তুমি/আমি আর আম আঁটির ভেঁপু by আনিসুল হক
তুমি আম আঁটির ভেঁপু কী চেনো? আজকের এই গুগলের যুগে কোনো কিছু অজানা থাকতে পারে না। গুগলে সার্চ দাও। হ্যাঁ, ওই তো দেখাচ্ছে। আম আঁটির ভেঁপু হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা বই। এটা একটা উত্তর হলো বটে, নির্ভুলই উত্তর, কিন্তু জিনিসটা আসলে কী, তুমি জানো! কোনো দিন দেখেছ? কোনো দিন বাজিয়েছ! অথচ এই
জিনিসটা ছিল আমাদের গ্রীষ্মকালের প্রধান বিনোদন। আমাদের বয়সী ছেলেমেয়েদের। আজ থেকে ৩০ কি ৪০ বছর আগের ছেলেমেয়েদের। তখনো গাছগাছড়া ছিল প্রচুর। জলা-জংলায় ভরা ছিল এই বাংলাদেশ। আমগাছ তো সারা বাংলাদেশেই ছিল। আর আমটা যেখানে ইচ্ছা, যখন ইচ্ছা, তখনই খাওয়া যেত। গ্রীষ্মকালে জামা ভরে যেত আমের রসের বিচিত্র দাগে। কমলা রঙের আমের রস কনুই বেয়ে টপটপ করে পড়ছে, এই দৃশ্য ছিল এক সাধারণ দৃশ্য। আর আমটি খেয়ে আঁটিটি যেখানে ইচ্ছা ছুড়ে ফেলে দিলেই হলো। সারা বাড়ি আমের গন্ধে ম-ম করছে। কাঁঠালের গন্ধে তো বাড়িতে টেকাই দায়। বড় বড় নীল রঙের মাছি ভন ভন করছে চারদিকে। আম-কাঁঠালের খোসা ছড়ানো-ছিটানো এখানে-ওখানে। কালবৈশাখীর হাত ধরে বছরের প্রথম বৃষ্টির আগমনের সঙ্গে সঙ্গে মাটি ফুঁড়ে বেরোতে লাগল আমের চারা, কাঁঠালের চারা। কাঁঠালের বিচি অবশ্য ছড়াত শিয়ালের পেটে পেটে। ওই আমের চারার পাতা কিন্তু লাল। ফুটখানেক লম্বা হয়েছে কি হয়নি, এই রকম একটা আমগাছ উপড়ে ফেলতে হতো শিকড়বাকরসহ। তার সঙ্গে তখনো রয়ে গেছে মাতা-আঁটিটা। সেই আঁটির শক্ত বাকলটা সরালে ভেতরে নরম দুটো বীজপত্র। সবুজ। সেটাকে ঘষতে হতো দেয়ালে, গাছের গায়ে। একটা পাশ ক্ষয়ে গেলে বাঁশি প্রস্তুত। ওটাতে ফুঁঁ দিলে পোঁ পোঁ শব্দ হতো। কে না বানাতে জানত ওই ভেঁপু আর কেই বা না জানত ওই ভেঁপু বাজাতে।
তবুও আম আঁটির ভেঁপু বলতে যদি বিভূতিভূষণের বইটাকে বোঝায়, তাতেই বা কী ক্ষতি। কিংবা ধরো, পথের পাঁচালী বলতেও যদি বোঝায় সত্যজিতের পথের পাঁচালীই, সেও তো একটা ভালো কিছুই বোঝানো হলো। কিন্তু ধরা যাক, দেবদাস বলতে যদি শরৎচন্দ্রের দেবদাস নয়, বোঝায় কেবল শাহরুখ খানের দেবদাস, তাহলে যেন কেমন লাগে! এই যুগের পার্বতীর নাম ঐশ্বরিয়া, চন্দ্রমুখীর নাম মাধুরী দীক্ষিত!
জানো, পয়লা বৈশাখ এলে অপু আর দুর্গার কথাও খুব মনে পড়ে। ও তো আমাদেরই শৈশব। যদিও অমন ঘোরতর গ্রামে বড় হইনি, কিংবা অমন অভাবী সংসারেও না। কিন্তু ঝড় উঠলেই আমগাছতলায় কে যায়নি ছোটবেলায়, আমাদের কালে, আমাদের জগতে? ঝোড়োবাতাসে টুপটাপ ধুপধাপ আম পড়তই আর আম কুড়িয়ে কোঁচা ভরে নিতে নিতে বৃষ্টিও একসময় আসত। তখন ওই অপু আর দুর্গার মতোই গাছের নিচে আশ্রয় নেয়া ছাড়া উপায়টাই বা কী থাকত বলো।। আর তখন বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে এক সময় ওই মন্ত্রও পড়তে হতো, কচুপাতায় করমচা, যা বৃষ্টি চলে যা, কালকে আসিস আজকে না। বৃষ্টিতে কে না ভিজেছে আমাদের কালে। ঘামাচি ভরা পিঠে বৃষ্টিতে ভিজতে কে না বেরিয়েছে, বৃষ্টির ছাটে নাকি ঘামাচি মরে যাবে!
পয়লা বৈশাখ আমাদের জন্য আলাদা উৎসব ছিল না। বাংলা পঞ্জিকা খুব নিত্যব্যবহার্য ছিল গ্রামের বাড়িতে। আমার জ্যাঠাইমা চোখে চশমা দিয়ে পঞ্জিকা দেখতেন, সে পঞ্জিকার গোলাপি রঙের নিউজপ্রিন্টের প্রচ্ছদ, তার ছোট্ট আকার, পকেট সাইজ। কবে কোন বীজধান বের করতে হবে কলসি থেকে, কবে বীজতলা প্রস্তুত করতে হবে, সবই তো চলত ওই বাংলা পঞ্জিকা অনুসারেই।
একবার গ্রামের বাড়ি থেকে বারুনির মেলায় গিয়েছিলাম। মাইলের পর মাইল হেঁটেছিলাম। এই তো আর এক কোরোশ। ক্রোশ আর শেষ হয় না। হাঁটতে হাঁটতে কত দূর যে চলে গেছি। মানুষের সারি যেন পিঁপড়ে। মাথায় বোঝা, কাঁধে বাঁক। গরুর গাড়ি চলেছে। মেলা একটা নদীর ধারে। দূর থেকে গমগম আওয়াজ আসছে। মানুষের। মেলার পাশে গরুর গাড়িগুলো পড়ে আছে ‘ব’-এর মতো। গরুগুলো চাকার সঙ্গে বাঁধা। রসুন আর রসুন। রসুনের সাদা খোসা উড়ছে। বড় বড় তরমুজ। তারপর খেলনা, মিঠাই। আর জুয়া। আর পুতুল নাচ। চুড়ি-ফিতা।
সেই মেলা থেকে এই মেলা। এই শহরের লোকশিল্প মেলা। বিসিক আয়োজিত। এই শহরের নববর্ষ বরণ। ছায়ানটের ভোরবেলাকার গান। সোনার দোকানের হালখাতা।
গ্রাম থেকে শহরে এল পয়লা বৈশাখ। আবার শহর থেকে ছুটে যাচ্ছে গ্রামে। পান্তা তো কেউ শখ করে খায়নি। গরমের দেশে ফ্রিজবিহীন ঘরগুলোতে ভাত পানি দিয়ে রাখলে পান্তা হবেই। তালপাখার বাতাস ছাড়া আর কী-ই বা ছিল।
তবুও এই যে নববর্ষ উদ্যাপনের এই মহা আয়োজন, এই যে রঙে-রেখায়, রসে-রসনায়, সংগীতে, প্রকাশনায়, গণমাধ্যমে, বাজারে, বিপণনে, হালখাতায়, মেলায় এমন মহা কলেবরে, মহা আড়ম্বরে বৈশাখ আসে, এই যে লাখ লাখ মানুষকে পথে নামায়, ধনী-নির্ধন, নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলিম, পাহাড়ি-বাঙালি—সব এক হয়ে যায়, এ সম্ভব হয় নিশ্চয়ই ওই শিকড়েরই টানে।
সময় তো বদলে যাবেই। কিছুই আর আগের মতো থাকে না। দেশ বদলে যাচ্ছে। গ্রাম বদলে যাচ্ছে। আমাদের গ্রামে আর নদী নেই। নদী মরে গেছে কিন্তু বাঁধ রয়ে গেছে। গ্রামে বিদ্যুৎ গেছে। টেলিভিশন গেছে। কেব্ল সংযোগ। ফেনসিডিল।
তবু আমাদের রক্তের ভেতরে যে ঐতিহ্য, তা তো থেকেই যায়। পয়লা বৈশাখ আমাদের তাই নাড়া দেয়। আমাদের এই সনটা দেখি শুধু বাঙালির নয়, আদিবাসীদের, পাহাড়িদের; এমনকি ব্যাংককে, তামিলনাড়ুতে পর্যন্ত এই সময়েই নববর্ষ পালিত হয়।
আমাদের পয়লা বৈশাখ আমাদের নিজস্বও। কারণ, এটা আমরা সংগ্রাম করে অর্জন করে নিয়েছি। ষাটের দশকের সেই যে বাঙালিত্বের সংগ্রাম, রবীন্দ্রনাথকে ধরে রাখার সংগ্রাম, সবটা মিলেমিশে আমাদের পয়লা বৈশাখ কেবল নওরোজ নয়। এ আমাদের নিজেকে খুঁজে পাওয়ার এক অপূর্ব উপলক্ষ।
নিজেকে কে আর খুঁজে পায়। আমগাছে দুলছে ছোট ছোট আম, কী সবুজ, স্বাস্থ্যবান! কিন্তু এই শহরে সেই জমিন কোথায়, যেখানে আমের আঁটি পড়লে লাল রঙের পাতা মাটি ফুঁড়ে বের হয়। যে আঁটি তুলে নিয়ে ভেতরের বীজপত্র বের করে ঘষে ঘষে বানাতে পারি ভেঁপু। সেই রোদ-তাতানো দুপুর কই, যখন চোরকাঁটা ভরা মাঠ পেরিয়ে আম আঁটির ভেঁপু বাজাতে বাজাতে চলে যেতে পারি দুই চোখ যেদিকে চায় সেই দিকে, নিখোঁজপুরের দিকে, নিশ্চিন্তিপুরের দিকে। যেখানে চিরকালের অপুর সঙ্গে বেরিয়েছে চিরকালের দুর্গা। না হয় কোথাও গেলাম না, গেলাম বাজ-পোড়া জামগাছের দিকে।
ঋতু বদলের সময় এলেই শৈশবের জানালা খুলে যায়। মনে হয়, আমাদের শৈশবেও এমনি করে চৈত্র পেরিয়ে বৈশাখ আসত, আকাশ ছেয়ে যেত রঙিন ঘুড়িতে। মনে পড়ে, একবার চড়কের মেলা দেখতে চলে গিয়েছিলাম বাড়ির গৃহপরিচারকের সঙ্গে। সে বুদ্ধি করে সঙ্গে নিল একটা বালতি আর একটা কাচের গেলাস, বালতিতে পানি ভরে তলায় গেলাসটা রেখে মেলার ভিড়ের একটা কাতারে দাঁড়িয়ে পড়ে সে চেঁচাতে লাগল—পয়সা ফেলেন, গেলাসে ফেলতে পারলেই ডাবল ফেরত। ভয়ে আমার কলজে শুকিয়ে আসছে। কারণ, ওর পকেটেও পয়সা নেই, আমার পকেটেও নেই, কারও পয়সা তো গেলাসে পড়তেও পারে, তখন কোত্থেকে দেব আমরা তাকে পয়সা। আশ্চর্য, কেউ এই সহজ কাজটা পারছে না, আমাদের কাজের ছেলের পকেট ভরে যেতে লাগল পয়সায়।
ফেরার পথে একটা টমটম কিনে নিয়ে আসি। আটার গোলার রসগোল্লা খেয়েছিলাম, না খেলেই ভালো ছিল। কিন্তু টমটমটা আমার কাছে চিরবিস্ময়। পোড়ামাটির বাটির ওপর বসানো কিসের যেন চামড়া, আমরা বলতাম ব্যাঙের, তীব্র ম্যাজেন্টা রঙের। পোড়ামাটির দুটো চাকা, সুতো ধরে ওই টমটম টানলে চাকার সঙ্গে লাগানো বাঁশের গিয়ার ঘোরে আর দুটো কাঠিকে অবিরাম ঢাকের ওপরে বাড়ি দিতে বাধ্য করে । ঢ্যাম ঢ্যাম করে সেই ঢাক বাজতে থাকে। মাত্র আট আনায় এই গাড়ি বিকোয় কী করে?
এখনো বৈশাখী মেলায় যাওয়া হলেই ওই টমটমটা খুঁজি। যদি পাওয়া যায়, কিনে এনে তোমার হাতে তুলে দেব। এখন আমগাছ দেখলেই খুঁজতে থাকি লাল পাতা। আর খুঁজতে থাকি একটুখানি উর্বর জমিন, যেখানে আমের আঁটি পড়লেই চারা গজাবে।
আর আমি সেই আঁটি তুলে নিয়ে ভেঁপু বানিয়ে বাজাতে বাজাতে ছুটে আসব তোমার কাছে, বলব, পদ্য, এই যে নাও... পদ্যকে বলব, নাকি মিটুনকে! হাফপ্যান্ট, বড় বড় কান, নাকের নিচে সর্দি, মিটুন দাঁড়িয়ে আছে সামনে, তার হাঁটু পর্যন্ত ধুলো, হাফপ্যান্টেই ওকড়া মানে চোরকাঁটা ভরে আছে। তাকে বলব, মিটুন মিটুন, আমি তোমার টমটমটা খুঁজে পেয়েছি...
হু হু করে ওঠে মন, এমন বৈশাখী দিনে তোমাকে নিয়ে চোরকাঁটা ভরা মাঠে হাঁটা আর কোনো দিন হবে না আমার। যেখানে শেয়ালের কল্যাণে মাটি ফুঁড়ে জেগেছে কাঁঠালের চারা। যেখানে আমের পাতার রং লাল।
তবুও আম আঁটির ভেঁপু বলতে যদি বিভূতিভূষণের বইটাকে বোঝায়, তাতেই বা কী ক্ষতি। কিংবা ধরো, পথের পাঁচালী বলতেও যদি বোঝায় সত্যজিতের পথের পাঁচালীই, সেও তো একটা ভালো কিছুই বোঝানো হলো। কিন্তু ধরা যাক, দেবদাস বলতে যদি শরৎচন্দ্রের দেবদাস নয়, বোঝায় কেবল শাহরুখ খানের দেবদাস, তাহলে যেন কেমন লাগে! এই যুগের পার্বতীর নাম ঐশ্বরিয়া, চন্দ্রমুখীর নাম মাধুরী দীক্ষিত!
জানো, পয়লা বৈশাখ এলে অপু আর দুর্গার কথাও খুব মনে পড়ে। ও তো আমাদেরই শৈশব। যদিও অমন ঘোরতর গ্রামে বড় হইনি, কিংবা অমন অভাবী সংসারেও না। কিন্তু ঝড় উঠলেই আমগাছতলায় কে যায়নি ছোটবেলায়, আমাদের কালে, আমাদের জগতে? ঝোড়োবাতাসে টুপটাপ ধুপধাপ আম পড়তই আর আম কুড়িয়ে কোঁচা ভরে নিতে নিতে বৃষ্টিও একসময় আসত। তখন ওই অপু আর দুর্গার মতোই গাছের নিচে আশ্রয় নেয়া ছাড়া উপায়টাই বা কী থাকত বলো।। আর তখন বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে এক সময় ওই মন্ত্রও পড়তে হতো, কচুপাতায় করমচা, যা বৃষ্টি চলে যা, কালকে আসিস আজকে না। বৃষ্টিতে কে না ভিজেছে আমাদের কালে। ঘামাচি ভরা পিঠে বৃষ্টিতে ভিজতে কে না বেরিয়েছে, বৃষ্টির ছাটে নাকি ঘামাচি মরে যাবে!
পয়লা বৈশাখ আমাদের জন্য আলাদা উৎসব ছিল না। বাংলা পঞ্জিকা খুব নিত্যব্যবহার্য ছিল গ্রামের বাড়িতে। আমার জ্যাঠাইমা চোখে চশমা দিয়ে পঞ্জিকা দেখতেন, সে পঞ্জিকার গোলাপি রঙের নিউজপ্রিন্টের প্রচ্ছদ, তার ছোট্ট আকার, পকেট সাইজ। কবে কোন বীজধান বের করতে হবে কলসি থেকে, কবে বীজতলা প্রস্তুত করতে হবে, সবই তো চলত ওই বাংলা পঞ্জিকা অনুসারেই।
একবার গ্রামের বাড়ি থেকে বারুনির মেলায় গিয়েছিলাম। মাইলের পর মাইল হেঁটেছিলাম। এই তো আর এক কোরোশ। ক্রোশ আর শেষ হয় না। হাঁটতে হাঁটতে কত দূর যে চলে গেছি। মানুষের সারি যেন পিঁপড়ে। মাথায় বোঝা, কাঁধে বাঁক। গরুর গাড়ি চলেছে। মেলা একটা নদীর ধারে। দূর থেকে গমগম আওয়াজ আসছে। মানুষের। মেলার পাশে গরুর গাড়িগুলো পড়ে আছে ‘ব’-এর মতো। গরুগুলো চাকার সঙ্গে বাঁধা। রসুন আর রসুন। রসুনের সাদা খোসা উড়ছে। বড় বড় তরমুজ। তারপর খেলনা, মিঠাই। আর জুয়া। আর পুতুল নাচ। চুড়ি-ফিতা।
সেই মেলা থেকে এই মেলা। এই শহরের লোকশিল্প মেলা। বিসিক আয়োজিত। এই শহরের নববর্ষ বরণ। ছায়ানটের ভোরবেলাকার গান। সোনার দোকানের হালখাতা।
গ্রাম থেকে শহরে এল পয়লা বৈশাখ। আবার শহর থেকে ছুটে যাচ্ছে গ্রামে। পান্তা তো কেউ শখ করে খায়নি। গরমের দেশে ফ্রিজবিহীন ঘরগুলোতে ভাত পানি দিয়ে রাখলে পান্তা হবেই। তালপাখার বাতাস ছাড়া আর কী-ই বা ছিল।
তবুও এই যে নববর্ষ উদ্যাপনের এই মহা আয়োজন, এই যে রঙে-রেখায়, রসে-রসনায়, সংগীতে, প্রকাশনায়, গণমাধ্যমে, বাজারে, বিপণনে, হালখাতায়, মেলায় এমন মহা কলেবরে, মহা আড়ম্বরে বৈশাখ আসে, এই যে লাখ লাখ মানুষকে পথে নামায়, ধনী-নির্ধন, নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলিম, পাহাড়ি-বাঙালি—সব এক হয়ে যায়, এ সম্ভব হয় নিশ্চয়ই ওই শিকড়েরই টানে।
সময় তো বদলে যাবেই। কিছুই আর আগের মতো থাকে না। দেশ বদলে যাচ্ছে। গ্রাম বদলে যাচ্ছে। আমাদের গ্রামে আর নদী নেই। নদী মরে গেছে কিন্তু বাঁধ রয়ে গেছে। গ্রামে বিদ্যুৎ গেছে। টেলিভিশন গেছে। কেব্ল সংযোগ। ফেনসিডিল।
তবু আমাদের রক্তের ভেতরে যে ঐতিহ্য, তা তো থেকেই যায়। পয়লা বৈশাখ আমাদের তাই নাড়া দেয়। আমাদের এই সনটা দেখি শুধু বাঙালির নয়, আদিবাসীদের, পাহাড়িদের; এমনকি ব্যাংককে, তামিলনাড়ুতে পর্যন্ত এই সময়েই নববর্ষ পালিত হয়।
আমাদের পয়লা বৈশাখ আমাদের নিজস্বও। কারণ, এটা আমরা সংগ্রাম করে অর্জন করে নিয়েছি। ষাটের দশকের সেই যে বাঙালিত্বের সংগ্রাম, রবীন্দ্রনাথকে ধরে রাখার সংগ্রাম, সবটা মিলেমিশে আমাদের পয়লা বৈশাখ কেবল নওরোজ নয়। এ আমাদের নিজেকে খুঁজে পাওয়ার এক অপূর্ব উপলক্ষ।
নিজেকে কে আর খুঁজে পায়। আমগাছে দুলছে ছোট ছোট আম, কী সবুজ, স্বাস্থ্যবান! কিন্তু এই শহরে সেই জমিন কোথায়, যেখানে আমের আঁটি পড়লে লাল রঙের পাতা মাটি ফুঁড়ে বের হয়। যে আঁটি তুলে নিয়ে ভেতরের বীজপত্র বের করে ঘষে ঘষে বানাতে পারি ভেঁপু। সেই রোদ-তাতানো দুপুর কই, যখন চোরকাঁটা ভরা মাঠ পেরিয়ে আম আঁটির ভেঁপু বাজাতে বাজাতে চলে যেতে পারি দুই চোখ যেদিকে চায় সেই দিকে, নিখোঁজপুরের দিকে, নিশ্চিন্তিপুরের দিকে। যেখানে চিরকালের অপুর সঙ্গে বেরিয়েছে চিরকালের দুর্গা। না হয় কোথাও গেলাম না, গেলাম বাজ-পোড়া জামগাছের দিকে।
ঋতু বদলের সময় এলেই শৈশবের জানালা খুলে যায়। মনে হয়, আমাদের শৈশবেও এমনি করে চৈত্র পেরিয়ে বৈশাখ আসত, আকাশ ছেয়ে যেত রঙিন ঘুড়িতে। মনে পড়ে, একবার চড়কের মেলা দেখতে চলে গিয়েছিলাম বাড়ির গৃহপরিচারকের সঙ্গে। সে বুদ্ধি করে সঙ্গে নিল একটা বালতি আর একটা কাচের গেলাস, বালতিতে পানি ভরে তলায় গেলাসটা রেখে মেলার ভিড়ের একটা কাতারে দাঁড়িয়ে পড়ে সে চেঁচাতে লাগল—পয়সা ফেলেন, গেলাসে ফেলতে পারলেই ডাবল ফেরত। ভয়ে আমার কলজে শুকিয়ে আসছে। কারণ, ওর পকেটেও পয়সা নেই, আমার পকেটেও নেই, কারও পয়সা তো গেলাসে পড়তেও পারে, তখন কোত্থেকে দেব আমরা তাকে পয়সা। আশ্চর্য, কেউ এই সহজ কাজটা পারছে না, আমাদের কাজের ছেলের পকেট ভরে যেতে লাগল পয়সায়।
ফেরার পথে একটা টমটম কিনে নিয়ে আসি। আটার গোলার রসগোল্লা খেয়েছিলাম, না খেলেই ভালো ছিল। কিন্তু টমটমটা আমার কাছে চিরবিস্ময়। পোড়ামাটির বাটির ওপর বসানো কিসের যেন চামড়া, আমরা বলতাম ব্যাঙের, তীব্র ম্যাজেন্টা রঙের। পোড়ামাটির দুটো চাকা, সুতো ধরে ওই টমটম টানলে চাকার সঙ্গে লাগানো বাঁশের গিয়ার ঘোরে আর দুটো কাঠিকে অবিরাম ঢাকের ওপরে বাড়ি দিতে বাধ্য করে । ঢ্যাম ঢ্যাম করে সেই ঢাক বাজতে থাকে। মাত্র আট আনায় এই গাড়ি বিকোয় কী করে?
এখনো বৈশাখী মেলায় যাওয়া হলেই ওই টমটমটা খুঁজি। যদি পাওয়া যায়, কিনে এনে তোমার হাতে তুলে দেব। এখন আমগাছ দেখলেই খুঁজতে থাকি লাল পাতা। আর খুঁজতে থাকি একটুখানি উর্বর জমিন, যেখানে আমের আঁটি পড়লেই চারা গজাবে।
আর আমি সেই আঁটি তুলে নিয়ে ভেঁপু বানিয়ে বাজাতে বাজাতে ছুটে আসব তোমার কাছে, বলব, পদ্য, এই যে নাও... পদ্যকে বলব, নাকি মিটুনকে! হাফপ্যান্ট, বড় বড় কান, নাকের নিচে সর্দি, মিটুন দাঁড়িয়ে আছে সামনে, তার হাঁটু পর্যন্ত ধুলো, হাফপ্যান্টেই ওকড়া মানে চোরকাঁটা ভরে আছে। তাকে বলব, মিটুন মিটুন, আমি তোমার টমটমটা খুঁজে পেয়েছি...
হু হু করে ওঠে মন, এমন বৈশাখী দিনে তোমাকে নিয়ে চোরকাঁটা ভরা মাঠে হাঁটা আর কোনো দিন হবে না আমার। যেখানে শেয়ালের কল্যাণে মাটি ফুঁড়ে জেগেছে কাঁঠালের চারা। যেখানে আমের পাতার রং লাল।
No comments