রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ অবশ্যই ঠেকাতে হবে-মিয়ানমারে জাতিগত সহিংসতা

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গত শুক্রবার থেকে যে জাতিগত সহিংসতা শুরু হয়েছে, তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ রাখাইনদের আক্রমণের শিকার সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নদী ও সীমান্তপথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। সোমবার এ রকম ছয় শতাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়লে বিজিবি ও কোস্টগার্ডের সদস্যরা তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠান।


কিন্তু রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে—শুধু এ কারণেই নয়, বিষয়টির আরও বড় মানবিক ও রাজনৈতিক দিকও রয়েছে।
দীর্ঘ সময় ধরে সামরিক স্বৈরশাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট মিয়ানমার সদ্য গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রবেশ করেছে, এই পথে এগিয়ে যাওয়াকে এ ধরনের ঘটনা নিঃসন্দেহে বাধাগ্রস্ত করবে। এখন দেশটির শাসন পরিচালনার দায়িত্ব যখন একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে রয়েছে, যখন গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চির মুক্তি, পার্লামেন্ট নির্বাচনে তাঁর দলের অভূতপূর্ব বিজয় এবং অপেক্ষাকৃত মুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করছে, সেই সময় আরাকান রাজ্যের এই জাতিগত সহিংসতা গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার মুখে একটি বড় আঘাত। প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনও এ কথা স্বীকার করেছেন। দেশটির জাতীয় টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে তিনি ঘৃণা, প্রতিশোধের স্পৃহা ও নৈরাজ্যের কথা উল্লেখ করে বলেন, এসব যদি ঘটতেই থাকে, তবে দেশের স্থিতিশীলতা, শান্তি, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হবে।
কিন্তু আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে যেসব খবর পরিবেশিত হয়েছে, তাতে এই জাতিগত সহিংসতা নিরসনের ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন জাগে। বার্তা সংস্থা রয়টার্স পরিবেশিত একাধিক খবরে বলা হয়েছে, জাতিগত সহিংসতা বন্ধ করতে মিয়ানমারের সরকারি নিরাপত্তা বাহিনী কার্যকর ভূমিকা পালন করছে না। অনেক স্থানে তারা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে; তাদের সামনে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা হয়েছে। এমনকি ‘নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা মুসলমানদের (রোহিঙ্গা) ঘরবাড়ি ভাঙচুর করতে সহায়তা করেছে’ বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমান ও সংখ্যাগরিষ্ঠ রাখাইন বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মধ্যকার বিরোধ অনেক পুরোনো। রোহিঙ্গারা বাংলার একটি উপভাষায় কথা বলে এবং তারা মুসলমান বলে তাদের বহিরাগত বিবেচনা করা হয়। কিন্তু রাখাইন রাজ্যের তিনটি জেলায় মোট প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা যুগ যুগ ধরে বংশপরম্পরায় বসবাস করে আসছে; মিয়ানমারকে তারা মাতৃভূমি বলেই জানে। তাদের দেশ থেকে উচ্ছেদ করার দুরভিসন্ধি থেকে মাঝে মাঝেই সেখানে সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়। মিয়ানমারের সামরিক স্বৈরশাসনের আমলে অনেক রোহিঙ্গাকে দেশছাড়া করা হয়েছে, তাদের অনেকেই প্রাণভয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। কিন্তু মিয়ানমার এখন একটি গণতান্ত্রিক দেশ। সেখানে প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপত্তা ও শান্তিতে জীবনযাপনের অধিকার রয়েছে, যে অধিকারের সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব দেশটির সরকারের।
রাখাইন রাজ্যে জাতিগত সহিংসতা দমনে মিয়ানমার সরকারের ব্যর্থতার ফলে যেহেতু বাংলাদেশের জন্য নতুন করে আবারও ‘অনুপ্রবেশ সমস্যা’র সৃষ্টি হয়েছে, তাই আমাদের মনে হয়, এ বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা হওয়া উচিত।

No comments

Powered by Blogger.