প্রধানমন্ত্রী ভীষণ ক্ষুব্ধ-পদত্যাগ মুহূর্তের ব্যাপার : সুরঞ্জিত
এই সময়ে দেশে সর্বাধিক আলোচিত ব্যক্তি রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, 'অবস্থা বাধ্য করলে আমার পদত্যাগ মুহূর্তের ব্যাপার। কারণ রাজনীতিবিদদের কাছে মন্ত্রিত্ব বড় নয়।' বিপদে আছেন স্বীকার করে বিপদ কাটিয়ে ওঠার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন তিনি।
তবে গত সোমবার রাতে পিলখানায় আটক টাকার বস্তাসহ গাড়িটির গন্তব্য তাঁর বাসা ছিল না দাবি করে রেলমন্ত্রী বলেন, 'রাত ১০টার পর মন্ত্রীর বাড়ি খোলা থাকে না।'
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকায় রেল ভবনে নিজের ডাকা সংবাদ সম্মেলনে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এসব কথা বলেন। রেলওয়েতে তিন বছর ধরে নিয়োগ বাণিজ্য চলছে স্বীকার করলেও সাংবাদিকদের অনেক প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি তিনি।
এদিকে মন্ত্রিসভার একজন দায়িত্বশীল সদস্য কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএসের টাকার বস্তাসহ আটক হওয়ার ঘটনায় ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি এ নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্যও করেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানিয়েছে, গত বুধবার তুরস্কে যাওয়ার আগে বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘটনাটি নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। এমনকি রেলমন্ত্রী পদত্যাগ করুক- এমন কথাও উচ্চারণ করেন তিনি।
রেলমন্ত্রী গতকাল সংবাদ সম্মেলন শুরু করেন বিকেল ৫টার দিকে। চেয়ারে বসে প্রথমেই সোমবার রাতের ঘটনাকে উদ্দেশ করে বলেন, 'ঘটনাটি অনভিপ্রেত। গতকাল আপনাদের অনেকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েও রাগ করেছি। আমার রাজনৈতিক জীবন ৫৫ বছরের। কিন্তু মন্ত্রী হিসেবে আমার বয়স তিন মাস। যোগাযোগের অপভ্রংশ রেলওয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আমাকে। আমি জেনেশুনে চ্যালেঞ্জ নিয়েছি। কিন্তু এখানে দুর্নীতিবাজ ও সুবিধাভোগীরা আছে। তিন মাসে রেলের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেছি। রেলের সময়ানুবর্তিতা ও পরিচ্ছন্নতা রক্ষার চেষ্টা করেছি। রেল মাথা তুলে দাঁড়াবে। রেল নির্ভরযোগ্য গণপরিবহন। তার প্রতিপক্ষ আছে। রেল ভালোভাবে চললে অনেকের লালবাতি জ্বলবে। শত্রুচক্র লেগেই আছে। একজন মন্ত্রীর একাধারে লড়াই করা কষ্টকর। আপনারা সাহায্য করুন।'
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, 'রেলকে পৃথক সত্তা হিসেবে দাঁড় করানো কঠিন। ষড়যন্ত্রের নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো কঠিন কাজ। দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিন থেকেই তা বুঝেছি। রেলে পরিচ্ছন্নতা রক্ষা ও দুর্নীতিবাজদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করে রেলকে সচল করতে চাই। ঐক্যবদ্ধ ষড়যন্ত্র কাজ করছে যেন রেল ইমেজ ফিরে না পায়। এরই ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে এপিএস ও জিএমের ঘটনাটি ঘটেছে।'
রেলমন্ত্রী বলেন, 'রাজনীতিবিদদের কাছে মন্ত্রিত্ব বড় নয়। পদত্যাগ স্বাভাবিক বিষয়। আমার মূল পরিচয় আমি এমপি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ছোটবেলা থেকে লড়েছি। সুবিধা নিইনি। আপস আমি করব না। রেলকে আমি দাঁড় করাবই।'
সোমবার রাতে এপিএস ওমর ফারুক অন্যদের নিয়ে রেলমন্ত্রীর বাসার দিকেই যাচ্ছিলেন- এ অভিযোগ বিষয়ে সুরঞ্জিত বলেন, 'আমি থাকি জিগাতলা। রাত ১০টার পর মন্ত্রীর বাড়ি খোলা থাকে না। আমার রেলে ৪০ হাজার কর্মী কাজ করেন। এর বাইরেও অনেকে কাজ করেন। বিপদে পড়লে কেউ সাহায্য নেবেই।'
রাজনীতি সেবার হাতিয়ার মন্তব্য করে রেলমন্ত্রী বলেন, 'এপিএসকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিতে রেলের ডিজিকে যুক্ত করা হয়েছে। জিএমকে বরখাস্তের এখতিয়ার আমাদের নেই। তদন্ত রিপোর্ট পেলে ব্যবস্থা নেব।'
সুরঞ্জিত আরো বলেন, 'রেলে নিয়োগ বাণিজ্য তদন্তে বর্তমান সংসদীয় সাবকমিটি হয়েছে। দুদক তদন্ত করতে চায়। তারা সহযোগিতা পাবে। আদালত ইচ্ছা করলে তদন্ত করতে পারেন। আমাদের সহযোগিতা পাবেন।' তিনি বলেন, 'মধ্যরাতে জিএমের আমার বাসায় যাওয়ার কারণ নেই। আমি তদবিরের লোক নই। এপিএস ও জিএম ব্যক্তিজীবনে কী করেন, তার দায়িত্ব আমার নয়। এনবিআর তাঁদের বিষয়টি তদন্ত করে দেখতে পারে। মধ্যরাতের ঘটনার পর পদত্যাগ দাবি- এসব ষড়যন্ত্র।'
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নিজের অবস্থা তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী বলেন, 'আমি বলতে পারি, এ দুর্নীতির সঙ্গে কে কিভাবে জড়িত, তা জানতে হবে। সরকার ও মন্ত্রীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা ঠিক নয়। গণমাধ্যম ও জনগণের সমর্থন পেলে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জয়ী হব। আমার শত্রুও আছে। শত্রু প্রতিক্রিয়াশীল ও দুর্নীতিবাজ। আমি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলি। আমার বন্ধু সৎ সাংবাদিকরা। সত্যের জয় হবেই।' তিনি বলেন, 'আমাকে শুভকামনার জন্য অসংখ্য লোক দেশ ও দেশের বাইরে থেকে ফোন করেছেন। বিপদে মোরে রক্ষা কর, এ নহে মোর প্রার্থনা, এ বিপদ কাটিয়ে উঠতে হবে। কঠিন অবস্থার মধ্যে আছি। সামনে সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এ সময় যদি বিব্রত করা যায়, তাহলে এর সুবিধা নেওয়ার মতো লোক আছে।'
মন্ত্রীর টানা বক্তব্যের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পদ অর্জন করা সাংঘাতিক বিষয় নয়। ত্যাগ করাও সহজ। তিনি বলেন, রেলে তিন বছর ধরে নিয়োগ বাণিজ্য হচ্ছে। রেলের পূর্বাঞ্চলের জিএম ইউসুফ আলী মৃধার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রেলে দুর্নীতির বিশাল শিকড় রয়েছে। পদত্যাগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'অবস্থা এমন হলে আমার জন্য পদত্যাগ সহজ হবে। এক মুহূর্তও দেরি করব না।' উদ্ধার হওয়া অর্থের পরিমাণ সম্পর্কে তিনি বলেন, টাকার পরিমাণ তিনিও শুনেছেন। গাড়িচালক কোথায় আছে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, বিজিবি বলতে পারবে।
অন্য এক প্রসঙ্গে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, 'এত দিন আমি তীর নিক্ষেপ করেছি। এখন আমার দিকেই সন্দেহের তীর আসছে।' তিনি আরো বলেন, কভু আশিবিষে দংশেনি যারে, বুঝিবে সে কিসে?
'কাছের লোক' এক দিনেই 'পর'
'যখন তোমার কেউ ছিল না, তখন ছিলাম আমি- এখন তোমার সব হয়েছে পর হয়েছি আমি।' ছন্দোবদ্ধ এই বাক্যের মতোই এক দিনের ব্যবধানে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কাছে 'পর' হয়ে গেছেন তাঁর এপিএস পদ থেকে বরখাস্ত হওয়া ওমর ফারুক তালুকদার। মন্ত্রীর বাসা থেকে একাধিকবার ফারুককে তিরস্কার করে বের করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নিজের ব্যবহারগুণে ফারুক মন্ত্রীর কাছাকাছিই ছিলেন।
মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, রেলমন্ত্রী নিজেই বিভিন্ন কারণে তাঁর এই কাছের লোকের কাছে 'ধরা' ছিলেন। গত সোমবার রাতে বিপুল পরিমাণ অর্থসহ আটক নাটকের পরই ফারুককে বহিষ্কারের দাবি ওঠে। কিন্তু ফারুক 'মন্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনো গোপন তথ্য ফাঁস করে দিতে পারেন'- এই আশঙ্কায় রেলমন্ত্রী ফারুকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি মঙ্গলবার পর্যন্ত। কিন্তু একপর্যায়ে চাপে পড়েই গত বুধবার মন্ত্রী ফারুককে সাময়িক বরখাস্ত করেন। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গত সোমবার আটক ঘটনার পর রেলমন্ত্রী নিজেই ফারুককে ছাড়িয়ে আনার জন্য তদবির করেছিলেন।
রেলমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠরা কালের কণ্ঠে পাঠানো ওমর ফারুকের চিঠিটি ফারুকের কাছ থেকে আনতে তাঁর সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেন গতকাল দুপুরে। কিন্তু তাঁরা যোগাযোগ করতে পারেননি। গতকাল বিকেলে রেল ভবনে রেলমন্ত্রী কথা প্রসঙ্গে বলেছেন, ফারুকের সঙ্গে তাঁর কোনো যোগাযোগ নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গতকাল রেলমন্ত্রীর নিজ নির্বাচনী এলাকা দিরাইয়ে যাওয়ার কথা ছিল বিমানযোগে। সেখানে গিয়ে একটি মার্কেট উদ্বোধনসহ অন্যান্য কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গতকাল কালের কণ্ঠসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সোমবারের ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ, প্রচার ও সর্বত্র আলোচনা বাড়তে থাকায় তিনি এই সফর বাতিল করেন। পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে আনতে গতকাল বিকেলে হঠাৎ করেই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন।
জানা গেছে, ওমর ফারুককে এপিএস পদ থেকে স্থায়ীভাবে সরিয়ে নেওয়ার পক্ষে মন্ত্রীকে তাঁর অনুসারীরা পরামর্শ দিয়েছেন। এ অবস্থায় আবার এপিএস পদে নিয়োগ পেতে তৎপরতা শুরু হয়েছে। একাধিক আগ্রহী প্রার্থীর মধ্যে মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ কামরুল হকের নাম জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে। তবে মন্ত্রী উদ্ভূত অবস্থায় এপিএস পদে তাড়াতাড়িই নিয়োগ দিচ্ছেন না, বরং পরিস্থিতি সামাল দিতে ঘনিষ্ঠ ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের পরামর্শ চাইছেন।
তদন্ত ধীরে : সোমবারের ঘটনা তদন্তে গত মঙ্গলবার দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। মন্ত্রীর পিএস আখতার উজ-জামানকে ফারুকের, যুগ্ম সচিব শশী কুমার সিংহকে জিএম ইউসুফ মৃধার অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। গতকাল রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আবু তাহেরকে শশী কুমারের সঙ্গে তদন্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আবু তাহের সোমবার রাতে আটক হওয়া রেল কর্মকর্তা এনামুল হকের বিষয়টি তদন্ত করবেন। এ বিষয়ে গতকাল রাতে আবু তাহের কালের কণ্ঠকে বলেন, 'শেষ পর্যায়ে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আগামী সপ্তাহে কাজ শুরু করব।' জানা গেছে, কমিটি অভিযোগ খতিয়ে দেখতে তথ্য সংগ্রহ করছে না। জিএম মৃধাকে গত বুধবার তদন্ত কমিটি একটি চিঠি দিয়েছে।
আবার একান্তে বৈঠক : গত বুধবার রাতেও মন্ত্রীর পিএস আখতার উজ-জামানের সঙ্গে ওমর ফারুকের বৈঠক হয়েছে মোহাম্মদপুরের একটি বাসায়। আধা ঘণ্টা স্থায়ী ওই বৈঠকে ফারুক নিজেকে কিভাবে বাঁচানো যায়- এ নিয়েই কথা বলেন বলে সূত্র জানিয়েছে। এ বিষয়ে জানার জন্য মন্ত্রীর পিএস আখতার উজ-জামানের সঙ্গে গতকাল রাতে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
গাড়িটি ফারুকের কাছেই : সোমবার রাতে বিজিবি সদস্যদের হাতে আটক হওয়া ফারুকের গাড়িটি এখন ফারুকের কাছেই। গতকাল দুপুরে ওমর ফারুক তালুকদারের মোহাম্মদপুরের পিসি কালচার রোডের বাসায় গেলে তাঁকে পাওয়া যায়নি। ওই সড়কের ৮৪ নম্বর বাসায় দায়িত্ব পালনরত কেয়ারটেয়ার তৌফিক আহমেদ জানান, ওমর ফারুক, তাঁর স্ত্রী, সন্তান, শ্যালিকা, শ্যালক এখন বাসায় নেই। সোমবার বিপুল টাকাসহ বিজিবি সদস্যদের কাছে ধরা পড়া ফারুকের ব্যক্তিগত গাড়িটি এখন ফারুকের শ্যালক চালাচ্ছেন। গত মঙ্গলবার বিকেল ৩টার দিকে ওই গাড়ি এ বাসা থেকে বেরোয়। আর ফেরেনি। যে গাড়িটি বিজিবি সদর দপ্তরে ঢুকেছিল, সেটির মালিক ফারুক নিজেই। সেটির নম্বর ঢাকা মেট্রো-চ-১৩-৭৯৯২। ২০১০ সালে গাড়িটি বিআরটিএ-তে নিবন্ধন করা হয় বলে জানা গেছে।
টাকা ফারুকের কাছেই
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকায় রেল ভবনে নিজের ডাকা সংবাদ সম্মেলনে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এসব কথা বলেন। রেলওয়েতে তিন বছর ধরে নিয়োগ বাণিজ্য চলছে স্বীকার করলেও সাংবাদিকদের অনেক প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি তিনি।
এদিকে মন্ত্রিসভার একজন দায়িত্বশীল সদস্য কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএসের টাকার বস্তাসহ আটক হওয়ার ঘটনায় ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি এ নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্যও করেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানিয়েছে, গত বুধবার তুরস্কে যাওয়ার আগে বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘটনাটি নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। এমনকি রেলমন্ত্রী পদত্যাগ করুক- এমন কথাও উচ্চারণ করেন তিনি।
রেলমন্ত্রী গতকাল সংবাদ সম্মেলন শুরু করেন বিকেল ৫টার দিকে। চেয়ারে বসে প্রথমেই সোমবার রাতের ঘটনাকে উদ্দেশ করে বলেন, 'ঘটনাটি অনভিপ্রেত। গতকাল আপনাদের অনেকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েও রাগ করেছি। আমার রাজনৈতিক জীবন ৫৫ বছরের। কিন্তু মন্ত্রী হিসেবে আমার বয়স তিন মাস। যোগাযোগের অপভ্রংশ রেলওয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আমাকে। আমি জেনেশুনে চ্যালেঞ্জ নিয়েছি। কিন্তু এখানে দুর্নীতিবাজ ও সুবিধাভোগীরা আছে। তিন মাসে রেলের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেছি। রেলের সময়ানুবর্তিতা ও পরিচ্ছন্নতা রক্ষার চেষ্টা করেছি। রেল মাথা তুলে দাঁড়াবে। রেল নির্ভরযোগ্য গণপরিবহন। তার প্রতিপক্ষ আছে। রেল ভালোভাবে চললে অনেকের লালবাতি জ্বলবে। শত্রুচক্র লেগেই আছে। একজন মন্ত্রীর একাধারে লড়াই করা কষ্টকর। আপনারা সাহায্য করুন।'
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, 'রেলকে পৃথক সত্তা হিসেবে দাঁড় করানো কঠিন। ষড়যন্ত্রের নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো কঠিন কাজ। দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিন থেকেই তা বুঝেছি। রেলে পরিচ্ছন্নতা রক্ষা ও দুর্নীতিবাজদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করে রেলকে সচল করতে চাই। ঐক্যবদ্ধ ষড়যন্ত্র কাজ করছে যেন রেল ইমেজ ফিরে না পায়। এরই ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে এপিএস ও জিএমের ঘটনাটি ঘটেছে।'
রেলমন্ত্রী বলেন, 'রাজনীতিবিদদের কাছে মন্ত্রিত্ব বড় নয়। পদত্যাগ স্বাভাবিক বিষয়। আমার মূল পরিচয় আমি এমপি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ছোটবেলা থেকে লড়েছি। সুবিধা নিইনি। আপস আমি করব না। রেলকে আমি দাঁড় করাবই।'
সোমবার রাতে এপিএস ওমর ফারুক অন্যদের নিয়ে রেলমন্ত্রীর বাসার দিকেই যাচ্ছিলেন- এ অভিযোগ বিষয়ে সুরঞ্জিত বলেন, 'আমি থাকি জিগাতলা। রাত ১০টার পর মন্ত্রীর বাড়ি খোলা থাকে না। আমার রেলে ৪০ হাজার কর্মী কাজ করেন। এর বাইরেও অনেকে কাজ করেন। বিপদে পড়লে কেউ সাহায্য নেবেই।'
রাজনীতি সেবার হাতিয়ার মন্তব্য করে রেলমন্ত্রী বলেন, 'এপিএসকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিতে রেলের ডিজিকে যুক্ত করা হয়েছে। জিএমকে বরখাস্তের এখতিয়ার আমাদের নেই। তদন্ত রিপোর্ট পেলে ব্যবস্থা নেব।'
সুরঞ্জিত আরো বলেন, 'রেলে নিয়োগ বাণিজ্য তদন্তে বর্তমান সংসদীয় সাবকমিটি হয়েছে। দুদক তদন্ত করতে চায়। তারা সহযোগিতা পাবে। আদালত ইচ্ছা করলে তদন্ত করতে পারেন। আমাদের সহযোগিতা পাবেন।' তিনি বলেন, 'মধ্যরাতে জিএমের আমার বাসায় যাওয়ার কারণ নেই। আমি তদবিরের লোক নই। এপিএস ও জিএম ব্যক্তিজীবনে কী করেন, তার দায়িত্ব আমার নয়। এনবিআর তাঁদের বিষয়টি তদন্ত করে দেখতে পারে। মধ্যরাতের ঘটনার পর পদত্যাগ দাবি- এসব ষড়যন্ত্র।'
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নিজের অবস্থা তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী বলেন, 'আমি বলতে পারি, এ দুর্নীতির সঙ্গে কে কিভাবে জড়িত, তা জানতে হবে। সরকার ও মন্ত্রীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা ঠিক নয়। গণমাধ্যম ও জনগণের সমর্থন পেলে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জয়ী হব। আমার শত্রুও আছে। শত্রু প্রতিক্রিয়াশীল ও দুর্নীতিবাজ। আমি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলি। আমার বন্ধু সৎ সাংবাদিকরা। সত্যের জয় হবেই।' তিনি বলেন, 'আমাকে শুভকামনার জন্য অসংখ্য লোক দেশ ও দেশের বাইরে থেকে ফোন করেছেন। বিপদে মোরে রক্ষা কর, এ নহে মোর প্রার্থনা, এ বিপদ কাটিয়ে উঠতে হবে। কঠিন অবস্থার মধ্যে আছি। সামনে সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এ সময় যদি বিব্রত করা যায়, তাহলে এর সুবিধা নেওয়ার মতো লোক আছে।'
মন্ত্রীর টানা বক্তব্যের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পদ অর্জন করা সাংঘাতিক বিষয় নয়। ত্যাগ করাও সহজ। তিনি বলেন, রেলে তিন বছর ধরে নিয়োগ বাণিজ্য হচ্ছে। রেলের পূর্বাঞ্চলের জিএম ইউসুফ আলী মৃধার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রেলে দুর্নীতির বিশাল শিকড় রয়েছে। পদত্যাগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'অবস্থা এমন হলে আমার জন্য পদত্যাগ সহজ হবে। এক মুহূর্তও দেরি করব না।' উদ্ধার হওয়া অর্থের পরিমাণ সম্পর্কে তিনি বলেন, টাকার পরিমাণ তিনিও শুনেছেন। গাড়িচালক কোথায় আছে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, বিজিবি বলতে পারবে।
অন্য এক প্রসঙ্গে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, 'এত দিন আমি তীর নিক্ষেপ করেছি। এখন আমার দিকেই সন্দেহের তীর আসছে।' তিনি আরো বলেন, কভু আশিবিষে দংশেনি যারে, বুঝিবে সে কিসে?
'কাছের লোক' এক দিনেই 'পর'
'যখন তোমার কেউ ছিল না, তখন ছিলাম আমি- এখন তোমার সব হয়েছে পর হয়েছি আমি।' ছন্দোবদ্ধ এই বাক্যের মতোই এক দিনের ব্যবধানে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কাছে 'পর' হয়ে গেছেন তাঁর এপিএস পদ থেকে বরখাস্ত হওয়া ওমর ফারুক তালুকদার। মন্ত্রীর বাসা থেকে একাধিকবার ফারুককে তিরস্কার করে বের করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নিজের ব্যবহারগুণে ফারুক মন্ত্রীর কাছাকাছিই ছিলেন।
মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, রেলমন্ত্রী নিজেই বিভিন্ন কারণে তাঁর এই কাছের লোকের কাছে 'ধরা' ছিলেন। গত সোমবার রাতে বিপুল পরিমাণ অর্থসহ আটক নাটকের পরই ফারুককে বহিষ্কারের দাবি ওঠে। কিন্তু ফারুক 'মন্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনো গোপন তথ্য ফাঁস করে দিতে পারেন'- এই আশঙ্কায় রেলমন্ত্রী ফারুকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি মঙ্গলবার পর্যন্ত। কিন্তু একপর্যায়ে চাপে পড়েই গত বুধবার মন্ত্রী ফারুককে সাময়িক বরখাস্ত করেন। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গত সোমবার আটক ঘটনার পর রেলমন্ত্রী নিজেই ফারুককে ছাড়িয়ে আনার জন্য তদবির করেছিলেন।
রেলমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠরা কালের কণ্ঠে পাঠানো ওমর ফারুকের চিঠিটি ফারুকের কাছ থেকে আনতে তাঁর সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেন গতকাল দুপুরে। কিন্তু তাঁরা যোগাযোগ করতে পারেননি। গতকাল বিকেলে রেল ভবনে রেলমন্ত্রী কথা প্রসঙ্গে বলেছেন, ফারুকের সঙ্গে তাঁর কোনো যোগাযোগ নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গতকাল রেলমন্ত্রীর নিজ নির্বাচনী এলাকা দিরাইয়ে যাওয়ার কথা ছিল বিমানযোগে। সেখানে গিয়ে একটি মার্কেট উদ্বোধনসহ অন্যান্য কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গতকাল কালের কণ্ঠসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সোমবারের ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ, প্রচার ও সর্বত্র আলোচনা বাড়তে থাকায় তিনি এই সফর বাতিল করেন। পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে আনতে গতকাল বিকেলে হঠাৎ করেই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন।
জানা গেছে, ওমর ফারুককে এপিএস পদ থেকে স্থায়ীভাবে সরিয়ে নেওয়ার পক্ষে মন্ত্রীকে তাঁর অনুসারীরা পরামর্শ দিয়েছেন। এ অবস্থায় আবার এপিএস পদে নিয়োগ পেতে তৎপরতা শুরু হয়েছে। একাধিক আগ্রহী প্রার্থীর মধ্যে মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ কামরুল হকের নাম জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে। তবে মন্ত্রী উদ্ভূত অবস্থায় এপিএস পদে তাড়াতাড়িই নিয়োগ দিচ্ছেন না, বরং পরিস্থিতি সামাল দিতে ঘনিষ্ঠ ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের পরামর্শ চাইছেন।
তদন্ত ধীরে : সোমবারের ঘটনা তদন্তে গত মঙ্গলবার দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। মন্ত্রীর পিএস আখতার উজ-জামানকে ফারুকের, যুগ্ম সচিব শশী কুমার সিংহকে জিএম ইউসুফ মৃধার অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। গতকাল রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আবু তাহেরকে শশী কুমারের সঙ্গে তদন্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আবু তাহের সোমবার রাতে আটক হওয়া রেল কর্মকর্তা এনামুল হকের বিষয়টি তদন্ত করবেন। এ বিষয়ে গতকাল রাতে আবু তাহের কালের কণ্ঠকে বলেন, 'শেষ পর্যায়ে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আগামী সপ্তাহে কাজ শুরু করব।' জানা গেছে, কমিটি অভিযোগ খতিয়ে দেখতে তথ্য সংগ্রহ করছে না। জিএম মৃধাকে গত বুধবার তদন্ত কমিটি একটি চিঠি দিয়েছে।
আবার একান্তে বৈঠক : গত বুধবার রাতেও মন্ত্রীর পিএস আখতার উজ-জামানের সঙ্গে ওমর ফারুকের বৈঠক হয়েছে মোহাম্মদপুরের একটি বাসায়। আধা ঘণ্টা স্থায়ী ওই বৈঠকে ফারুক নিজেকে কিভাবে বাঁচানো যায়- এ নিয়েই কথা বলেন বলে সূত্র জানিয়েছে। এ বিষয়ে জানার জন্য মন্ত্রীর পিএস আখতার উজ-জামানের সঙ্গে গতকাল রাতে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
গাড়িটি ফারুকের কাছেই : সোমবার রাতে বিজিবি সদস্যদের হাতে আটক হওয়া ফারুকের গাড়িটি এখন ফারুকের কাছেই। গতকাল দুপুরে ওমর ফারুক তালুকদারের মোহাম্মদপুরের পিসি কালচার রোডের বাসায় গেলে তাঁকে পাওয়া যায়নি। ওই সড়কের ৮৪ নম্বর বাসায় দায়িত্ব পালনরত কেয়ারটেয়ার তৌফিক আহমেদ জানান, ওমর ফারুক, তাঁর স্ত্রী, সন্তান, শ্যালিকা, শ্যালক এখন বাসায় নেই। সোমবার বিপুল টাকাসহ বিজিবি সদস্যদের কাছে ধরা পড়া ফারুকের ব্যক্তিগত গাড়িটি এখন ফারুকের শ্যালক চালাচ্ছেন। গত মঙ্গলবার বিকেল ৩টার দিকে ওই গাড়ি এ বাসা থেকে বেরোয়। আর ফেরেনি। যে গাড়িটি বিজিবি সদর দপ্তরে ঢুকেছিল, সেটির মালিক ফারুক নিজেই। সেটির নম্বর ঢাকা মেট্রো-চ-১৩-৭৯৯২। ২০১০ সালে গাড়িটি বিআরটিএ-তে নিবন্ধন করা হয় বলে জানা গেছে।
টাকা ফারুকের কাছেই
No comments