তিগত বৈষয়িক এজেন্ডা এত গুরুত্বপূর্ণ ও মুখ্য যে জনগণ ও দেশের ইস্যু গৌণ হয়ে পড়ছে। ফলে রাজনীতিতে কেবল দুর্নীতি বা অপরাধপ্রবণতা বাড়েনি, অসহিষ্ণুতা-অনুদারতাও বাড়ছে। আর তাতে সংকটাপন্ন হচ্ছে গণতন্ত্রের অভিযাত্রা।
আমরা এ কথা বলব না যে সংবাদপত্র বা সাংবাদিকতায় কোনো সংকট নেই। অনেক ধনী, হঠাৎ ধনী, নানা মতলবে যেমন পত্রিকা প্রকাশ করে থাকেন, তেমনি গণতান্ত্রিক সমাজের সাংবাদিকতার জন্য যে পরিণতি ও প্রস্তুতি দরকার তা ছাড়াই বেনোজলের মতো অনেকেই এ পেশায় ঢুকে পড়ছে। তাতে মাত্রাজ্ঞানের ঘাটতি তো বটেই, এমনকি নানা রকম ধান্ধার প্রমাণও পাওয়া যায় সংবাদপত্রের পাতায় ও সাংবাদিক পেশায়। সোজা কথায় বলা যায়, সাংবাদিকের ও সাংবাদিকতার যে মূল্যবোধ থাকা উচিত, সে বিষয়ে সচেতনতার প্রমাণ সব সময় সব ক্ষেত্রে পাওয়া যাচ্ছে না।
সংবাদপত্র যে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হয়ে উঠবে তাকে তো সেভাবে প্রজ্ঞা ও প্রস্তুতিতে পরিণত হয়ে প্রতিষ্ঠানরূপে দাঁড়াতে হবে। আর বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় সে ঘাটতি নিয়ে কেউ আফসোস বা সমালোচনা করতেই পারেন।
তবে এ কথাটাও মনে রাখতে হবে, যখন বিষয়টা সরকার ও সংবাদপত্র বা রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকের মধ্যে বিচার ও বিতর্কের ব্যাপারে দাঁড়িয়ে যায়, তখন সে উত্তাপে ঘি না ঢেলে পানি দেওয়াই সবার জন্য কল্যাণকর হবে। বিশেষত গণতন্ত্র যদি আমাদের অভীষ্ট গন্তব্য হয়ে থাকে।
যদি সত্যিই এ দুইয়ের মধ্যে একটা প্রতিপক্ষতার বোধ দাঁড়িয়ে যায় সে ক্ষেত্রে কলামের শুরুর কথার সূত্র ধরে বলি, কার কী ভূমিকা সেটা মাথায় রেখেই বিশ্লেষণ করতে হবে। রাজনীতিক যখন সরকারে থাকেন অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে থাকেন, তখন তিনি ক্ষমতা ভোগ করেন ও ব্যবহার করেন। আর সংবাদপত্রের ভূমিকা হচ্ছে তাঁর এই ভোগ ও ব্যবহারের খোঁজখবর রাখা, প্রয়োজনে সমালোচনা করা, সে সমালোচনা তির্যক, কঠোর এবং অভিযোগমূলকও হতে পারে—যদি বস্তুনিষ্ঠ তথ্য-পরিসংখ্যান দিয়ে তা করা সম্ভব হয়। মনে রাখতে হবে, রাজনীতিবিদদের কিন্তু পাবলিক লাইফ—তাঁর কাজকর্মের আলোচনা, প্রশংসা-সমালোচনা সবই প্রকাশ্যেই হবে। যাঁদের স্নায়ু দুর্বল, মর্যাদাবোধ ঠুনকো, তাঁদের পক্ষে সত্যিই রাজনীতিবিদের জীবন গ্রহণ করা সম্ভব নয়।
২১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় সংসদে প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে মাননীয় স্পিকারসহ কয়েকজন মন্ত্রী ও সাংসদ যেভাবে প্রথম আলোসহ কয়েকটি সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন, তাতে দেশের সচেতন মানুষমাত্রই বিচলিত হয়েছেন। তাঁদের সমালোচনা তির্যক, কঠোর এবং আক্রমণাত্মক ছিল। ক্ষুব্ধ সাংসদেরা আইনের মাধ্যমে সংবাদপত্রের সমালোচনার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দাবিও তুলেছেন। ক্ষমতা সব সময়ই চায় নির্ঝঞ্ঝাট থাকতে, সাংবাদিকের খোঁচাখুঁচি যে ক্ষমতাবানদের ভালো লাগে না তা বাংলাদেশের কোনো কোনো সাংসদ ও রাজনীতিক বলপ্রয়োগের ভাষায় বুঝিয়ে দিয়েছেন, দিয়ে থাকেন।
আগেই বলেছি, বিএনপির জন্ম থেকে বিকাশে ক্ষমতালিপ্সু ‘রাজনীতিকের’ সমাবেশ ঘটেছে। এরশাদও একই পথ অনুসরণ করেছেন। আর টানা দীর্ঘ প্রায় দুই দশক ধরে এই দুই দলের ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে যুঝতে গিয়ে আওয়ামী লীগেও একই মনোবৃত্তির মানুষ কিছু ঢুকে পড়েছে, কিংবা একই মনোভাবের সংক্রমণ ঘটেছে কারও কারও মধ্যে। ফলে সামগ্রিকভাবে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ও রাজনৈতিক বাতাবরণে যেমন বাড়ছে অনুদারতা, তেমনি চলছে জবরদস্তির দাপট। এর বিরুদ্ধে লড়ে কিংবা এর সঙ্গে সহবাস করে টিকে থেকে সাংবাদিকতাও কি দূষণ ও সংক্রমণের শিকার হয়নি? হয়েছে।
পরস্পর দোষারোপ না করে, পরস্পরকে প্রতিপক্ষতার দূরত্বে ঠেলে না দিয়ে উভয় পক্ষেরই নিজ নিজ ভূমিকা ঠিক করতে হবে।
এখানে এ কথাটুকুও একটু বলে নিতে চাই। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অভিযাত্রাকে বারবার থামিয়ে দেওয়ার ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের পরিচয় বহু দিনের। ৯২ ক ধারা জারি থেকে, আইউব-ইয়াহিয়া হয়ে জিয়া-এরশাদ এবং সর্বশেষ ১/১১-এর সরকার বলুন, এই ব্যতিক্রমী ও ‘বেআইনি’ সরকারগুলোর ক্ষমতা গ্রহণের মূল কারণ কিন্তু সংবাদপত্রের দুর্বলতা বা ভ্রান্তি নয়, মূল কারণ আমাদের রাজনৈতিক দুর্বলতা ও ভ্রান্তি। অবশ্যই মানতে হবে, এই দুর্বলতা ও ভ্রান্তির দায় সাংবাদিকও এড়াতে পারেন না। কারণ, তাঁরা সমাজের সচেতন অংশ হিসেবে রাজনীতির বাইরে নন, কিন্তু তবুও মূল দায় তো রাজনীতিকেরই। ষড়যন্ত্রতত্ত্ব খাড়া করা যায় সহজেই, কিন্তু সেটা হবে সত্যকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার ব্যাপার। ষড়যন্ত্র ছিল না বা হয়নি তা বলব না, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হলো নিজের দোষ ও দুর্বলতা বুঝে তা সংশোধন করা। তবেই ষড়যন্ত্র পাকানো যায় না, পাকালে তা সফল হবে না।
সংসদের সেদিনের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছিল আমাদের রাজনীতিবিদ-সাংসদদের রাগের পারদ বেশ চড়া ছিল। তবে ইংরেজি প্রবাদে বলে—রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন, আর বাংলা প্রবাদ আছে—যে সয় সে রয়। একটু রয়ে-সয়ে ভেবেচিন্তে পা বাড়াতে হবে। বহু বহু কাল ধরে আমরা এক সুদীর্ঘ ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। আমি আগেও এ পত্রিকায় লিখেছি যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের মাধ্যমেই গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় বলিষ্ঠ ও স্থায়ীভাবে উত্তরণের শেষ সুযোগ আমাদের। এ সুযোগ হাতছাড়া হলে মহাপ্রলয় ছাড়া কিছু বাকি থাকবে না। অনুদারতা ও অসহিষ্ণুতা থেকেই কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক বিপর্যয় ঘটেছে বারবার। ক্ষমতায় বসে নিজের ভুল ও সীমাবদ্ধতা দেখতে-বুঝতে অক্ষম হলে শেষ পর্যন্ত ক্ষমতার খুঁটি নড়ে যায়। কারণ জনগণই শেষ বিচারক।
আলোচনাটা শেষ করতে চাই এ কথা বলে যে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সংবাদপত্রকেও রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভরূপে প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠতে হবে। সরকার চাপে রেখে দমিয়ে রাখলে তার বিকাশ ঘটবে না, প্রতিষ্ঠান হওয়াও হবে না। গণতন্ত্র ও সরকারের পরিণতি ও প্রতিষ্ঠা সম্পূর্ণভাবে পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। ফলে সংবাদপত্রকে কতল করলে নিজেরই নাক কাটা পড়বে, গণতন্ত্রের যাত্রা ভঙ্গ হবে।
আমার দীর্ঘ সাংবাদিকতাজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সবিনয়ে বলতে চাই, প্রথম আলো অত্যন্ত সচেতনতার সঙ্গে গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং ভবিষ্যতের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ (ডিজিটাল বাংলাদেশ বলা যায়) বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকতে চায়। কেউ যখন কোনো দায়কে মিশন হিসেবে নিতে যায়, তাতে আপসহীন নিরপেক্ষ অবস্থানের জেদ থেকে হয়তো স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনার ক্ষেত্রে ভুল হতে পারে, কিন্তু উদ্দেশ্য কখনো ক্ষুদ্র স্বার্থে গণ্ডিবদ্ধ নয়। নয় যে তার প্রমাণ এর পাঠকভিত্তির বিস্তার ও পাঠকসম্পৃক্তি। ভুল হলে সেটা প্রয়োগের ভুল, তার জন্য উদ্দেশ্যের সততাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হবে ভুল। বরং খেয়াল করলে দেখা যাবে, প্রথম আলো সংবাদপত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপে বিকাশ ও ভূমিকা পালনের যোগ্যতা অর্জনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। সেই চেষ্টাকে সন্দেহ ও সমালোচনার তীরে বিদ্ধ করে রাখার চেয়ে প্রয়োজনে আইনি পর্যবেক্ষণে রাখা স্বাস্থ্যকর। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করে বা সাংবাদিক, সম্পাদক, সংবাদপত্রকে হুমকি-ধমকি দিয়ে দেশে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া যাবে না।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান তাঁর কলামের নাম দিয়েছিলেন ‘আমার সমালোচক আমার বন্ধু’। রাজনীতিবিদদের উদ্দেশে বলব, বন্ধু চিনতে ভুল করবেন না—সৎ বন্ধু তো তোষামোদকারী নয়, সমালোচক। কারণ, রাজনীতিবিদদের ভুলের মাশুল অনেক বড়। আর তা গুনতে হয় সমগ্র জাতিকে সমষ্টিগতভাবে এবং বহুকালের জন্য।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
টমাস জেফারসন এ কথা এ কারণে বলেননি যে তিনি কোনোভাবে সংবাদপত্রের পক্ষভুক্ত ব্যক্তি। না, তাঁর বিবেচ্য বিষয়টি সংবাদপত্র নয়, গণতন্ত্র। গণতন্ত্রকে গণতন্ত্ররূপে বাঁচাতে হলে স্বাধীন সংবাদপত্র অপরিহার্য। জেফারসনের বক্তব্যে এ কথাটার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
এ কথা অনস্বীকার্য, আমাদের সমাজে গণতন্ত্রচর্চার ঐতিহ্য দীর্ঘও নয়, ততটা পোক্তও নয়। ফলে আদর্শ গণতান্ত্রিক আচরণে—সেটা ঔদার্য-সহিষ্ণুতার দিক থেকে বলুন কিংবা অধিকার-দায়িত্বশীলতার দিক থেকেই বলুন—আমরা এখনো অভ্যস্ত নই। রাজনীতিবিদ এবং সাংবাদিক উভয় দিক থেকেই এ ক্ষেত্রে ঘাটতি ও ভ্রান্তির ভূরি ভূরি প্রমাণ দেওয়া যাবে। কিন্তু এ নিয়ে বাগ্যুদ্ধ বা উভয় পক্ষে স্ব স্ব ক্ষমতা প্রয়োগের ঝোঁক চাপলে লাভ হবে স্বৈরতন্ত্রের। কারণ, এতে মারা পড়বে গণতন্ত্রের দুর্বল চারাটি।
বিষয়টা বস্তুত কার কতটা ক্ষমতা আছে তার নয়, বিষয়টা হলো ভূমিকার। অর্থাৎ কার কী ভূমিকা, সেটা বুঝে নেওয়া ও তা পালনের।
রাজনীতির মূল কাজ দেশসেবা ও জনসেবা। এ কাজ দুটি অবস্থানে থেকে সম্পাদন করতে হয়—
১. রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ ও দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে এবং ২. ক্ষমতার বাইরে জনতার কাতারে থেকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে।
প্রকৃত রাজনীতিবিদদের কেউ কেউ কেবল দ্বিতীয় দায়িত্বটি পালন করেই তৃপ্ত থেকেছেন (যেমন মহাত্মা গান্ধী বা মওলানা ভাসানী), তবে যিনি দুটি দায়িত্বই পালন করেন, তিনিও প্রকৃত রাজনীতিবিদ। কিন্তু আমাদের দেশের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, কেবল প্রথমোক্ত দায়িত্বের মাধ্যমে অনেকেই রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন। এ কথাও আমরা জানি, এই ধারার সূত্রপাত করেছিলেন জেনারেল জিয়া। সেই থেকে ক্ষমতাকেই ধ্যান-জ্ঞান ও লক্ষ্য করে বহু ধরনের মানুষ রাজনীতিতে জাঁকিয়ে বসেছেন। সামরিক স্বৈরাচারেরা এ কাজ করেছেন, তাঁদের সঙ্গে লড়তে গিয়ে আওয়ামী লীগকেও এ রকম কিছু আপস করতে হয়েছে। তাতে রাজনীতিতে এমন অনেক মানুষ যুক্ত হয়েছেন, যাঁদের কাছে ব্যক্তিগত বৈষয়িক এজেন্ডা এত গুরুত্বপূর্ণ ও মুখ্য যে জনগণ ও দেশের ইস্যু গৌণ হয়ে পড়ছে। ফলে রাজনীতিতে কেবল দুর্নীতি বা অপরাধপ্রবণতা বাড়েনি, অসহিষ্ণুতা-অনুদারতাও বাড়ছে। আর তাতে সংকটাপন্ন হচ্ছে গণতন্ত্রের অভিযাত্রা।
আমরা এ কথা বলব না যে সংবাদপত্র বা সাংবাদিকতায় কোনো সংকট নেই। অনেক ধনী, হঠাৎ ধনী, নানা মতলবে যেমন পত্রিকা প্রকাশ করে থাকেন, তেমনি গণতান্ত্রিক সমাজের সাংবাদিকতার জন্য যে পরিণতি ও প্রস্তুতি দরকার তা ছাড়াই বেনোজলের মতো অনেকেই এ পেশায় ঢুকে পড়ছে। তাতে মাত্রাজ্ঞানের ঘাটতি তো বটেই, এমনকি নানা রকম ধান্ধার প্রমাণও পাওয়া যায় সংবাদপত্রের পাতায় ও সাংবাদিক পেশায়। সোজা কথায় বলা যায়, সাংবাদিকের ও সাংবাদিকতার যে মূল্যবোধ থাকা উচিত, সে বিষয়ে সচেতনতার প্রমাণ সব সময় সব ক্ষেত্রে পাওয়া যাচ্ছে না।
সংবাদপত্র যে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হয়ে উঠবে তাকে তো সেভাবে প্রজ্ঞা ও প্রস্তুতিতে পরিণত হয়ে প্রতিষ্ঠানরূপে দাঁড়াতে হবে। আর বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় সে ঘাটতি নিয়ে কেউ আফসোস বা সমালোচনা করতেই পারেন।
তবে এ কথাটাও মনে রাখতে হবে, যখন বিষয়টা সরকার ও সংবাদপত্র বা রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকের মধ্যে বিচার ও বিতর্কের ব্যাপারে দাঁড়িয়ে যায়, তখন সে উত্তাপে ঘি না ঢেলে পানি দেওয়াই সবার জন্য কল্যাণকর হবে। বিশেষত গণতন্ত্র যদি আমাদের অভীষ্ট গন্তব্য হয়ে থাকে।
যদি সত্যিই এ দুইয়ের মধ্যে একটা প্রতিপক্ষতার বোধ দাঁড়িয়ে যায় সে ক্ষেত্রে কলামের শুরুর কথার সূত্র ধরে বলি, কার কী ভূমিকা সেটা মাথায় রেখেই বিশ্লেষণ করতে হবে। রাজনীতিক যখন সরকারে থাকেন অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে থাকেন, তখন তিনি ক্ষমতা ভোগ করেন ও ব্যবহার করেন। আর সংবাদপত্রের ভূমিকা হচ্ছে তাঁর এই ভোগ ও ব্যবহারের খোঁজখবর রাখা, প্রয়োজনে সমালোচনা করা, সে সমালোচনা তির্যক, কঠোর এবং অভিযোগমূলকও হতে পারে—যদি বস্তুনিষ্ঠ তথ্য-পরিসংখ্যান দিয়ে তা করা সম্ভব হয়। মনে রাখতে হবে, রাজনীতিবিদদের কিন্তু পাবলিক লাইফ—তাঁর কাজকর্মের আলোচনা, প্রশংসা-সমালোচনা সবই প্রকাশ্যেই হবে। যাঁদের স্নায়ু দুর্বল, মর্যাদাবোধ ঠুনকো, তাঁদের পক্ষে সত্যিই রাজনীতিবিদের জীবন গ্রহণ করা সম্ভব নয়।
২১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় সংসদে প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে মাননীয় স্পিকারসহ কয়েকজন মন্ত্রী ও সাংসদ যেভাবে প্রথম আলোসহ কয়েকটি সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন, তাতে দেশের সচেতন মানুষমাত্রই বিচলিত হয়েছেন। তাঁদের সমালোচনা তির্যক, কঠোর এবং আক্রমণাত্মক ছিল। ক্ষুব্ধ সাংসদেরা আইনের মাধ্যমে সংবাদপত্রের সমালোচনার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দাবিও তুলেছেন। ক্ষমতা সব সময়ই চায় নির্ঝঞ্ঝাট থাকতে, সাংবাদিকের খোঁচাখুঁচি যে ক্ষমতাবানদের ভালো লাগে না তা বাংলাদেশের কোনো কোনো সাংসদ ও রাজনীতিক বলপ্রয়োগের ভাষায় বুঝিয়ে দিয়েছেন, দিয়ে থাকেন।
আগেই বলেছি, বিএনপির জন্ম থেকে বিকাশে ক্ষমতালিপ্সু ‘রাজনীতিকের’ সমাবেশ ঘটেছে। এরশাদও একই পথ অনুসরণ করেছেন। আর টানা দীর্ঘ প্রায় দুই দশক ধরে এই দুই দলের ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে যুঝতে গিয়ে আওয়ামী লীগেও একই মনোবৃত্তির মানুষ কিছু ঢুকে পড়েছে, কিংবা একই মনোভাবের সংক্রমণ ঘটেছে কারও কারও মধ্যে। ফলে সামগ্রিকভাবে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ও রাজনৈতিক বাতাবরণে যেমন বাড়ছে অনুদারতা, তেমনি চলছে জবরদস্তির দাপট। এর বিরুদ্ধে লড়ে কিংবা এর সঙ্গে সহবাস করে টিকে থেকে সাংবাদিকতাও কি দূষণ ও সংক্রমণের শিকার হয়নি? হয়েছে।
পরস্পর দোষারোপ না করে, পরস্পরকে প্রতিপক্ষতার দূরত্বে ঠেলে না দিয়ে উভয় পক্ষেরই নিজ নিজ ভূমিকা ঠিক করতে হবে।
এখানে এ কথাটুকুও একটু বলে নিতে চাই। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অভিযাত্রাকে বারবার থামিয়ে দেওয়ার ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের পরিচয় বহু দিনের। ৯২ ক ধারা জারি থেকে, আইউব-ইয়াহিয়া হয়ে জিয়া-এরশাদ এবং সর্বশেষ ১/১১-এর সরকার বলুন, এই ব্যতিক্রমী ও ‘বেআইনি’ সরকারগুলোর ক্ষমতা গ্রহণের মূল কারণ কিন্তু সংবাদপত্রের দুর্বলতা বা ভ্রান্তি নয়, মূল কারণ আমাদের রাজনৈতিক দুর্বলতা ও ভ্রান্তি। অবশ্যই মানতে হবে, এই দুর্বলতা ও ভ্রান্তির দায় সাংবাদিকও এড়াতে পারেন না। কারণ, তাঁরা সমাজের সচেতন অংশ হিসেবে রাজনীতির বাইরে নন, কিন্তু তবুও মূল দায় তো রাজনীতিকেরই। ষড়যন্ত্রতত্ত্ব খাড়া করা যায় সহজেই, কিন্তু সেটা হবে সত্যকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার ব্যাপার। ষড়যন্ত্র ছিল না বা হয়নি তা বলব না, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হলো নিজের দোষ ও দুর্বলতা বুঝে তা সংশোধন করা। তবেই ষড়যন্ত্র পাকানো যায় না, পাকালে তা সফল হবে না।
সংসদের সেদিনের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছিল আমাদের রাজনীতিবিদ-সাংসদদের রাগের পারদ বেশ চড়া ছিল। তবে ইংরেজি প্রবাদে বলে—রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন, আর বাংলা প্রবাদ আছে—যে সয় সে রয়। একটু রয়ে-সয়ে ভেবেচিন্তে পা বাড়াতে হবে। বহু বহু কাল ধরে আমরা এক সুদীর্ঘ ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। আমি আগেও এ পত্রিকায় লিখেছি যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের মাধ্যমেই গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় বলিষ্ঠ ও স্থায়ীভাবে উত্তরণের শেষ সুযোগ আমাদের। এ সুযোগ হাতছাড়া হলে মহাপ্রলয় ছাড়া কিছু বাকি থাকবে না। অনুদারতা ও অসহিষ্ণুতা থেকেই কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক বিপর্যয় ঘটেছে বারবার। ক্ষমতায় বসে নিজের ভুল ও সীমাবদ্ধতা দেখতে-বুঝতে অক্ষম হলে শেষ পর্যন্ত ক্ষমতার খুঁটি নড়ে যায়। কারণ জনগণই শেষ বিচারক।
আলোচনাটা শেষ করতে চাই এ কথা বলে যে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সংবাদপত্রকেও রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভরূপে প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠতে হবে। সরকার চাপে রেখে দমিয়ে রাখলে তার বিকাশ ঘটবে না, প্রতিষ্ঠান হওয়াও হবে না। গণতন্ত্র ও সরকারের পরিণতি ও প্রতিষ্ঠা সম্পূর্ণভাবে পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। ফলে সংবাদপত্রকে কতল করলে নিজেরই নাক কাটা পড়বে, গণতন্ত্রের যাত্রা ভঙ্গ হবে।
আমার দীর্ঘ সাংবাদিকতাজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সবিনয়ে বলতে চাই, প্রথম আলো অত্যন্ত সচেতনতার সঙ্গে গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং ভবিষ্যতের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ (ডিজিটাল বাংলাদেশ বলা যায়) বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকতে চায়। কেউ যখন কোনো দায়কে মিশন হিসেবে নিতে যায়, তাতে আপসহীন নিরপেক্ষ অবস্থানের জেদ থেকে হয়তো স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনার ক্ষেত্রে ভুল হতে পারে, কিন্তু উদ্দেশ্য কখনো ক্ষুদ্র স্বার্থে গণ্ডিবদ্ধ নয়। নয় যে তার প্রমাণ এর পাঠকভিত্তির বিস্তার ও পাঠকসম্পৃক্তি। ভুল হলে সেটা প্রয়োগের ভুল, তার জন্য উদ্দেশ্যের সততাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হবে ভুল। বরং খেয়াল করলে দেখা যাবে, প্রথম আলো সংবাদপত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপে বিকাশ ও ভূমিকা পালনের যোগ্যতা অর্জনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। সেই চেষ্টাকে সন্দেহ ও সমালোচনার তীরে বিদ্ধ করে রাখার চেয়ে প্রয়োজনে আইনি পর্যবেক্ষণে রাখা স্বাস্থ্যকর। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করে বা সাংবাদিক, সম্পাদক, সংবাদপত্রকে হুমকি-ধমকি দিয়ে দেশে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া যাবে না।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান তাঁর কলামের নাম দিয়েছিলেন ‘আমার সমালোচক আমার বন্ধু’। রাজনীতিবিদদের উদ্দেশে বলব, বন্ধু চিনতে ভুল করবেন না—সৎ বন্ধু তো তোষামোদকারী নয়, সমালোচক। কারণ, রাজনীতিবিদদের ভুলের মাশুল অনেক বড়। আর তা গুনতে হয় সমগ্র জাতিকে সমষ্টিগতভাবে এবং বহুকালের জন্য।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments