সাদাকালো-বাংলাদেশের স্বার্থে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তন জরুরি by আহমদ রফিক
সমস্যার শুরু আজকের নয়। কয়েক দশক আগে বার্মার (মিয়ানমার) থেকে তাদের হঠাৎ অনুপ্রবেশ এবং শরণার্থী হিসেবে তাদের থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়ার পর যত ঝামেলার সূত্রপাত। কিছু সময় পরই দেখা গেল, রোহিঙ্গাদের নিয়ে রাজনীতি শুরু হয়ে গেছে। এর সূচনায় বিএনপি।
মিয়ানমারের এই রক্ষণশীল মুসলমান সম্প্রদায়কে ব্যবহার করতে স্থায়ী ব্যবস্থা হলো। এদের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে রাজনৈতিক প্রচার, অস্ত্র-প্রশিক্ষণ, অর্থের জোগান দেওয়া- সব কিছুতেই ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য।
শরণার্থী তো স্থায়ী বাসিন্দা হতে পারে না। মিয়ানমারের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, সেখানকার সম্প্রদায়গত সমস্যা- সব কিছুর ফলে রোহিঙ্গাদের সীমান্ত অতিক্রম করে টেকনাফ, রামু, বান্দরবান এলাকায় বসবাস শুরু। এতে মদদ জুগিয়েছে পশ্চিমা সাহায্য সংস্থা। নিশ্চয়ই নেপথ্যে উদ্দেশ্য ছিল। মিয়ানমারের সামরিক শাসকরা তখন কট্টর ইঙ্গ-মার্কিনবিরোধী- সম্ভবত চীনা সহযোগিতায়।
পশ্চিমা শক্তির বরাবরের লক্ষ্য মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে শায়েস্তা করে সেখানে তাদের পছন্দসই সরকার বসানো। এ ক্ষেত্রে সু চি হয়ে গেলেন তাদের তুরুপের তাস। আর সে জন্য সু চির কপালে যত লাঞ্ছনা, কারাবরণ ইত্যাদি। এখানে রয়েছে বিশ্ব রাজনীতির খেলা, মূলত পশ্চিমা বিশ্বের। মিয়ানমারকে মার্কিনিদের হাতের মুঠোয় আনার উদ্দেশ্য একটাই- চীনের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য ভূ-রাজনৈতিক অনুকূল অবস্থা তৈরি। সে জন্য বঙ্গোপসাগরসহ ভারত মহাসাগরে মার্কিন নৌবহর বৃদ্ধির ঘোষণাও সম্প্রতি শোনা গেল।
রোহিঙ্গা শরণার্থীরা ওই বিশাল রাজনৈতিক দাবার ছকে ছোট একটি ঘুঁটি- হলেই বা কী? সময়বিশেষে ছোট-বড়রও ভূমিকা হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমাদের গণতন্ত্রী জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকদের এসব দিকে বড় একটা মনোযোগ দেখা যায় না। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের রাজনৈতিক গুরুত্ব বুঝতে চাইলে বাংলাদেশ সরকার তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে তাৎক্ষণিক আলোচনা অব্যাহত রাখা ও চাপ সৃষ্টি করার নীতি গ্রহণ করতে পারত।
এদের নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। ওদের অস্ত্রধারী হওয়া, ইসলামী জঙ্গিদের সঙ্গে আঁতাত ও তাদের শিবিরে তরুণদের জঙ্গিপনার প্রশিক্ষণ ইত্যাদি ঘটনাও সরকারের টনক নড়ায়নি। সে সময় রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে সরকারকে সতর্ক করে লিখেছিলাম ভবিষ্যৎ সমস্যার কথা উল্লেখ করে। বিভিন্নজনের সেসব লেখা হিসেবে আনা দূরে থাক, আফগান যুদ্ধশেষে কয়েক শ রোহিঙ্গা তালেবান যোদ্ধা বাংলাদেশে ফিরে আসার পরও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
বাংলাদেশ সরকার বোধ হয় ভুলে গিয়েছিল, এখনো ভুলেই আছে যে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক এবং বাংলাদেশে শরণার্থী সেজে স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার মতলবে আছে। হরকাতুল জিহাদের ধর্মান্ধ জঙ্গিদের সঙ্গে ওঠাবসা সত্ত্বেও কেন যে এদের ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে সরকার নিরাসক্ত, তা বুঝে ওঠা দায়। বিএনপি-জামায়াত জোটের সরকার এ বিষয়ে তাদের স্বার্থের কারণে চুপচাপ থাকতে পারে; কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার একই পন্থা নেবে কেন? তাদের নীতি স্বদেশি স্বার্থভিত্তিক হবে না কেন?
বিশেষ করে যখন এ তথ্য অজানা নয় যে এদের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত ও ইসলামী সংগঠনগুলোর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, রয়েছে হরকাতুল জিহাদের মতো জঙ্গিদের সঙ্গে। ওরা ভবিষ্যতে বিএনপি-জামায়াত জোটের ভোটবাক্স হতে পারে; কিন্তু আওয়ামী লীগের কখনোই নয়। তা ছাড়া যে আওয়ামী লীগ সরকার ইসলামী জঙ্গিদের হিংসাত্মক তৎপরতা দমনে কঠোর ভূমিকা নিয়েছে, তারা কেন রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে নির্বিকার?
আমরা সংগত কারণে আশঙ্কা করছি যে ক্রমবর্ধমান রোহিঙ্গা শরণার্থীদল ভবিষ্যতে গণতন্ত্রী, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্য ছোটখাটো হলেও সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। এদের ভূমিকা কোনো দিক থেকেই বাংলাদেশের জন্য সদর্থক হবে না- থাকবে দুষ্ট ক্ষত হয়ে, ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠীর সমর্থক হয়ে এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাতে খেলার মতো ছোট একটি দাবার ঘুঁটি হয়ে।
তারা নানাভাবে সীমান্ত-সংলগ্ন চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিবেশ দূষিত করতে থাকবে। ইতিমধ্যে সেসবের এন্তার লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে। ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না যে এদের সংখ্যা এখন কয়েক লাখ (কারো মতে চার লক্ষাধিক), যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে যেমন অনিয়ন্ত্রিত জন্মহারে, তেমনি নতুন অনুপ্রবেশে। মিয়ানমার সরকার তাদের ফেরত নেওয়ার বিষয়ে মোটেই আগ্রহী নয়, যেমন পাকিস্তান আগ্রহী নয় স্বঘোষিত পাকিস্তানি নাগরিক বিহারিদের ফেরত নিতে। এদের সংখ্যাও দ্রুত বেড়ে চলেছে। এদেরও অধিকাংশ প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির চক্করে ঘুরপাক খাচ্ছে, যেমন রোহিঙ্গা শরণার্থী।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের বিষয়ে অনাগ্রহের কারণ রাজনৈতিক ও সামাজিক। দিন কয়েক আগে মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চলে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সহিংসতা থেকে এ সমস্যার চরিত্র বোঝা যায়। এ সহিংসতা ওখানকার রাখাইন ও রোহিঙ্গা অর্থাৎ বৌদ্ধ ও মুসলমানদের মধ্যে। অহিংস বৌদ্ধরা এতই সহিংস হয়ে উঠেছে যে সে হিংসায় স্থানীয় রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পুড়ছে, লাশের সংখ্যা বাড়ছে, শিক্ষায়তনে আগুন দেওয়া হচ্ছে। অবস্থা এমনই গুরুতর যে স্থানীয় আরাকান সরকারকে সান্ধ্য আইন জারি করতে হয়েছে। সর্বশেষ খবরে জরুরি অবস্থা জারি।
আর এদিকে সহিংসতার কারণে নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চলে নতুন করে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের চেষ্টা চলছে। এ অনুপ্রবেশের ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। অর্থাৎ অব্যাহত বিশৃঙ্খলায় নতুন মাত্রা যোগ হবে। এ আশঙ্কা শুধু আমার নয়, সম্ভবত রাজনীতি-সচেতন প্রতিটি নাগরিকের। আর সীমান্তরক্ষা বাহিনীর তো বটেই।
খবরে প্রকাশ, উখিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ (বিজিবি) অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিনিদ্র পাহারায় রত। আর ওই সীমান্তের এক বাংলাদেশি বাসিন্দার উদ্বেগও তাৎপর্যপূর্ণ। তার ভাষায়- 'মিয়ানমার থেকে আবার যদি অনুপ্রবেশ ঘটে, তাহলে আমাদের এই ছোট দেশটির বারটা বাজবে। এমনিতেই কমপক্ষে চার লাখ অবৈধ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গার জ্বালায় আমরা অতিষ্ঠ। তার ওপর যদি আবার নতুন করে অনুপ্রবেশ ঘটে, তাহলে আমাদের অর্থনীতি ও সমাজজীবনে ব্যাপক নেতিবাচক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।
শুধু 'নেতিবাচক পরিস্থিতি' নয়- অঞ্চলবিশেষে বিশৃঙ্খলা ও নয়া রাজনৈতিক সামাজিক মেরুকরণ পর্বের সূচনা ঘটবে। যেমন ঘটেছে পূর্ববর্তী অনুপ্রবেশের কারণে। দৈনিক কাগজের শিরোনাম উদ্ধার করেই বলতে হয়, 'অপরাধের আখড়া রোহিঙ্গা বসতি'/'নাগালের মধ্যেই ইয়াবা, চাইলে অস্ত্রও মেলে'। মিয়ানমার সীমান্ত থেকে ফিরে দুই সাংবাদিক জানান : 'বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরের কাছে ধরা পড়েছিলেন মিয়ানমার থেকে আসা দুই নারী। তাঁদের গন্তব্য ছিল কক্সবাজার শহর।'
স্থানীয় সূত্রগুলোর মতে, 'রোহিঙ্গা'রা এখন বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে মাদক চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশ সরকারের উদারতার সুযোগে এ দেশে আশ্রয় নিয়ে তাদের বসতিগুলোকেও ইয়াবাসহ নানা রকম মাদকের আখড়া বানিয়েছে তারা।' '...রোহিঙ্গাদের ঘিরে টেকনাফ এলাকায় মাদক ব্যবসা জমিয়ে তুলেছে স্থানীয় প্রভাবশালী চক্র।... দেশি-বিদেশি অবৈধ অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গেও এরা জড়িত।'
'সরকারি উদারতা'র কারণ কি রোহিঙ্গারা মুসলমান বলে? তা এভাবে যদি সরকারি উদারতার প্রসার অব্যাহত থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ মাদকরাজ্য হিসেবে চিহ্নিত হবে লাতিন আমেরিকার কলম্বিয়ার মতো। মাদক উৎপাদন না করেও মাদকরাজ্য। একদিকে মিয়ানমার, অন্যদিকে দীর্ঘ ভারতীয় সীমান্ত- যেদিক থেকে আসছে ফেনসিডিল, হেরোইনসহ নানা জাতের মাদক-সম্ভার। কী বিপদেই না আছি আমরা। পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও রেহাই নেই। সুশাসনের অভাবে চারদিক থেকেই সমস্যা। বাদ যাচ্ছে না সমুদ্রসীমান্তও।
বিশ্বস্ত সূত্রের খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা নানা অবৈধ কর্ম ও সামাজিক অপরাধই নয়, আন্তর্জাতিক অপরাধচক্রের সঙ্গেও জড়িত। বাংলাদেশের পূর্ব-দক্ষিণ অঞ্চলে সামাজিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করছে এরা। একদিকে মাদক, অন্যদিকে অস্ত্র ব্যবসা ইত্যাদির মাধ্যমে রোহিঙ্গারা অপরাধী জনগোষ্ঠীতে পরিণত হচ্ছে। এদের সঙ্গে যোগসাজশ অসাধু প্রভাবশালী মহল, রাজনীতিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের।
তদুপরি এরা সামাজিক সংগঠন তৈরি করে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের মদদদাতা বিদেশি এনজিও তথা দাতাগোষ্ঠী। তারা এদের স্থায়ী বসতির জন্য সামাজিক-রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে চলেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশি দক্ষিণপন্থী ও ইসলামী রাজনৈতিক নেতাদের কারো কারো চেষ্টা- দলীয় স্বার্থে তাদের ভোটার বানানো। একবার ভোটার হওয়া মানে নাগরিকত্বের সনদ পাওয়া।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের বোঝা দরকার, এ ক্ষেত্রে নির্বিকার-নীরবতার সুযোগ নেই। একে তো এরা বিদেশি, উদ্বাস্তু এবং এমন দেশ থেকে আসা, যেখানে জীবন সামরিক সন্ত্রাসে অভ্যস্ত, সম্প্রদায়গত ও জাতিগত সহিংসতা নিত্যদিনের বিষয়। বহুসংখ্যক জাতিসত্তার সংঘাতে জর্জরিত মিয়ানমার। তাই তাদের বাস্তুচ্যুত করে সীমান্ত অতিক্রম করাতে পারলে শাসকগোষ্ঠী নিশ্চিন্ত।
এ অবস্থায় তাদের নিয়ে আমাদের মানবিক উদারতার অবকাশ নেই। অবিলম্বে রোহিঙ্গাদের তাদের স্বদেশে পাঠানোর জোরালো কূটনৈতিক প্রচেষ্টা শুরু করা দরকার। এ দেশে অভিবাসন নয়, ভোটার করা নয়, দরকার তাদের নিজ দেশে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা, প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আইনি সাহায্য নেওয়ার কথা ভাবতে হবে। এমনিতেই বাংলাদেশে সমস্যার কমতি নেই, সেখানে নতুন সমস্যা আমদানি করা আত্মঘাতী প্রচেষ্টাই হয়ে দাঁড়াবে। বর্তমান সরকারকে এই সত্যটা বুঝতে হবে।
লেখক : কবি, ভাষসৈনিক ও গবেষক
শরণার্থী তো স্থায়ী বাসিন্দা হতে পারে না। মিয়ানমারের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, সেখানকার সম্প্রদায়গত সমস্যা- সব কিছুর ফলে রোহিঙ্গাদের সীমান্ত অতিক্রম করে টেকনাফ, রামু, বান্দরবান এলাকায় বসবাস শুরু। এতে মদদ জুগিয়েছে পশ্চিমা সাহায্য সংস্থা। নিশ্চয়ই নেপথ্যে উদ্দেশ্য ছিল। মিয়ানমারের সামরিক শাসকরা তখন কট্টর ইঙ্গ-মার্কিনবিরোধী- সম্ভবত চীনা সহযোগিতায়।
পশ্চিমা শক্তির বরাবরের লক্ষ্য মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে শায়েস্তা করে সেখানে তাদের পছন্দসই সরকার বসানো। এ ক্ষেত্রে সু চি হয়ে গেলেন তাদের তুরুপের তাস। আর সে জন্য সু চির কপালে যত লাঞ্ছনা, কারাবরণ ইত্যাদি। এখানে রয়েছে বিশ্ব রাজনীতির খেলা, মূলত পশ্চিমা বিশ্বের। মিয়ানমারকে মার্কিনিদের হাতের মুঠোয় আনার উদ্দেশ্য একটাই- চীনের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য ভূ-রাজনৈতিক অনুকূল অবস্থা তৈরি। সে জন্য বঙ্গোপসাগরসহ ভারত মহাসাগরে মার্কিন নৌবহর বৃদ্ধির ঘোষণাও সম্প্রতি শোনা গেল।
রোহিঙ্গা শরণার্থীরা ওই বিশাল রাজনৈতিক দাবার ছকে ছোট একটি ঘুঁটি- হলেই বা কী? সময়বিশেষে ছোট-বড়রও ভূমিকা হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমাদের গণতন্ত্রী জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকদের এসব দিকে বড় একটা মনোযোগ দেখা যায় না। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের রাজনৈতিক গুরুত্ব বুঝতে চাইলে বাংলাদেশ সরকার তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে তাৎক্ষণিক আলোচনা অব্যাহত রাখা ও চাপ সৃষ্টি করার নীতি গ্রহণ করতে পারত।
এদের নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। ওদের অস্ত্রধারী হওয়া, ইসলামী জঙ্গিদের সঙ্গে আঁতাত ও তাদের শিবিরে তরুণদের জঙ্গিপনার প্রশিক্ষণ ইত্যাদি ঘটনাও সরকারের টনক নড়ায়নি। সে সময় রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে সরকারকে সতর্ক করে লিখেছিলাম ভবিষ্যৎ সমস্যার কথা উল্লেখ করে। বিভিন্নজনের সেসব লেখা হিসেবে আনা দূরে থাক, আফগান যুদ্ধশেষে কয়েক শ রোহিঙ্গা তালেবান যোদ্ধা বাংলাদেশে ফিরে আসার পরও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
বাংলাদেশ সরকার বোধ হয় ভুলে গিয়েছিল, এখনো ভুলেই আছে যে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক এবং বাংলাদেশে শরণার্থী সেজে স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার মতলবে আছে। হরকাতুল জিহাদের ধর্মান্ধ জঙ্গিদের সঙ্গে ওঠাবসা সত্ত্বেও কেন যে এদের ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে সরকার নিরাসক্ত, তা বুঝে ওঠা দায়। বিএনপি-জামায়াত জোটের সরকার এ বিষয়ে তাদের স্বার্থের কারণে চুপচাপ থাকতে পারে; কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার একই পন্থা নেবে কেন? তাদের নীতি স্বদেশি স্বার্থভিত্তিক হবে না কেন?
বিশেষ করে যখন এ তথ্য অজানা নয় যে এদের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত ও ইসলামী সংগঠনগুলোর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, রয়েছে হরকাতুল জিহাদের মতো জঙ্গিদের সঙ্গে। ওরা ভবিষ্যতে বিএনপি-জামায়াত জোটের ভোটবাক্স হতে পারে; কিন্তু আওয়ামী লীগের কখনোই নয়। তা ছাড়া যে আওয়ামী লীগ সরকার ইসলামী জঙ্গিদের হিংসাত্মক তৎপরতা দমনে কঠোর ভূমিকা নিয়েছে, তারা কেন রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে নির্বিকার?
আমরা সংগত কারণে আশঙ্কা করছি যে ক্রমবর্ধমান রোহিঙ্গা শরণার্থীদল ভবিষ্যতে গণতন্ত্রী, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্য ছোটখাটো হলেও সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। এদের ভূমিকা কোনো দিক থেকেই বাংলাদেশের জন্য সদর্থক হবে না- থাকবে দুষ্ট ক্ষত হয়ে, ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠীর সমর্থক হয়ে এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাতে খেলার মতো ছোট একটি দাবার ঘুঁটি হয়ে।
তারা নানাভাবে সীমান্ত-সংলগ্ন চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিবেশ দূষিত করতে থাকবে। ইতিমধ্যে সেসবের এন্তার লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে। ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না যে এদের সংখ্যা এখন কয়েক লাখ (কারো মতে চার লক্ষাধিক), যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে যেমন অনিয়ন্ত্রিত জন্মহারে, তেমনি নতুন অনুপ্রবেশে। মিয়ানমার সরকার তাদের ফেরত নেওয়ার বিষয়ে মোটেই আগ্রহী নয়, যেমন পাকিস্তান আগ্রহী নয় স্বঘোষিত পাকিস্তানি নাগরিক বিহারিদের ফেরত নিতে। এদের সংখ্যাও দ্রুত বেড়ে চলেছে। এদেরও অধিকাংশ প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির চক্করে ঘুরপাক খাচ্ছে, যেমন রোহিঙ্গা শরণার্থী।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের বিষয়ে অনাগ্রহের কারণ রাজনৈতিক ও সামাজিক। দিন কয়েক আগে মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চলে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সহিংসতা থেকে এ সমস্যার চরিত্র বোঝা যায়। এ সহিংসতা ওখানকার রাখাইন ও রোহিঙ্গা অর্থাৎ বৌদ্ধ ও মুসলমানদের মধ্যে। অহিংস বৌদ্ধরা এতই সহিংস হয়ে উঠেছে যে সে হিংসায় স্থানীয় রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পুড়ছে, লাশের সংখ্যা বাড়ছে, শিক্ষায়তনে আগুন দেওয়া হচ্ছে। অবস্থা এমনই গুরুতর যে স্থানীয় আরাকান সরকারকে সান্ধ্য আইন জারি করতে হয়েছে। সর্বশেষ খবরে জরুরি অবস্থা জারি।
আর এদিকে সহিংসতার কারণে নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চলে নতুন করে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের চেষ্টা চলছে। এ অনুপ্রবেশের ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। অর্থাৎ অব্যাহত বিশৃঙ্খলায় নতুন মাত্রা যোগ হবে। এ আশঙ্কা শুধু আমার নয়, সম্ভবত রাজনীতি-সচেতন প্রতিটি নাগরিকের। আর সীমান্তরক্ষা বাহিনীর তো বটেই।
খবরে প্রকাশ, উখিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ (বিজিবি) অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিনিদ্র পাহারায় রত। আর ওই সীমান্তের এক বাংলাদেশি বাসিন্দার উদ্বেগও তাৎপর্যপূর্ণ। তার ভাষায়- 'মিয়ানমার থেকে আবার যদি অনুপ্রবেশ ঘটে, তাহলে আমাদের এই ছোট দেশটির বারটা বাজবে। এমনিতেই কমপক্ষে চার লাখ অবৈধ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গার জ্বালায় আমরা অতিষ্ঠ। তার ওপর যদি আবার নতুন করে অনুপ্রবেশ ঘটে, তাহলে আমাদের অর্থনীতি ও সমাজজীবনে ব্যাপক নেতিবাচক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।
শুধু 'নেতিবাচক পরিস্থিতি' নয়- অঞ্চলবিশেষে বিশৃঙ্খলা ও নয়া রাজনৈতিক সামাজিক মেরুকরণ পর্বের সূচনা ঘটবে। যেমন ঘটেছে পূর্ববর্তী অনুপ্রবেশের কারণে। দৈনিক কাগজের শিরোনাম উদ্ধার করেই বলতে হয়, 'অপরাধের আখড়া রোহিঙ্গা বসতি'/'নাগালের মধ্যেই ইয়াবা, চাইলে অস্ত্রও মেলে'। মিয়ানমার সীমান্ত থেকে ফিরে দুই সাংবাদিক জানান : 'বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরের কাছে ধরা পড়েছিলেন মিয়ানমার থেকে আসা দুই নারী। তাঁদের গন্তব্য ছিল কক্সবাজার শহর।'
স্থানীয় সূত্রগুলোর মতে, 'রোহিঙ্গা'রা এখন বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে মাদক চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশ সরকারের উদারতার সুযোগে এ দেশে আশ্রয় নিয়ে তাদের বসতিগুলোকেও ইয়াবাসহ নানা রকম মাদকের আখড়া বানিয়েছে তারা।' '...রোহিঙ্গাদের ঘিরে টেকনাফ এলাকায় মাদক ব্যবসা জমিয়ে তুলেছে স্থানীয় প্রভাবশালী চক্র।... দেশি-বিদেশি অবৈধ অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গেও এরা জড়িত।'
'সরকারি উদারতা'র কারণ কি রোহিঙ্গারা মুসলমান বলে? তা এভাবে যদি সরকারি উদারতার প্রসার অব্যাহত থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ মাদকরাজ্য হিসেবে চিহ্নিত হবে লাতিন আমেরিকার কলম্বিয়ার মতো। মাদক উৎপাদন না করেও মাদকরাজ্য। একদিকে মিয়ানমার, অন্যদিকে দীর্ঘ ভারতীয় সীমান্ত- যেদিক থেকে আসছে ফেনসিডিল, হেরোইনসহ নানা জাতের মাদক-সম্ভার। কী বিপদেই না আছি আমরা। পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও রেহাই নেই। সুশাসনের অভাবে চারদিক থেকেই সমস্যা। বাদ যাচ্ছে না সমুদ্রসীমান্তও।
বিশ্বস্ত সূত্রের খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা নানা অবৈধ কর্ম ও সামাজিক অপরাধই নয়, আন্তর্জাতিক অপরাধচক্রের সঙ্গেও জড়িত। বাংলাদেশের পূর্ব-দক্ষিণ অঞ্চলে সামাজিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করছে এরা। একদিকে মাদক, অন্যদিকে অস্ত্র ব্যবসা ইত্যাদির মাধ্যমে রোহিঙ্গারা অপরাধী জনগোষ্ঠীতে পরিণত হচ্ছে। এদের সঙ্গে যোগসাজশ অসাধু প্রভাবশালী মহল, রাজনীতিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের।
তদুপরি এরা সামাজিক সংগঠন তৈরি করে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের মদদদাতা বিদেশি এনজিও তথা দাতাগোষ্ঠী। তারা এদের স্থায়ী বসতির জন্য সামাজিক-রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে চলেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশি দক্ষিণপন্থী ও ইসলামী রাজনৈতিক নেতাদের কারো কারো চেষ্টা- দলীয় স্বার্থে তাদের ভোটার বানানো। একবার ভোটার হওয়া মানে নাগরিকত্বের সনদ পাওয়া।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের বোঝা দরকার, এ ক্ষেত্রে নির্বিকার-নীরবতার সুযোগ নেই। একে তো এরা বিদেশি, উদ্বাস্তু এবং এমন দেশ থেকে আসা, যেখানে জীবন সামরিক সন্ত্রাসে অভ্যস্ত, সম্প্রদায়গত ও জাতিগত সহিংসতা নিত্যদিনের বিষয়। বহুসংখ্যক জাতিসত্তার সংঘাতে জর্জরিত মিয়ানমার। তাই তাদের বাস্তুচ্যুত করে সীমান্ত অতিক্রম করাতে পারলে শাসকগোষ্ঠী নিশ্চিন্ত।
এ অবস্থায় তাদের নিয়ে আমাদের মানবিক উদারতার অবকাশ নেই। অবিলম্বে রোহিঙ্গাদের তাদের স্বদেশে পাঠানোর জোরালো কূটনৈতিক প্রচেষ্টা শুরু করা দরকার। এ দেশে অভিবাসন নয়, ভোটার করা নয়, দরকার তাদের নিজ দেশে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা, প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আইনি সাহায্য নেওয়ার কথা ভাবতে হবে। এমনিতেই বাংলাদেশে সমস্যার কমতি নেই, সেখানে নতুন সমস্যা আমদানি করা আত্মঘাতী প্রচেষ্টাই হয়ে দাঁড়াবে। বর্তমান সরকারকে এই সত্যটা বুঝতে হবে।
লেখক : কবি, ভাষসৈনিক ও গবেষক
No comments