দক্ষিণাঞ্চলে জলাবদ্ধতা-জোয়ারাধারের বিকল্প নেই by রানা আব্বাস ও অলক পাল
২ জুন টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট বা টিআরএম (জোয়ারাধার) প্রকল্পকে কেন্দ্র করে যশোরের অভয়নগরের কালিশাকুল গ্রামে জনরোষে পড়ে আহত হলেন জাতীয় সংসদের হুইপ শেখ আবদুল ওহাব, অভয়নগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মালেকসহ অন্তত ৩০-৪০ জন। কিন্তু এমনটি হওয়ার কথা ছিল না।
কারণ এ জোয়ারাধার স্থানীয় জনগণের উদ্ভাবন। জোয়ারাধার চালু করার জন্য স্থানীয় জনগণকে দীর্ঘ সংগ্রাম করতে হয়েছে। তাহলে এখন তারা কেন এ জোয়ারাধার প্রকল্পের বিরোধিতা করছে?
আশির দশকের শেষে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার বিল ডাকাতিয়ায় জলাবদ্ধতা প্রকট হয়ে ওঠে। স্থানীয় জনগণ জলাবদ্ধতা দূর করতে পোল্ডার ও বাঁধ কেটে দেয়। এর ফলে বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে নির্বিঘ্নে পানি প্রবেশ করায় সাময়িকভাবে জলাবদ্ধতার পরিমাণ কিছুটা বাড়ে। কিন্তু জোয়ারের পানির সঙ্গে পলির কারণে জমি উঁচু হওয়ায় এবং ভাটার পানি নামার সময় নদী প্রাকৃতিকভাবেই খনন হয়। এতে পানি নেমে গিয়ে জলাবদ্ধতা কমে যায়। অপরদিকে, একই সময়ে বিলের মধ্যে পলি জমে উঁচু হতে থাকে। এতে বিল ডাকাতিয়া-সংশ্লিষ্ট হামকুড়া নদীর নাব্যতা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে স্থানীয় জনগণ ইতিমধ্যে জলাবদ্ধ হয়ে পড়া বিল ভায়নায় একইভাবে পোল্ডার কেটে জলাবদ্ধতা দূর করার দাবি তোলে। এর মধ্যে সরকার এডিবির অর্থায়নে ১৯৯৪ সালে খুলনা-যশোর নিষ্কাশন পুনর্বাসন প্রকল্প (কেজেডিআরপি) গ্রহণ করে। এ প্রকল্প শেষ হয় ২০০২ সালে।
জনগণের দাবি বাস্তবায়নে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) না নিলে স্থানীয় জনগণ সংগঠিত হয়ে ১৯৯৭ সালে নিজেরাই পোল্ডার কেটে বিল ভায়নায় জোয়ারাধারের ব্যবস্থা করে। কিন্তু বেড়িবাঁধ কেটে ফেলার অভিযোগে পাউবো ‘সরকারি সম্পদের ক্ষতি করার অভিযোগে’ শত শত লোকের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা করে। পরে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন আন্দোলনকারীদের পক্ষে আইনি লড়াইয়ে নামেন। টানা চার বছর আইনি লড়াই চলার সময়ই বিল ভায়নায় চলতে থাকে জোয়ারাধার। এ সময়ের মধ্যে বিল ভায়নায় প্রায় ৬০০ হেক্টর জমি পলি পড়ে উঁচু হয়। প্রায় ৭০ হাজার হেক্টর জমির জলাবদ্ধতা দূর হয়।
বিল ভায়নায় জোয়ারাধার সফল হওয়ার পর ২০০২ সালে প্রথম সরকারি উদ্যোগে জোয়ারাধার প্রকল্প চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয় বিল কেদারিয়ায়। বিল কেদারিয়ায় জোয়ারাধার চালু থাকে ২০০৪-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত। এরপর জোয়ারাধার প্রকল্প কিছুদিন বন্ধ থাকে। ২০০৫ সালের অক্টোবর মাসের টানা বর্ষণে পুনরায় ওই এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। ২০০৬ সালের চার দফা অতি বর্ষণে জলাবদ্ধতা প্রকট আকার ধারণ করে। এ সময় পানিবন্দী হয়ে পড়ে অভয়নগর, মনিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলার দেড় শতাধিক গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ। পানি সরানোর দাবিতে ‘ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটি’র নেতৃত্বে শুরু হয় আন্দোলন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৬ সালের ৩০ নভেম্বর পূর্ব বিল খুকশিয়ায় চালু করা হয় জোয়ারাধার। চার বছরের মেয়াদে জোয়ারাধার প্রকল্প শুরু হলেও পাউবো এখনো পূর্ব বিল খুকশিয়ায় জোয়ারাধার শেষ করতে পারেনি। পূর্ব খুকশিয়ার পরই পাউবোর জোয়ারাধার চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে বিল কপালিয়ায়। এই বিল কপালিয়ায় ২ জুন রণক্ষেত্রে পরিণত হয় অভয়নগরের কালিশাকুল গ্রাম।
জলাবদ্ধতা নিরসন তথা নদীর নাব্যতা রক্ষার্থে জোয়ারাধার বা টিআরএমের কোনো বিকল্প নেই। এটা ওই অঞ্চলের জনগণ ভালোভাবেই জানে। কিন্তু যে বিলে জোয়ারাধার চালু থাকে সে বিলে সাধারণত কোনো ধরনের ফসল ফলানো যায় না। এ সময় বিলের কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা, কিন্তু তা সঠিকভাবে দেওয়া হয় না। কৃষকদের অভিযোগ, যে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে সেটাও নিতান্ত কম। এ ছাড়া ক্ষতিপূরণ পেতে হলে একজন কৃষককে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়। ক্ষতিপূরণ দিতে পাউবো নানা টালবাহানা করে। ক্ষতিপূরণের টাকা কৃষকেরা দ্রুত পেতে চান। কিন্তু তাঁরা তা ঠিকমতো পাচ্ছেন না বলে তাঁদের ধারণা হচ্ছে, সরকার তাঁদের ন্যায্য পাওনা ক্ষতিপূরণ না দিয়েই এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে ফেললে তাঁরা আর কখনোই ক্ষতিপূরণ পাবেন না। এ কারণেই তারা এ প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধা দিচ্ছে। তা ছাড়া, প্রচুর খাসজমির অবৈধ দখলদার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জোয়ারাধার চালু করার বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত গরিব কৃষকদের উসকে দিচ্ছেন। আর জোয়ারাধার নিয়ে নোংরা রাজনীতি করছেন কিছু স্থানীয় রাজনীতিক।
জোয়ারাধার শুধু জলাবদ্ধতা দূরীকরণের ক্ষেত্রেই কার্যকর নয়, জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজনেও এটি ভীষণ কার্যকর। জাতিসংঘের আন্তসরকার জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত প্যানেলের (আইপিসিসি) চতুর্থ মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৫০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল সমুদ্রে তলিয়ে যাবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ একটি গবেষণা চালিয়ে দেখেছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাজনিত সমস্যা মোকাবিলায় জোয়ারাধার যথেষ্ট কার্যকর। কারণ, জোয়ারাধারের মাধ্যমে এ পর্যন্ত ওই অঞ্চলে প্রায় ৩১ বর্গকিলোমিটার এলাকা এক মিটার উঁচু করা সম্ভব হয়েছে। শুধু হরি-টেকা নদীর অববাহিকাতেই উঁচু হয়েছে প্রায় দুই হাজার হেক্টর জমি। পাশাপাশি ওই অঞ্চলের আর একটি সমস্যা—ভূমি দেবে যাওয়া বা নিচু হয়ে যাওয়ার বিপরীতেও জোয়ারাধারকে কাজে লাগানো যেতে পারে।
বর্তমান জোয়ারাধার কার্যকর করা হচ্ছে ক্ষুদ্র পরিসরে (একটি বিলে)। এভাবে এ অঞ্চলের অর্ধশতাধিক বিলে তিন-চার বছর মেয়াদে (নানা অব্যবস্থাপনার কারণে সেটিও এখন সম্ভব হচ্ছে না) জোয়ারাধারের মাধ্যমে জমি উঁচু করতে প্রায় ৫০-১০০ বছর লেগে যাবে। কিন্তু আইপিসিসির অনুমান সত্য ধরে নিলে আমাদের হাতে এত সময় নেই। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাজনিত সমস্যা থেকে বাঁচতে হলে আমাদের অল্প সময়ে অধিক জমি উঁচু করতে হবে। এ কারণে একটি বিলে না করে এক সঙ্গে অনেকগুলো বিল কিংবা একেকটি অববাহিকা ধরে (রিভার বেসিনওয়াইজ) জোয়ারাধার চালু করতে পারলে এটি অধিক কার্যকর হতে পারে। অবশ্য এর ভালো-মন্দ উভয় দিকই রয়েছে। এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন। সেই সঙ্গে জোয়ারাধার নিয়ে একটি সমন্বিত পরিকল্পনাও প্রয়োজন। জোয়ারাধার জনগণের আবিষ্কার। তাই জনগণকে সম্পৃক্ত রেখেই এ পদ্ধতিটির ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত করা প্রয়োজন। জমির ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রক্রিয়াটি আরও স্বচ্ছ ও সহজতর করে পুরো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে জোয়ারাধার দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়া জরুরি।
রানা আব্বাস: পরিবেশবিষয়ক গবেষক, রিভারাইন পিপলের সঙ্গে যুক্ত।
rana_geographer@yahoo.com
ড. অলক পাল: সভাপতি, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
alak1973@yahoo.com
আশির দশকের শেষে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার বিল ডাকাতিয়ায় জলাবদ্ধতা প্রকট হয়ে ওঠে। স্থানীয় জনগণ জলাবদ্ধতা দূর করতে পোল্ডার ও বাঁধ কেটে দেয়। এর ফলে বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে নির্বিঘ্নে পানি প্রবেশ করায় সাময়িকভাবে জলাবদ্ধতার পরিমাণ কিছুটা বাড়ে। কিন্তু জোয়ারের পানির সঙ্গে পলির কারণে জমি উঁচু হওয়ায় এবং ভাটার পানি নামার সময় নদী প্রাকৃতিকভাবেই খনন হয়। এতে পানি নেমে গিয়ে জলাবদ্ধতা কমে যায়। অপরদিকে, একই সময়ে বিলের মধ্যে পলি জমে উঁচু হতে থাকে। এতে বিল ডাকাতিয়া-সংশ্লিষ্ট হামকুড়া নদীর নাব্যতা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে স্থানীয় জনগণ ইতিমধ্যে জলাবদ্ধ হয়ে পড়া বিল ভায়নায় একইভাবে পোল্ডার কেটে জলাবদ্ধতা দূর করার দাবি তোলে। এর মধ্যে সরকার এডিবির অর্থায়নে ১৯৯৪ সালে খুলনা-যশোর নিষ্কাশন পুনর্বাসন প্রকল্প (কেজেডিআরপি) গ্রহণ করে। এ প্রকল্প শেষ হয় ২০০২ সালে।
জনগণের দাবি বাস্তবায়নে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) না নিলে স্থানীয় জনগণ সংগঠিত হয়ে ১৯৯৭ সালে নিজেরাই পোল্ডার কেটে বিল ভায়নায় জোয়ারাধারের ব্যবস্থা করে। কিন্তু বেড়িবাঁধ কেটে ফেলার অভিযোগে পাউবো ‘সরকারি সম্পদের ক্ষতি করার অভিযোগে’ শত শত লোকের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা করে। পরে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন আন্দোলনকারীদের পক্ষে আইনি লড়াইয়ে নামেন। টানা চার বছর আইনি লড়াই চলার সময়ই বিল ভায়নায় চলতে থাকে জোয়ারাধার। এ সময়ের মধ্যে বিল ভায়নায় প্রায় ৬০০ হেক্টর জমি পলি পড়ে উঁচু হয়। প্রায় ৭০ হাজার হেক্টর জমির জলাবদ্ধতা দূর হয়।
বিল ভায়নায় জোয়ারাধার সফল হওয়ার পর ২০০২ সালে প্রথম সরকারি উদ্যোগে জোয়ারাধার প্রকল্প চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয় বিল কেদারিয়ায়। বিল কেদারিয়ায় জোয়ারাধার চালু থাকে ২০০৪-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত। এরপর জোয়ারাধার প্রকল্প কিছুদিন বন্ধ থাকে। ২০০৫ সালের অক্টোবর মাসের টানা বর্ষণে পুনরায় ওই এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। ২০০৬ সালের চার দফা অতি বর্ষণে জলাবদ্ধতা প্রকট আকার ধারণ করে। এ সময় পানিবন্দী হয়ে পড়ে অভয়নগর, মনিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলার দেড় শতাধিক গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ। পানি সরানোর দাবিতে ‘ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটি’র নেতৃত্বে শুরু হয় আন্দোলন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৬ সালের ৩০ নভেম্বর পূর্ব বিল খুকশিয়ায় চালু করা হয় জোয়ারাধার। চার বছরের মেয়াদে জোয়ারাধার প্রকল্প শুরু হলেও পাউবো এখনো পূর্ব বিল খুকশিয়ায় জোয়ারাধার শেষ করতে পারেনি। পূর্ব খুকশিয়ার পরই পাউবোর জোয়ারাধার চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে বিল কপালিয়ায়। এই বিল কপালিয়ায় ২ জুন রণক্ষেত্রে পরিণত হয় অভয়নগরের কালিশাকুল গ্রাম।
জলাবদ্ধতা নিরসন তথা নদীর নাব্যতা রক্ষার্থে জোয়ারাধার বা টিআরএমের কোনো বিকল্প নেই। এটা ওই অঞ্চলের জনগণ ভালোভাবেই জানে। কিন্তু যে বিলে জোয়ারাধার চালু থাকে সে বিলে সাধারণত কোনো ধরনের ফসল ফলানো যায় না। এ সময় বিলের কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা, কিন্তু তা সঠিকভাবে দেওয়া হয় না। কৃষকদের অভিযোগ, যে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে সেটাও নিতান্ত কম। এ ছাড়া ক্ষতিপূরণ পেতে হলে একজন কৃষককে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়। ক্ষতিপূরণ দিতে পাউবো নানা টালবাহানা করে। ক্ষতিপূরণের টাকা কৃষকেরা দ্রুত পেতে চান। কিন্তু তাঁরা তা ঠিকমতো পাচ্ছেন না বলে তাঁদের ধারণা হচ্ছে, সরকার তাঁদের ন্যায্য পাওনা ক্ষতিপূরণ না দিয়েই এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে ফেললে তাঁরা আর কখনোই ক্ষতিপূরণ পাবেন না। এ কারণেই তারা এ প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধা দিচ্ছে। তা ছাড়া, প্রচুর খাসজমির অবৈধ দখলদার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জোয়ারাধার চালু করার বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত গরিব কৃষকদের উসকে দিচ্ছেন। আর জোয়ারাধার নিয়ে নোংরা রাজনীতি করছেন কিছু স্থানীয় রাজনীতিক।
জোয়ারাধার শুধু জলাবদ্ধতা দূরীকরণের ক্ষেত্রেই কার্যকর নয়, জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজনেও এটি ভীষণ কার্যকর। জাতিসংঘের আন্তসরকার জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত প্যানেলের (আইপিসিসি) চতুর্থ মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৫০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল সমুদ্রে তলিয়ে যাবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ একটি গবেষণা চালিয়ে দেখেছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাজনিত সমস্যা মোকাবিলায় জোয়ারাধার যথেষ্ট কার্যকর। কারণ, জোয়ারাধারের মাধ্যমে এ পর্যন্ত ওই অঞ্চলে প্রায় ৩১ বর্গকিলোমিটার এলাকা এক মিটার উঁচু করা সম্ভব হয়েছে। শুধু হরি-টেকা নদীর অববাহিকাতেই উঁচু হয়েছে প্রায় দুই হাজার হেক্টর জমি। পাশাপাশি ওই অঞ্চলের আর একটি সমস্যা—ভূমি দেবে যাওয়া বা নিচু হয়ে যাওয়ার বিপরীতেও জোয়ারাধারকে কাজে লাগানো যেতে পারে।
বর্তমান জোয়ারাধার কার্যকর করা হচ্ছে ক্ষুদ্র পরিসরে (একটি বিলে)। এভাবে এ অঞ্চলের অর্ধশতাধিক বিলে তিন-চার বছর মেয়াদে (নানা অব্যবস্থাপনার কারণে সেটিও এখন সম্ভব হচ্ছে না) জোয়ারাধারের মাধ্যমে জমি উঁচু করতে প্রায় ৫০-১০০ বছর লেগে যাবে। কিন্তু আইপিসিসির অনুমান সত্য ধরে নিলে আমাদের হাতে এত সময় নেই। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাজনিত সমস্যা থেকে বাঁচতে হলে আমাদের অল্প সময়ে অধিক জমি উঁচু করতে হবে। এ কারণে একটি বিলে না করে এক সঙ্গে অনেকগুলো বিল কিংবা একেকটি অববাহিকা ধরে (রিভার বেসিনওয়াইজ) জোয়ারাধার চালু করতে পারলে এটি অধিক কার্যকর হতে পারে। অবশ্য এর ভালো-মন্দ উভয় দিকই রয়েছে। এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন। সেই সঙ্গে জোয়ারাধার নিয়ে একটি সমন্বিত পরিকল্পনাও প্রয়োজন। জোয়ারাধার জনগণের আবিষ্কার। তাই জনগণকে সম্পৃক্ত রেখেই এ পদ্ধতিটির ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত করা প্রয়োজন। জমির ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রক্রিয়াটি আরও স্বচ্ছ ও সহজতর করে পুরো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে জোয়ারাধার দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়া জরুরি।
রানা আব্বাস: পরিবেশবিষয়ক গবেষক, রিভারাইন পিপলের সঙ্গে যুক্ত।
rana_geographer@yahoo.com
ড. অলক পাল: সভাপতি, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
alak1973@yahoo.com
No comments