ধর্ম-মানুষকে প্রতারিত করা যাবে না by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

ইসলামের দৃষ্টিতে জনসাধারণকে প্রতারণা, ঠকানো ও ধোঁকাবাজি মানবতাবিরোধী অত্যন্ত ঘৃণ্য ও শরিয়তগর্হিত কর্মকাণ্ড, যা সমাজ ও সভ্যতাকে কলুষিত করে। কাউকে ফাঁকি দিয়ে কোনো কিছু করাই হচ্ছে প্রতারণা। মানুষের অসততা, কুপ্রবৃত্তি ও অসৎ বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে এটি খুবই নিকৃষ্ট ও মারাত্মক।


যেহেতু প্রতারণা মিথ্যার চেয়েও ভয়ংকর, তাই এটা ক্ষমার অযোগ্য গুরুতর অপরাধ। প্রতারণা মানে ঠকানো, শঠতা, ছলনা, ধোঁকা, ফাঁকিবাজি, বিশ্বাস ভঙ্গ করা, মাপে বা ওজনে কম দেওয়া, বেশি দামের জিনিসের সঙ্গে কম দামের বস্তু বা ভেজাল মিশিয়ে দেওয়া, জাল মুদ্রা চালিয়ে দেওয়া, মিথ্যা শপথ করে অন্যের ন্যায্য প্রাপ্য বা হক বিনষ্ট করা—এসবই মনুষ্যত্ববিধ্বংসী প্রবঞ্চনার শামিল। ইসলামের পরিভাষায় আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নির্দেশ অনুযায়ী কাউকে ন্যায্য প্রাপ্য ও অধিকার থেকে বঞ্চিত করাই প্রতারণা। ব্যবসা-বাণিজ্য, লেনদেন ছাড়াও মানুষ বিভিন্ন আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ডে পারস্পরিক প্রতারণা ও প্রবঞ্চনা করে থাকে। ইসলাম সামাজিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে সব বিষয়ে নানা ধরনের প্রতারণাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে মানবচরিত্র থেকে প্রতারণা বর্জনের জন্য বিশেষভাবে জোরালো তাগিদ দিয়েছে।
ইসলাম সত্যের সঙ্গে মিথ্যার মিশ্রণকে কখনোই সমর্থন করে না। মিথ্যাকে সত্যের আবরণ পরিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টাই হচ্ছে প্রতারণা। মিথ্যা দিয়ে যেমন বাস্তব ও প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল বা গোপন করা হয়, প্রতারণার মাধ্যমেও অনুরূপভাবে প্রকৃত অবস্থাকে আড়াল করে সাধারণ মানুষকে ঠকানো হয়। ইসলামের দৃষ্টিতে মানবজীবনে যা কিছু করণীয়, তার মধ্যে ফাঁকিবাজি ও প্রতারণার কোনো স্থান নেই। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তা’আলা নিষেধাজ্ঞা জারি করে ইরশাদ করেছেন, ‘আর তোমরা সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশ্রিত করবে না এবং তোমরা জেনেশুনে সত্য গোপন করবে না।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-৪২)
মুসলমানদের পারস্পরিক লেনদেন, চালচলন, আচার-ব্যবহার, জীবনাচরণ প্রভৃতি সম্পর্কে ইসলামের সুস্পষ্ট নীতিমালা রয়েছে। কোনো ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রতারণার মাধ্যমে যে জীবিকা উপার্জন করা হয় তা সম্পূর্ণরূপে হারাম বা নিষিদ্ধ। এসব নীতিমালা লঙ্ঘন করে ইসলামে প্রতারণার আশ্রয় নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যে ধরনের ক্রয়-বিক্রয় বা লেনদেনে অজ্ঞাত বা ধোঁকাবাজি হওয়ার বা এক পক্ষ কর্তৃক অন্য পক্ষকে ক্ষতিসাধনের সুযোগ থাকে, এমন প্রতারণামূলক ক্রয়-বিক্রয় করা ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ সম্পর্কে নবী করিম (সা.) সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘পণ্যের দোষত্রুটি না জানিয়ে বিক্রয় করা অবৈধ। দোষত্রুটি জানা থাকা সত্ত্বেও তা বলে না দেওয়া বা গোপন করা অবৈধ।’
মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা মুনাফিকের স্বভাব। যারা প্রতারণা করে, তারা প্রকৃত মুসলমান হতে পারে না। একসময় প্রতারকের মুখোশ খুলে যায়, তখন আর পালানোর পথ থাকে না। প্রতারকদের স্বরূপ উন্মোচন করে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ‘মন্দ পরিণাম তাদের জন্য যারা মাপে কম দেয়! যারা লোকের কাছ থেকে মেপে নেওয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করে এবং অন্যকে মেপে বা ওজন করে দেওয়ার সময় কম দেয়।’ (সূরা আল-মুতাফিফফীন, আয়াত ১-৩)
প্রতারক চক্র কখনো ঈমানদার বা বিশ্বাসী হতে পারে না। ধর্মভীরু হতে হলে তাকে নিশ্চয়ই প্রতারণামূলক আচরণ পরিহার করতে হবে। যে লোক প্রতারণা করে তাকে কেউ বিশ্বাস ও ভক্তি-শ্রদ্ধা করে না। এমনকি তার সঙ্গে কেউ লেনদেন বা ব্যবসা-বাণিজ্য করতে উৎসাহিত হয় না। সবার কাছে সে উপেক্ষিত ও ঘৃণিত ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হয়। ফলে প্রতারক ব্যক্তির সামাজিক মর্যাদা দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হয় এবং সে সমাজের সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীব হয়ে যায়। যারা প্রতারণামূলক অপরাধে জড়িয়ে পড়বে, তাদের ইসলামি আদর্শের গণ্ডিবহির্ভূত বলে গণ্য করা হয়েছে। নবী করিম (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করে সে আমাদের মুসলমানদের দলভুক্ত নয়।’ (মুসলিম)
একটি সুস্থ, সুন্দর, শান্তিময় ও সমৃদ্ধশালী সমাজ গঠনে প্রতারণা বর্জনের বিকল্প নেই। প্রতারণার ফলে প্রায়ই প্রতারিত ব্যক্তিরা বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। প্রতারণা মানবসমাজে পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি করে এবং বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধ ভূলুণ্ঠিত হয়। ব্যক্তি স্বার্থান্ধতা, অর্থলিপ্সা, আত্মসাৎ প্রবণতা, সীমাহীন ভোগ-বিলাসপ্রীতি যখন মানুষের বিবেক-বিবেচনাকে প্রচ্ছন্ন করে দেয়, তখন সে প্রতারণায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে। এভাবে পণ্য বিপণনের নামে হায় হায় কোম্পানি কর্তৃক নিরীহ ও নিরপরাধ ব্যক্তিকে ধোঁকা দিয়ে বিপদে ফেলা ও পরের হক নষ্ট করা ইসলামের দৃষ্টিতে মানবতাবিরোধী অত্যন্ত গর্হিত কাজ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নিজের কিংবা অন্যের কোনো ক্ষয়ক্ষতি করা যাবে না।’ (ইবনে মাজা)
মানবজীবনে প্রতারণার মাধ্যমে অন্যের অধিকার দারুণভাবে খর্ব হয়; নৈতিক, ধর্মীয় ও মানবিক মূল্যবোধ বিনষ্ট হয় এবং সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, যা মানুষের নেক আমলকে ধ্বংস করে তাকে জাহান্নামের পথে পরিচালিত করে। অথচ সমাজের সর্বত্রই মানুষের কথাবার্তায়, কাজকর্মে, লেনদেনে, ব্যবসা-বাণিজ্যে, বিদেশ গমনে এমনকি হজযাত্রায়ও ট্রাভেল এজেন্সির বিভিন্নভাবে প্রতারণার অপপ্রয়াস চলছে। তাই ইহকালীন ও পারলৌকিক অনিষ্ট সৃষ্টিকারী এহেন জঘন্য অমানবিক অপকর্ম থেকে ধর্মপ্রাণ মানুষকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে এবং একে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টিতে জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাইকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.