নগর দর্পণ: চট্টগ্রাম-শেখ হাসিনার ‘ঈদ-উপহার’ by বিশ্বজিৎ চৌধুরী

ঈদের মাত্র দুই দিন আগে চট্টগ্রাম শহরে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক দিনের এই সফরে এখানকার চারটি প্রকল্প উদ্বোধন করে চট্টগ্রামবাসীর ঈদের আনন্দ বহুগুণ বাড়িয়ে তোলেন তিনি। কেননা, প্রকল্পগুলোর জন্য এ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষা যেমন ছিল, তেমনি পেরিয়ে আসতে হয়েছে আন্দোলন-সংগ্রামের নানা পর্ব।


কর্ণফুলীর তৃতীয় সেতু
এরশাদ সরকারের আমলে কর্ণফুলী নদীর ওপর নির্মিত শাহ আমানত সেতুটি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-বান্দরবান—এ তিন জেলার যোগাযোগের বিশাল চাহিদার জন্য অপ্রতুল হয়ে উঠেছিল অনেক আগেই। পুরোনো সেতুটি যানবাহনের উত্তরোত্তর চাপে প্রায় অকেজো হয়ে পড়েছিল, অন্যদিকে প্রায় ৮০ বছর আগে নির্মিত কালুরঘাট সেতুটি বয়সের ভারে ন্যুব্জ। সব মিলিয়ে কর্ণফুলীর ওপর তৃতীয় সেতুটি অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। এ দাবি সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের কানে তুলতে সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন ইত্যাদি হেন কর্মসূচি পালন বাকি রাখেনি এ অঞ্চলের মানুষ। দেখা যাচ্ছে, ২০০৩ সাল থেকে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন নিয়ে টানাপোড়েন শুরু হয়। এ ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম চেম্বারের নেতারা ও তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর ভূমিকায় কাজ কিছুটা এগিয়েছিল।
আগ্রহী ডাচ প্রতিষ্ঠান ইন্টারব্রেটন এ সেতুর সম্ভাব্য নির্মাণব্যয় ধরেছিল ৫০০ কোটি টাকার মতো। এর মধ্যে প্রায় ২৭০ কোটি টাকা ডাচ সরকারের অনুদান ও বাকি অর্থ ঋণ হিসেবে পাওয়া যাবে বলে প্রতিশ্রুতি মিলেছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান না করে ইন্টারব্রেটন নিজেরাই ঠিকাদার নিয়োগ করায় সরকারের বহিঃসম্পদ বিভাগ (ইআরডি) প্রস্তাবটি নাকচ করে দেয়। অন্যদিকে তৎকালীন অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী সাইফুর রহমানের ছেলে নাসের রহমানের সঙ্গে আমীর খসরুর ব্যক্তিগত সম্পর্কের অবনতির কারণে সাইফুর রহমানের অনীহাই এ প্রকল্পের করুণ পরিণতির জন্য দায়ী বলে আলোচনা ছিল তখন রাজনৈতিক মহলে। আমাদের পক্ষে এর সত্যতা যাচাই করা অবশ্য সম্ভব হয়নি। এভাবে কয়েক বছর গড়িয়ে যাওয়ার পর সেতুটির জন্য কুয়েত সরকারের কাছে ঋণ-সহায়তার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এ পর্যায়ে সেতুর নির্মাণব্যয় ধরা হয় ৫৯০ কোটি টাকা। কুয়েত সরকার তার মধ্যে ৩৭২ কোটি টাকা ঋণ-সহায়তা দেয়। বিএনপি সরকারের শেষ দিকে ২০০৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
এ সময় পিলার সেতু হলে নদীর নাব্যতা নষ্ট হবে এবং এতে বন্দর হুমকির মুখে পড়বে বলে যুক্তি দেখিয়ে আন্দোলনে নামেন চট্টগ্রামের তৎকালীন মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী। তিনি ঝুলন্ত সেতু করার দাবি জানালে বিশেষজ্ঞদের একটি অংশও তাঁর পক্ষে অবস্থান নেয়। তবে ফোরাম ফর প্ল্যানড চিটাগংয়ের পক্ষ থেকে মাত্র চারটি পিলারের এ সেতু নদীর নাব্যতার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হবে না বলে মত প্রকাশ করা হয়। তাঁরা বরং নদীর নিয়মিত ড্রেজিংয়ের ওপর গুরুত্ব দেন। এই টানাপোড়েনের মধ্যে নির্মাণকাজ শুরু হলেও মূলত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই নির্মাণের বেশির ভাগ কাজ হয় এবং বর্তমান সরকারের আমলে তা সম্পন্ন হয়।
সেতুটি উদ্বোধন করার ফলে দক্ষিণ চট্টগ্রামের এক বিরাট অংশের সঙ্গে চট্টগ্রামের যোগাযোগের দ্বার প্রশস্ত হলো। কিন্তু ‘শেষ হয়েও হইল না শেষ’-এর মতো এখানেও বিরাট একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে যথাসময়ে সংযোগ (অ্যাপ্রোচ) সড়ক নির্মিত না হওয়া। আগে যেখানে শাহ আমানত সেতু দিয়ে ছয় হাজার যানবাহন চলাচল করত, সেখানে এখন শুরু থেকেই প্রায় ১৩ হাজার যানবাহন চলাচল করছে। সেতুর উভয় দিকে, অর্থাৎ একদিকে নগরের বহদ্দারহাট পর্যন্ত, অন্যদিকে মইজ্যারটেক থেকে পটিয়ার শান্তিরহাট পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিন যানজট ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। এভাবে চললে মাত্র কয়েক মিনিটে সেতু পারাপারের আনন্দ মিইয়ে যাবে অচিরেই। এখন নগরের বহদ্দারহাট পর্যন্ত ছয় লেনের সংযোগ সড়ক করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা সম্পন্ন হতে কমপক্ষে দেড় বছর সময় লাগবে। অথচ সেতু নির্মাণের সময় থেকেই সংযোগ সড়ক তৈরির কাজ শুরু হলে এ বিড়ম্বনায় পড়তে হতো না।
কর্ণফুলী নদীতে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আমরা চাই অবিলম্বে এ প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হোক, যাতে দেশের সম্পদ চট্টগ্রাম বন্দর কোনোভাবেই ঝুঁকির মুখে না পড়ে।

পিকিং পাওয়ার প্লান্ট
গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রায় সাড়ে ৭০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘পিকিং পাওয়ার প্লান্ট’ প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। প্রকল্পের কাজও প্রায় সম্পন্ন হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। প্রধানমন্ত্রী এর উদ্বোধন করলেন বটে, কিন্তু গ্যাস-সংকটের কারণে এটি নিয়মিত উৎপাদনে যেতে পারছে না এখন। এমনকি এই ব্যয়বহুল প্রকল্প হাতে নেওয়া আদৌ বাস্তবসম্মত ছিল কি না, সেই প্রশ্নটিও উঠছে। দেশে গ্যাস-সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছিল গত বিএনপি সরকারের আমল থেকেই। ৩৫০ মিলিয়ন ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে জাতীয় গ্রিড থেকে চট্টগ্রাম গ্যাস পায় ২১০-২২০ মিলিয়ন ঘনফুট। পর্যাপ্ত গ্যাসের অভাবে যেখানে রাউজান তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিট এবং শিকলবাহা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র পূর্ণ উৎপাদনে যেতে পারছে না, সেখানে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আরও ৩৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের জোগান দেওয়ার পরিকল্পনাটি কতটা দূরদর্শী, ভেবে দেখা দরকার। বলা হচ্ছে, এ বিদ্যুৎ-প্রকল্প দ্বৈত জ্বালানি (ডুয়েল-ফুয়েল) পদ্ধতির। অর্থাৎ, গ্যাস ছাড়া ফার্নেস অয়েল দিয়েও চালানো সম্ভব। কিন্তু ফার্নেস অয়েল মজুদ বা লোড-আনলোড করার কোনো ব্যবস্থা সেখানে এখনো গড়ে তোলা হয়নি। এর জন্য যে কর্মযজ্ঞ, তাও সময়সাপেক্ষ।
রমজান মাসকে সামনে রেখে কাফকোতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছিল। আগামী কিছুদিনের মধ্যে কাফকো চালু হলে সেখানে ৪৫ মিলিয়ন ঘনফুটের জোগান দিতে হবে। বোরো মৌসুমে সিইউএফএলকে দিতে হবে আরও ৪৮ মিলিয়ন ঘনফুট। সব মিলিয়ে গ্যাসের সংকট যেভাবে তীব্রতর হতে চলেছে, সেখানে পিকিং পাওয়ার প্লান্টের জন্য বাড়তি গ্যাসের সংস্থান যে অদূর ভবিষ্যতে হচ্ছে না, তা এখনই বলা যায়।

আদালত ভবন
ব্যস্ত নগরের ভেতর চমৎকার এক পাহাড়। সেই পাহাড়ে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত স্থাপত্যশৈলী নিয়ে আদালত ভবন গড়ে উঠেছিল ব্রিটিশ শাসনামলে। আদালত ভবনের কারণেই পাহাড়ের নাম কাছারি পাহাড়।
ভবনটি পুরোনো ও ঝুঁকিপূর্ণ—এ কারণে ভেঙে নতুন ভবন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ১৯৯৬-এর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। তখনই নগর পরিকল্পনাবিদ ও পরিবেশবাদীরা আপত্তি জানিয়ে ভবনটি সংস্কার করে ব্যবহারযোগ্য রেখে পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণের দাবি জানান। তৎকালীন মন্ত্রী মোশাররফ হোসেন পুরোনো ভবন সংরক্ষণের দাবি উপেক্ষা করে নতুন ভবন তৈরির পক্ষে অবস্থান নিলেও শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি সচেতন নাগরিক সমাজের আন্দোলন-সংগ্রামের মুখে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ আন্দোলনের যৌক্তিকতা অনুধাবন করেছিলেন বলে জানা যায়। তিনি সে সময় কয়েকবার পর্যবেক্ষক দলও পাঠিয়েছিলেন। ইতিমধ্যে সরকার পরিবর্তন হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তৎকালীন আইনসচিব পুরোনো ভবনকে ছেঁড়া জুতার সঙ্গে তুলনা করে এটি ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণের যুক্তি দিলে আন্দোলন আবার চাঙা হয়ে ওঠে। পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের নেতৃত্বে সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন, মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদির পর ২০০১ সালে তিনটি নাগরিক সংগঠন—ফোরাম ফর প্ল্যানড চিটাগং, চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতি ও বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট যৌথভাবে সরকারের বিরুদ্ধে ভবনটি পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা ও সংরক্ষণের জন্য উচ্চ আদালতে মামলা করে। এর মধ্যে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এলে বাণিজ্য ও পূর্তমন্ত্রী আদালত ভবন পরিদর্শন করে নাগরিক সমাজের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন।
২০০৪ সালে মামলার রায়ে পুরোনো ভবনটি সংস্কার ও নতুন ভবন প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেওয়া হয়। একই বছরে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। এভাবে পুরোনো আদালত ভবন রক্ষা পায় এবং নতুন ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। শেখ হাসিনা সম্প্রতি নতুন ভবনটি উদ্বোধন করেছেন। তবে নাগরিক সমাজ এ ব্যাপারে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তাদের মতে, সাযুজ্যহীন নতুন ভবন নির্মাণের ফলে পুরোনো ভবনের নান্দনিকতা ক্ষুণ্ন হয়েছে।

কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেড
বাখরাবাদ গ্যাসের সদর দপ্তর কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামে স্থানান্তর বা চট্টগ্রামের জন্য নতুন গ্যাস কোম্পানি করার দাবি উঠেছিল গত বিএনপি সরকারের আমলে। ব্যবসায়ীদের দাবি, এর ৯০-৯৫ শতাংশ গ্রাহক চট্টগ্রামের বলে কুমিল্লায় এর সদর দপ্তর থাকার যুক্তি নেই। এতে এখানকার ব্যবসায়ীদের সময়ক্ষেপণ, যোগাযোগের অসুবিধাসহ নানা জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এ দাবি জোরালো হলে উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান এর যৌক্তিকতা উপলব্ধি করে নতুন গ্যাস কোম্পানি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ত্বরান্বিত করেন। ইতিমধ্যে সরকার বদল হলে আঞ্চলিকতার প্রশ্নে স্থানীয় জনসাধারণের নানা কর্মসূচির মুখে এটি বাধাগ্রস্ত হয়। এদিকে চট্টগ্রামে এ নিয়ে জনমত গড়ে ওঠে। তৎকালীন মেয়র ও আওয়ামী লীগের নেতা মহিউদ্দিন চৌধুরীও এই দাবির সমর্থনে জোরালো ভূমিকা নেন। অবশেষে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে সর্বস্তরের মানুষ।
আগেই বলেছি, চারটি প্রকল্পের উদ্বোধন ঘোষণা করে চট্টগ্রামবাসীর ঈদের আনন্দ বাড়িয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে চারটি প্রকল্পের বাস্তবায়নে যেসব জটিলতা, সিদ্ধান্তহীনতা, দীর্ঘসূত্রতা ও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে মাঝখানে হারিয়ে গেছে অনেক বছর। ভবিষ্যতে এ ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়ার সময় এ দিকটি ভেবে দেখতে বলি। এই দীর্ঘ উত্থান-পতনময় কালপর্বে পূর্ববর্তী সরকারসহ নাগরিক সমাজের অবদান ও ভূমিকার কথাও স্মরণ করা উচিত।
এসব উন্নয়নের সুফল প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এখনো যে অবকাঠামোগত অসুবিধা রয়ে গেছে, তা দ্রুত নিরসনের উদ্যোগ নিতে হবে। ‘ঈদ-উপহার’-এর আনন্দ অমলিন রাখতে হলে সেটাই জরুরি।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.