অপহরণের ১৬ বছর-কেমন আছে ‘কল্পনা’র পাহাড় by জোবাইদা নাসরীন

কল্পনা চাকমা। হিল উইমেনস ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ঠিক যেন ছিলেন প্রতিবাদের শাণিত এক তরবারি। সেই শাণ ঠিকই আঁচ ফেলেছিল প্রতিপক্ষের ওপর। তারা বুঝতে পেরেছিল, সেই প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে চিরতরে থামিয়ে দিতে হবে। তাই তাঁকে অপহরণের পরিকল্পনা করা হয়। তারিখ ১৯৯৬ সালের ১২ জুন।


বাংলাদেশের মানুষ তখন জাতীয় নির্বাচনের আমেজে মত্ত। আর সেই মুহূর্তেই পাহাড়ি এলাকা বাঘাইছড়ির লাল্লাঘোনা গ্রামে চলচিল সেই নারকীয় অপহরণের ঘটনা। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবেই এ ঘটনার জন্য বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের আগের রাতটিকেই বেছে নেওয়া হয়। দেশের ও বিদেশের কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা কল্পনা অপহরণের সঙ্গে সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্যের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেলেও সরকার এ বিষয়ে নীরব ভূমিকায় ছিল। ১৬ বছর ধরে ‘নিঁখোজ’ থাকা কল্পনার অপহরণ-পরবর্তী কোনো সংবাদ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। কিন্তু পাহাড়ের সঙ্গেই যে মিশে আছে সেই লড়িয়ে কল্পনার লড়াই ও অপহরণের ইতিহাস।
এই ১৬ বছরে পাল্টেছে অনেক কিছু। বদলেছে পাহাড়ের রাজনীতি। পাহাড়ি রাজনীতি বিভক্ত হয়েছে জনসংহতি সমিতি এবং ইউপিডিএফের তরীতে। হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়। কল্পনা অপহরণের পরের বছরই শান্তির পায়রা উড়িয়ে ঘটা করে তৎকালীন ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকার আর পাহাড়ের রাজনৈতিক দল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি করেছিল ‘শান্তি চুক্তি’। কল্পনা অপহরণের পর আদিবাসী নেতারা এ বিষয়ে আন্দোলন গড়ে তুললেও অপহরণের পরের বছরই হওয়া চুক্তিতে কল্পনার বিষয়টিসহ আদিবাসী নারীদের বিষয় তেমন গুরুত্ব পায়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে তৈরি হওয়া আন্দোলনে জ্যোতিপ্রভা লারমা, উমে মংসহ অনেক আদিবাসী নারী স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও শান্তি চুক্তিতে আদিবাসী নারীর নিরাপত্তার বিষয়ে কোনো ধারা ছিল না। তাই পাহাড়ে স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়াইয়ের অগ্রগামী সৈনিক কল্পনা এখন অনেকটাই স্মৃতি।
কল্পনা নেই। কিন্তু কেমন আছে এখন সেই কল্পনার পাহাড় আর পাহাড়ি মানুষেরা? যে পাহাড়ে জুলুম, নির্যাতনের বিরুদ্ধে কল্পনা লড়েছিল। কল্পনা তোমাকে বলছি, তোমার প্রিয় জুম পাহাড়ের অনেকটাই দখল করেছে রাবার আর তামাক। এখনো শান্তি চুক্তির শর্ত মোতাবেক সব সেনা ক্যাম্প তুলে নেওয়া হয়নি। এখনো চুক্তির শর্ত অনুযায়ী পাহাড়িদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা হয়নি। আজও ভূমিহারা পাহাড়িরা তাদের জায়গাজমি ফেরত পায়নি। আজও তোমার পাহাড়ের কোল থেকেই পাওয়া যায় ধর্ষিত সুজাতার লাশ। এখনো বাংলাদেশের অন্য কোনো জেলায় না হলেও পাহাড়ের তিন জেলার বিভিন্ন জায়গায় বাস থামিয়ে চেকিং করা হয়। অন্যদিকে ঢাকাই শাড়িতে এখন পিনন-খাদির নকশা। কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং ‘বিউটিফুল বাংলাদেশ’-এ আদিবাসীদের উপস্থাপন করা হলেও সাংবিধানিক স্বীকৃতির সময়ে সরকার বলল, ‘বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই।’ কী এক অদ্ভুত কারণে আজও ভূমি কমিশনের কাজ আগাতে পারছে না! শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন না করলেও এখনো সরকারের মুখে আছে শান্তি চুক্তি করার অহং।
জাতীয় নির্বাচনের আর অল্প বাকি। তাই আবারও সরকারি দলের নেতাদের মুখে শান্তি চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের ফুলঝুরি। আবারও নিশ্চয়ই দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের ইশতেহারে থাকবে আদিবাসীদের জন্য ‘অনেক কিছু’ করার প্রতিশ্রুতি। আবারও আশ্বাস বিক্রির প্রতিযোগিতা। ভোটারদের কাছে বিশ্বাসী হয়ে ওঠার চেষ্টা। শান্তি চুক্তির প্রায় ১৫ বছরে দুই সরকারের সঙ্গে নানামুখী দেনদরবার কম হয়নি। তাই চুক্তি স্বাক্ষরকারী অপর পক্ষ অর্থাৎ জনসংহতি সমিতির নেতারাও হতাশ। না, পাহাড়ে সেই কাঙ্ক্ষিত শান্তি আসেনি, বরং অশান্তির নতুন নতুন দুয়ার তৈরি হয়েছে। আর সরকার নিয়মিতই সরকারি কর্মকর্তাদের সেখানে পাঠাচ্ছে শাস্তিমূলক বদলি হিসেবে। রাষ্ট্রের কাছে পাহাড় এখনো আন্দামান আর রোবেন দ্বীপের মতো? পাহাড়ের এই বিরাজমান অবস্থায় কল্পনাদের কতটা প্রয়োজন, তা সহজেই বোঝা যায়। তাই তো মনে পড়ে তাকে। কল্পনার লড়াইয়ের জায়গাগুলো ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাহাড়ে স্বায়ত্তশাসন, আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্রে বিরাজমান পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শের বিরুদ্ধে তার ছিল শক্ত অবস্থান। কল্পনা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করত পাহাড়ি নারীর স্বায়ত্তশাসন পাহাড়ের স্বায়ত্তশাসনেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। নিজ চাকমা সমাজ, বাঙালি সমাজে পিতৃতান্ত্রিক শোষণ ও রাষ্ট্রীয় জাতিগত দেমাগের বিরুদ্ধে তার অবস্থান ছিল অত্যন্ত সুদৃঢ়। কিন্তু এ দেশে প্রতিবাদী মানুষের টিকে থাকা সহজ নয়। আর যদি সে হয় আদিবাসী, নারী আর ধর্মীয় সংখ্যালঘু, তাহলে তো কথাই নেই।
কল্পনা বন্ধু আমাদের। ১৬ বছরের ব্যবধানেও পাহাড়ের দিকে তাকালেই যেন তোমার ছবি দেখি। তোমার চিঠি বারবার পড়ি। পাহাড়ে তোমার স্লোগানের প্রতিধ্বনি শুনি। প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের প্রতিধ্বনি শুনি।
জোবাইদা নাসরীন: সহকারী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পিএইচডি গবেষক, ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য।
zobaidanasreen@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.