স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ছাড়া গণতন্ত্র চলতে পারে কি?-সংসদে অনির্ধারিত আলোচনা

গত মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে অনির্ধারিত আলোচনায় কয়েকজন সাংসদ অধিকার ক্ষুণ্ন হওয়ার অভিযোগ এনে প্রথম আলোসহ কয়েকটি জাতীয় পত্রিকার কঠোর সমালোচনা করেছেন। এমনকি তাঁরা পত্রিকাগুলোর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া এবং সংসদে সম্পাদকদের তলব করারও দাবি জানিয়েছেন।


তাঁদের এই ক্ষোভ ও দাবির বিষয়টি দেখতে হবে জনপ্রতিনিধিদের অধিকার এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার আলোকে। মনে রাখতে হবে, আইন অনুযায়ী সাংসদেরা যেমন নির্দিষ্ট অধিকার ভোগ করেন, তেমনি সংবাদমাধ্যমেরও বাংলাদেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কিছু অধিকার আছে, যা কোনো গণতান্ত্রিক দেশই অগ্রাহ্য করতে পারে না।
সাংসদেরা সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এনেছেন, তার দুটি দিক আছে। একটি তথ্যগত, অন্যটি মতামতভিত্তিক। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অসত্য ও ভিত্তিহীন হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ক্ষুব্ধ হতেই পারেন। সে ক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধরা প্রতিবাদ পাঠালে সংশ্লিষ্ট পত্রিকা তা ছাপতে বাধ্য। এ ছাড়া তাঁরা প্রতিকারের জন্য প্রেস কাউন্সিল বা আদালতেরও আশ্রয় নিতে পারেন। কিন্তু সেসব না করে আইনপ্রণেতারা জাতীয় সংসদে যে ঢালাও অভিযোগ এনেছেন, তা সংবাদমাধ্যম ও সংবাদকর্মীদের প্রতি হুমকি ছাড়া কিছু নয়।
এ ক্ষেত্রে কার্যপ্রণালিবিধি রক্ষিত হয়েছে কি না, সেটিও প্রশ্ন। কেননা, সাংসদেরা যেখানে এসব অভিযোগ করেছেন, সেখানে গিয়ে সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের জবাব দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সংসদের কার্যপ্রণালিবিধিতে বলা হয়েছে, ‘স্পীকার বা মন্ত্রীকে পূর্বেই না জানাইয়া কোন সদস্য কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মানহানিকর বা দোষারোপমূলক অভিযোগ আনয়ন করিতে পারিবেন না।’ আবার স্পিকার যদি মনে করেন, এসব অভিযোগ সংসদের জন্য মানহানিকর বা জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট নয়, তাহলে তিনি তা উত্থাপন করতে নাও দিতে পারেন। গত মঙ্গলবার একাধিক দৈনিক পত্রিকার বিরুদ্ধে সাংসদদের ঢালাও অভিযোগ উত্থাপনের ক্ষেত্রে তা সংসদের কার্যবিধি প্রণালি মানা হয়নি বলেই আমাদের ধারণা। দেশে ও জনজীবনে সমস্যার অন্ত নেই। সেসব বিষয়ে আলোচনা না করে সাংসদেরা কেন সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগলেন, তা আমাদের বোধগম্য নয়।
সাংসদদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট। রাগ বা অনুরাগের বশবর্তী না হয়ে প্রথম আলো বরাবর বস্তুনিষ্ঠ খবর ও মতামত পরিবেশন করে থাকে। গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাক্ ও ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষায় আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। হরতাল-অবরোধ বর্জনসহ ধ্বংসাত্মক রাজনীতির বিপক্ষে এবং কার্যকর সংসদের পক্ষে সব সময়ই প্রথম আলো দৃঢ় ভূমিকা রেখে আসছে। আমরা সব সময়ই সংসদকে কার্যকর হিসেবে দেখতে চাই। অতএব, গণতন্ত্র বা জাতীয় সংসদকে হেয়প্রতিপন্ন করার যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা শুধু অমূলক নয়, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতও।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জাতীয় সংসদ ও সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা পরস্পরের পরিপূরক, বিপরীতমুখী নয়। টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় উভয়েরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক মঙ্গলবার একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে যথার্থই বলেছেন, ‘কোনো অবস্থায় সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করা যাবে না। আবার সংবাদমাধ্যমকেও তার বস্তুনিষ্ঠ ভূমিকা বজায় রাখতে হবে।’ সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে আমরা বরাবর এই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে থাকি। সংবাদমাধ্যমের সমালোচনাকে বৈরী হিসেবে দেখা ঠিক নয়। গণতন্ত্রের বিকাশে ভিন্নমত পোষণের পূর্ণ সুযোগ থাকতে হবে। সংবাদমাধ্যমকে প্রতিপক্ষ না ভেবে সাংসদেরা তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবেন—সেটাই দেশবাসী প্রত্যাশা করে।
আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই, স্বাধীন সংবাদমাধ্যম হিসেবে দায়িত্বপালনে প্রথম আলো কখনো পিছপা হবে না, সত্য প্রকাশে থাকবে অবিচল; গণতন্ত্রের বিকাশ, মানবাধিকার রক্ষা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় রাখবে বলিষ্ঠ ভূমিকা।

No comments

Powered by Blogger.