শুভ হালখাতা by রফিকুর রশীদ
‘আদিত্য’ মানে যে সূর্য, এ কথা আগে জানা ছিল না আদিত্যের। এই এক শব্দের অর্থ জানার জন্য তাকে আফ্রিকা থেকে এশিয়া, মানে বাংলাদেশে আসতে হয়েছে। না, না, আদিত্যর জন্ম এই বাংলাদেশেই, দাদু খুব মজা করে বলেন—বাংলাদেশের জন্ম যেখানে, সেই মুজিবনগরে। জন্মের পরপরই তাকে যেতে হয় প্রবাসে।
মা-বাবার কর্মস্থল আফ্রিকার জাম্বিয়ায়। সাত বছরের জীবনে আদিত্যের যেটুকু বেড়ে ওঠা, তা ওই জাম্বিয়ার রাজধানী লুসাকা শহরে। সেখানে বাঙালি পরিবার তো খুব বেশি নেই, আছে অল্প কিছু। তবু আদিত্যের বাংলা নামটা নিয়ে তাদের মধ্যে বেশ তর্ক হয়। কেউ কেউ মুখ ঘুরিয়ে বলেই ফেলে—কেমন যেন হিন্দুয়ানি নাম!
শুনতে খারাপ লাগে আদিত্যর। মাকে জিজ্ঞেস করে, হিন্দুয়ানি মানে কী, মা? প্রশ্ন শুনে তেড়ে ওঠে ওর মা—কোথায় শিখেছ ওই বাজে শব্দ?
আদিত্য কিছু বলার আগে এগিয়ে আসে ওর বাবা। মাথায় হাত বুলিয়ে হেসে ওঠে। তারপর ওর মাকে বলে,
ওকে ধমকানোর মানে হয়। শুনেছে নিশ্চয় কোনো বাঙালি পরিবারে। এত দূরে এসেও জাত-ধর্ম নিয়ে কী যে টানাটানি! আদিত্যকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে—তোর নাম তো আদিত্য মুরশিদ, সবাইকে বলিস।
এরপর শুরু হয় এক প্রশ্ন—‘আদিত্য’ মানে কী, বাবা?
আদিত্য মানে আদিত্য। মজা করে ওর বাবা। আদিত্য হেসে ফেলে ফিক করে। তখন ওর বাবা জানায়—এই নাম রেখেছে তোর দাদু। আগামী মাসে তো আমরা দেশে যাব, তখন দাদুভাইকে শুধাস।
দাদুভাই দিব্যি এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়েই জানিয়ে দেয় আদিত্য মানে সূর্য। ওদের সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফেরার পর একদিন খুব মজা করে এই আদিত্য নামের গল্প শোনান। বাংলা ভাষায় একই শব্দের কত রকম যে অর্থ হয়! সেসব কথা বিস্তারিত বলতে বলতে একসময় আদিত্যর মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলেন, তোমার নামটা, অদিতি হলে বেশ হয় বউমা!
এত দিন পর নিজের নতুন নামকরণ শুনে লজ্জা পায় আদিত্যের মা। মুখে কিছু না বলে শ্বশুরের মুখের দিকে চোখ তুলে তাকায়। আদিত্যের দাদু হা হা করে হাসতে হাসতে বলেন—অদিতি পুত্র হচ্ছে আদিত্য। এ তো আমার কথা নয় মা, এসব অনেক পুরোনো কথা।
আদিত্যের দাদু এমনই গল্পপ্রিয় মানুষ।
স্থানীয় এক কলেজে বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক ছিলেন। ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-সহকর্মী সবাইকে গল্প শুনিয়ে মজা পান। বিষয় একটা পেলেই হলো, সবকিছু নিয়ে গল্প তার জমানোই থাকে, সুযোগ পেলেই গল্পের লাটাই থেকে সুতো ছাড়েন। এই তো সেদিন পয়লা বৈশাখে নাতিকে ডেকে বললেন, চল যাই, হালখাতা করে আসি!
আদিত্য তো অবাক, কী খাতা?
দাদু হেসে আবারও বলেন—হালখাতা।
এরপর শুরু হয় হালখাতার গল্প। বাংলা নববর্ষের গল্প। পয়লা বৈশাখের বৈশাখী মেলার গল্প। বাঙালি হয়েও আদিত্য কখনো এসব দেখেনি। সত্যি বলতে কি, তেমন কিছু জানেও না এসব উৎসব-অনুষ্ঠানের। বাঙালির নিজস্ব বছর আছে, তার আবার বারো মাস আছে; বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ...কী যে সুন্দর নামগুলো সব! এসবই আদিত্যের কাছে নতুন মনে হয়। ভালো লাগে খুব।
সেই কবে কোন কালে নাকি সম্রাট আকবরের আমলে বাঙালির এই বর্ষগণনার শুরু হয়। কেন আলাদা বছর, কেন? দাদু গল্প বলেন—কৃষিপ্রধান এই বাংলাদেশের প্রজাদের খাজনা আদায় করতে হলে মাঠে ফসল বোনা কিংবা ফসল তোলার দিকে নজর দিতে হবে না? এ দেশের কৃষক বৈশাখ মাসে মাঠে নতুন ফসল বোনে। এই ফসল বোনা নিয়েই কত রকম অনুষ্ঠান হয়। সকালে উঠে কলাপাতায় শিরনি খাওয়া, মাঠে বসে কৃষকের পান্তা খাওয়া, পাখপাখালির জন্য খাবার ছড়িয়ে দেওয়া—আরও কত কী! পয়লা বৈশাখ, নতুন সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় বাঙালির নতুন জীবন। মুগ্ধ হয়ে শোনে আদিত্য। একসময় দাদুকে বলে,
বাঙালি জাতির তাহলে এত অনুষ্ঠান আছে, দাদুভাই!
হ্যাঁ, তাই। নাতির কাঁধে হাত রেখে বলেন—এই জন্যই তো বলে বারো মাসে তেরো পার্বণ। পার্বণ মানে হচ্ছে অনুষ্ঠান। বুঝেছিস?
আদিত্য ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়।
দাদুর সঙ্গে হালখাতা করতে গিয়ে সে তো ভীষণ অবাক। রঙিন কাগজের মালা, ফুল, জরির ঝালর দিয়ে সব দোকান সাজানো। বাজারের একটা দোকানের সামনে কলাগাছের গেট তৈরি করে দেবদারু পাতা দিয়ে ছাওয়া হয়েছে। তারই মাঝখানে রঙিন অক্ষরে লেখা ‘শুভ হালখাতা’। দাদুর সঙ্গে আদিত্য ঢুকে পড়ে এক হালখাতার দোকানে। না, দোকানটা কাপড়ের, কাজল বস্ত্রমেলা। দোকানদার খুব আদর করে বসতে দেয়। প্লেটভর্তি মিষ্টি এনে সামনে ধরে। দাদু সারা বছরের দেনার টাকা শোধ করে আদিত্যের পরিচয় বলেন—আমার নাতি। বিদেশি সাহেব। হালখাতা চেনে না, বুঝেছ। হা হা করে খানিক হেসে আদিত্যকে বলেন—ইহার নাম হালখাতা। খা, মিষ্টি।
এর পরও দোকান থেকে ওঠার সময় আরও এক প্যাকেট মিষ্টি ধরিয়ে দেয় দোকানদার। আদিত্য ধরবে কোন হাতে! বৈশাখী মেলা থেকে নানা রকম খেলনা, বাঁশি, বেলুন কিনে দাদু-নাতি দুজনেরই হাত ভর্তি। তবু দোকানদার নাছোড়। হালখাতার মিষ্টি না নিলে তার দোকানের অকল্যাণ হবে। অতিথি দোকানে বসে খাবে, আর বাড়ির লোকেরা খাবে না, তাই হয়! সবশেষে আদিত্যর কাঁধের ওপরে একটা লাল রঙের জামা চাপিয়ে দিয়ে দোকানদার বলে—তোমার জন্য এটা হচ্ছে নববর্ষের উপহার, দাদুভাই। নাও, ধরো।
রাস্তায় নেমে আদিত্যর মুখে আর কথা সরে না। রিকশায় ওঠার পর দাদুভাই বুঝিয়ে বলেন, বাঙালি হচ্ছে অতিথিপরায়ণ জাতি। অতিথিকে খাইয়ে-পরিয়ে আশ মেটে না। এত উদারতা তুই কোথায় পাবি!
আদিত্য চুপ।
কী হলো, কথা বলছিস না যে!
আদিত্য মুখ খোলে, তুমি আমাকে বিদেশি বললে কেন?
দাদু এবার এত জোরে হেসে ওঠেন যে রিকশা পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। নাতিকে জাপটে ধরে বলেন, এই জন্য রাগ হয়েছে! বিদেশ থেকে এসেছিস যে তুই, সেই জন্য...
দাদুর কথা শেষ হওয়ার আগেই আদিত্য জানিয়ে দেয়,
তবু আমি বাঙালি।
শুনতে খারাপ লাগে আদিত্যর। মাকে জিজ্ঞেস করে, হিন্দুয়ানি মানে কী, মা? প্রশ্ন শুনে তেড়ে ওঠে ওর মা—কোথায় শিখেছ ওই বাজে শব্দ?
আদিত্য কিছু বলার আগে এগিয়ে আসে ওর বাবা। মাথায় হাত বুলিয়ে হেসে ওঠে। তারপর ওর মাকে বলে,
ওকে ধমকানোর মানে হয়। শুনেছে নিশ্চয় কোনো বাঙালি পরিবারে। এত দূরে এসেও জাত-ধর্ম নিয়ে কী যে টানাটানি! আদিত্যকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে—তোর নাম তো আদিত্য মুরশিদ, সবাইকে বলিস।
এরপর শুরু হয় এক প্রশ্ন—‘আদিত্য’ মানে কী, বাবা?
আদিত্য মানে আদিত্য। মজা করে ওর বাবা। আদিত্য হেসে ফেলে ফিক করে। তখন ওর বাবা জানায়—এই নাম রেখেছে তোর দাদু। আগামী মাসে তো আমরা দেশে যাব, তখন দাদুভাইকে শুধাস।
দাদুভাই দিব্যি এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়েই জানিয়ে দেয় আদিত্য মানে সূর্য। ওদের সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফেরার পর একদিন খুব মজা করে এই আদিত্য নামের গল্প শোনান। বাংলা ভাষায় একই শব্দের কত রকম যে অর্থ হয়! সেসব কথা বিস্তারিত বলতে বলতে একসময় আদিত্যর মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলেন, তোমার নামটা, অদিতি হলে বেশ হয় বউমা!
এত দিন পর নিজের নতুন নামকরণ শুনে লজ্জা পায় আদিত্যের মা। মুখে কিছু না বলে শ্বশুরের মুখের দিকে চোখ তুলে তাকায়। আদিত্যের দাদু হা হা করে হাসতে হাসতে বলেন—অদিতি পুত্র হচ্ছে আদিত্য। এ তো আমার কথা নয় মা, এসব অনেক পুরোনো কথা।
আদিত্যের দাদু এমনই গল্পপ্রিয় মানুষ।
স্থানীয় এক কলেজে বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক ছিলেন। ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-সহকর্মী সবাইকে গল্প শুনিয়ে মজা পান। বিষয় একটা পেলেই হলো, সবকিছু নিয়ে গল্প তার জমানোই থাকে, সুযোগ পেলেই গল্পের লাটাই থেকে সুতো ছাড়েন। এই তো সেদিন পয়লা বৈশাখে নাতিকে ডেকে বললেন, চল যাই, হালখাতা করে আসি!
আদিত্য তো অবাক, কী খাতা?
দাদু হেসে আবারও বলেন—হালখাতা।
এরপর শুরু হয় হালখাতার গল্প। বাংলা নববর্ষের গল্প। পয়লা বৈশাখের বৈশাখী মেলার গল্প। বাঙালি হয়েও আদিত্য কখনো এসব দেখেনি। সত্যি বলতে কি, তেমন কিছু জানেও না এসব উৎসব-অনুষ্ঠানের। বাঙালির নিজস্ব বছর আছে, তার আবার বারো মাস আছে; বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ...কী যে সুন্দর নামগুলো সব! এসবই আদিত্যের কাছে নতুন মনে হয়। ভালো লাগে খুব।
সেই কবে কোন কালে নাকি সম্রাট আকবরের আমলে বাঙালির এই বর্ষগণনার শুরু হয়। কেন আলাদা বছর, কেন? দাদু গল্প বলেন—কৃষিপ্রধান এই বাংলাদেশের প্রজাদের খাজনা আদায় করতে হলে মাঠে ফসল বোনা কিংবা ফসল তোলার দিকে নজর দিতে হবে না? এ দেশের কৃষক বৈশাখ মাসে মাঠে নতুন ফসল বোনে। এই ফসল বোনা নিয়েই কত রকম অনুষ্ঠান হয়। সকালে উঠে কলাপাতায় শিরনি খাওয়া, মাঠে বসে কৃষকের পান্তা খাওয়া, পাখপাখালির জন্য খাবার ছড়িয়ে দেওয়া—আরও কত কী! পয়লা বৈশাখ, নতুন সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় বাঙালির নতুন জীবন। মুগ্ধ হয়ে শোনে আদিত্য। একসময় দাদুকে বলে,
বাঙালি জাতির তাহলে এত অনুষ্ঠান আছে, দাদুভাই!
হ্যাঁ, তাই। নাতির কাঁধে হাত রেখে বলেন—এই জন্যই তো বলে বারো মাসে তেরো পার্বণ। পার্বণ মানে হচ্ছে অনুষ্ঠান। বুঝেছিস?
আদিত্য ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়।
দাদুর সঙ্গে হালখাতা করতে গিয়ে সে তো ভীষণ অবাক। রঙিন কাগজের মালা, ফুল, জরির ঝালর দিয়ে সব দোকান সাজানো। বাজারের একটা দোকানের সামনে কলাগাছের গেট তৈরি করে দেবদারু পাতা দিয়ে ছাওয়া হয়েছে। তারই মাঝখানে রঙিন অক্ষরে লেখা ‘শুভ হালখাতা’। দাদুর সঙ্গে আদিত্য ঢুকে পড়ে এক হালখাতার দোকানে। না, দোকানটা কাপড়ের, কাজল বস্ত্রমেলা। দোকানদার খুব আদর করে বসতে দেয়। প্লেটভর্তি মিষ্টি এনে সামনে ধরে। দাদু সারা বছরের দেনার টাকা শোধ করে আদিত্যের পরিচয় বলেন—আমার নাতি। বিদেশি সাহেব। হালখাতা চেনে না, বুঝেছ। হা হা করে খানিক হেসে আদিত্যকে বলেন—ইহার নাম হালখাতা। খা, মিষ্টি।
এর পরও দোকান থেকে ওঠার সময় আরও এক প্যাকেট মিষ্টি ধরিয়ে দেয় দোকানদার। আদিত্য ধরবে কোন হাতে! বৈশাখী মেলা থেকে নানা রকম খেলনা, বাঁশি, বেলুন কিনে দাদু-নাতি দুজনেরই হাত ভর্তি। তবু দোকানদার নাছোড়। হালখাতার মিষ্টি না নিলে তার দোকানের অকল্যাণ হবে। অতিথি দোকানে বসে খাবে, আর বাড়ির লোকেরা খাবে না, তাই হয়! সবশেষে আদিত্যর কাঁধের ওপরে একটা লাল রঙের জামা চাপিয়ে দিয়ে দোকানদার বলে—তোমার জন্য এটা হচ্ছে নববর্ষের উপহার, দাদুভাই। নাও, ধরো।
রাস্তায় নেমে আদিত্যর মুখে আর কথা সরে না। রিকশায় ওঠার পর দাদুভাই বুঝিয়ে বলেন, বাঙালি হচ্ছে অতিথিপরায়ণ জাতি। অতিথিকে খাইয়ে-পরিয়ে আশ মেটে না। এত উদারতা তুই কোথায় পাবি!
আদিত্য চুপ।
কী হলো, কথা বলছিস না যে!
আদিত্য মুখ খোলে, তুমি আমাকে বিদেশি বললে কেন?
দাদু এবার এত জোরে হেসে ওঠেন যে রিকশা পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। নাতিকে জাপটে ধরে বলেন, এই জন্য রাগ হয়েছে! বিদেশ থেকে এসেছিস যে তুই, সেই জন্য...
দাদুর কথা শেষ হওয়ার আগেই আদিত্য জানিয়ে দেয়,
তবু আমি বাঙালি।
No comments