স্মরণ-খ্যাপা পাগলাকে নিয়ে প্যাঁচাল by হাসান শাহরিয়ার
আমরা ২০০১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর তারিখটি স্মরণ করব এবং তখন দেখব, আমাদের মনে পড়ছে যে এদিন আমরা নাটকের একজন খ্যাপা পাগলাকে হারিয়েছিলাম। এবং আমরা এও লক্ষ করব, ক্যালেন্ডারের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে এখন ২০১০ সাল, অনেক দিন হয়ে গেলেও আমরা তাঁকে ভুলতে পারি না।
আমরা মনে করতে পারি, আমরা শুনেছি, মানুষ মরে গেলে পচে যায়, কিন্তু এখন লক্ষ করলে দেখব, এস এম সোলায়মান মরে গেছেন, কিন্তু তাঁর শিল্পদেহে পচন ধরেনি।
আমরা, যারা অনেক পরে এই থিয়েটার মহল্লায় এসেছি, তারা শুনেছি এস এম সোলায়মানের একাগ্রতার কথা, শুনেছি সেই দিনগুলোর কথা, যখন তিনি পড়ে থাকতেন টিএসসির মহড়াকক্ষে, যেখানে সব সময়ই তাঁর সামনে থাকত হারমোনিয়াম। সেই হারমোনিয়ামে তিনি একের পর এক সুর খুঁজে বেড়াতেন। থিয়েটার মানে যে কেবল মাসে এক-দুইটা শো করা নয়, সন্ধ্যায় মহড়াকক্ষে যেনতেনভাবে ছুটে এসে সংলাপ মুখস্থর পরীক্ষা দেওয়া নয়, সেটা প্রথম যাঁরা জানান দিয়েছিলেন, তাঁদের একজন বোধ করি এস এম সোলায়মান। আমাদের স্মরণ হবে, টিএসসি মুখরিত ছিল খ্যাপা পাগলা সোলায়মানের খ্যাপামিতে। এবং তখন আমরা লক্ষ করব, আজও, এই বৈরী পরিবেশেও, কিছু কিছু খ্যাপা পাগলা থিয়েটার অঙ্গনে তাঁদের খ্যাপামি অব্যাহত রেখেছেন।
থিয়েটার চায় পাগলামি, এস এম সোলায়মান প্রাণপণে করেছিলেন পাগলামি। পাগলেরা শান্ত থাকে না, শান্ত থাকলে তাকে আর পাগল বলা যায় না, পাগলদের হতে হয় খ্যাপাটে। কিন্তু খ্যাপা পাগলা সোলায়মান শুরুই করলেন এত উঁচু স্কেলে যে, তাঁর সঙ্গের অনেকেই আর অন্তরায় পৌঁছে সুর মেলাতে পারলেন না। তাঁর শুরুটা ছিল পঁচাত্তরের পর। তারপর তো একটানা বৈধ-অবৈধ সামরিক শাসন। আর কে পারে খ্যাপা পাগলার দৌড় থামাতে! মঞ্চ-রাজপথ সব জায়গায় দাপটের সঙ্গে লাফ-ঝাঁপ দিতে দিতে এগোতে থাকলেন এই খ্যাপা পাগলা। কিন্তু এরপর আমরা বুঝতে পারি, সবকিছুর হিসাব এত সহজে শেষ হয় না, এবং, অতঃপর, এও বুঝতে পারি, বাংলাদেশের থিয়েটার কেবল নন্দন চায় না, মনন চায় না। তাঁকে কেবল পাগল হলেই চলে না, কলা (আর্ট) জানলেই চলে না, তাঁকে কলার সঙ্গে কৌশলও জানতে হয়। আর সেই সাংগঠনিক কৌশল করতে মহড়াকক্ষ লাগে না, হারমোনিয়াম লাগে না, নাট্যকার-নির্দেশক-কুশীলব কিছুই লাগে না। তাই আমরা এবার আর কেবল শুনতেই পাই না, দেখতেও পাই, তার সহযাত্রীরা, যাঁরা গানের অন্তরায় পৌঁছে আর সুর মেলাতে পারছিলেন না, তাঁরা খ্যাপা পাগলার খ্যাপামি বন্ধ করার সব উদ্যোগ নেন সাংগঠনিকভাবে।
আমরা স্মরণ করতে পারব, একসময় এস এম সোলায়মান অন্তর্মুখী হয়ে পড়েছিলেন, নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন সব কোলাহল থেকে, হয়ে পড়েছিলেন নিঃসঙ্গ। তাঁর এই নিঃসঙ্গতা, স্পষ্টতই ছাপ ফেলতে শুরু করেছিল তাঁর সৃজনশীল কর্মে। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের দু-দুবারের সেক্রেটারি জেনারেল, খ্যাপা পাগলা, কেবল মঞ্চেই নয়, দেশের সব ধরনের রাজনৈতিক সংকটেও যিনি ছিলেন রাজপথে, তাঁর হঠাৎ করেই অর্ন্তমুখী হতে, কোলাহল থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে ‘ইচ্ছে’ হলো কেন? এবং আমরা বুঝতে পারি, যখন ‘ইচ্ছে’ শব্দটির মানে হয় ‘বাধ্য’ হওয়া, তখন একজন শিল্পীর জীবনে নানা ধরনের সংকট দেখা দেয়। এই সংকট সময়কালকে কেউ কেউ তাঁর ‘অভিমানকাল’ হিসেবে দেখাতে চেয়েছিলেন, এবং তখন আমরা লক্ষ করব, একজন শিল্পীর বেশভূষা, বৈচিত্র্যময় জীবন, এবং তাঁর নানা নেশাপ্রীতি নিয়ে এন্তার গল্প-কাহিনি প্রচারিত হলেও, তাঁর নাট্যকর্মের উৎকর্ষ বা অপকর্ষ সম্বন্ধে কোনো কথা বলতে কেউ রাজি ছিলেন না। নানা কিছু লক্ষ করে আমরা বুঝতে পারব, ইংরেজিতে যাকে বলা হয়, কনসপাইরেসি অব সাইলেন্স, সেই কনসপাইরেসি অব সাইলেন্সই সোলায়মানকে নিয়ে থিয়েটার স্টাবলিশমেন্টের লোকজন করে যাচ্ছিলেন। নীরব উপেক্ষার মাধ্যমে সোলায়মানের শিল্পকর্মকে সর্বসাধারণের সচেতন মনোযোগ থেকে আড়াল করে রাখাই ছিল এঁদের অভিপ্রায়। কিন্তু আমরা পরক্ষণেই দেখি, একজন শিল্পীর ‘সাসটেইন ইফোর্ট’ এবং কতটুকু ‘সাসটেইন ইফোর্ট’ থাকলে শিল্পভূমিতে নিঃসঙ্গ একজন শিল্পী কেবল নব্বইয়ের দশকের নয়, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের থিয়েটারের জন্য কোর্ট মার্শাল আর গোলাপজান-এর মতো প্রধান দুটি নাটক উপহার দিতে পারেন! এস এম সোলায়মান যা দিলেন, আমরা কেবল তা-ই পেলাম। কিন্তু নিঃসঙ্গতা বেছে নিতে বাধ্য হওয়ার কারণে যা যা দিয়ে যেতে পারলেন না, সেগুলো পাওয়ার উপায় কী?
আমরা তাঁর মৃত্যু-পরবর্তী সময়েও কনসপাইরেসি অব সাইলেন্সের সঙ্গে পরিচিত হই এবং দেখি, তাঁর স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য খোদ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন তাঁর নামে যে পদক দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল, তা যখন জীবিত সোলায়মানের চেয়ে মৃত সোলায়মানকে আরও শক্তিধর করে তরুণ প্রজন্মকে খেপিয়ে তুলছিল এবং মঞ্চগুলো উজ্জীবিত হতে শুরু করেছিল নয়া প্রজন্মের নয়া থিয়েটারওয়ালাদের সৃষ্টিকর্ম দিয়ে, ঠিক তখনই খ্যাপা পাগলার নামাঙ্কিত পদক দেওয়া বন্ধ হয়ে গেল। এবং হয়তো বা পদকটিও ‘অভিমান’ করতে শিখে গেছে।
কিন্তু আমরা দেখতে পাই, এই অভিমানকে সমূলে উপড়ে ফেলতেই সোলায়মান-উত্তর কিছু খ্যাপা পাগলা তাঁকে নিয়ে অনিয়মিতভাবে রঙ্গমাতন সোলায়মান মেলার আয়োজন করতে শুরু করে। এবং প্রথম দুই বছর নয়া প্রজন্মের খ্যাপা পাগলারা এ নিয়ে উৎসবে মেতে ওঠে। সামনের বছরগুলোতে আবারও খ্যাপা পাগলারা খেপে উঠবে এই ‘রঙ্গমাতন সোলায়মান মেলা’ নিয়ে এবং আমরা দেখব, যেকোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক পদক দেওয়ার চেয়ে এই ‘রঙ্গমাতন’ অনেক বেশি মানুষকে জীবন্ত করে তুলছে।
আমরা, যারা অনেক পরে এই থিয়েটার মহল্লায় এসেছি, তারা শুনেছি এস এম সোলায়মানের একাগ্রতার কথা, শুনেছি সেই দিনগুলোর কথা, যখন তিনি পড়ে থাকতেন টিএসসির মহড়াকক্ষে, যেখানে সব সময়ই তাঁর সামনে থাকত হারমোনিয়াম। সেই হারমোনিয়ামে তিনি একের পর এক সুর খুঁজে বেড়াতেন। থিয়েটার মানে যে কেবল মাসে এক-দুইটা শো করা নয়, সন্ধ্যায় মহড়াকক্ষে যেনতেনভাবে ছুটে এসে সংলাপ মুখস্থর পরীক্ষা দেওয়া নয়, সেটা প্রথম যাঁরা জানান দিয়েছিলেন, তাঁদের একজন বোধ করি এস এম সোলায়মান। আমাদের স্মরণ হবে, টিএসসি মুখরিত ছিল খ্যাপা পাগলা সোলায়মানের খ্যাপামিতে। এবং তখন আমরা লক্ষ করব, আজও, এই বৈরী পরিবেশেও, কিছু কিছু খ্যাপা পাগলা থিয়েটার অঙ্গনে তাঁদের খ্যাপামি অব্যাহত রেখেছেন।
থিয়েটার চায় পাগলামি, এস এম সোলায়মান প্রাণপণে করেছিলেন পাগলামি। পাগলেরা শান্ত থাকে না, শান্ত থাকলে তাকে আর পাগল বলা যায় না, পাগলদের হতে হয় খ্যাপাটে। কিন্তু খ্যাপা পাগলা সোলায়মান শুরুই করলেন এত উঁচু স্কেলে যে, তাঁর সঙ্গের অনেকেই আর অন্তরায় পৌঁছে সুর মেলাতে পারলেন না। তাঁর শুরুটা ছিল পঁচাত্তরের পর। তারপর তো একটানা বৈধ-অবৈধ সামরিক শাসন। আর কে পারে খ্যাপা পাগলার দৌড় থামাতে! মঞ্চ-রাজপথ সব জায়গায় দাপটের সঙ্গে লাফ-ঝাঁপ দিতে দিতে এগোতে থাকলেন এই খ্যাপা পাগলা। কিন্তু এরপর আমরা বুঝতে পারি, সবকিছুর হিসাব এত সহজে শেষ হয় না, এবং, অতঃপর, এও বুঝতে পারি, বাংলাদেশের থিয়েটার কেবল নন্দন চায় না, মনন চায় না। তাঁকে কেবল পাগল হলেই চলে না, কলা (আর্ট) জানলেই চলে না, তাঁকে কলার সঙ্গে কৌশলও জানতে হয়। আর সেই সাংগঠনিক কৌশল করতে মহড়াকক্ষ লাগে না, হারমোনিয়াম লাগে না, নাট্যকার-নির্দেশক-কুশীলব কিছুই লাগে না। তাই আমরা এবার আর কেবল শুনতেই পাই না, দেখতেও পাই, তার সহযাত্রীরা, যাঁরা গানের অন্তরায় পৌঁছে আর সুর মেলাতে পারছিলেন না, তাঁরা খ্যাপা পাগলার খ্যাপামি বন্ধ করার সব উদ্যোগ নেন সাংগঠনিকভাবে।
আমরা স্মরণ করতে পারব, একসময় এস এম সোলায়মান অন্তর্মুখী হয়ে পড়েছিলেন, নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন সব কোলাহল থেকে, হয়ে পড়েছিলেন নিঃসঙ্গ। তাঁর এই নিঃসঙ্গতা, স্পষ্টতই ছাপ ফেলতে শুরু করেছিল তাঁর সৃজনশীল কর্মে। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের দু-দুবারের সেক্রেটারি জেনারেল, খ্যাপা পাগলা, কেবল মঞ্চেই নয়, দেশের সব ধরনের রাজনৈতিক সংকটেও যিনি ছিলেন রাজপথে, তাঁর হঠাৎ করেই অর্ন্তমুখী হতে, কোলাহল থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে ‘ইচ্ছে’ হলো কেন? এবং আমরা বুঝতে পারি, যখন ‘ইচ্ছে’ শব্দটির মানে হয় ‘বাধ্য’ হওয়া, তখন একজন শিল্পীর জীবনে নানা ধরনের সংকট দেখা দেয়। এই সংকট সময়কালকে কেউ কেউ তাঁর ‘অভিমানকাল’ হিসেবে দেখাতে চেয়েছিলেন, এবং তখন আমরা লক্ষ করব, একজন শিল্পীর বেশভূষা, বৈচিত্র্যময় জীবন, এবং তাঁর নানা নেশাপ্রীতি নিয়ে এন্তার গল্প-কাহিনি প্রচারিত হলেও, তাঁর নাট্যকর্মের উৎকর্ষ বা অপকর্ষ সম্বন্ধে কোনো কথা বলতে কেউ রাজি ছিলেন না। নানা কিছু লক্ষ করে আমরা বুঝতে পারব, ইংরেজিতে যাকে বলা হয়, কনসপাইরেসি অব সাইলেন্স, সেই কনসপাইরেসি অব সাইলেন্সই সোলায়মানকে নিয়ে থিয়েটার স্টাবলিশমেন্টের লোকজন করে যাচ্ছিলেন। নীরব উপেক্ষার মাধ্যমে সোলায়মানের শিল্পকর্মকে সর্বসাধারণের সচেতন মনোযোগ থেকে আড়াল করে রাখাই ছিল এঁদের অভিপ্রায়। কিন্তু আমরা পরক্ষণেই দেখি, একজন শিল্পীর ‘সাসটেইন ইফোর্ট’ এবং কতটুকু ‘সাসটেইন ইফোর্ট’ থাকলে শিল্পভূমিতে নিঃসঙ্গ একজন শিল্পী কেবল নব্বইয়ের দশকের নয়, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের থিয়েটারের জন্য কোর্ট মার্শাল আর গোলাপজান-এর মতো প্রধান দুটি নাটক উপহার দিতে পারেন! এস এম সোলায়মান যা দিলেন, আমরা কেবল তা-ই পেলাম। কিন্তু নিঃসঙ্গতা বেছে নিতে বাধ্য হওয়ার কারণে যা যা দিয়ে যেতে পারলেন না, সেগুলো পাওয়ার উপায় কী?
আমরা তাঁর মৃত্যু-পরবর্তী সময়েও কনসপাইরেসি অব সাইলেন্সের সঙ্গে পরিচিত হই এবং দেখি, তাঁর স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য খোদ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন তাঁর নামে যে পদক দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল, তা যখন জীবিত সোলায়মানের চেয়ে মৃত সোলায়মানকে আরও শক্তিধর করে তরুণ প্রজন্মকে খেপিয়ে তুলছিল এবং মঞ্চগুলো উজ্জীবিত হতে শুরু করেছিল নয়া প্রজন্মের নয়া থিয়েটারওয়ালাদের সৃষ্টিকর্ম দিয়ে, ঠিক তখনই খ্যাপা পাগলার নামাঙ্কিত পদক দেওয়া বন্ধ হয়ে গেল। এবং হয়তো বা পদকটিও ‘অভিমান’ করতে শিখে গেছে।
কিন্তু আমরা দেখতে পাই, এই অভিমানকে সমূলে উপড়ে ফেলতেই সোলায়মান-উত্তর কিছু খ্যাপা পাগলা তাঁকে নিয়ে অনিয়মিতভাবে রঙ্গমাতন সোলায়মান মেলার আয়োজন করতে শুরু করে। এবং প্রথম দুই বছর নয়া প্রজন্মের খ্যাপা পাগলারা এ নিয়ে উৎসবে মেতে ওঠে। সামনের বছরগুলোতে আবারও খ্যাপা পাগলারা খেপে উঠবে এই ‘রঙ্গমাতন সোলায়মান মেলা’ নিয়ে এবং আমরা দেখব, যেকোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক পদক দেওয়ার চেয়ে এই ‘রঙ্গমাতন’ অনেক বেশি মানুষকে জীবন্ত করে তুলছে।
No comments